সৌমিতা চট্টরাজ | জীবন মানে জি বাংলা

তকাল আমাদের প্রতিবেশী মলয় কাকু মারা গেলেন। মলয় সরকার। আমি ডাকি মIলয় কাকু বলে। কাকু মানসিক প্রতিবন্ধী। কর্মঠ। স্বাভাবিকের তুলনায় বোধশক্তি কম। কাকু থাকতেন ছোটো বোনের সাথে তাদের পৈতৃক বাড়িতে। বোন অবিবাহিতা। মা বাবার অবর্তমানে অন্যান্য ভাইবোনেরা প্রতিবন্ধী ভাই আর অবিবাহিতা বোনের দায়িত্ব নেয়নি। এরা একে অপরের দায়িত্ব নিয়েছিল।

কমবয়সে কাকুকে দেখেছি গ্রিল ফ্যাক্টরিতে ঠিকে মজুরের কাজ করতে। বোন ছোটোখাটো একটা চাকরি করে বটে। কিন্তু কাকুকে কেউ কাজে যেতে আটকাতে পারতো না। মজুরি বোন কে এনে দিত। বোনের একার রোজগারে কি আর সংসার চলে! প্রতি শুক্রবার একটা করে সিনেমা দেখত। আমাদের রঞ্জন সিনেমাহলে প্রতি শুক্রবার ছবি বদলায়। পছন্দের বা অপছন্দের বলে কাকুর কিছু ছিল না। যা পেত খেত, যা পেত পড়ত, যেখানে ইচ্ছে যেত, যা সিনেমা পেত দেখত। কথা বলতে সমস্যা হত। জিভ জড়িয়ে যেত বলে সর্বসমক্ষে কখনো তাকে মুখ খুলতে দেখিনি। গরম লোহায় হাতুড়িপিটে এসেই লেবু দিয়ে ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে রাখতো। তেতেপুড়ে বাড়ি ফিরে বোন খাবে। মাছ বাছা, আনাজ কোটাতে কাকু যেকোনো গৃহিণী কে গুনে গুনে দশগোল দেবে। হাতে হাতে বোনকে এগিয়ে দিত রান্নার জোগাড়। বোনের কোনোরকম অসুখ করলে ছুট্টে চলে যেত আমাদের পাড়ার কম্পাউন্ডার প্রদীপ কাকুর কাছে। 

এখানে সেইসময় লোডশেডিং হত খুব। বাড়িতে তখনও ইনভার্টার আসে নি। গরম আর পড়াশোনা থেকে বাঁচতে প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি তড়িঘড়ি ছাদে চলে যেতাম। কাকুকেও দেখতাম নিজেদের ছাদে পায়চারি করতে। কোথায় কোন সার্কাসে বাঘ-সিংহ এসেছে, কোন ঝুপড়ির জিলিপি কড়া করে ভাজা আর মচমচে, ফুটপাতের কোন ঠ্যালায় ভেজিটেবল চপের সাথে স্যালাড দিচ্ছে বেশী এইসমস্ত ইনফরমেশনের ক্ষেত্রে আমার একমাত্র বিশ্বস্ত ইনফর্মার ছিল কাকু। কখনো কখনো রাস্তা দিয়ে পার্টির মিছিল পেরোলে দেখতাম কাকুও মিছিলে হাঁটছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঝাণ্ডা হাতে। কাকু মানসিক প্রতিবন্ধী। বোধশক্তি কম। পছন্দ, অপছন্দ নেই। আস্থা, অনাস্থা নেই। আদর্শ, অনাদর্শ নেই। তবে? 

এক লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যায় ছাদে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই কাকু জড়ানো জিভটাকে যথাসম্ভব খুলে রেখে স্পষ্ট করে বলেছিল, "ঝাণ্ডা ধরলে ওরা পয়সা দেয় রে। রঞ্জনে এখন টিকিটের দাম কত করেছে জানিস! ইন্দুকে খবরদার বলবি না। খুব বকবে আমায়।" ঝাণ্ডা ধরতে পয়সা কে দেয়, কারা দেয়, কেন দেয় তখন আমিও জানতাম না। তবে কাকু জানবে কি করে! কাকু মানসিক প্রতিবন্ধী। বোধশক্তি কম। কাকু শুধু জানে পয়সা না দিলে এই দুনিয়াও কিচ্ছু দেবে না। 

পার্টি, পলিটিক্স, বদলা, বদল, কলকাতা, লন্ডন ইত্যাদি প্রভৃতি ইনফরমেশন ফিড করতে করতে আমি কখন যেন বড় হয়ে গেলাম। ঝাণ্ডার রঙ আর সিনেমার স্ক্রিন পাল্টাতে পাল্টাতে কাকুও কখন যেন বুড়ো হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন পিসির মুখে শুনলাম কাকুর নার্ভাস সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ করছে না। কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে আগের চাইতেও বেশী। ক্রমে অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগল। মাস চারেক আগে তো কাউকে চিনতে পর্যন্ত পারছিল না। হাতুড়ি পেটানো হাতটা এখন ভাতের দলা তুলতেও বাঁশপাতার মতো কাঁপে। টয়লেট ইউজ না করে ঘরের মধ্যে যেখানে সেখানে... পিসি সেসব পরিষ্কার করতে করতে গালমন্দ করত খুব। কাকুকে? বাপ মা কে? নিজের কপাল কে? নাকি ঈশ্বর কে? ঠিক জানি না। পিসিও জানে না হয়তো। কাকুর জন্মগত আই-কিউ 50, বোধশক্তি কম। যখনতখন বিছানাপত্তর নোংরা করে হাসত ফ্যালফ্যাল করে। কখনো কখনো কাঁদতোও। খুব কাঁদতো। 

