কৃষ্ণা কর্মকার | গর্ভধারিণী
0
মে ০৯, ২০২২
রাত গড়াচ্ছে আপন নিয়মে। নির্ঘুম বিছানায় এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছেন সুরমা। গত চারদিন ধরে যা ঘটে যাচ্ছে তার খেই মেলানোর চেষ্টা করে চলেছেন আপ্রাণ, কিন্তু না, কোনোভাবেই মেলাতে পারছেন না। কী থেকে কী যে হলো? দিনক’টাকে নিয়ে তোলপাড় করছেন, নেড়েচেড়ে ধুলোঝেড়ে দেখছেন ছোটবড় ঘটনাগুলো, পরপর সাজাচ্ছেন, ভাঙছেন, এলোমেলো করে দিচ্ছেন, তারপর আবার সাজাতে বসছেন। মিলছে না, মিলছে না! ছটফট করে উঠে বসছেন। ঘুমহীন চোখের ওপর কেবল ঘন অন্ধকার! নেমে আসতে চাইলেন বিছানা থেকে, পারলেন না। কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগছে। বাইরে যাবার দরজাটাও ঠিক কোনদিকে ঠাওর করতে পারছেন না। যেন নিজের ঘর নয়, অন্য কোনো ঘরে আছেন। ক’বছর ধরে এই ঘরে তিনি একাই থাকেন। স্বামীর ঘর আলাদা। পাশের ঘরেই রুমকি ঘুমোচ্ছে। ডাকবেন? না থাক। বিরক্ত হবে। বাবলুটা যে কোথায় রইলো, কেমন রইলো কে জানে? কেন, কী, কীভাবে, কোথায়, কোনো কিছু জেনে ওঠার আগেই ‘জরুরি কাজে বাইরে যাচ্ছি’ বলে দুম করে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। তারপর থেকে কী না কী ঘটে যাচ্ছে! কেউ কোনো কথা তাঁকে তো বলছেই না পরন্তু তাঁকেও মুখে কুলুপ আঁটতে হয়েছে তাঁর স্বামীর পরামর্শে – পরামর্শ না হুকুম, কে জানে? সারাজীবন তো তাঁর হুকুম তামিল করেই যাচ্ছেন। উপায়ই বা কী! না বেশি বিদ্যে আছে পেটে, না খুব সাহস আছে বুকে। সেই কোন ছোটবেলায় বাপ পরগোত্তর করে বোঝা নামিয়েছিল কাঁধ থেকে, তারপর থেকে কেবল সংসার আর ছেলেপুলে লালনপালন। সেটাও নাকি ঠিকঠাক পারেন না তিনি। এই নিয়ে দিনরাত কথা দিয়ে কিংবা হাত দিয়ে চড়-থাপ্পড় চলতেই থাকে। এখন তো আবার পাঁচটা অসুখে তাঁর শরীর ভেঙেছে। কানাকড়ি মূল্যও সংসারে আর নেই। কিন্তু চিন্তাটা কী করে ফেলেন তিনি! তবে হ্যাঁ, তাঁর স্বামীর এলেম আছে, এক টাকাকে কী করে দশটাকা করতে হয়, কী করে পাঁচজনের মাথা হয়ে উঠতে হয়, সেসব পাকা বুদ্ধির কাছে ঝুঁকে থাকে শতেক লোক। এমন এলেমদার স্বামীর কথা না মেনে উপায় আছে? কোনো কিছু জানতে চেয়েছো কি চড়াৎ করে তেনার মেজাজ সপ্তমে চড়বে। এই যে তাঁর স্বামী একটা ছেড়ে তিন তিনখানা বাড়ি করে রেখেছেন, চারচাকা, দুচাকা কিনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন বাড়ির সামনে, কী করে হলো, তিনি কি জানেন? কখনো বুঝতেই দেননি, কোথা দিয়ে কীভাবে তিনি সম্পদ বাড়িয়ে চলেছেন। জিজ্ঞেস করলে, একটাই উত্তর,
--‘জেনে তুমি কী করবে? মুখ্যু মেয়েমানুষ কোথাকার! এই চৌহদ্দির বাইরে তো কোনোদিন যেতে হয়নি। দুনিয়াদারির তুমি কী জানো? সুখে রেখেছি, সুখে থাকো, ভূতের কিল খেতে যেও না’।
