🇮🇳 রিঙ্কি বোস সেন | তুমি বল আমি শুনি

ইংরাজি ভাষায় একটি শব্দ আছে gullible, যাকে বাংলায় অর্থ করলে যা দাঁড়ায় তা বোঝানোর জন্য আমরা 'কানপাতলা' শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। হ্যাঁ, 'কানপাতলা' মানুষ হলেন তারা, যারা খুব অনায়াসে অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে যান এবং সেই অনুযায়ী সুর-তাল-লয় দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।সমগ্র 'সৃষ্টির' সর্বোত্তম প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও মানুষ যেসব ক্ষেত্রগুলিতে অবলীলায় নিজেকে আকাট মুর্খ বলে প্রমাণ করে তার মধ্যে অন্যতম হল এই 'কানপাতলা' স্বভাব, অন্যের মুখপাত্র( spokesperson)হয়ে হাউমাউ করে ওঠা... আদ্যপ্রান্ত, ভিতরবাহির কিছুই না বুঝে।

মানুষের এই স্বভাব আজকের নয়, অতি-আধুনিকতারও নয়। এই স্বভাব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষের চরিত্রে লালিত-পালিত হয়ে আসছে। এক শ্রেণি উস্কায় আর এক শ্রেণি উস্কানি খায়। যারা উস্কায় তারা অনেকটা ঐ শব্দের মধ্যে উপস্থিত 'উহ্য-ধ্বনি', দেখা গেলেও শোনা যায় না। আর যারা উস্কানি খায় তারা এসে মঞ্চ মাতায়। প্রথম শ্রেণির কাজ হল অতি সন্তর্পণে পরিকল্পনার ছক কষা। আর দ্বিতীয় শ্রেণির কাজ হল বাস্তবিক বোধ বিসর্জন দিয়ে কল্পনায় ভাসা।

খুব ছোটবেলায় যখন বাইবেলের গল্প পড়েছিলাম, তখনই জেনেছিলাম কীভাবে স্যাটানের কথায় ইভ আর ইভের কথায় এ্যাডম পরিচালিত হয়েছিল। আর পরিচালিত হয়ে ডেকে এনেছিল এমন এক পরিস্থিতি যা তাদের কল্পনা থেকে পরিকল্পনা কোনো কিছুতেই ছিল না। রামায়ণেও তো দেখতে পাই, কেমন করে মন্থরার কুমন্ত্রণায় কৈকেয়ী হয়ে উঠলো বিদ্রোহী, আর মহাভারতে শকুনির বিষ-মন্ত্রে কৌরবরা। সবই সেই 'কানপাতলা' স্বভাবের ফলাফল।

সাহিত্যেও আছে এমন ঝুড়ি ঝুড়ি উদাহরণ। শেক্সপিয়রের নাটকের কথাই না হয় ধরা যাক। মনে পড়ে সেই ওথেলোকে। কেমন সে তার বুদ্ধিশুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা সর্বস্ব শিকেয় তুলে ইয়াগোর ছলচাতুরীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। অত বড় এক যোদ্ধা, অত বড় এক ব্যক্তিত্বের নায়ক শেষমেশ কিনা
এক 'কানপাতলা' অপদার্থে পরিণত হল!

🇮🇳 রিঙ্কি বোস সেন | তুমি বল আমি শুনি




ইতিহাসেও এমন নিদর্শন আছে।যুগে যুগে যুদ্ধ তো আর এমনি এমনি বাধেনি, আর এমনি এমনি বাধেও না।

এই 'অপদার্থতা' কমবেশি আমরা প্রত্যেকেই জীবনের বিভিন্ন সময়ে বা বলতে গেলে দু:সময়ে দেখিয়ে থাকি...কুমন্ত্রণার জালে জড়িয়ে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিই, বিদ্রোহ করি এবং শহীদও হই, বিনা গৌরবে। কিছুজন শিক্ষা নিয়ে, কান মুলে বলেন, "ভুল পথে চালিত হয়েছিলাম কিন্তু আর নয়"। আর বাদবাকি কিছুজন কিছুই বলেন না। কারণ তারা ততদিনে দীক্ষা নিয়ে ফেলেছেন, উস্কানি খেয়ে মস্তানি করার। এই রীতি সংসার জীবনে ভীষণভাবে চলে। কর্মক্ষেত্রেও চলে, রমরমিয়ে। দেশ তথা বিশ্ব রাজনীতি তো এইসবের উপরেই দাঁড়িয়ে।

প্রচার মাধ্যমের তো কথাই নেই! বিশেষ করে বর্তমানে, 'হয় কে নয় আর নয় কে হয়' করে আমাদের কান ভাঙাচ্ছে আর আমরাও নাচছি আমাদের 'পাতলা পাতলা' একজোড়া কান নিয়ে। এক কথায় ঘরেবাইরে,হাটেবাজারে, অফিসে-স্কুলে, ট্রেনেবাসে, জি বাংলা থেকে জয় বাংলা, মহাভারত থেকে 'মেরা ভারত' সর্বত্রই একদল কান ভাঙাচ্ছে আর একদল কান বিকোচ্ছে।


এই 'কানপাতলার' দলের সবাই প্রবক্তা। এরা ঠিক কী বলছেন জানেন না, কেন বলছেন জানেন না। কাদের হয়ে বলছেন সেটাই তো জানেন না।কিন্তু যারা বলাচ্ছেন তারা সব জানেন৷ তারা জানেন কাকে কোথায় কীভাবে কী বলতে হবে, বলানোর জন্য। এই এনারা হচ্ছেন সব ডুগডুগি বাদক, বাজাচ্ছেন। আর ওনারা নাচছেন। অবাক লাগে যখন দেখি কিছু মানুষকে তাতিয়ে দিলেই কেমন সুন্দর তেতে ওঠে। অথচ ঠিক এরাই যখন জ্বলে ওঠার সময় আসে তখন সব ভেজা দিয়াশলাই।

আচ্ছা, আমরা শুধুই কেন প্রভাবিত হতে ভালোবাসি, উৎসাহিত হতে নয়? Influenced হবার চেয়েও বেশি করে কি inspired হওয়া যায় না?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.