রাহুল ঘোষ | প্রিয় শব্দের কাছে কিছু অক্ষর



"দিল না-উমিদ তো নেহি, নাকাম হি তো হ্যায়
লম্বি হ্যায় গম কি শাম মগর শাম হি তো হ্যায়"


আমি নাকি বদলে গিয়েছি বলতে-বলতে প্রিয় শব্দেরা যখন আচমকা অচেনা হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই সামনে ভেসে ওঠে অপরিচিত একটা মুখ। নির্লিপ্ত এবং পাথুরে। তখন মনে পড়ে, আরও অনেকের মতো আমিও কঠিন হতে চেয়েছিলাম। অথচ এখনও ভিতরে কাচ ভাঙার ঝুরঝুর শব্দ! যেন কিছু একটা হারিয়ে গেল। যেন কেউ একটানে পায়ের নিচ থেকে সরিয়ে নিচ্ছে মাটির চাদর। যেন উড়ে যাচ্ছি হাওয়ায়, মালিকানাহীন ধূলিকণার মতো। যেন ভেসে যাচ্ছি জলে, ঠিকানাবিহীন খড়কুটো। আমি কঠিন হতে পারছি না। কঠোর তো নয়ই! তবুও যদি বদলে গিয়ে থাকি, বদলটা আসলে কোথায়? প্রিয় শব্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছি অকাতরে। উত্তর আসছে না; অথবা যেটুকু আসছে, তা শুধু অনুভবের খেলা। নিজের কবিতায় একদিন লিখেছিলাম, "কথা শুধু কথা নয়, কথার অধিক"। পরিস্থিতির বিড়ম্বনায় তখন শুধু কথা খুঁজছি তাই।​

অথচ আমি শক্ত থাকা শিখতে চেয়েছিলাম। একেও কি বদলে যাওয়া বলা যায়? নিজের মগ্নতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে শক্ত হতে চাওয়ার মধ্যে কি কোনো অপরাধ আছে? 

আমি তো আমিই থাকলাম! শক্ত হতে পারার মধ্যে যে ভীষণ একটা শক্তি থাকে, শুধু সেইটুকু অর্জনের চেষ্টা করেছি সাম্প্রতিক। অনুশীলনও। সেখানে সাফল্যের থেকে এই মুহূর্তে ব্যর্থতার পরিমাপ সহজ। কারণ, ওই যে কাচ ভাঙার শব্দ; অথবা কোথাও যেন ঝুরোবালি গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে ঝুপঝাপ। এখন তো চারদিকে অনন্ত ভাষা-সন্ত্রাস! এর মধ্যে প্রিয় শব্দেরাও যখন প্রিয় বাক্য চেয়ে নিতে ভুলে যায়, অথবা প্রিয় অভ্যাসের উপরে বিস্মৃতির আড়াল টেনে দেয় প্রিয় মুখ, তখন নিজেকে হঠাৎ নিরাশ্রয় মনে হয়। তাহলে আর শক্ত হতে পারলাম কই! অথচ একটি চারাগাছকে বেড়ে ওঠার নিশ্চিত-পরিসর দিতে, দুটি প্রবীণ বৃক্ষকে আপাত-স্বস্তিপ্রদানের জন্য এইটুকু শক্তি অর্জন জরুরি ছিল।​

অরণ্যবাসের অন্ধকার থেকে ফিরে নাগরিকতার ঔজ্জ্বল্যে আবার প্রবেশ করার আগেই তো আমরা জানতাম, মোহিনী আড়ালে এবার অনেক বাস্তবমুখী হতে হবে আমাদের। শীতের সন্ধ্যার কুয়াশায় ভিজে যে-পথ একলা পড়ে থাকে, তার গায়ে এক উজ্জ্বল মনখারাপ লেগে আছে। বুড়ো সাধু প্রণীত তরলের রক্তিম আর সোনালি তামাকের ধোঁয়া তখন দেখিয়ে দেয়, মনখারাপে মিশে আছে এক আশ্চর্য মনকেমন। মনকেমন কারণ, আমি তো জানি, এই বিস্মৃতি তার সচেতন নয়! আমি তো জানি, এই বিস্মৃতি সাময়িক। প্রিয় শব্দের চারপাশে এত যে কালো জাদু, তাকে নিজেদের কবলে আনার এত যে গোপন হানাদারি, তার মাঝে এইটুকু বিভ্রান্তি সহনীয় করে নিতে পারবো না? তাহলে আর কিসের মগ্নতা! নিজেকে বাঁচানোর কথা এই তো সদ্য ভেবেছি। এবং ব্যর্থ হয়েছি। প্রিয় শব্দকে বাঁচিয়ে রাখার দায় কবে যে স্বেচ্ছায় ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলাম, আজ আর মনে নেই!

