আখতার মাহমুদ

নাইকোস্ত্রাতাস
মুক্ত আকাশে চোখ রেখে তিনি পা রাখেন কারাগারের ভেতর চত্বরে। অপেক্ষারত নাইকোস্ত্রাতাস দেখে, চওড়া কপালে হাত ঘষে স্থির তাকিয়েই থাকেন আকাশে। দৃষ্টি স্থির। তাকিয়ে আছেন তবে দেখছেন না। চোখ তাঁর যেন তাকিয়ে আছে দৃষ্টিসীমারও অনেক অনেক দূরে। হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে প্রার্থনা করছেন। মৌনতায় কেটে যায় বেশ ক’টি মুহূর্ত। আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে চত্বরে নাইকোস্ত্রাতাস ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ে না তাঁর। সহজাত আন্তরিকতায় তাকিয়ে হাসেন। তারপর আবার মগ্ন হন আকাশে দৃষ্টি রেখে। এবার যেন ভাবছেন, নতুন কিছু। শিষ্যদের সামনে নতুন কোনো জ্ঞানের স্বরূপ উন্মোচন করবেন হয়তো খুব জলদি। জাগতিক পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন তবু আক্ষেপের ছাপ নেই। আছে আনন্দের ঝিকমিক। আছে জীবন রহস্য উন্মোচনের খুশি। প্রশান্তি। নাইকোস্ত্রাতাস পায়ে পায়ে এগিয়ে বসে পড়ে তাঁর পায়ের কাছে।

তিনি আকাশে চোখ রেখেই বলেন, ‘এই প্রথম এলে নাইকোস্ত্রাতাস। বন্দী হবার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে তোমাকে দেখিনি।’

‘অসুস্থ ছিলাম হে মহামতি। তবে অসুখটা আমাকে নতুন উপলব্দি এনে দিয়েছে। কিছু ধারণায় আলোড়িত হয়েছি। সেসব নিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করব। আশা করছি আপনি আমাকে আলোকিত করবেন আপনার উত্তর দিয়ে। কেননা আপনার কথা, আপনার দর্শন এবং আপনাকে নিয়েই আমার সকল ধারণা।’

‘আজ আমি কিছু বিষয় নিয়ে ভাবছি। কাল এসো।’

‘ক্ষমা করবেন হে মহামান্য। আমাকে ধারণাগুলো নিয়ে আপনার সাথে আলাপ করতেই হবে। আজই। তাকিয়ে দেখুন আজ আমি একাই এখানে। অন্য কেউ নেই। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ আমার ওপরে আছে বলেই আপনাকে একা পেয়েছি। আপনার সাথে একা কথা বলার সৌভাগ্যলাভ থেকে বঞ্চিত করবেন না আমাকে।’

‘আমি আত্মা ও দর্শন নিয়ে ভাবছি। বিশেষ করে জন্মের পূর্বে আত্মার অস্তিত্ব ও মৃত্যুর পর দেহের বিনাশের পর আত্মার স্থিতি-গন্তব্য নিয়ে। তোমার কথাগুলো কী সত্যিই জরুরি নাইকোস্ত্রাতাস? আমি কেন যেন অশুভ ছায়া দেখছি তোমার চোখে। অদ্ভুত এক লোভ তোমার চোখের তারায়। এটা কী আমার সঙ্গলাভের আনন্দে না পেছনে অন্য কারণ? আচ্ছা, আজ তোমার কথা শুনব। আজ তুমিই প্রশ্ন করে যাবে আমি উত্তর দেব। আজ তুমি বক্তা আমি শ্রোতা। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করব না তোমাকে। যেমনটা সত্য উদঘাটনে আমি করে থাকি।’

‘ধন্যবাদ হে মহামান্য। আপনি সত্যিই মহৎ।’

‘শুরু করো। হয়তো খুব শীঘ্রই অন্য কেউ এসে পড়বে।’

‘আপনি বলে থাকেন- “জ্ঞানই সদগুণ।”- সাধারণভাবে বুঝি, জ্ঞান হলো সে বিষয় যা অর্জিত ও চর্চিত এবং মানুষ যা প্রয়োগ করে কর্মক্ষেত্রে বা বাস্তব জীবনে। এখন জ্ঞান যদি সদগুণই হয়ে থাকে তবে কী তর্কের খাতিরে এটা ধরে নিতে পারি না যে, যারা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, যারা বিচারকার্য পরিচালনা করে তাদের জ্ঞানও সদগুণ? যারা আপনাকে সে জ্ঞানের ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ড দান করেছে সে বিচারসংক্রান্ত জ্ঞানকেও কী সদগুণ বলব?’

‘আমি বিশ্বাস করি, জ্ঞান নেতিবাচক হতে পারে না। সেই অর্থে, জ্ঞানই সদগুণ- ভুল কথা নয়। কেউ যদি জ্ঞানকে জেনে বুঝেও ভুল পথে ব্যবহার করে তখন তা জ্ঞান থাকে না। হয়ে ওঠে অসততা, স্বেচ্ছাচারিতা। যে ব্যক্তি অসৎ ও স্বেচ্ছাচারী সে জ্ঞানী নয়। তার জ্ঞানও সদগুণ নয়।’

নাইকোস্ত্রাস মন্ত্রমুগ্ধ ভঙ্গিতে তাঁর হাতে চুমু খায়। ‘আপনি অতুলনীয় হে মহামান্য শিক্ষক। তবে আজ আমার থলিতে এমন কিছু আছে যা হয়তো আপনাকে চমকে দেবে।’

