তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় | অভ্যাসে বলি ভালো আছি
0
মে ০৯, ২০২২
এ তো খুব পুরনো অভ্যাস। যাদের সঙ্গে খুব ঘন ঘন দেখা সাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয়না, তাদের সঙ্গে হঠাৎ পথচলতি দেখা হয়ে গেলে খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলে উঠি, ‘ভালো তো’? তারাও উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, ভালো। আপনি’?
এটুকু আসলে সৌজন্য। স্বাভাবিক কুশল বিনিময়। এর বাইরে ভালো আছি কথাগুলোর কতটা মূল্য আছে কে জানে! ভালো আছি বলে যে পাশ কাটিয়ে চলে গেল, সেই মুহূর্তে হয়তো সে একদমই ভালো নেই। কিম্বা তার জরুরী কোনও প্রয়োজন আছে কোথাও যাওয়ার। হয়তো তার মাথায় তখন হাজারও চিন্তা। তবু তাকে মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলতে হয়, ভালো আছি। ভালো নেই বলার যে অনেক দাবি। তখন তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়না। একটু সময় নিয়ে আরও অনেক কথা বলতে হয়। কেন ভালো নেই, এমন কি হলো যে ভালো নেই সেই সব। তার চেয়ে এই ভালো।
বিপন্নতা মাথায় নিয়েও এভাবে সময় অতিবাহিত করছে যে মানুষ তার কাছে এ ছাড়া আর কিই বা বলার আছে? বিপন্নতাগুলো তো সবাইকে বলা যায়না। হয়তো বলতেও নেই। তাই এই বাধ্যবাধকতা।
অথচ সত্যিকারের ভালো থাকাই যেত। খুব ইচ্ছে করে সবাই মিলে ভালো থাকি। ভাবি, যদি ব্যবস্থাগুলো কিম্বা সামগ্রিক অবস্থাটা আর একটু গোছানো হতো! আর একটু নিয়মমাফিক। খুব কি কঠিন? একেবারে কি অসম্ভব? আমাদের চারপাশে ভালো থাকার ভালো রাখার সম্ভার তো কিছু কম নেই! বিশ্বাস, ভরসা, ভালবাসা এখনও তো শেষ হয়ে যায়নি। তবু যেন যা হওয়ার ছিল তা হচ্ছেনা। কিছু মানুষ অযথা হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। ভীষণ অসহিষ্ণু। কোন সে ক্ষমতা তাকে শেখায় হঠকারী আর ধ্বংসাত্মক হতে? এর উল্টো-পিঠেই তো সাধারণ নাগরিকের প্রাণান্তকর আতংকের জীবন। চেহারাতে চাপা অস্থিরতা। অসহায় ক্রোধ। হৃদয়ে ব্যথা। কিন্তু মুখে কুলুপ। ভদ্রতার খাতিরে তাকে বলতে হয় - ভালো আছি। শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করে তাঁর গান গেয়ে - আনন্দধারা বহিছে ভুবনে।
ঐটুকুই করতে পারি আমরা। তাও উপরে উপরে। তাঁকে অন্তরে সেভাবে গ্রহণ করলাম কই? শুধু লোক দেখানো অনুষ্ঠান করা ছাড়া।
তাঁর কথা মানিনা কেউ। আক্ষরিক অর্থেই কেউ না। না জীবনে, না মননে, না নিয়ম নীতিতে। অথচ তিনি সর্ববিধ পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন। মানতে পারলে জীবন বদলে যেত। সমাজ বদলে যেত। এমনকি প্রকৃতিও কখনও বিরূপ হতোনা। স্বাভাবিক সুখ দুঃখ হাসি কান্না নিয়ে যে জীবন যাপন, সেখানে বড় ছোট উঁচু নীচ সবাই গলা মিলিয়ে একসঙ্গে বলতে পারতাম ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’।
মাঝে মাঝে মনে হয় গলা ছেড়ে হাঁক পাড়ি। কিন্তু কে শুনবে? ছোটবেলায় জনশূন্য প্রান্তরে কিম্বা আম জামের বাগানে গিয়ে যেমন বিনা কারণেই হাঁক পাড়তাম, নির্দিষ্ট কারও উদ্দেশ্যে নয়, যে শুনবে তার উদ্দেশ্যেই, তেমনটি তো আর সম্ভব নয় এখন। ঘরের কাছে সেই উন্মুক্ত প্রান্তরও তেমন নেই কোথাও। সে বাগানও নেই। না থাকার নিয়মেই নেই। যখন ছিল, তখন রাত্রে রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ শেষ হওয়ার একটু পরেই পড়া ছেড়ে উঠে গিয়ে বলতে পারতাম, খেতে দাও, ঘুম পেয়েছে।
এখন ঘুম ছুঠে যায়। সবাইকে নিয়ে যে ভালো থাকা সেটা স্বপ্ন মনে হয়। ক্ষুদ্র হয়ে যাওয়া পরিসরে সে স্বপ্নের জায়গা হয়না। মিথ্যা আশ্বাস আর বিজ্ঞাপনের মতো একই কথা বারবার বলি। বলি ভালো আছি। জানি সারা জীবন বলে গেলেও জীবনধারা না বদলালে এই বলা সত্যি হবেনা কোনোদিনও। হতে পারে একমাত্র তবেই, যদি তাঁর কথাগুলি স্মরণে রাখি। মননে রাখি। পালনে রাখি।
Tags
সুচিন্তিত মতামত দিন