বিভ্রান্তি আমাদের ছিল। বিচ্যুতিও। মানুষের মুখ ম্লান করে দেওয়ার মতো অপরাধ কি আমারও অন্তত একবার ঘটেনি? কিন্তু সে-অপরাধ সচেতন নয়। একদিন আচানক পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলে মনে হয়েছিল, নিজেকে চুপচাপ বদলে ফেলার থেকে প্রতি-আক্রমণ ভালো। সেও এক বিভ্রান্তি। সেও খুব সাময়িক। কারণ সময় বুঝিয়ে দেয়, অন্তত প্রিয় শব্দের উপর প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। উল্টে নেমে আসে এক চিরন্তন বিষাদ। ফিরে এসে সবকিছু পাওয়া হয়, হয়তো আগের থেকেও অনেক-অনেক বেশি। তবুও কেন যেন মনে হয়, পুরোনো জায়গাটি ফিরে পাওয়া হলো না ঠিকঠাক! দেবতার মানবায়ন তো আমিই চেয়েছিলাম; কিন্তু দেবতার দানবায়ন ঘটে গেছে ততদিনে! সেই কাঁটা আজীবন রক্তাক্ত করে যায়।​

বিষের মতো নীল ও শূন্যতার মতো সাদা রঙে একের পর এক জনপদ ক্লেদাক্ত করার আগে পর্যন্ত বদলা ও বদল নিয়ে বিস্তর ভাষণ দিয়েছিল একদল লোক। হাঁ করে গিলেছিল মোহগ্রস্ত জনগণেশ। বিশ্বাসও করেছিল। কিন্তু আমার মতো অনেকে করেনি। আমাদের কি স্বভাবসন্দিগ্ধ বলা হবে? আমরা করিনি, কারণ আমরা জানতাম, সাপেদের অভ্যাসে ছোবল মিশে আছে। আজ সেই সাদা-নীল ফাঁস গলায় বসে গিয়ে চেপে ধরেছে আমাদের শ্বাস। মোহগ্রস্ত জনগণেশের সম্বিত ফিরছে একটু-একটু করে। পুরোটা ফিরিয়ে আনতে হলে নিজেদের বদলে ফেলা দরকার। কিন্তু ব্যক্তিজীবন তো অত সরল পথে চলে না! তার মনোজগতের স্তরে-স্তরে কথিত-অকথিত অনেক অন্ধকার থাকে। প্রিয় শব্দ আমার কাছে চেয়েছে, কোনোদিন সে আবার বিস্মরণে গেলে সামলে থাকার আশ্বাস! এই অন্ধকার থেকে তাকে স্থায়ীভাবে বাইরে নিয়ে আসতে হলেও তো শক্ত থাকা দরকার! ঠিক যেন সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিকের কথায়, "জীবনের নানা ওঠাপড়া যেন সহজে গায়ে না-লাগে"! আমি তো প্রিয় শব্দের জন্যই নিয়ে এসেছি সুরক্ষাবলয়। ঝড়-ঝঞ্ঝার এক-একটি প্রবল বিক্ষুব্ধ আবহাওয়ার মধ্যেও দাঁড়িয়েছি কাঙ্ক্ষিত রাস্তার মোড়ে। কাছে রেখেছি ভরসার দীর্ঘমেয়াদি রেইনকোট। কেন-না আমি তো জানি,

"সিতারোঁ সে আগে জাহাঁ অউর ভি হ্যায়
আভি ইশক কে ইমতিহাঁ অউর ভি হ্যায়"।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.