‘উপুর করো থলি।’ ফের আকাশে তাকিয়ে সদয় হাসেন তিনি।

‘দাসপ্রথা নিয়ে আপনার বক্তব্য অস্পষ্ট আমার কাছে। এমনটা হতে পারে যে, হয়তো কোথাও বলেছেন তাদের কথা কিন্তু আমার কানে আসেনি। দাসদের জীবন আমাকে ব্যথিত করে হে মহামান্য। তারাও কী মানুষ নয়? তারাও কী জ্ঞানলাভে সক্ষম নয়? তারা যে জ্ঞান অর্জনে সক্ষম এটা আপনি একটি পরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন। তবু তাদের শেখাবার কোনো দায়িত্ব তো আপনি নেন না। তাদের মুক্তির ব্যাপারে নীরব কেন আপনি? তারা মানুষ হয়ে যে নির্মম পশুর জীবন কাটিয়ে চলছে, এ বিষয়ে আপনি নীরব কেন? দাসদের শিক্ষিত করে তোলার তৎপরতা কেন নেই আপনার। কেন আপনি বলেন না দাসমুক্তিই হয়ে উঠবে সত্যিকারের মানবতা। জিউসের দোহাই হে মহামান্য, চুপ করে থাকবেন না। আমাকে বলুন দাসদের মুক্তি কী আবশ্যক নয়? মানুষ কী প্রাণীকুলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়? সেই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা কী ভূলুণ্ঠিত করে না দাস প্রথা? এই মহান শহরের শপথ আপনাকে। আপনার ভাবনা জানান আমাকে। কেন আমরা দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েছি। এ-তো অস্বাভাবিক। মানুষের স্বাধীনতা হরণ এটা। অন্তত দাসদের মানবিক অধিকার দেবার কোনো পদ্ধতি আপনি আমাদের শেখাতে পারেন না?’

চিন্তিত মুখে সক্রেটিস চোখ ফেরান। নাইকোস্ত্রাতাসের মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন বিপন্ন করতে চাও নিজ জীবন। আমাকে ছাড়া কাউকে এ-কথা বলোনি তো? শাসকগোষ্ঠী শুনলে তোমার গর্দান নেবে। যা-হোক, আমার এ বিষয়ে ভাবনা নেই তা নয়। দাসেরা যে মানুষ, দাসেরা যে জ্ঞান অর্জনে সক্ষম সেটা আমি জানি এবং এটা তুমিও স্বীকার করলে। এর বাইরে, নগরের আইন মেনে চলা আমার ধর্ম। আমি আইনের বাইরে যাই না। দাসদের শিক্ষাদান করতে গেলে আইনের বিরুদ্ধে সরাসরি দাঁড়াতে হতো। তোমরা হয়তো তখন নিজেরাই আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে। এ সময়ের মানুষের মনন এখনো দাসপ্রথা বিলুপ্তি বা দাসের মানবিক অধিকার মেনে নেবার মত পরিপক্ব নয়। এছাড়াও, দাসেরা আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এটা সর্বজন স্বীকৃত প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতি। এসব ভুলে গেলেও চলবে কেন?  তবে হ্যাঁ, মুক্তির ইচ্ছে-মনন নির্দিষ্ট শ্রেণীর ভেতর থেকেই আসা উচিত। দাসেরা যদি নিজেরা ভেবে থাকে তারা জ্ঞানে তাদের প্রভুদের সমকক্ষ এবং তা যদি প্রমাণ করে দেখায়, তবেই ওদের মুক্তির জন্যে অনেকেই কথা বলবে। তবে সে স্ফুলিঙ্গ তাদের ভেতর দেখা যায় না। অক্ষম বিদ্রোহ কিছু ঘটে অবশ্যই, তবে তা মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের যথাযোগ্য স্ফুলিঙ্গ বলে মনে হয়নি কখনো।’

‘আপনি যেমন আমাদের শিখতে, জ্ঞান অর্জনে সত্য-মিথ্যার তফাত বুঝতে উদ্বুদ্ধ করেন তেমনি কখনো ওদের জন্যে করেন নি বলেই জানি। তবে এর ব্যাখ্যা আপনি দিয়েছেন- আপনি নগরের আইন মেনে চলেন। আর নগরের আইন দাসের স্বার্থ দেখে না। এমনকি এই আইন তো আপনার মত মহাজ্ঞানীকেও রক্ষা করছে না। রক্ষা করছে ভন্ডদের, ক্ষমতাবানদের। তাহলে যে আইন জ্ঞানীদের, সাধারণদের রক্ষা করে না সে আইন মেনে চলা কী দুর্বলতা নয়?’

‘নগরের আইন মেনে চলা আমার ধর্ম। আমি আইন ভঙ্গ করতে পারি না। সে শিক্ষা তোমাদেরও দিই না। তোমার কী আরো জিজ্ঞাসা তথা অভিযোগ আছে নাইকোস্ত্রাতাস?’

‘অভিযোগ নয় প্রশ্ন। আপনি যখন মানুষকে প্রশ্ন করেন সত্য উদঘাটনে, সেগুলো কী অভিযোগ মহামান্য? নিশ্চয়ই তা নয়। আপাতদৃষ্টিতে আমার অভিযোগের আড়ালে আছে জ্ঞান তৃষা, এক মহীরুহ হয়ে ওঠা জ্ঞানীকে আবিষ্কারের। একজন গুরুকে বোঝার।’

‘আমার এমন কেন মনে হচ্ছে যে, তোমার জ্ঞান তৃষার আড়ালে আছে গুরুবধের অবচেতন কামনা?’

‘যদি সত্যিই তেমনটা আপনার মনে হয়, তাতে আমি আসলে লজ্জিত নই। জ্ঞান অর্জনের পথে গুরুবধ চেষ্টা কী অনৈতিক হে মহৎপ্রাণ?’

