পর্ব- ৫
আষাঢ়ী পূর্ণিমার উৎসব শেষে রানি মায়াদেবী ঘুমিযে পড়লেন। পূর্ণচন্দ্রের বিভায় উদ্ভাসিত রজনী। স্বপ্নে রানি দেখলেন চারদিক থেকে চার দিকপাল দেবতা এসে সোনার পালঙ্কে শায়িত করে তাঁকে তুলে নিয়ে গেলেন হিমালয় পর্বতের মানস-সরোবরে। স্বর্গের দেবীরা তাঁকে স্নান করিয়ে সুবাসিত দিব্যবস্ত্রে ভূষিত করলেন। স্বর্ণ-পালঙ্কে শুয়ে রানি দেখলেন, পাশের সুবর্ণ-পর্বত থেকে এক বিপুলাকার শ্বেতহস্তী নেমে আসছে, শুঁড়ে তার একটি শুভ্র উজ্জ্বল পদ্ম। রানির পালঙ্কের চারপাশে তিনবার প্রদক্ষিণ করে সেই শ্বেতহস্তী রানির জঠরের দক্ষিণ ভাগ থেকে শ্বেতপদ্মটি প্রবেশ করিয়ে দিল। অলৌকিক আনন্দে শিহরিত হলেন রানি। নিদ্রাবেশ ভঙ্গ হল। আকাশে আষাঢ়ী পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদ যেন তাঁর অলৌকিক স্বপ্নের সাক্ষী। নিশিপ্রভাতে স্বপ্ন-বৃত্তান্ত বললেন মহারাজ শুদ্ধোদনকে, তিনি জানালেন রাজ-জ্যোতিষীকে। রাজজ্যোতিষী গণনা করে জানালেন, এ অতি সুলক্ষণ। রানীমা শীঘ্রই এক মহাপুরুষের জন্ম দিতে চলেছেন।
না, এ গল্প তো মারিয়মের নয়। তবে ‘ধান ভাঙতে শিবের গীত’ কেন? এর কারণ আছে। নাজারেথের চাষী-পরিবারের দরিদ্র কন্যা মারিয়মের গর্ভসঞ্চারের সঙ্গে সুদূর প্রাচ্যের কপিলাবাস্তু নগরীর রানী মায়াদেবীর এই স্বপ্ন ও গর্ভসঞ্চারের ঘটনা যেন মহাকাল এক সুতোয় বেঁধে রেখেছেন। শুধু কি তাই? পল্লীবাংলার এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পূজারির স্ত্রীও মন্দিরে গিয়ে মূর্ছিতা হন এক দিব্য জ্যোতির আবেশে। ইতিহাস-অখ্যাত এক গ্রাম্য মন্দিরের কালো শিবলিঙ্গ থেকে নির্গত সেই জ্যোতি তাঁকে সম্পূর্ণ ছেয়ে ফেলে, আচ্ছন্ন করে সরলা রমণীর সমগ্র চেতনা, জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সখীর শুশ্রূষায় চেতনা ফিরে পেয়ে বলেন, “ঐ শিবলিঙ্গ থেকে আলো ঠিকরে আমার পেটের মধ্যে ঢুকেছে, আমার গর্ভ ভীষণ ভারী বোধ হচ্ছে, যেন পেটে বাচ্চা এসেছে!” বয়স্কা সখী তার সমবয়সিনী প্রোষিতভর্তৃকা সরলা সখীর গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলেন, “মর মাগী! এই বুড়ো বয়সে বাচ্চা বিয়োবি কি রে! তাও আমাদের জামাইবাবু রয়েছেন তীর্থে! এ-কথা আবার বলিসনি যেন কাউকে! তোর তো পেটে কথা থাকে না!” তারপর থেকেই ঘটতে লাগলো কত অলৌকিক ঘটনা। চন্দ্রমণি জাগ্রত অবস্থায় পুরাণবর্ণীত দেবদেবীর প্রত্যক্ষ দর্শন পেতে আরম্ভ করলেন। গয়াধাম থেকে প্রত্যাগত স্বামীকে বললেন সমস্ত কথা। শিহরিত হলেন ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়। ঈশ্বর স্বয়ং যে তাঁকেও স্বপ্নে দর্শন দিয়েছেন! ক্ষুদিরামের গৃহে, চন্দ্রমণির গর্ভে সন্তান হয়ে জন্ম নেওয়ার আকুতি স্পষ্ট জানিয়েছেন তাঁকে। দরিদ্র ক্ষুদিরামের সকল ওজর-আপত্তি নস্যাৎ করে তাঁর দেওয়া যৎসামান্য খুদকুঁড়োতেই সন্তুষ্ট হবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন! শুদ্ধস্বভাবা