স্বপন পাল | ত্রিসন্ধ্যা ও দু’চার কথা

শব্দের মিছিল

ত্রিসন্ধ্যা শব্দটি অনেকেই শুনেছেন, অনেকেই এর অর্থ জানেন। কিছু জায়গায় দেখতে পেলাম অর্থের হেরফের। কেউ আবার জানিয়েছেন ত্রিসন্ধ্যা ভুল। ওটি দ্বি-সন্ধ্যা হবে তাঁর বিবেচনায়। তিনি আবার বেদ টেনেছেন এই প্রসঙ্গে, টানতেই পারেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাঁর কেনইবা থাকবেনা ?

ব্রাহ্মণ পরিবারের পুরুষ যাঁর উপনয়ন (পৈতা) হয়ে গেছে তাঁকে ত্রিসন্ধ্যা জপ করার বিধান দেওয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে বেশিরভাগ ব্রাহ্মণ-পুরুষ তা করে উঠতে পারেননা নানা কারণে। প্রথমত, বেদোক্ত সমাজ বিভাজন এখন নেই। ব্রাহ্মণ তাঁর কাজকর্ম, জীবিকা নির্বাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেদ অনুসরণ করতে পারেন না। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তাঁকে অনেক প্রাচীনতা ত্যাগ করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অনেক পরিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে উপনয়নের অনুষ্ঠান করেন বটে তবে তা তাঁদের জীবনে জন্মগত সূত্রে পাওয়া একটি শুভ অনুষ্ঠান মাত্র হয়ে রয়ে গিয়েছে। অন্নপ্রাশন, বিবাহ ইত্যাদির মতো অনুষ্ঠেয় একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের উৎসব অনুষ্ঠান মাত্র। জীবন যাপনের গোলকধাঁধায় ও নিয়ে ভাবনার অবকাশ নেই বললেই চলে।

তদুপরি ব্যতিক্রম যেমন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে, তেমনই কোন কোন ব্রাহ্মণ একালেও নিষ্ঠার সঙ্গে ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক ও গায়ত্রী মন্ত্রপাঠ করে থাকেন। আহ্নিক অর্থ প্রাত্যহিক, দৈনিক বা নিত্যকর্ম যা প্রতিদিন নিয়ম মতো করা হয়ে থাকে। আবার অহ্ন অর্থ দিবাভাগটিকে সমান তিনভাগে ভাগ করে তার এক এক ভাগ। ভোর থেকে প্রথম চার ঘণ্টা পূর্বাহ্ন ও সেই মতো মধ্যাহ্ন এবং অপরাহ্ন। সায়াহ্ন হলো সন্ধ্যাকাল। পঠিত গায়ত্রী মন্ত্রটি অনেকেই জানেন।

ওঁ ভূর্ভুবস্ব

তৎসবিতুর্বরেণ্যং

ভর্গোদেবস্য ধীমহি

ধীয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ ।।

এখানে, ওঁ অর্থ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা ব্রহ্ম বা পরব্রহ্ম। যা থেকে বস্তুজগতের সৃষ্টি, ভূ অর্থ পৃথিবী, ভুবঃ অর্থ আকাশ, স্ব অর্থ স্বর্গ, তৎ অর্থ চূড়ান্ত সত্য, সবিতু অর্থ সব কিছুর উৎস, বরেণ্যম অর্থ বরণ করি অর্থাৎ ভক্তি সহকারে প্রণাম করি, ভর্গো অর্থ অধ্যাত্মশক্তি, দেবস্য অর্থ দৈবসত্তা, ধীমহি অর্থ ধ্যান করি, ধীয়ো অর্থ ধীশক্তি বা বুদ্ধির উৎকর্ষতা, য়ো অর্থ –কে, নঃ অর্থ আমাদের, প্রচোদয়াৎ অর্থ আলোকিত করা এখানে জ্ঞানালোকে পূর্ণ করা।

পূজার মতো বিবিধ তথাকথিত হিন্দু আচার অনুষ্ঠানে সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ বা উচ্চারণ করা হয়ে থাকে। মন্ত্র শব্দটি এসেছে মনকে ত্রাণ করা থেকে। বিভিন্ন ধরণের শব্দ যা বিশেষ বিশেষ কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সিতে উচ্চারণ করলে বা বাদ্যযন্ত্রে বাজালে জীবদেহে এক এক রকম প্রতিক্রিয়া হয়, এটা পরীক্ষিত সত্য। শুদ্ধ স্বর ও সুরে মন্ত্রোচ্চারণের ক্ষমতা আছে মনকে প্রভাবিত করার। আর শরীরের অনেক সমস্যা ও অসুস্থতা মনকে প্রভাবিত করে সারিয়ে তোলা যায়, প্রাচীনকালের মনীষি থেকে আধুনিক বিজ্ঞানী ও ডাক্তার একথা একবাক্যে স্বীকার করেন। গায়ত্রীমন্ত্র এরকম একটি অতিপ্রভাবশালী মন্ত্র। এবার জানা যাক দিনে কয়বার এই গায়ত্রীমন্ত্র উচ্চারণ বা গাওয়া উচিত। কোথাও পাচ্ছি গায়ন্তম ত্রিয়তে ইতি গায়ত্রী। তিন সাড়েতিন হাজার বৎসর পূর্বে প্রথম-বেদ ঋগ্বেদে মন্ত্রটিকে পাওয়া যায়। তখন সংস্কৃত ভাষার উদ্ভব হয়নি। কারণ পাণিনি তার বহু পরে জন্মেছেন ও তাঁর রচিত ব্যকরণবিধি মেনে সংস্কার হয়ে আদি ভাষাটির নাম হয় সংস্কৃত। ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি উচ্চারিত হতো যে ভাষায় তাকে আমরা পরবর্তীকালে নাম দিয়েছি ছান্দস। তখন মুখে মুখে কবিতার মতো, গানের মতো একজন থেকে অন্যজনে মন্ত্রগুলি সচল থাকতো। গুরুর মুখ থেকে শিষ্যে আবার শিষ্য বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে গুরু হলে তার শিষ্যদের মধ্যে মন্ত্রজ্ঞান গায়নের মাধ্যমে সঞ্চারিত হতো। শুনে শুনে বেদের মানবসমাজে বিস্তার তাই এর আদিনাম শ্রুতি। সেই আদিকালে মানুষের জীবনচর্চা বর্তমান থেকে বহুলাংশে পৃথক ছিল। তখন পৌত্তলিকতা ছিলনা। প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে বিভিন্নভাবে শ্রদ্ধা জানানো হতো। সেই শক্তিগুলি জীবন ধারণে সহায়ক একথা মানুষ বুঝতো ও সেই কারণে তাকে নানা অর্ঘ প্রদান করে ও তার গুণকীর্তণ করে তুষ্ট রাখার কথা ভাবতো।