‘না। তবে লোভ হলে অনৈতিক। তোমার হয়তো মনে হচ্ছে গুরুবধের চেষ্টায় সফল হলে তুমি খ্যাতি লাভ করবে, এমনটাই তোমার অবচেতন ভাবনা। তোমার এই ভাবনায় যে গলদটা তা হলো- আমি জানি আমার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু তুমি নিজ সীমাবদ্ধতায় সচেতন নও।’

‘এ তর্কে না জড়িয়ে আমি বরং আলাপ এগিয়ে নিতে আগ্রহী মহামান্য।’

‘তাই হোক তবে।’

‘আপনি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের আকৃষ্ট করেন। অথচ তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকেরা ও দাসেরা আপনার বক্তব্যে ঠিক আগ্রহী নয়। তাই সকল শ্রেণীতে আপনার আবেদন সমান নয়। আপনি আত্মপক্ষ সমর্থনেও বলেছেন যে, যারা আপনাকে অনুসরণ করে, তারা মূলত ধনীর সন্তান। তাদের অফুরন্ত অবসর আছে বলেই তারা আপনাকে অনুসরণ করে। তো একথা তাহলে বলাই যায়, দরিদ্ররা আপনাকে অনুসরণ করে না? কেন? আপনি যেভাবে ভাবেন সেভাবে তারা ভাবে না। এখানেই আপনি সার্বজনীনতা হারান। আপনি সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করে যেতে চান। আপনি তথাকথিত জ্ঞানীদের প্রশ্ন করেন উত্তম, সৌন্দর্য ও গুণ নিয়ে। অথচ শ্রমিক ও দাসদের কাছে এসব প্রশ্ন অবান্তর। ওদের কাছে একমাত্র সত্য দু’বেলার আহার, জীবনধারণের ন্যূনতম উপকরণ। সেসবের বাইরে তাদের কী দায় উত্তম, সৌন্দর্য, গুণ নিয়ে চিন্তার? তাদের কাছে উত্তম- খাবারে ভরা পেট। তাদের কাছে সৌন্দর্য- থালাভর্তি খাবার। তাদের কাছে গুণ- শারীরিক সামর্থ্য। দার্শনিক প্রশ্নসমূহ তাদের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক, অবাস্তব, হাস্যকর। এটা কী কখনো মনে হয়নি আপনার? দার্শনিক প্রশ্ন টপকে পেট ভরানোই যাদের লক্ষ্য তারা তো আপনার শিক্ষা নেবে না। দর্শন তাদের কাছে মৃত। দার্শনিক বোধকে তারা একচুলও ছাড় দেবে না। তাদের কোনো কাজেই আসবে না আপনার জ্ঞান। খালি পেটে দার্শনিক বোধ ও জ্ঞানের স্থান কোথায়? আপনার এ সকল দার্শনিক উপলব্ধি-প্রজ্ঞা-জ্ঞান-নৈতিকতা তবে কার জন্যে, হে মহামান্য শিক্ষক? আমি যে পূর্বে বলেছি, আপনি কেন দাসদের নিয়ে কিছু বলেননি? আসলে আমি জানতাম, আপনার ভাবনায় ওরা নেই। ওদের আপনি স্বাভাবিক উৎপাদন যন্ত্র হিসেবেই দেখেন। ফলে, আপনার শিক্ষা-দর্শন আসলে সার্বজনীন হয়ে ওঠে না। ধনী ও সচ্ছলদের জন্যেই আপনার শিক্ষা। যে শিক্ষা সার্বজনীন নয়, সকল শ্রেণীর বোধগম্য নয় সে শিক্ষা আসলে কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম? আপনি কী শুধু ধনী ও সচ্ছলদেরই বদলাতে চান?’

‘তর্কের স্বার্থে ধরে নাও ধনী ও ক্ষমতাবানদের বদলাতে চাই, প্রজ্ঞাবান করে তুলতে চাই।’

‘হে মহৎপ্রাণ, তবে কী আমি আমার বক্তব্যেই স্থির থাকব যে আপনার শিক্ষা আসলে সার্বজনীন নয়? আপনি আসলে সকল শ্রেণীকে মাথায় রেখে শিক্ষাদান করেন না?’

‘আমি আগেই বলেছি নাইকোস্ত্রাতাস, তুমি নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন নও। আচ্ছা আমাকে বলো সমাজ কারা বদলাতে পারে? মানুষের উপকারার্থে আইন-সমাজ বদলাতে পারে কারা? উত্তরটা আমিই দিচ্ছি- ধনী ও ক্ষমতাবানরা। ধনী ও ক্ষমতাবানরা যদি নৈতিক হয়ে ওঠে জ্ঞানী হয়ে ওঠে তবে এমনিতেই সমাজ বদলে যাবে। ঈশ্বরের শপথ, যেদিন সকল ধনী ও ক্ষমতাবানরা পুণ্যাত্মা হয়ে উঠবে, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস স্থাপন করবে সেদিনই ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবে। তাই আমি যদি কেবল ধনী ও সচ্ছলদের শিক্ষা দিই বা উল্টোভাবে বলতে গেলে যদি কেবল ধনী ও সচ্ছলরাই আমার শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে থাকে তাতে দোষের কী আছে? তোমার যুক্তিতেই তুমি হেরে যাও নাইকোস্ত্রাতাস। এটা তোমারই বক্তব্য যে, আমি সব শ্রেণীকে মাথায় রেখে শিক্ষাদান করি না। এমনও হতে পারে, আমার পদ্ধতি হয়তো তোমার উপলব্ধিতে আসেনি?’