স্ত্রীর প্রতিটি কথা পরম বিশ্বাসে গ্রহণ করতে তাঁর আর দ্বিধা রইল না। নিষ্কলঙ্ক চন্দ্রমণিকে আশ্বস্ত করে বললেন, “আমিও স্বপন দেখেছি। এবার ভগবান আসবেন তোমার গর্ভে। এমন অনেক দর্শন পাবে। তবে সেসমস্ত আমাকে ছাড়া আর কাকেও বোলো না, কেমন?” গ্রামে গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। এর হাঁড়ির খবর থাকে তার কাছে। অধিক বয়সে সন্তানসম্ভবা চন্দ্রমণির উপর দেবতার আবেশ হয়েছে, একথা পাড়াপ্রতিবেশীরা কোনও একভাবে জেনে গেল এবং জাত পুত্র গদাই-এর শৈশব থেকেই প্রকাশিত নানা ব্যাখ্যাতীত কাণ্ডকারখানা তাই তাদের অনেককেই বিন্দুমাত্র আশ্চর্য করেনি।
এমনই হয় ও হয়ে আসছে যুগ-যুগান্ত ধরে। ব্যাখ্যা মেলে না, তবু মেলানোর চেষ্টা চলে। কেউ বিশ্বাসে ডুব দেয়, কেউ বা অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে দোলে। একবার নয়, দুবার নয়, বারম্বার এমন করেই মহামানবরা আসেন, পিতার শোণিত-শুক্র ধার করেন কি না—সে প্রশ্ন থাকে অমীমাংসিত, কিন্তু মাতৃজঠরের ঋণ তাঁরা সকলেই স্বীকার করেন।
মায়ার গর্ভে এসেছিলেন বুদ্ধ, মেরির গর্ভে যিশু। আরও অনেক পরে শচীর গর্ভে এলেন চৈতন্য, তারও পরে জগৎ পেল রামকৃষ্ণকে। বুদ্ধ, যিশু, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ সকলের ক্ষেত্রেই একটি কথা প্রযোজ্য—যে কথা গীতামুখে বললেন শ্রীকৃষ্ণ, “জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্।” হিমবাহের কোটর থেকে নদী যেমন আছড়ে পড়ে, লোকে লোকে মিটায় তৃষ্ণা, মাটিকে দেয় উর্বরতা, সেভাবেই দেবভূমি থেকে ঈশ্বরের অবতরণ ‘চোদ্দ পোয়া’ মানবদেহে। জন্মরহিত, অব্যয় ও সর্বভূতের অধিষ্ঠান হয়েও আপন ত্রিগুণাত্মিকা মায়া অবলম্বন করে তিনি আবির্ভূত হন—
“অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন।
প্রকৃতিং স্বামাধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।”১
অর্থাৎ, “যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।”
তাই তাঁর জন্ম, কর্ম সবই অলৌকিক, যে-জন বোঝে সেই অবতারতত্ত্বের মর্ম, তাঁর আর ঘুরতে হয় না জন্মমৃত্যু চক্রে—ভবের হাটে তাঁর আসা-যাওয়া ফুরায়।
“জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম এবম্ যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
ত্যত্ত্বা দেহম্ পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সঃ অর্জুন।।”২
ঈশ্বরতনয় শিশু-যিশুকে বুকে ধরে মেরীমাতা আমাদের দিকে চেয়ে আছেন, পবিত্র ও সুন্দর এই মূর্তি খ্রিস্টবিশ্বাসীদের ধারণায় মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের প্রতীক, "Sign of God"
