কমলিনী আর রজতের সুখের সংসার। দুজনের মনের মিলও খুব। তবে সমস্যা একটাই। রজতের কোন কাজেই বেশিদিন মন টেঁকে না। আট বছর হল তাদের বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যে রজতের তিনটে চাকরি বদলানো হয়ে গেছে। কমলিনী রজতের সঙ্গে ঝগড়া তো করেই না, বরং ও এতে আরও খুশি। কারণ চাকরি বদল মানেই নতুন নতুন জায়গায় বাসা খোঁজা। এই যে প্রত্যেকবার এত এত মালপত্র বাঁধাছাঁদা করে আবার নতুন করে ঘর সাজাবার ঝক্কি, কত জিনিস ফেলে দিতে হয়, সেসব কমলিনী সয়ে নেয় কেবল নতুন একটা পরিবর্তনের আনন্দে। নতুন জায়গা, নতুন ঘর, সেখানে নতুন প্রতিবেশি, নতুন দোকানপাট সবই নতুন করে আবার আবিষ্কার করা। এই রোমাঞ্চটা কমলিনী ও রজত দুজনেই উপভোগ করে। কিন্তু তাদের একমাত্র ছেলে কিংশুক এই ভ্রাম্যমান জীবনের মধ্যেই ছয় বছরে পা দিয়েছে, এবার ওকে একটা স্কুলে ভর্তি না করলেই নয়। এবার থিতু হতেই হবে, কমলিনী ও রজতের বাবা-মা এই কথাটাই ওদের বারবার করে বুঝিয়েছেন। “অনেক তো ঘোরাঘুরি হল, এবার থিতু হয়ে মন দিয়ে সংসার কর, ছেলেকে স্কুলে দাও।”
ওরাও সেকথা ভেবেছে। রজত তাই কম্পানি জব ছেড়ে একাডেমিকস-এ চলে আসবে ভেবে একটা প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনার কাজ নিয়েছে। জায়গাটা আধা মফঃস্বল শহরতলী। গাছপালা প্রচুর। বাজারে অনেক টাটকা শাক-সবজি পাওয়া যায়। কলেজটা নতুন। এখনও ক্যাম্পাস তৈরি হয়নি। ওরা কলেজের কাছেই পাড়ায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। পাশের ঘরের প্রতিবেশী রজতের কলেজেরই এক অধ্যাপক, হিমাদ্রি ভাড়া নিয়েছে। হিমাদ্রি ব্যাচেলর, তবে পাত্রী দেখা চলছে। ওর নতুন চাকরি। রজতের চেয়ে বয়সে প্রায় বছর সাতেকের ছোট। কমলিনীর থেকে চার বছরের ছোট। ওকে দিদি ডাকে, সব ব্যাপারে পরামর্শ নিতে আসে, ভারি মিশুক ছেলে। কমলিনীর সঙ্গে সহজেই ভাব জমে উঠেছে। ভালমন্দ কিছু রান্না হলেই ও তার নতুন ভাইয়ের জন্য বাটিতে করে তুলে রাখে, কিংশুক স্কুল থেকে ফিরলে ওর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।
নতুন জায়গা ভালই লাগছিল। কিন্তু বাদ সাধল করোনা ভাইরাস। এমন মহামারী হয়ে রোগটা ছড়িয়ে পড়ল যে সরকারি নির্দেশে স্কুল কলেজ সব বন্ধ হয়ে গেল। সরকারী নির্দেশে সম্পূর্ণ ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হল। স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার পর কিংশুক মহা উৎসাহে নতুন স্কুলে যাতায়াত করছিল। এখন বাড়িতে সর্বক্ষণ বন্দী থাকতে থাকতে মনমরা আর জেদী হয়ে গেছে। আর কমলিনীর অবস্থাও তথৈবচ। হিমাদ্রি সময় কাটাতে ফ্ল্যাটের সামনের ফাঁকা জায়গায় প্রচুর সবজির বাগান করে ফেলেছে। কমলিনীও গাছপালা বাগান এসব খুব ভালবাসে, কিন্তু তার যে পায়ের তলায় চাকা! বছরে দু’তিন বার ওরা বেড়াতে চলে যায়। কখনো পুরী, কখনো দার্জিলিং, কখনো সুন্দরবন তো আবার কখনো সিমলা। মা কতবার বলেছে, “কমলি, বাড়িতে তুলসী গাছ থাকা ভাল। তুলসী, এলোভেরা, লঙ্কা চারা টুকটাক বারান্দায় টবে রাখলে পারিস তো!” কমলিনী আঁতকে ওঠে, “ও বাবা! বেড়াতে গেলে গাছে জল দেবে কে? শুকিয়ে মরে যাবে তো? একটা প্রাণ অবহেলায় মরে যাবে, তার থেকে না থাকাই