গায়ত্রীমন্ত্র একটি দিবসে তিনবার পাঠের নির্দেশ আছে। একেই ত্রিসন্ধ্যা করা বলে। তবে সন্ধ্যা শব্দটি যুক্ত থাকায় আগে সন্ধ্যা বা সন্ধিক্ষণের বিষয়টি পরিস্কার হওয়া দরকার। দিন ও রাতের দু’টি সন্ধিক্ষণ স্পষ্ট। ভোর বা ঊষাকালে রাত্রি সরে গিয়ে দিবসের আলো আসতে চলেছে এটি একটি সন্ধিক্ষণ। সন্ধ্যাকালে দিবসের আলো নিভে রাত্রি আসছে এও আর এক সন্ধিক্ষণ। কিন্তু আর একটি সন্ধিক্ষণ দিনের আলোতেই রয়ে যায়। অষ্টপ্রহর হলো একটি দিনরাত্রির সমন্বয়। ২৪ ঘণ্টাকে আটভাগ করলে প্রতি ভাগ হয় ৩ ঘণ্টার। দিনেরবেলা চার প্রহর ও রাত্রি চার প্রহরের। দিনের দ্বিতীয় প্রহর শেষে যখন তৃতীয় প্রহর আসতে চলেছে তখন আর একটি সন্ধিক্ষণ তৈরি হয়। গায়ত্রী মন্ত্র রাত্রিকালের জন্য নয়। এটি দিনের শুরু, মধ্যাহ্ন ও সূর্যাস্তর পরপর গাইবার মন্ত্র। আসলে ওই সন্ধিক্ষণগুলোয় প্রতিটি জীবদেহে রসের তারতম্য ঘটে। হরমোনের ও এনজাইমের হেরফের হয়। মেটাবোলিক সিস্টেমে বা শারীরবৃত্তীয় কাজে রকমফের ঘটে। এইসব সময়ে শব্দের নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক মনে ও শরীরে বিশেষ ধরণের ভাল প্রতিক্রিয়া প্রদান করে। গায়ত্রীমন্ত্রকে যে কারণে সুস্থতার প্রতীক ধরা হয়। আর একটি বিষয় ত্রিসন্ধ্যার কারণে উল্লেখনীয়। সূর্যর স্ত্রীর নাম সঞ্জনা, যিনি ছিলেন বিশ্বকর্মার কন্যা। সঞ্জনার অপর নাম সন্ধ্যা। সন্ধ্যা বিবাহের পর তাঁর স্বামী সূর্যর প্রখর তেজ সহ্য করতে না পেরে নিজের ক্লোন বা প্রতিমূর্তি তৈরি করে ফিরে যান বাপের বাড়ি। পরে বিশ্বকর্মার মধ্যস্থতায় সূর্য তাঁর প্রখরতা কিছুটা কমালে সঞ্জনা বা সন্ধ্যা সূর্যর কাছে ফিরে আসেন ও ছায়াকে বিলুপ্ত করেন। তবে ইতিমধ্যে ছায়ার পুত্র শনির জন্ম ঘটে গিয়েছে। সন্ধ্যার পরবর্তীকালে যম ও যমী বা যমুনা নামে দুই সন্তান হয়, সে আর এক কাহিনী। এখন সন্ধ্যা সূর্যের সেবায় খুবই তৎপর। পতিপ্রাণা তিনি। প্রভাতে স্বামীর নিদ্রাভঙ্গ, দ্বিপ্রহরে তাঁর আহারাদি সেবা ও সায়াহ্নে তাঁর পুনরায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করে পত্নির পরম কর্তব্য পালন করেন। তাঁর এই পতিসেবা সূর্যকে তৃপ্ত করে। তৃপ্ত সূর্য জগতকে করুণা করেন। ত্রিসন্ধ্যার দ্বারা সন্ধ্যাদেবীর সাথে সাথে মানবগণ সূর্য তথা প্রত্যক্ষ পালনকর্তাকে স্মরণ ও তুষ্টকরায় ব্রতী হয়ে থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.