সুমনা সাহা | মৃত্যুর গন্ধ

কয়েক মাস আগে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, কী নাম ছিল সেটার, মনে পড়ছে না, তবে ইংরাজি সিনেমা, একটা কথা মনে গেঁথে আছে। এক বৃদ্ধ মাফিয়া ডন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে, বাঁচার আশা নেই, ক্যান্সারের সর্বশেষ স্টেজ। এক তরুণ অনেক কষ্ট করে ছদ্মবেশে সেই ঘরে ঢুকেছে, ঐ ডনের লাগিয়ে রাখা এজেন্ট তার জীবনটা নরক করে তুলেছে, বুড়োকে নরকে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় বুঝিয়ে বলতে এসেছে। বুড়ো যখন তার কষ্টের কথা বলে, যুবক বলে, “জানি আমি বুঝি ওসব!” বুড়ো বলে ওঠে, “তুমি ছাই জানো হে ছোকরা! ইউ হ্যাভ নট ইয়েট স্মেলড ডেথ!” খুব মনে বেজেছিল কথাটা। ‘মৃত্যুর গন্ধ শোঁকা?’ তার মানে মৃত্যু কাছাকাছি এসে গেলে, তার গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। সেই গন্ধটা কেমন? একটা অনুভূতিকে কি রঙ বা গন্ধ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? কেবল অনুভব করা যায়। মৃত্যুকে আমরা জানি না, মরতে কেমন লাগে, ঠিক জ্যান্ত থেকে ‘মরা’ হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে কী হয় মনের অবস্থা, জানি না। মরে যাওয়ার পরে কী হয়, সেও অজানা। আর ঐ অজানা বলেই মৃত্যু সংক্রান্ত সব কিছুই কালো রঙ দিয়ে বোঝাই। কালী তাই কালো, মৃত্যুরূপা মাতা!

অল্প বয়সে অনেক কিছুই বোঝা যায় না। একটা বয়সের পর হাঁটুর জোর কমে যায়, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হাঁফ ধরে যায়, লিফট বন্ধ থাকলে প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। যখন একসঙ্গে দুটো-তিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে উঠতাম, সিঁড়ির উপরের ল্যান্ডিং থেকে নিচে লাফ দিতাম, ওটা যেন খেলা ছিল, তখন আজকের সময়টা ভাবতে কি পেরেছিলাম?

একটা বয়সের পর জীবন সম্পর্কে যে বোধ জন্মায়, সেটা এত বেশি বাস্তব, মানুষের হুড়োহুড়ি উল্লাস জলসা, হাউমাউ কান্নাকাটি সবই কেমন অর্থহীন মনে হয়। জানি ওরা সবে চ্যুইংগামটা মুখে পুরে চুষতে আরম্ভ করেছে। উপরকার মিষ্টি কোটিং এখনও উঠে যায়নি। তাই ওরা পুরোটা বুঝবে না এখন। কিন্তু মুখে কিছু বলি না। একটা হাসি টেনে রাখি। কারণ গীতায় বলেছে—‘ন বুদ্ধি ভেদং জনয়তে’। মানে, তুমি বুঝে ফেলেছ, চুপ করে থাকো। যারা বোঝেনি, তাদের রসটা মাটি করে দিও না।

এমন নয় যে, আমার কাছে জীবনটা বিস্বাদ হয়ে গেছে। বরং আরও গভীরে দেখতে শিখেছি বলে একটা প্রশান্তি এসেছে। কোন তাড়াহুড়ো নেই, ছটফটানি নেই। জীবনের ছোটখাট অজস্র রঙ যেন অনায়াসে ছুঁতে পারছি।