সৌমিতা চট্টরাজ | জীবন মানে জি বাংলা

এখানে বাড়ির সীমান্তের পাঁচিল গুলো এখনও খুব একটা বড় নয়। চাইলেই ডিঙিয়ে দেওয়া যায়। আমাদের পাঁচিল ঘেঁষেই রয়েছে পিসিদের জামগাছ। তার ছায়ায় বসে পিসি বাসন মাজে। কাজের মাসী ছিল। ছাড়িয়ে দিয়েছে। ওষুধপথ্যের খরচা সামলিয়ে কোনোরকম লাক্সারি সামলানো যাচ্ছে না। আমাদের দেখা সাক্ষাৎ বলতে ওই দুপুরটুকুনই। বেলা বাড়লে মশার চোটে দাঁড়ানো যায় না। এইপার থেকে আমি হাঁক পাড়ি, "কি পিসি! খাওয়া হল!" ওই পাড় থেকে জবাব আসে, "এই তোর কাকুকে খাওয়ালাম রে। এরপর সময় পেলে দুটো গিলবো "। জবাবের চেয়ে বাসনের ঝনঝন কানে আসে বেশী। সত্যিই তো একা হাতে কদিক সামলানো যায়! কাল বিকেলেরই কথা। চারটে থেকে পিসির যোগা ক্লাস। আমারও। সন্ধ্যায় আবার স্পিরিচুয়াল লেসন নিতে যাবে গুরুজীর কাছে। পিসি ইন্টারনেটে দেখেছে স্পিরিচুয়ালিটি পান্তা পড়া জীবনেও নাকি পজিটিভ অ্যাপ্রোচ আনে! ওখানে অবশ্য আমি যাই না। যোগার ক্লাসটা পরপর মিস্ যাচ্ছে পিসির। ডাকতে গিয়েছিলাম তাই। একসাথেই তো যাই আমরা। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর তখনই কিনা কাকু কাপড়েচোপড়ে একাকার। খুব বকা খেল কাল বুড়োটা। পিসি গোলাপি রঙের যোগা ম্যাট্রেসটা ধাঁই করে কাকুর বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বললো "মরতে পারিস না তুই"! আমি পেছনে সরে যেতে যেতে আস্তে করে দরজা ভেজিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। এসব এখন দৈনন্দিনের হাঙ্গামা। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ পিসির প্রতি সহানুভূতি, কাকুর প্রতি করুনা আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা জানিয়ে দিদি নম্বর ওয়ান দেখতে বসে যায়। যেহেতু জীবন মানে জি বাংলা। পিসি যেখানেই যাক আটটার মধ্যে ঘরে ফেরে। সাড়ে আটটায় কম্পাউন্ডার প্রদীপ কাকু আসেন ক্যাথিটার চেঞ্জ করতে। ক্যাথিটারের ঘষা লেগে লেগে ইনফেকশন হচ্ছে ঘনঘন। দিবারাত্রি পিসি ফিনাইল ছড়ায়। ড্রেসিং হয় সপ্তাহে দুবার। কাকু তখন চিৎকার করে। ক্ষয়ে যাওয়া পা দু'টোর সমস্ত শক্তি মিশিয়ে শরীরটাকে সরিয়ে নিতে চায়। পারে না। খালি কাঁদে। খুব কাঁদে। 

আগে পিসির চোখটাতেও ব্যথা দেখতাম। এখন বিরক্তি দেখি। ড্রেসিং শুরু হলেই পিসি হাই ভলিউমে টিভি খুলে খবর শোনে। এবারকার মতো ডি এ ঘোষণা করলো কি না রাজ্য সরকার! বর্ষা আসতে আর কতদিনই বা দেরী! এই প্রচণ্ড গরমে পেট ঠান্ডা রাখতে মৌরির জল নাকি তালমিছিরি কোনটা বেশি কার্যকরী! পিসির চোখদুটো হেডলাইন্সে থাকে। কনসাসনেসটা পাশের ঘরে। কালকে তার ক্লাসে যাওয়া হয়নি। গোলাপি ম্যাট্রেসে পড়ে পড়ে সারা সন্ধ্যা কেঁদেছে হয়তো। কিংবা বসে বসে কাকুর ঘায়ে গরম সেঁক দিয়ে টিপে টিপে বার করেছে ফ্যাকাসে হলুদ পুঁজ। অথবা ক্রমাগত বলে গেছে হয়তো "মরতে পারিস না তুই!" 

আমি ক্লাস থেকে ফিরে একবার গিয়েছিলাম ওখানে। প্রায়ই যাই। সাড়ে আটটা নাগাদ কম্পাউন্ডারও এসেছিল। কিন্তু ক্যাথিটারটা আর চেঞ্জ করতে হয়নি গতকাল। মলয়কাকু মানসিক প্রতিবন্ধী। ৫০ আই-কিউ। বোধশক্তি কম।

সোজা কথা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.