‘দৈববাণী শুনে আপনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ঘোষণার পর যাদের দিয়ে দৈববাণীর যথার্থতা পরীক্ষা করেছিলেন তারা মূলত আপনার সহানুভূতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ নয় বলেই আপনি পরীক্ষা করেছিলেন, তাই না? আপনি কোনো ব্যবসায়ীর কাছে যান নি, যোদ্ধার কাছে যান নি। পুরোহিতের কাছে যান নি তাদের পরীক্ষা করতে। হয়তো সকলের কাছেই গিয়েছিলেন, যদিও সে তথ্য আমি পাইনি। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে সকলের কাছেই আপনি গিয়েছিলেন, সকল পেশার মানুষকেই আপনি পরীক্ষা করেছিলেন তবুও এটা নিশ্চয়ই ঠিক কথা নয় যে, একা আপনি-ই জ্ঞানী আর কেউই নয়? মানে এমন নিশ্চয়ই না যে, আর কেউই নেই; -“যে জানে যে সে জানে না”? দৈববাণীর পেছনে আপনার কোনো শিষ্যের বা অনুসারীর কারসাজি থাকতে পারে সেটা মাথায় না রেখে, সে অনুসন্ধানে না নেমে কী করে অন্যদের পরীক্ষা করতে নেমে পড়েন আমার বোধগম্য হয় না। আচ্ছা আপনার কী মনে হয় না, এই যে, পরীক্ষা পদ্ধতি আপনার- যার দ্বারা আপনি কে জ্ঞানী কে জ্ঞানী নয় পরীক্ষা করতে চান সেটাই হয়তো ত্রুটিযুক্ত? কেননা আপনি মানুষকে প্রশ্ন করে বেড়ান কিন্তু প্রশ্নকর্তা আর উত্তরকারীর অবস্থান এক থাকে না। আপনি তো ঠিকঠাক জানেন কী কী উপায়ে প্রশ্ন করে বিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে পারবেন। এ বিষয়ে আপনি অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেছেন। প্রশ্ন করার আগে আপনার প্রস্তুতি থাকে। গোছানো ভাবনা থাকে। আপনি জানেন, কোনপথে প্রশ্ন এগিয়ে নেবেন। কিন্তু উত্তরদাতাতো অপ্রস্তুত থাকে! ফলে, সঠিক উত্তর তার অন্তরে থাকলেও সেটা প্রস্তুতির অভাবে বেরিয়ে আসার সুযোগ বা সময় পায় না। তার আগেই আপনি তাকে ভুল প্রমাণ করে দেন। এছাড়া, আপনার বিনয় ছিল সবসময়েই আপনার ভাণ। আড়াল। এ-ও এক স্ববিরোধ। হে মহামান্য, আপনি কারো সাথে আলাপের আগেই ঠিকঠাক জেনে যান প্রতিপক্ষকে আপনি পরাস্ত করতে পারবেন। বাগ্মীতায় আপনার সমকক্ষ এই মহান নগরীতে কেউ নেই। তবু যখন আপনি বিনয়ে বলেন, “আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না”।- এটি মস্ত ভাণ। একরকম ধোঁকাবাজি। বিনয় নামক প্রতারণাই কেবল এটি। এছাড়াও যখন বলেন- “আমি কারো শিক্ষক নই”, তবে তা মিথ্যাভাষণ হিসেবেই ধরে নেয় সাধারণ মানুষ। মিথ্যা বিনয়ও এটি। আসল কথাতো এই যে, আপনি মানুষকে শিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। তা কিন্তু শিক্ষকেরই কাজ। তবে কেন নিজেকে শিক্ষক বলেন না? এর উত্তর যদিও আমার জানা আছে।’

‘দৈববাণীকে তুমি সাজানো নাটক মনে করো? আর উত্তর জানা থাকলে বলো শুনি।’

‘না দৈববাণীকে সাজানো বলার দুঃসাহস আমার নেই। আমি কেবল একটা বাস্তব সম্ভাবনার কথা বলেছি। যৌক্তিক মানুষ হিসেবে আপনার এটা মেনে নেয়া উচিত যে এটি আপনার বন্ধু বা অনুসারীর সাজানো নাটক হতে পারে। আপনি সরলমনা বলে তা বিশ্বাস করেছেন।- এটা এক সম্ভাবনা হে মহামতী। বাস্তব প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। আর উত্তরটা হলো, শিক্ষক বলতে আমরা সোফিস্টদের বুঝে থাকি। যারা শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করে থাকে। আর প্রচলিত শিক্ষক অর্থে যদি আপনি নিজেকে শিক্ষক বলেন তবে এটা প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয় যে, আপনিও অর্থ নিয়ে থাকেন অথবা এ বিষয়ে মানুষ আপনাকে অপবাদ দিয়ে বসতে পারে। এ বিষয়ক স্ববিরোধী বক্তব্য রয়েছে আপনার। আমি কী বলব স্ববিরোধী বক্তব্য কী কী?’

‘কী?’

‘আপনি একবার বলেছেন- “অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে অশিক্ষিত থাকা ভাল”। আবার অন্যসময় বলেছেন- “পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটি-ই ভাল আছে, জ্ঞান। আর একটি-ই খারাপ আছে, অজ্ঞতা।”... এখন কেউ যদি খারাপটি মানে অজ্ঞতা বেছে নিতে না চায় আপনি কী দোষ দেবেন? অর্থের বিনিময়ে পৃথিবীর সবথেকে ভাল জিনিস- জ্ঞান অর্জনে এমন কী ক্ষতি? তবে কী আপনি এটাই চান যে সকল জ্ঞানী দরিদ্র হয়ে পড়ুক আর আপনার মত সংসার নিয়ে উদাসীন হয়ে পড়ুক? শিক্ষাদানের ক্ষমতা কী পেশাগত দক্ষতার পর্যায়ে পড়ে না? আপনার নীতি কিন্তু ভুল হে মহামান্য, আপনি বাইরে জ্ঞানের আলো জ্বেলে গেছেন আজীবন কিন্তু আপনার পরিবার সেই আলোয় বিন্দুমাত্র আলোকিত হয়নি। এ-কী এক চরম ব্যর্থতা নয়? যদি আপনি নিজের সন্তানদের প্রতি মনোযোগ দিতেন তবে হয়তো এই নগরী একাধিক মহৎ শিক্ষক পেতো। তা না হোক নিদেনপক্ষে তারা আলোকিত মানুষ হয়ে তো বাঁচতো। তাদের যা অবস্থা তাতে আপনার মৃত্যুর পর তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি হয়তো মৃত্যুর পরও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কিন্তু তাতে আপনার পরিবারের কী আসে যায়? আপনার মত বিখ্যাত ব্যক্তির পরিবার বিস্মৃত হয়ে যাবে সেটা কী করে মেনে নেয়া যায়? এ বিষয়ে আমি গভীরভাবে ভেবেছি। যে জ্ঞানী মানুষ নিজেকে সৎ বলে দাবি করে, নৈতিক দাবি করে, জ্ঞান সন্ধানী বলে ঘোষণা করে সে মানুষটির পরিবারও সেই সততা, সেই নৈতিকতা, সেই জ্ঞান সন্ধানী মানসিকতা ধারণ করতে পারে না কেন? সেটা যদি করতে না পারে তবে কী ব্যর্থতার দায় সেই জ্ঞানী মানুষটির নয়? সেটা যদি হয়, তবে কী আসলে সে মানুষটির মতবাদ, দর্শন সার্বজনীন হতে পারে? আমি সংশয়ে পড়ে গেছি এ নিয়ে। আশা করছি আপনি সংশয় দূর করে দেবেন।’