আগে কেউ রূঢ় বাক্য বললে রাগ হত। তাকে তখনই একটা প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য মুখিয়ে উঠতাম। এখন বিষয়টাকে আমতেলের মত মনের মধ্যে মজতে সময় দিই। ফেসবুক ও অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায় দেখি, একটা ইস্যু নিয়ে জবাবের সপাট জবাব, তার পালটা জবাব— চলতেই থাকে। অনেকে আবার খুব চালাক। সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানে না নেমে কোন মহামানবের বাণীর ঢাল নিয়ে জবাব দেয়। আমি কিছু বলিনি বাবা, এতো আব্রাহাম লিঙ্কন বলছেন! সবটাই নেপথ্যে দাঁড়িয়ে খেলা দেখলে বোঝা যায়। ঐ ব্যক্তির বুদ্ধির তারিফ করি, কারণ সে সেই ইস্যুর পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত কোটেশন খুঁজে বের করেছে। তার মেধা ও নেট-সার্চিং শ্রমের সম্মান করি। কিন্তু আমার নিজের কথা বলি, আমি এখন এই চোর চোর খেলা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি নিজের মনের কথা শুনেই চলতে আরম্ভ করেছি। কে কি ভাববে, কী বলবে এসব চিন্তা যদি একবার ছেড়ে দেওয়া যায়, সে যে কী অপরিমিত আনন্দ তা বুঝিয়ে বলার সাধ্য নেই। একটা কাজ করে পরদিন যদি সেটা ‘আন-ডু’ করি, কেউ যদি ভাবে মনের স্থিরতা নেই, ভাবুক গে। আমি তা নিয়ে ভাবি না। গান্ধীজীর একটা কথা মনে ধরেছে। তিনি বলছেন, “আমার দুটো কথার মধ্যে যদি সঙ্গতি না পাও, দুটি কথা যদি পরস্পর বিরোধী মনে হয়, তবে দ্বিতীয়টাই ধরতে হবে। কারণ আমি একজন সাধারণ গৃহস্থ মানুষ। কোন মহাপুরুষ নই। কাজেই প্রতিদিন আমার ভাবনাচিন্তা পরিবর্তিত হচ্ছে, আমি নিত্য শিখছি, নিজেকে ভেঙ্গেচুরে গড়ছি। তাই আগের বলা কথার সংগে পরবর্তী কথার মিল নাও থাকতে পারে।” সত্যিই তো! প্রত্যেক দিনই তো মনের কিছু না কিছু আপডেটস হতে থাকে। প্রত্যেকটা দিন আগের আমিটাকে একটু মুছে আমার আরেকটা নতুন ভার্শন। পৃথিবীটা যদি বহু বর্ণ বিশিষ্ট অসংখ্য কাঁচের টুকরো জুড়ে তৈরি একটা গ্লোব হয়, আর আমি প্রতিদিন ঐ গ্লোবের একটা টুকরো সরিয়ে ওখানে অন্য রঙের একটা কাঁচের টুকরো বসিয়ে দিই, তাহলে জগতটা আমার কাছে কালকে যা ছিল, তার থেকে অন্যরকম হয়ে গেল। একটুখানি হলেও পালটে গেল। আর জগতকে আমি যেমনটা দেখছিলাম, তার সাপেক্ষে পালটে যাওয়া জগতের বাসিন্দা ও দ্রষ্টা ‘আমি’ও বদলে গেলাম। মানে আপডেটেড হলাম। ব্যাপারটা মিউচুয়াল। আমিও যেমন পাল্টাই, আমার জগতও আমার সংগে পালটায়। এ এক অপূর্ব অনুভব। প্রতিদিন আমার এক্সপেরিমেন্ট-এর বিষয়বস্তু ‘আমি’। ডিসেকশন টেবিলে আমিই সার্জেন, আমিই পেশেন্ট। আমারই তুলতুলে মনখানি অপারেশন টেবিলে ফেলে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে আমিই কাটাছেঁড়া করি। এ এক দারুণ নেশা। এ নেশায় পেয়ে বসলে কেউ আর জগতের দিকে তাকাবে না। কোথায় ফেসবুকে কী লেখা হল, ওদিকে অমুক তমুককে কী বলল, তার উত্তরে তমুক কী কাণ্ডটাই না করল, ওর বই বিক্রি, তার গান চুরি, এর পিঠ চাপড়ানি, তার চোখ রাঙ্গানি, কিছুই গায়ে লাগে না। জোয়ার আসে যায় মাথার উপর দিয়ে। আমি আর্কিমিডিসের মত আমারই উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখি—আমার নাকের পাটা ফুলে ওঠে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে, কী নিবিড়, সুন্দর, গভীর এই দেখা! আর কিছু দেখার সময় কই? কী বললে? স্বার্থপর? জগত-বিমুখ? হলেই বা! ‘অগর দাগ লাগনে সে কুছ আচ্ছা হোতা হ্যায়, তো দাগ আচ্ছে হ্যায়’—সেই বিজ্ঞাপনের সুরে সুর মিলিয়ে বলি, নিজেকে দেখতে দেখতে, ভেঙ্গেচুরে গড়তে গড়তে যদি ভাল কিছু গড়ে ওঠে, সেই ভালটা জগতেরই থাকবে।

আবার শুরুর কথায় ফিরে যাই। নিজেকে এই দেখা আর ভেঙ্গে গড়ার ইচ্ছা শুরু হয় মৃত্যুর গন্ধ পেলেই। গন্ধটা আমাদেরকে ঘিরে থাকে। সবাইকে। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই চাঁপা ফুলের গন্ধের মত ঘন হয়ে উঠে মনে করায় একটা দিন চলে গেল। হ্যাঁ, ওটা ফুরিয়ে যাওয়ার গন্ধ, নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার গন্ধ। যে জিনিসটা চলে যায়, যে দিনটা চলে যায়, যে মানুষটা চলে যায়, যে সম্পর্কটা ভেঙে যায়, যে ষড়যন্ত্রটা বোঝা হয়ে যায়, যে রহস্য গল্পের শেষটা জানা হয়ে যায়, নদীর যে স্রোতটা বয়ে যায়, শক্তি সামর্থ্যের যে বিন্দুগুলো ঝরে পড়ে যায় গাছের ডালের বোঁটা থেকে শিউলি খসার মত—সেই সমস্তই ঐ গন্ধটা মেখে থাকে। ঐ গন্ধ যার ঘ্রাণে ধরা দেয়, তার কাছে জগত আরেকরকম হয়ে যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.