মা যশোদার কোলে বাল-গোপাল, শচীর কোলে নিমাই, ঠিক ততটাই সুন্দর, যেমনটি মেরীর কোলে শিশু-যিশু! সন্তান বুকে আগলে জননী--পৃথিবীর সর্বত্র জাতিধর্ম-নির্বিশেষে মধুরতম এক ছবি। নিঃসন্দেহে তাকে ঈশ্বরের প্রতীক বলা যেতে পারে। মাতৃস্নেহের সেই কমনীয় ছবি, এমনকি ইতর জীবজন্তুর মধ্যেও যখনই প্রকাশ পায়, তা ঈশ্বরপ্রেমের সমতুল্য। সেই মুহূর্তে সেখানেই ঈশ্বর প্রকাশিত হয়েছেন বুঝতে হবে। সেই স্থানে দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ ঈশ্বরের আরাধনা করা যেতে পারে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন একথা। খ্রিস্টসাধক বলেন, মেরী-পুত্র যিশু, সেই অর্থে, পূর্ণ ঈশ্বর হয়েও এক পূর্ণ মানবসন্তান।
খ্রিস্টধর্মে পাপের ধারণা আসে দুভাবে—প্রথম আদি পাপ, যা থেকে কোন জীবই মুক্ত নয়, তা হল পিতা-মাতার কামজ মিলনের ফলে জন্ম। এটি জন্মগত পাপ—‘সিন বাই বার্থ’। এরপর জীবৎকালে কৃত অন্যান্য পাপ। মানবের পরিত্রাতা যিশু যেহেতু ঈশ্বরতনয়, তিনি এসেছেন মানুষকে পাপ থেকে পরিত্রাণ করতে, তাই তিনি সম্পূর্ণ নিষ্পাপ, অনঘ। তাই তাঁর জন্মও হতে হবে এক পবিত্র নিষ্কলঙ্ক আধার অবলম্বনে। তাই কুমারী মেরী। অক্ষতযোনি মেরী। জীববিজ্ঞান বলে, নারী ও পুরুষের অর্ধেক সংখ্যক ক্রোমোজোমের মিলনে সৃষ্টি হয় ২-এন সংখ্যক ক্রোমোজোম বিশিষ্ট জাইগোট—প্রাণের প্রথম মুকুল। তারপর কোষ বিভাজিত হতে হতে পূর্ণাবয়ব মানব শিশু। অথচ দেবমানবের জন্মের ইতিহাসে সব হিসেব কেন মেলে না, সৃষ্টির বহু রহস্যের মত তারও উত্তর নেই।
যিশুর ঈশ্বরত্ব ও মেরীর কুমারীত্ব একই সূত্রে গাঁথা। ‘হোলি মেরী’, তথা ‘ভার্জিন মেরী’ ধারণা আজ খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাসের এক স্তম্ভস্বরূপ। তবুও এই কুমারীত্ব নিয়ে ২০০০ বছর ধরে চলছে তর্কযুদ্ধ। যিনি ‘থিওটোকোস’, অর্থাৎ ভগবানের মা, ঈশ্বরকে গর্ভে ধারণ করেছেন, কেউ কেউ বলেন, তাঁতে পাপের লেশমাত্র থাকতে পারে না। অতএব মেরী আজন্ম কুমারী, আদিপাপ থেকেও তিনি মুক্ত। অতএব মেরীর নিজের জন্মও কুমারী মাতার মাধ্যমে। আরেক মতে, মেরী আদি পাপ থেকে মুক্ত ছিলেন না, কিন্তু ঈশ্বরতনয়কে গর্ভে ধারণ করবার জন্য যে মুহূর্তে ঈশ্বরকর্তৃক তিনি চিহ্নিত হয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই স্বয়ং ঈশ্বরের কৃপায় তিনি সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়েছেন। ঈশ্বরকে জন্ম দেওয়ার পরেও তিনি দৈবকৃপায় আজীবন রয়ে গেলেন অক্ষতযোনি। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা যিশুর পালক-পিতা যোসেফের যে ছবি আঁকলেন, তাতে যিশুর জন্মকালে যোসেফ অশীতিপর বৃদ্ধ, অতএব যৌনমিলনের ক্ষমতাহীন, এবং যিশুর শৈশবেই তাঁর মৃত্যু হয়। এইভাবে কুমারী মেরীর গর্ভ কেবল ঈশ্বরতনয়ের জন্মদানের জন্য দৈবনির্দিষ্ট দেখানো হয়। এই তথ্যকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবার জন্য যোসেফের আরও চার পুত্র ও দুই কন্যা, গসপেল-এ যিশুর ভাইবোনের যে উল্লেখ আছে, তাদের যোসেফের মৃতা প্রাক্তন স্ত্রী মেলচা-র (মতান্তরে এসচা বা সালোম) গর্ভজাত ও যিশুর