‘অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদান আমি ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ করি। আর জ্ঞান সন্ধানে আমি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছি। ত্যাগ করেছি আয়েশপূর্ণ জীবন। তাতে প্রভাবিত হয়েছে আমার পরিবার। তাদের প্রতি অবিচার কিছু থেকে থাকলে এটুকুই যে, সচ্ছলতা দিতে পারিনি। এটাকে আমি আত্মত্যাগই বলছি। আর তুমি কী করে জানো আমি তাদের জ্ঞান সন্ধানী করে তুলতে চাইনি? তবে জ্ঞান-সন্ধান, জ্ঞান-প্রেম শেষতক নিজের ওপর। হয়তো কেউ পথ দেখিয়ে দেয়। জ্ঞান বিষয়ে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই যে, যে জ্ঞানপিপাসু, সে, কেউ পথ দেখালেও জ্ঞানের পথে হাঁটবে না দেখালেও হাঁটবে। এমনকি যে আন্তরিক-সৎ জ্ঞান সন্ধানী তাকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হলেও সে ঠিকঠাক ফিরে আসবে সঠিক পথে। ক্ষুধার্ত  যেমন খাবারের পেছনে ছোটে তেমনি সরল বিষয়টা। আশা করি তোমার সংশয় দূর হয়েছে।’

কিছু মুহূর্ত উদাস হয়ে থাকে নাইকোস্ত্রাতাস। জ্বলজ্বলে তীব্র চোখে তাকায় গুরুর দিকে। গুরু ফের তাকিয়েছেন আকাশে! ভাবছেন কিছু একটা মগ্ন হয়ে। অটল পাহাড়ের মতো স্থির মানুষটিকে দেখে হিংসে হয় হঠাৎ তার। সে আরো কঠিন আক্রমণে যায়, লক্ষ্য ও নিজ উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে।
তীব্র কণ্ঠে বলে, ‘আপনার স্ববিরোধিতা আমার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হয় যখন আপনার বিরুদ্ধে ভোটদানকারী জুরিদের বিচারকের সম্মান দেন না। তাদের জুরি বলে সম্বোধন করেন না। মৃত্যুদন্ড ঘোষণার পর তাদের অভিশাপ দেন কিন্তু নিজেই আবার বলেন- “আমাকে আইন মানতেই হবে”। সাধারণত আইন মেনে নেয়ার অর্থই কিন্তু বিচার মেনে নেয়া। আইন যদি মেনেই নেবেন তবে কেন অভিশাপ?’

‘তুমি ভেঙে পড়ছো নাইকোস্ত্রাতাস। তোমার গলার স্বরে আবেগ কাঁপছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছো তুমি। আমাকে ভুল প্রমাণ করে, আমার আচরণ ভুল প্রমাণ করতে চেয়ে আসলে কোন অশুভ উদ্দেশ্য সফল করতে চাও? তুমি কী এটাও ভুলে গেলে যে আমি একজন মানুষ। আমারও ভুল হয়? আমিও হতাশাগ্রস্ত হই? এছাড়াও অজ্ঞানতা দেখলে আমার অস্বস্তি হয়। বিচারালয়ে যখন আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমি খন্ডন করি আর তা গৃহীত হয় না তখন মুহূর্তের জন্যে কী ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারি না আমি? এটুকু মানবিক অধিকার আমার নেই? এমন না যে মৃত্যুদন্ড দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। ক্ষোভ প্রকাশ করেছি ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা না পাওয়ায়।’

