শ্রীশুভ্র | রুচির বিকার

শব্দের মিছিল

রুচির কোন নির্দিষ্ট সঙ্গা হয় কি? সঙ্গা নিশ্চয় হয়। তবে তা এক এক কালে এক এক অঞ্চলে এক এক গোষ্ঠীর ভিতর এক এক রকমেরও হতে পারে। এর একটা কারণ রয়েছে। রুচি কোন নিশ্চল অটল বিষয় নয়। স্থান কাল এমন কি জলবায়ু ভেদে রুচি পরিবর্তনশীল। রুচি ব্যক্তি বিশেষের শিক্ষা দীক্ষা নীতি নৈতিকতার উপরেও বিশেষ করে নির্ভরশীল। এমন কি বয়স ও অভিজ্ঞতার উপরেও রুচির গতি প্রকৃতি নির্ভরশীল। ফলে এক এক কালে এক একটি অঞ্চলে এক একজনের কাছে রুচির সঙ্গাও এক এক রকমের হতেই পারে। এবং সেক্ষেত্রে রুচির নির্দিষ্ট কোন মানদণ্ড থাকারও কথা নয়। থাকেও না। ফলে আমরা কখনোই রুচির মানদণ্ডে কারুর বিচার করতে পারি না। কিন্তু সেই রুচির উপরে নির্ভর করেই আমরা কাউকে কাছে টানতে পারি। কাউকে দূরে ঠেলে দিতে পারি। এটা আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের বিষয়। এক এক সময়ে এক এক অঞ্চলের অধিকাংশের ভিতর রুচির যে সামঞ্জস্য তৈরী হয়ে ওঠে, তাকে আমরা জনরুচি বলতে পারি। এই জনরুচি একটি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনরুচি অবশ্য গড়ে ওঠে জনশিক্ষার গতিপ্রকৃতির উপরে। জনশিক্ষার মান যখন যে অঞ্চলে যেরকম, জনরুচির মানও তার অনুরূপ হয়ে দেখা দেয়। সেটাই স্বাভাবিক। আবার বর্তমানের বিশ্বায়নের যুগে গণমাধ্যমগুলির ভিতর দিয়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলির দিকনির্দেশনায় জনরুচির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণও করা সম্ভব। ফলে রুচি বিষয়টি অনেকগুলি শর্তের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তার নিজস্ব কোন সুনির্দিষ্ট ভিত নাই। সেটা ভালো না খারাপ, সে কথা ভিন্ন। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, রুচি সদাই পরিবর্তনশীল।

এখন জনরুচির উপর ভিত্তি করে সমাজ সংসারের একটা সুস্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে। আবার সেই সমাজের মূলগত প্রকৃতিই কিন্ত এই জনরুচি তৈরীতে তলায় তলায় কাজ করতে থাকে। ফলে জনরুচি ও সমাজ অনেকটাই একে অন্যের পরিপূরক। একটি শিক্ষিত ও উন্নত সমাজের রুচি আর একটি অনুন্নত অশিক্ষিত সমাজের জনরুচি অভিন্ন হতে পারে না। গরুর দুধে জল মিশিয়ে ব্যবসা করার রুচি যে সমাজের ভিত, সেই সমাজ কখনোই মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করতে সক্ষম নয়। আবার যে সমাজ নিরন্তর মানবসম্পদ উন্নয়নে ক্রিয়াশীল, সেই সমাজের জনরুচি কখনোই গরুর দুধে জল মিশিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না। এমনটাই হয়ে থাকে। পরীক্ষায় পাশ করানোই যে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল অভিমুখ, সেই ব্যবস্থায় পড়া মুখস্থ করার জনরুচিই শিক্ষার মানদণ্ড ঠিক করে দেবে। এটাই স্বাভাবিক। আবার সেই পড়া মুখস্থের জনরুচির কারণেই ঠিকমত পড়া মুখস্থ না হলেই পরীক্ষার খাতায় গণটোকাটুকির ঐতিহ্য গড়ে ওঠার জনরুচিও অতি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু শিক্ষার অভিমুখ যেখানে মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটানো, সেখানে কোনভাবেই পড়া মুখস্থের জনরুচি গড়ে উঠবে না। ওঠে না।