সৎ ভাই বলে দাবি করা হয়। প্রাক খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ববেত্তাদের মধ্যে হিপোলিটাস, এপিফেনিয়াস (৩য় শতক) এই মতের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। আবার কারো কারো মতে, জেমস, জোসেজ, সিমিয়ন ও জুডা চারভাই ও দুই বোন যিশুর সৎ ভাইবোন নয়, তাঁর খুড়তুতো ভাইবোন। যোসেফের ভাই ক্লোপাস ও তাঁর স্ত্রী মেরীর সন্তান তারা, এই মেরী সম্পর্কে কুমারী মেরীর জা হন, অর্থাৎ যিশুর কাকিমা। কারো মতে এই মেরী যিশুর মাসি, কুমারী মেরীর বোন তিনি। তবে যিশুর জীবনের অন্তিম পর্বে, ক্রুশের পদপ্রান্তে মেরীমাতার সঙ্গে যিশুর প্রিয় যে কয়েকজন অনুগামী উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের অন্যতমা হিসেবে ‘মেরী অব ক্লোপাস’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী কালের খ্রিস্ট গবেষকরা প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন যে, যদিও যিশু যোসেফের ঔরসজাত সন্তান নয়, কিন্তু মেরী ও যোসেফের পরে অন্যান্য সন্তান হয়েছিল, যিশুর ভাইবোনের উল্লেখ পাওয়া যায় ম্যাথিউ ও লুক-এর গসপেল-এ। এরপর আরেকদল ইতিহাস-গবেষক ‘কুমারী’ তত্ত্বে আঘাত না করেই উদার ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে যিশুর আবির্ভাব ও তাঁর সময়কালকে বিশ্লেষণ করেন, যাঁদের মতে মানবিক বিকাশের পূর্ণ প্রকাশ হলেন যিশু, তিনি ঈশ্বরীয় চেতনায় পরিপূর্ণ রূপে নিস্নাত এক মানব সন্তান—‘গড-ম্যান’, দেবমানব। তাঁর জন্মের রহস্যের থেকে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বিপন্ন মানবাত্মার মুক্তির জন্য তাঁর প্রাণপণ আকুতি। অর্থহীন কুসংস্কার ও লোকদেখানো ধর্মাচরণের পরিবর্তে অকপটতা, নিঃস্বার্থপরতা ও নীতিপরায়ণ জীবনযাপনের মাধ্যমে ইহকালে সুখ ও পরকালে স্বর্গবাসের আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন তিনি মানুষকে। এই শ্রেণিভুক্ত ঐতিহাসিকদের মতে, যোসেফ যিশুর জন্মদাতা পিতা না হলেও যে সাহসিকতার সঙ্গে তিনি সমাজের চোখরাঙ্গানির পরোয়া না করে কুমারী মেরীকে তাঁর গর্ভস্থ সন্তানসহ আশ্রয় ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, তা প্রশংসনীয়। তাই পরবর্তীকালে পুরনো ক্যাথলিক চার্চের প্রচারিত শিশু-যিশুকে কোলে নিয়ে বৃদ্ধ যোসেফের চিত্রের পরিপন্থী এক যুবক, শক্তিশালী ও উদারমনা ‘গুড যোসেফ’ ভাবমূর্তি তৈরি হল। কিন্তু যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন, সমস্ত মতবিরোধের ঊর্ধ্বে ‘মেরী মাতা’ স্বয়ং এক অনন্য ঈশ্বর-তত্ত্ব রূপে প্রতিষ্ঠিত। ‘মারিয়ান কাল্ট’ বা ‘মারিওলজি’ অর্থাৎ ঈশ্বর-জননীর উপাসনা বিশ্বের সর্বত্র খ্রিস্টপ্রণতির অনন্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটেল-এ রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও অ্যাংলিকান কমিউনিয়ন