‘আপনার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ ওরা করেনি কিন্তু ভেতরের কারণ আমরা সকলেই যেমন অবগত আপনিও তেমন অবগত। আপনার এ দন্ড গণতন্ত্রবিরোধীতার কারণে। গণতান্তিক শাসন ব্যবস্থায় শাসকেরা আপনাকে হুমকি মনে করেছে। কেননা আপনি বলে থাকেন-“সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের মাধ্যমে নয় বরং সত্যিকার জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতার অধিকারী গুটিকয়েক লোকই সঠিক নীতির জন্ম দিতে পারে।”- এ বিষয়ে আমার দ্বিমত আছে। আমি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই বিশ্বাসী। গুটিকয়েক লোক কী সঠিক নীতির জন্ম দিতে পারে হে মহামান্য? আর সত্যিকার জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতা বলতে কী বুঝি আমরা? সত্যিকার জ্ঞান বলে কী কিছু আছে? আমরা যা দেখি, যা উপলব্দি করি তা কী বিভ্রম হতে পারে না? মরুভূমিতে মরিচীকা যখন আমরা দেখি তখন কী সেটা সত্যিকারের জ্ঞান না বিভ্রম? আয়না? আয়না কী সত্যিটা বলে আমাদের? জ্ঞান বিপথে যেতে পারে ব্যক্তিগত অবস্থান, আবেগ, সুখ-অসুখ, সফলতা-ব্যর্থতা ও পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতায়। আবার পেশাগত দক্ষতা থাকলেই কেউ সঠিক নীতির জন্ম দিতে পারে এ-তো বড় অদ্ভুত কথা হে মহামান্য। একজন যোদ্ধা বর্শা নিক্ষেপে দক্ষ হলেই কী সে নীতি প্রণয়নে দক্ষ হবে? যৌক্তিক ভাবেই সে সেটা হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। গুটিকয়েক লোক যখন নীতির জন্ম দিতে যাবে তখন স্বেচ্ছাচারীতাই আসবে ফলাফলে। এরচেয়ে বেশি মানুষের অংশগ্রহণে গণতন্ত্রই ভালো বলে মনে করি আমি। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠতা যতটা নির্ভুল নীতির জন্ম দিতে পারে সংখ্যালঘুতা তত নির্ভুল নীতি উপহার দেয় না। কেননা গণতন্ত্রে আলোচনা সমালোচনার জায়গা থাকে। স্বৈরতন্ত্রে আলোচনা সমালোচনার স্থান খুবই সংকীর্ণ।’

মুচকি হাসেন তিনি, আকাশে তাকিয়েই। ‘আমার সমালোচনা কিন্তু তোমাদের গণতন্ত্র সহ্য করতে পারেনি। আমাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছে।’

‘আপনি ভাল করেই অবহিত যে, আপনার বিরুদ্ধে অধার্মিকতা বা নাস্তিকতার অভিযোগ আসল নয়। ইঙ্গিতে আপনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন-“অনেক মানুষেরই বৈরিতা অর্জন করেছি আমি। আমি যদি দন্ডলাভ করি তবে সেটিই হবে তার কারণ; নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি নয়, বরং সেইসব মানুষের অপবাদ এবং বিদ্বেষ। তারা নিশ্চয়ই আরো অনেক ভালো মানুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করে দন্ড দিয়েছে; আমার ধারণা আবারও তারা তা-ই করবে; আমার পর্যন্ত এসে থেমে যাবার তো কোনো কারণ নেই।”- আপনার এই বক্তব্য কাউকে কাউকে বিভ্রান্ত করলে আমি অন্তত জানি, আপনার গণতন্ত্রবিরোধী মনোভাবই আপনাকে বিচারের সম্মুখিন করেছে। আর গণতন্ত্রবিরোধীদের যে পূর্বেও শাস্তি দেয়া হয়েছে সেটাই আপনি বলছেন ইঙ্গিতে। আপনাকে ইঙ্গিতে বলতে হয়েছে কেননা গণতন্ত্র বিরোধীতার অভিযোগ সরাসরি করা হয়নি। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বা কোনো প্রজ্ঞা থেকে সে অভিযোগ হয়তো আড়াল করা হয়েছে এবং  যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেসব কতটা হাস্যকর তা আপনি জানেন। যদিও আপনার মত মহৎপ্রাণ একজন মানুষের মৃত্যুদন্ড দিয়েছে গণতান্ত্রিক সরকার কিন্তু তারপরও গণতন্ত্রই সামনের পৃথিবীতে ক্ষমতার রূপরেখা হয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। আর শাস্তি প্রদানের বিষয়টা চিরকাল অমনই। কখনো কখনো মন্দের স্থলে জ্ঞানী শাস্তি পেয়ে বসেন। স্বৈরতন্ত্রে এ ভুল ঘটবে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে কী? স্বৈরতন্ত্রেতো বিচারের বালাইও পড়তো না। গণতন্ত্র অন্তত বিচারের সম্মুখীন করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে শাস্তি প্রদান করে থাকে। আর আপনি না, আসলে হুমকি হয়ে উঠেছিল আপনার জনপ্রিয়তা। আপনার অনুসারীরা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। সংখ্যাটা বিপদজনক হয়ে, সরকারের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হবার আগেই আপনাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাও গণতন্ত্রের একটা দোষের দিক। আবার দোষের দিকও বা কেন বলব? গণতন্ত্র একটা নিয়মতন্ত্র অনুসরণ করছে। আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও একই কাজ করত তারা। সেক্ষেত্রে এটা আপনার মেনে নেয়া উচিত যে, আপনি হয়তো সৎ, কিন্তু আপনার মত অন্য কেউ সৎ ও সঠিক হবে তার নিশ্চয়তা তো নেই। বা আপনিও বদলে যাবেন না, জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে যাবার চেষ্টা করবেন না, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন না,সেটাও কী করে নিশ্চিত হতো তারা? আমি সামনে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, গণতন্ত্র সকল দেশ ও নগরের জনগণের কাম্য বস্তু হয়ে দাঁড়াবে।’

‘তুমি ভাবালু তরুণ তাই গণতন্ত্রের ভয়ঙ্কর রূপটি উন্মোচিত হচ্ছে না। গণতন্ত্র, সংখ্যালঘুদের অত্যাচারে প্রলুব্ধ করে। স্বভাবতই সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ দেখতে গিয়ে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হবেই। এছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন অজ্ঞ তখন গণতন্ত্রও অজ্ঞের বাহন হয়ে পড়ে না? এটাও কি চরম স্বেচ্ছাচারীতা নয় যে, কারো মৃত্যুর বিষয়ে পাঁচশ বিচারকের দুইশত একান্নজন একমত হলে বাকি দুইশত উনপঞ্চাশজনের মতকে অগ্রাহ্য করে, অসম্মান করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়? এখানে ভালোটা কোথায় নাইকোস্ত্রাতাস? আমি তাকিয়ে আছি অনেক সামনে। কতটা সামনে সেটা তোমার উপলব্ধিতেও নেই। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি গণতন্ত্র মানুষের জন্যে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তবে যাই হোক, আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এটাই আসল কথা। স্বৈরাচার সরকার বা গণতান্ত্রিক সরকার উভয়ের ক্ষমতায় থাকাকালীন আমি আইন মেনে চলেছি। তবু বিচারকেরা আমাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। এটা কী চরম অজ্ঞতা নয়? জ্ঞান চর্চার অসম্মান নয়? জনপ্রিয়তাকে ভয় পাওয়া ক্ষমতাবানরা তবে অজ্ঞ নয়?’