ভাল।” এবার রজতের কলেজ বন্ধ, কিংশুকের স্কুল বন্ধ, সব্বাই ঘর বন্দী অনেকদিন হল। কমলিনী ভাবে, “কটা ফুলগাছের চারা লাগালে মন্দ হয় না?” বাজার থেকে একদিন ও লাল আর গোলাপি দুই রঙের জবা, চাইনিজ টগর আর নীল অপরাজিতার চারা কিনে আনে। হিমাদ্রির সঙ্গে পরামর্শ করে সার টার দেওয়াতে গাছগুলো কিছুদিনের মধ্যেই বেশ ঝাঁকরা হয়ে ফুল দিতে শুরু করেছে। প্রথম যেদিন অপরাজিতা লতায় নীল ফুল দেখা গেল, সে যে কী আনন্দ তা পুরীর সি-বিচে সানরাইজ দেখার আনন্দের থেকে কম নয়। এখন গাছের নেশা বেশ পেয়ে বসেছে কমলিনীকে। নিত্যনতুন ফুলের গাছে বারান্দা ভরে উঠছে, রোজ কোন না কোনও গাছে ফুল ফোটে। মনে মনে প্রত্যেকটা গাছের নাম দিয়েছে সে। টগরের নাম শ্বেতা, লাল জবার নাম লালি, গোলাপি জবা পিঙ্কি আর অপরাজিতা হল ময়ূরী। সন্ধ্যাবেলা দেখে রাখে লালির নতুন কুঁড়ি এসেছে, ও ফিসফিস করে বলে, “সাবধানে থাকিস লালি, সকালে উঠে তোর মেয়ের মুখ দেখব!” হিমাদ্রির সবজি বাগান আর কমলিনীর বারান্দা-বাগান নিয়ে দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছে। দুদিন হয়তো কমলিনী একটাও ফুল পায়নি, হিমাদ্রি বিজয়ী হাসি হেসে দিয়ে গেছে গাছের চারটি উচ্ছে কিম্বা সীম। আবার যেদিন কমলিনীর বারান্দা ফুলে ফুলে আলো হয়ে উঠেছে, প্রাণভরে ঠাকুরের সিংহাসন ফুল দিয়ে সাজিয়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছে হিমাদ্রিকে। তবে কমলিনী হল দিদি, ছোট ভাইয়ের বাগান নিয়ে তার মনে কোন ঈর্ষা তৈরি হয়নি।
অবশেষে মারণ ভাইরাসের টীকা বাজারে এসে গেল আর রোগটার উপরেও খানিকটা কাবু পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে অফিস-দোকানপাট আবার খুলতে আরম্ভ করেছে। একটানা সাত মাস সমস্ত ট্রাভেল নিষিদ্ধ থাকার পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই নিষেধাজ্ঞা সরকার শিথিল করেছেন। ফলে অনেকদিনের সুপ্ত ভ্রমণ বাসনার রুদ্ধ আবেগ আবার জেগে উঠেছে, রজত আর কমলিনী দুজনেই নবীন উৎসাহে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান আরম্ভ করে দেয়। দক্ষিণভারত ভ্রমণের সমস্ত পরিকল্পনা ছকে ফেলা হল। কিন্তু হঠাৎ কমলিনী চেঁচিয়ে উঠল, “আমার বারান্দা বাগানের কী হবে?” রজত ওকে আশ্বস্ত করে বলে, “কেন, তোমার ভাই আছে তো? বাইরের ঘরের চাবিটা হিমাদ্রিকে দিয়ে যাব, ও একদিন অন্তর গাছগুলোতে একটু জল দিয়ে দেবে, ব্যাস, মিটে গেল সমস্যা!” কমলিনীও রজতের প্রস্তাবে নিশ্চিন্ত হয়। টিকিট কাটা হয়ে গেলে কমলিনী আনন্দসংবাদ দেয় প্রতিবেশী ভাইকে। ওর গাছে জল দেওয়ার কথাও বলে। হিমাদ্রি বলে, “কোন ব্যাপারই না। তোমার গাছের দায়িত্ব আমার। যাও, ভাল করে ঘুরে এস।” নির্দিষ্ট দিনের দুদিন আগে থেকে হিমাদ্রিকে কিছুতেই ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাওয়া যায় না। যেন কমলিনীর মুখোমুখি হবে না বলেই ও ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ওকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে, ওকে ঘরের চাবিটা দিতে হবে। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর অবশেষে ওকে ফোনে পাওয়া যায়, ব্যস্ত স্বরে ও বলে, “হ্যাঁ কমলদি, কদিন একটু চাপ যাচ্ছে। তোমরা কখন বেরচ্ছ? চিন্তা কোরো না, ঠিক এসে চাবি নিয়ে নেব। তোমার গাছ শুকিয়ে মরবে না গো!” কমলিনী আবারও আশ্বস্ত হয়।