অনেকেই রসিকতা করে বলতে পারেন, গরুর দুধে জল মেশানোর জনরুচি তো বহু পুরানো। সাম্প্রতিক জনরুচি তো গরুর দুধে সোনা থাকায় বিশ্বাসী হয়ে জনসভায় ভিড় বাড়ানো। এইখানেই রাজনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের বিশেষ ভুমিকা। যে সকল রাজনৈতিক নেতা যত বেশি অকথা কুকথা বলতে পারবেন, জনসমর্থনের জনরুচি তাদের অভিমুখেই চালিত হতে থাকবে। মিডিয়ার কৃতিত্ব তো সেখানেই। নির্বাচনের প্রক্কালে যে যত বেশি মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ঢেউ তুলতে সক্ষম হবে, সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠার জনরুচি ততই জনসমর্থন বাড়িয়ে তুলবে। এটাই এই সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট।

বর্তমানে জনরুচির অভিমুখ সত্যিই গবেষণা করার মতোন বিষয়। রাজনৈতিক সভায় নির্বাচনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভোট প্রার্থী ঘোষণা করছেন আপনারা আমাদের ভোট দিন। আমরা আপনাদের নাগরিকত্ব দেবো। এবং আশ্চর্য্যের বিষয়। জনরুচি সেই আশ্বাসে উন্মত্ত আনন্দে জয়োল্লাসে মেতে উঠছে। জনরুচি প্রশ্ন করছে না। ভারতীয় সংবিধান একমাত্র দুইটি শর্তেই কাউকে ভোটাধিকার প্রদান করে। এক ন্যূনতম আঠারো বছর বয়স। এবং দুই ভারতীয় নাগরিকত্ব। অর্থাৎ সংবিধান অনুসারে কেবলমাত্র আঠারো বছর ও তার বেশি বয়সী ভারতীয় নাগরিকরাই ভারতবর্ষের মাটিতে অনুষ্ঠিত কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। ফলে ভোটাধিকার প্রাপ্তরাই কেবল মাত্র কোন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। অন্যরা নয়। অন্য কোন দেশের নাগরিকরা নয়। বা অন্য দেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরাও নয়। সেই ভোটাধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তিরাই আজ নাগরিকত্ব পাওয়ার লোভে পড়েছেন। কি বিচিত্র এই জনরুচি। না ঠিক বিচিত্রও নয়। রাজনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রীন্ত গণ মাধ্যমগুলিই এই জনরুচি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। প্রচারের এমনই শক্তি। হাতে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত ভোটারকার্ড নিয়েই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে সেই প্রার্থীর কথাই মানুষ চিন্তা করছে। যে প্রার্থী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নাগরিকত্ব দেওয়ার।

আসলে জনরুচি কোনদিনই চিন্তা করে না। কাজ করে। সে ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন। জনশিক্ষার ভিত্তি যত মজবুত থাকে। জনরুচি তত বেশি ভালো কাজে সামিল হয়। শিক্ষার ভিত্তি যত আলগা থাকে, জনরুচি তত মন্দ কাজে সামিল হয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতামন্ত্রীরা নির্বাচনের আগে যত বেশি দলবদল করছেন, তত বেশি করে জনসমর্থন পাচ্ছেন। এটাই এই সময়ের জনরুচির প্রধান অভিমুখ। যে জনরুচি গড়ে তুলছে বিশেষ রাজনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রীত গণমাধ্যমগুলি। ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনের মূল সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলি থেকে জনগণকে দূরে রাখার অন্যতম কার্যকরি কৌশল এই জনরুচি নিয়ন্ত্রণ। আর সেই বিষয়ে গণমাধ্যমগুলির ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ রাজনৈতিক অভিসন্ধি সেই ভুমিকার সুযোগ ও সুবিধে যেভাবে নিতে চাইবে, জনরুচিও সেইভাবে রূপ নিতে থাকবে।