চার্চ-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক খ্রিস্টীয় অধিবেশনে আলোচনার মাধ্যমে নেওয়া সিদ্ধান্তের সার হল—“কয়েকটি ক্ষেত্রে মতবিরোধ সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে যে, ঈশ্বরের আদেশ ও কৃপার মুখাপেক্ষী হয়ে প্রতীক্ষা করাই এক খ্রিস্ট সাধকের জীবনের প্রধান লক্ষ্য যা পবিত্র মেরীমাতার জীবনে পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়েছে, অতএব পবিত্র মেরী মাতার উপাসনা আমাদের উভয় খ্রিস্টীয় ধারার অভিন্ন উত্তরাধিকার। আমাদের প্রভু যিশুখ্রিস্টের মাতা আমাদের সম্মুখে আনুগত্য ও আজ্ঞাবাহীতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ রূপে উপস্থিত, যিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন প্রভুর উদ্দেশ্যসাধনের যন্ত্র রূপে, বলেছিলেন, ‘Be it to me according to your word’, অর্থাৎ “তোমার ইচ্ছা কর হে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে!” যা আমাদের প্রত্যেকের ব্রত, ব্যক্তিগত দিক থেকে এবং সঙ্ঘের দিক থেকেও। কারণ সঙ্ঘই খ্রিস্টের দেহ। দুই বাহু প্রসারিত করে যখন মেরী প্রভুর গুণগান করছেন, যেন ঐশী কৃপা বিতরণ করছেন—সেই মুহূর্তে আমরাও মেরীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি। লুক-এর গসপেল-এ ঈশ্বরের মহিমা গান গেয়ে মেরী যে বলেছেন, ‘from this day all generations will call me blessed,’ তা সত্যই বটে। আমাদের চার্চের দুটি ধারা মেরীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকগুলি ‘ফিস্ট’ সাধারণ ভাবে পালন করে থাকে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, উপাসনার ক্ষেত্রে আমাদের গভীরতম একাত্মতার অনুভব মেরীর প্রতি সপ্রেম কৃতজ্ঞতায়—যিনি আমাদের জন্য ঈশ্বরকে গর্ভে ধারণ করেছেন, আরেক অর্থে প্রেমে ও প্রার্থনায় গড়ে ওঠা এই সুবিশাল সঙ্ঘরূপ খ্রিস্টের দেহ, যাকে আমরা বলি সন্তহৃদয় মিলনভূমি, তাতেও আমাদের সঙ্গে মেরীর ঐকাত্ম্য।”৩
তৎকালীন রোমের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পিতার নামেই সন্তানের পরিচয় দেওয়া প্রচলিত ছিল। তা সত্ত্বেও যিশু একান্ত ভাবেই ‘সন অব মেরী’ নামে নিজ জন্মস্থানে পরিচিত হয়েছিলেন। অন্যদিকে তাঁর অন্য ভাইরা ‘সন অব যোসেফ’ নামে গসপেল-এ উল্লেখিত। আমাদের কাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল যিশুর আদেশপ্রাপ্ত ধর্মপ্রচারক পল-কে নিয়ে। এক অলৌকিক দিব্য দর্শনের মাধ্যমেই ঘটে যায় পলের মানস রূপান্তর। খ্রিস্ট তথা সকল ধর্মের সাধকদের জীবনে এমন দিব্য দর্শন ও দিব্য উপলব্ধির নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। ঘোর খ্রিস্ট-বিরোধী পল খ্রিস্টীয় ভাবধারায় রঞ্জিত হলেন, স্বীকার করলেন যিশুর ঐশী ক্ষমতা ও আনুগত্য। মেরীর মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল না। এক গ্রাম্য সরলা