‘অজ্ঞদের শাস্তি মেনে নেয়াও কী অজ্ঞতাকে প্রশ্রয় দেয়া নয় হে মহামান্য? সেটাও তো জ্ঞানীর শোভা পায় না।’

আকাশ থেকে চোখ ফেরান তিনি, ফেরেন নাইকোস্ত্রাতাসের দিকে। ‘তোমার মনে কী লুকিয়ে রেখেছো নাইকোস্ত্রাতাস? কেন বারবার রঙ বদলাচ্ছে তোমার ভাবনা? প্রশ্ন?’

গলার স্বর নামিয়ে আনে নাইকোস্ত্রাতাস। ‘হে মহামান্য শিক্ষক, সত্যিটা তবে বলেই ফেলি- আমি আজ এখানে আপনাকে তর্কে পরাজিত করে এখান থেকে পালিয়ে যেতে রাজি করাব বলেই এসেছি। তবে আপনাকে পরাজিত করার মত যথেষ্ট জ্ঞানী আমি নই। কিন্তু এ কয়েদখানা আপনার স্থান নয়। আমরা চাই আপনি আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন আমাদের মধ্যে আলো হয়ে। এ কথা হয়তো আরো অনেকেই বলেছে, আমিও বলছি, সামনেও আরো কেউ হয়তো বলবে। প্রয়োজনে আপনার সকল শিষ্য আপনার সাথে দেশান্তরি হবে। আপনাকে আমাদের প্রয়োজন। কেন আপনি শাস্তি মেনে নিচ্ছেন? আপনি বেঁচে থাকলে আরো কত কত মানুষ আপনার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে সেটা আপনি ভাবতেও পারছেন না।’

‘আহ, নাইকোস্ত্রাতাস। আমার আনন্দ হচ্ছে, এই ভেবে যে তুমি আমাকে বাঁচাতেই এত তর্ক করে গেছ। এত তীব্র আক্রমণ তোমার আগে কেউ আমাকে করেনি। তবে কী গণতন্ত্র সম্পর্কে তোমার কথাগুলো মিথ্যে? তুমি আসলে তেমনটা ভাবো না?’

‘না মহামান্য। আমি সত্যিই অমনটা ভাবি। আমি গণতন্ত্রকে অন্যান্য শাসনব্যবস্থার উর্ধ্বে স্থান দিই। গণতন্ত্র অন্তত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত তো নেয়।’

‘আমার ঠিক সেখানেই আপত্তি নাইকোস্ত্রাতাস। অজ্ঞরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে সেটাও গণতন্ত্র মেনে নেয়। তখন জ্ঞানী ও জ্ঞান হয়ে পড়ে কোণঠাসা।’

‘এ আলাপ পরেও করতে পারব মহামান্য। আপনি কেবল অনুমতি দিন। আপনার পালাবার সকল ব্যবস্থা প্রস্তুত।’

‘তোমরা, আমার প্রিয় অনুসারীরা, আমাকে কিনে দিতে চাইছ পাঁচ-দশ বা বড়জোর বিশ-ত্রিশ বছর। এ সামান্য ক’টা বছর নয় হে গুণমুগ্ধ, আমি তাকিয়ে আছি হাজার হাজার বছর সামনে। আমার এ আত্মত্যাগ সত্যের পক্ষে, নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায়, দুর্নীতির প্রতিবাদে এবং জ্ঞানের মহিমা প্রকাশে। এ আত্মত্যাগ জ্ঞান অর্জনে অসংখ্য মানুষকে তাড়িত করবে। কত কত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে এ ত্যাগ, তার সংখ্যা আমি কল্পনায়ও আনতে পারছি না। এছাড়াও, এই বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুতো যেকোনো মুহূর্তে আসতে পারে। পালানোর পরেরদিনই দেখা গেল মৃত্যু হাজির। তখন কী, ঘৃণায়-অসম্মানে আমার নাম উচ্চারিত হবে না? আমার সমস্ত প্রচেষ্টা কী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে না? আর তা-ও যদি না হয় তবে আমার মত বৃদ্ধ মানুষের জীবন রক্ষায় কেন তোমরা তরুণরা নিজেদের বিপন্ন করবে? আমিও বা সেটা কেন হতে দেব? মৃত্যুতে কী আসে যায় নাইকোস্ত্রাতাস? লক্ষ্য সমুন্নত রাখতে গিয়ে যদি মৃত্যু আসে তবে কী তা শ্রেয় নয়?’

‘কিন্তু এমনতো নয় যে আপনি নিষ্কৃতি পেতে চান নি। আপনার শিষ্যরা মুক্তিপণ হিসেবে ত্রিশ মিনা প্রস্তাব করেছিল আপনার হয়ে। আপনিও সায় দিয়েছিলেন। কিন্তু জুরিরা সেটা মেনে নেয় নি।’

‘মুক্তিপণ প্রস্তাব কি আমাদের আইনে নেই? না থাকলে অবশ্যই করতাম না। আমি চলমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, আইন মেনেই নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছি। আইন অমান্য করে নয়। এটা যে আত্মত্যাগ, তা তুমি হয়তো বুঝতে পারছো না। নইলে সত্যিই নিষ্কৃতি পেতে চাইলে, বাঁচতে চাইলে এবং সেটাই একমাত্র কাম্য হলে আমার হাতে তো উপায় ছিল। শিক্ষাদানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা এবং ভবিষ্যতে মানুষকে শিক্ষাদান থেকে বিরত থাকলেই আমি নিষ্কৃতি পেতাম, এটা কি তুমি ভুলে গেছ?’