আমরা আগেই দেখেছি, জনশিক্ষার ভিতের উপরে জনরুচির গতি প্রকৃতি অনেকাংশেই নির্ভরশীল। আবার বিশেষ রাজনৈতিক শক্তি নিয়ন্ত্রীত গণমাধ্যমগুলি এই জনরুচি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভুমিকা নিয়ে থাকে। ফলে জনশিক্ষার ভিত যত আলগা ও অপুষ্ট হবে গণমাধ্যমগুলির কাজ তত সহজ হয়ে উঠবে। আমাদের দেশে ঠিক সেটাই হয়েছে। এবং হচ্ছে। ঠিক এই কারণেই বর্তমানে শিক্ষার সুযোগকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একদিকে। আর একদিকে গণমাধ্যমগুলিকেই জনরুচি নিয়ন্ত্রণে কাজ লাগানো হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ঢেলে। এইভাবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত এক বিশাল জনশক্তি তৈরী করে তোলা হচ্ছে। তাদের জনরুচিকে বিশেষ দিশায় নিয়ন্ত্রীত করে। রাজনৈতিক স্বার্থের কাজে এই বিপুল জনশক্তিকে কাজে লাগানো অধিকতর সহজ। রাজনৈতিক স্বার্থেই এই জনশক্তিকে পোষ মানিয়ে রাখাও কঠিন নয়। কেবল ধর্ম সম্প্রদায়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। দেশপ্রেম, বৈদেশিক শত্রু। লোক খ্যাপানো স্লোগান ইত্যাদি বিষয়গুলি ব্যবহার করেই সেই কাজ সুসম্পন্ন করা সম্ভব।

এই ভাবে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তির স্বার্থের অনুসারী একটা জনরুচি তৈরী করা সম্ভব। একটা গোটা সমাজকে রাজনৈতিক স্বার্থে পণবন্দী করার জন্য। সেই ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের রুচি জনরুচির উল্টো স্রোতের অভিমুখি হলেই বিপদ। তখন প্রাণ রক্ষাই কঠিন। এই একটা ভয় দিনে দিনে ব্যক্তিজীবনকে গ্রাস করতে থাকে। অনেকেই সেই ভয়ে জনরুচির সাথে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করে। সমাজ যখন এইভাবে আবর্তিত হতে শুরু করে। সেই সমাজ তখন সুনির্দিষ্ট ভাবে স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়ার দিকে পা বাড়িয়েই থাকে। ফলে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ গণতান্ত্রিক সমাজের জনরুচিকে স্বৈরতন্ত্রের ভিত হিসাবে তৈরী করে তুলতে সক্ষম।

এমনটা নয় যে, এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কোন শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে না। করে অবশ্যই। কিন্তু জনরুচির ঢেউ যখন স্বৈরতান্ত্রিক স্বার্থের পোষ মানানো জনশক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। তখন সে একটা জান্তব শক্তি হয়ে ওঠে। সেই শক্তিকে সম্মুখ সমরে প্রতিহত করা সহজ কথা নয়। জান্তব এই শক্তির উন্মত্ততা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৯২ সালে। প্রত্যক্ষ করেছি ২০০২ সালে। সাম্প্রতিক সময় আবারো প্রত্যক্ষ করতে হলো ২০২০ সালে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব এই শক্তিকে প্রতিহত করা? পথ কিন্তু একটাই। যে জনশিক্ষার দূর্বল ভিতের উপরে গড়ে তোলা জনরুচির মাধ্যমে এই জান্তব শক্তির উত্থান ঘটে, সেই দূর্বল জনশিক্ষার ভিতটাকেই তলায় তলায় শক্তিশালী করে তোলার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া। একমাত্র সেই পথেই রুচির বিকারকে আটকানো সম্ভব। সেটি সম্ভব হলে জনরুচির পরিবর্তন ঘটিয়ে জনশক্তিকে মানবসম্পদ উন্নয়নের কাজে লাগানো শুরু করতে পারলেই স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির পতন অনিবার্য।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.