বালিকা মেরীকে প্রভু বেছে নিলেন নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম রূপে এবং ঈশদূতের মুখে সেকথা শুনে বিহ্বল মেরী বলেছিলেন, ‘Be it to me according to your word’, অর্থাৎ “তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক আমার মধ্যে দিয়ে, তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র!” যদিও মেরীর দেহে দিব্য আবেশ ও যিশুর অলৌকিক জন্মবৃত্তান্তের কথা জন ও মার্ক-এর গসপেল-এ নেই। কেবল ম্যাথিউ ও লুক এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। গসপেল সঙ্কলকদের মধ্যে লুক কনিষ্ঠতম ও আধুনিকতম। যদিও তাঁর অগ্রজ প্রচারক পল-এর মতই, তিনিও যিশুকে ‘ইন ফ্লেশ’, অর্থাৎ রক্ত-মাংসের শরীরে দেখেননি, কিন্তু তিনি ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ধরতে চেয়েছেন তাঁর লেখনী, সর্বোপরি, একমাত্র তাঁর গসপেল-এ যিশু সম্পূর্ণ মানবসন্তান, ‘সন অব গড’-এর থেকে বেশী করে ‘সন অব ম্যান’, এবং লুক-এর গসপেলের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয়টি হল মেরীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার ও খোদ মায়ের মুখ থেকে ছেলের কথা শোনার সৌভাগ্য, যেকথা গসপেলের আরম্ভেই লুক বলেন (যাঁরা প্রথম থেকে প্রভুর সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন, তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী, তাঁদের কাছে রক্ষিত প্রভুর বাণী ও জীবন, সরাসরি তাঁদেরই মুখে শুনে পারম্পর্য রক্ষা করে আমি লিখেছি এবং তুলে দিচ্ছি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে৪), এবং এটাই সর্বকালের ঐতিহাসিকদের কাছে লুক-গসপেল-এর জনপ্রিয়তার কারণ।
লুক-এর গসপেলে মেরী গুরুত্ব পেয়েছেন। জন মেরীকে কেবল ‘এক ইহুদী নারী’ পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কেবল লুক-এর গসপেল থেকেই আমরা মেরীর জীবনের অনালোকিত অনেকটা অংশের উন্মোচন দেখতে পাই। লুক-এর আচার্য তুল্য পল-এর জীবনেও যে দিব্য আবেশের ঘটনা পল-কে বিবশ করে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, মেরীর জীবনও সেভাবেই ঈশ্বরেচ্ছায় সমর্পিত হয়ে যায়। এই সাদৃশ্য দেখবার তাগিদেই যে কেবল পল-এর গল্প থেকে মেরীর কাহিনীতে ঢুকে পড়া, তা তো নয়। প্রতি পলে সব ঘটনা এক অদৃশ্য ডোরে গ্রথিত। যেন একটির পর একটি পাপড়ি মেলা আর সম্পূর্ণ ফুলটি ফুটে ওঠা। একটি ঘটনার সঙ্গে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। সুতোর খেই ধরে ধরে যত পথই পরিক্রমা করি না কেন, গসপেল-সঙ্কলক জন, মার্ক, ম্যাথিউ, কিম্বা লুক—প্রত্যেকেই ছুঁতে চেয়েছেন প্রভুর জীবন-রূপ আলোকবর্তিকা।
(ক্রমশ) চতুর্থ পর্বটি পড়ুন
তথ্যসূচী
(১) গীতা> ৪/৬
(২) গীতা- ৪/৯
(৩) Seattle, Feast of the Presentation, February 2, 2004
(৪) Gospel of Luke, Prologue-1
সুচিন্তিত মতামত দিন