‘আপনি আসলে একিলিসের ভাগ্য বরণ করে অমর হয়ে যেতে চান। এটাও একরকম ভাবালুতা।’

মমতায় নাইকোস্ত্রাতাসের কাঁধে হাত রাখেন তিনি। ‘বিষয়টা অমরত্বের নয় বা এটা ‘‘তুমি’’ কিংবা ‘‘আমি’’ প্রসঙ্গেও নয়। আমার সিদ্ধান্ত সম্ভাব্য সকল দিক বিবেচনা করে নেয়া। পৃথিবীতে এটা জ্ঞানের পক্ষে প্রথম আত্মত্যাগ হতে যাচ্ছে। হয়তো এটা আমাকে অমরত্ব দেবে বা না-ও দিতে পারে। তবে এটা জ্ঞানতৃষ্ণাকে চলমান রাখবে। জ্ঞান অর্জনে উদ্বুদ্ধ করবে মানুষকে। মানুষ প্রশ্ন করতে শিখবে। প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসাই জ্ঞানের প্রথম ধাপ। উত্তরদান নয়। অবশ্যই তুমি দেখবে, এমন একটা সময় আসবে, যখন দেয়ালে দেয়ালেও মানুষ জ্ঞান ছড়াতে চাইবে। নির্লজ্জ ভাবেই। স্বপ্রণোদিত হয়ে উত্তর দিতে চাইবে নানা প্রশ্নের, ব্যাখ্যা দিতে চাইবে সবকিছুর-সব ঘটনার, ঢালাও সমালোচনা করবে কিছু একটা অপছন্দ হলেই; নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণে। তারা এটা মনে রাখবে না যে, জিজ্ঞাসা তথা জানতে থাকাটাই জ্ঞানীর বৈশিষ্ট্য; সকলসময়েই উত্তর প্রদান, জ্ঞান বিতরণ, সমালোচনা, মতামত প্রদান জ্ঞানীর বৈশিষ্ট্য নয়। তবে হ্যাঁ, একিলিস ও আমার মূল চাওয়া অভিন্ন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও একিলিস প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্য থেকে সরে যায়নি। আমিও সরে আসিনি লক্ষ্য থেকে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও। এর বাইরে তোমাকে আর কিছু বলার নেই। আমি নিজেকে যথেষ্ট ব্যাখ্যা করেছি। এবার তুমি যাও, আমি কিছু জটিল বিষয়ে চিন্তিত। বেশ কিছু প্রশ্ন জাগছে মনে সেগুলোর সদুত্তর খুঁজছি। কাল এসো। বিদায়।’

‘আমি আর আসব না হে মহামান্য। আমি হয়তো এ নগর ছেড়েই চলে যাব। আপনার মত জ্ঞানীকে যে নগর মৃত্যুদন্ড দেয় সে নগর মৃত-বন্ধ্যা। এই নগরে জ্ঞানপিপাসুদের জীবন-যাপন অসম্ভব। আমার জন্যে প্রার্থনা করবেন মহামান্য। বিদায়।’

অশ্রুসজল চোখে বিদায় নেয় নাইকোস্ত্রাতাস। তাঁর সেদিকে খেয়াল থাকে না। নাইকোস্ত্রাতাস যেতে যেতে ফিরে দেখে তিনি আকাশে তাকিয়ে ডুবে গেছেন নিজ ভাবনায়। চোখে-মুখে জাগতিক পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আক্ষেপ নেই। আছে আনন্দের ঝিকমিক। আছে মানব মনের রহস্য উন্মোচনের খুশি। আছে প্রশান্তি। শিশুর সারল্য। তৃপ্তি।



বিঃদ্রঃ
লেখাটার ধারণা পেয়েছি মূলত আমিনুল ইসলাম ভুইয়ার অনুবাদে প্লেটোর লেখা ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’ (Apology Of Socrates) পড়ে। আরো কিছু  আলো পেয়েছি ড. সফিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড ও হেমলকপান’, মোঃ লিয়াকত আলী খানের অনুবাদে মাইকেল ই. হেটারস্লে রচিত ‘সক্রেটিস অ্যান্ড জেসাস’ পড়ে। আরো প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক তথ্যের জন্যে, বিশেষ করে গ্রীক দর্শন নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে কে কী ভাবছে তা জানতে পড়েছি ইমাম গাজ্জালী রচিত ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা’।

‘‘নাইকোস্ত্রাতাস’’ সক্রেটিসের শিষ্যদের একজন যার উল্লেখ কেবল মাত্র পাওয়া যায় প্লেটোর লেখা ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’তে। এর বাইরে আর কোথাও নাইকোস্ত্রাতাসের নামমাত্র উল্লেখও নেই। ফলে, তাকে নিয়ে এই কাল্পনিক সংলাপটি দাঁড় করানোর প্রয়াস পেয়েছি।

লেখার প্রয়োজনে সক্রেটিসের কিছু বিখ্যাত উক্তি ব্যবহৃত হয়েছে যা কোটেশন মার্ক দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে সেসব আসলে আমার বক্তব্য নয়। এছাড়াও লেখার মনন-ভাব পুরোটাই সক্রেটিসের সময়ের এবং সক্রেটিসের জবানবন্দী, ক্রিটোর সংলাপ ইত্যাদির ভাব বা প্রভাব এই লেখাতে থাকতে পারে। 

akthermahmud@gmail.com 







Previous Post Next Post