বেরোবার সময় হয়ে গেছে। হিমাদ্রির দেখা নেই। ওকে বার বার ফোন করছে কমলিনী আর রজত দুজনেই। ফোন সুইচ অফ আর সকাল থেকে ওর ঘরেও তালা দেওয়া। রজত বলে, “চাবিটা কি একটা প্যাকেটে ভরে ওর দরজায় ঝুলিয়ে রেখে যাব?” কমলিনী বলে, “সেটা কখনো হয়? কী যে বলো তুমি? পনেরো দিনের ব্যাপার, চাবি এভাবে রাখা যায় নাকি? কিন্তু হিমাদ্রির কী হল, সেটাই বুঝতে পারছি না!” কিন্তু দেরী করলে ওদিকে ট্রেন মিস হয়ে যাবে। অগত্যা কমলিনী একটা অদ্ভুত বুদ্ধি বের করে। পায়জামায়, সায়ায় দড়ি পরানোর জন্য ও একসময় নরম গেঞ্জির কাপড়ের দড়ি অনেকগুলো কিনে রেখেছিল। ঘরে ২ লিটারের কোল্ডড্রিংকের বড় বড় খালি বোতল রাখা ছিল। সেইরকম বেশ কয়েকটা বোতলে জল ভরে তার মধ্যে ডুবিয়ে দেয় দড়ি। সেই ভেজা দড়ির অপর প্রান্ত ও গুঁজে দেয় এক একটা টবের মাটিতে। ভাবে, সরু মুখ বোতলে জল সহজে উবে যাবে না। ভেজা দড়ি বেয়ে খুব অল্প হলেও চুঁয়ে জল আসবে ও মাটি শুকিয়ে যাবে না একেবারে। দেখা যাক, গাছগুলোর কপালে কী আছে?” লালি, পিঙ্কি, শ্বেতা, ময়ূরী সবার কাছে বিদায় নিয়ে ভারি মন নিয়েই কমলিনী বেড়াতে বের হয়। দেখতে দেখতে ঝড়ের বেগে দু’সপ্তাহের আনন্দ-ভ্রমণ শেষ হয়ে যায়। এবার ঘরে ফেরার পালা। এর মধ্যে একবারও হিমাদ্রি যোগাযোগ করেনি। কমলিনীরও খুব অভিমান হয়। তার নিজের ভাই নেই। ছেলেটাকে ছোট ভাইয়ের মত ভালবেসেছিল। দুরুদুরু বুকে ঘরের তালা খুলে ঢুকেই আগে ছুটে যায় বারান্দায়। আছে আছে, ওরা সবাই বেঁচে আছে, এমনকি কমলিনীর অভ্যর্থনায় দুচারটে ফুলও ফুটিয়ে রেখেছে! আনন্দে চোখে জল আসে। কিছুক্ষণ পরে হিমাদ্রি এসে হাজির হয়, হাতে একটা পুঁইশাকের ডগা, “কি? কেমন বেড়ালে?” যেন কিছুই হয়নি, কিছুই জানে না, এমন একটা ভাব। কমলিনী কিচ্ছু জানতে চায় না, কেন সে একটাও ফোন ধরেনি, বেড়াতে যাওয়ার দিন সকাল থেকে কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল, সেসব কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। শুধু বলে, “খুব ভাল ঘুরেছি। তুমি ভাল আছ তো?” আকর্ণ হেসে হিমাদ্রি বলে, “তোমার ফুলগাছ কি একটাও বেঁচে আছে? বেড়ানোর অত শখ থাকলে কি আর বাগান করা যায়? যাই হোক, আমার বাগানের পুঁই খেয়ে দেখ, কীটনাশক নেই এতে...” শিউরে ওঠে কমলিনী, হিমাদ্রির মনের হিংসা যেন একটা সবুজ লিকলিকে সাপ হয়ে ওর হাতে দুলছে। এতদিন পাশাপাশি থেকেও ওর ভিতরে যে এত কুৎসিত একটা মন লুকিয়ে রয়েছে, তাকে তো দেখতে পায়নি? নিরাসক্ত স্বরে কমলিনী বলে, “আমাদের পুঁইশাকে এলার্জি ভাই, দুঃখিত, নিতে পারব না। এখন খুব ক্লান্ত। পরে কথা হবে, কেমন?” হতভম্ব হিমাদ্রির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে গিয়েও ভাবে, “হিংসার বিনিময়ে ভালবাসা দিতে তো কোন বাধা নেই?” পিছন ফিরে বলে, “দাঁড়াও এক মিনিট,” বারান্দা থেকে কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে হিমাদ্রির হাতে দেয়, “আমার গাছের ফুল! একটা প্লেটে করে জল ছিটিয়ে ফুলগুলো টেবিলে সাজিয়ে রেখো, মন ভাল করে দেবে!”
সুচিন্তিত মতামত দিন