হ্যাঁ সুখেই আছেন। হাভাতে বাপের ঘর থেকে এসে ‘অভাব’ কথাটার মানে ভুলে গেলেও আনুগত্য আর দাসত্ব কাকে বলে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। অবশ্য এসব নিয়ে আজকাল আর ভাবেন না তিনি। দুটো ছেলেমেয়েই বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে। ছেলে তো বাপের ব্যবসাতেই ঢুকেছে আর মেয়ের জন্যেও বড়ঘরের ছেলে ঠিক করা আছে। যদিও আজকাল ছেলেমেয়েরাও তাঁকে তেমন পাত্তা দেয় না। তাদের যা কিছু গর্ব, সব বাবাকে নিয়ে। তা হওয়ারই কথা। ওদের পেছনে কম টাকা তো ঢালে না! আর কে না জানে, মানুষ টাকার বশ! তবে এসব নিয়ে তিনিও যে খুব কষ্টে থাকেন, তা নয়। ঘরে অঢেল জিনিস আছে, পাশে ঝি-চাকর আছে। কাঁচাপয়সা, জামাকাপড়, গয়নাগাটি সব আছে। ভাবনা কি? স্বামীর অনুগত নাহয় রইলেন, সেটাই বা মন্দ কি! সেই স্বামীর হুকুমে তিনি এখন ঘরবন্দী। বাইরে বেরনো, কারো সাথে কথা বলা, এমন কি টিভি দেখাও বন্ধ। কেবল কাটা। কিন্তু ছেলেটা? বোতাম ফোন একটা আছে তাঁর। ছেলের নম্বরে বারবার ফোন করে যদিও সুইচ অফ পাচ্ছেন, তবু সেটা দেখেই স্বামী ফোনটা নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। বুকটা ভয়ে গুড়গুড় করে উঠলো তাঁর। ছেলেটার কোনো বিপদ হলো না তো?
# # #
কালু একটা বেতের চেয়ারে বসে বেশ উদগ্রীব হয়ে মোবাইলে ঘাঁটছিল। দেখতে দেখতে কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়ে উঠলো। সেটটা বন্ধ করে পকেটে রেখে বললো,
-- দাদা, পাবলিক কিন্তু হেবি খার খেয়ে আছে।
বিমল মন দিয়ে হিসেবের খাতা চেক করছিল। কালুর কথায় মুখ তুললো। সে মুখে স্পষ্টতই বিরক্তি। চড়া গলায় খেঁকিয়ে উঠলো,
-- এই ‘পাবলিক পাবলিক’ ন্যাকড়াবাজিটা তুই বন্ধ করবি? শালার পাবলিককে তুই যা খাওয়াবি তাই খাবে, খেয়ে দেয়ে দুদিন চরকি নাচবে, তারপর হজম হয়ে গেলেই পোকার লোভে গু ঘাঁটবে। আমার কাছে পাবলিক মারাতে আসিস না। হুঁ! পাবলিকের চরিত্র গুলে খেয়েই আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। বাজে না বকে তোকে যে কাজটা দিয়েছি সেটা কর। শুধু খোঁজটা দে, কোন শালা পাবলিক ভিডিওটা ছেড়েছে সোস্যাল-মিডিয়ায়। তাকে কচুকাটা করব।
-- কচুটা পেলে তবে তো কাটবে। এসব পাবলিককে হাতেনাতে ধরা কি চাট্টিখানি কথা? সবতো সফটকপি, কি যেন বলে – ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাসিন্দা। এদের হার্ডকপি মিলবে না। আসলে পুরো কেসটাই তো ফোনে ফোনে ঘুরছে। যাকে বলে সুপার-ভাইরাল।
-- তা তুমি কি এই কুড়িহাজারি ফোনটা নিয়ে দাঁত কেলিয়ে শুধু সেলফি মারাচ্ছো? পাঁঠা কোথাকার! তোকে আমি দানাপানি দিয়ে এমনি পুষেছি? পাবলিকের খার উল্টোদিকে ঢালবে কে রে শালা? লাগাতার অ্যাণ্টিপোস্ট দিয়ে আর অ্যাণ্টি ভিডিও আপলোড করে সুপার ডুপার ভাইরালটা তুমি করতে পারছো না?
-- সে তো করছি দাদা, করেই যাচ্ছি। কিন্তু ওই ‘জোনাকি’ এন. জি. ও.-টার মেম্বারগুলো এক একটা ধানিলঙ্কা। শালাদের ঝাঁঝ কী!
-- পাত্তি ছড়া। ভেপসে যাবে।
-- হচ্ছে না গুরু। টোপ গিলছে না। ফাৎনা ওপরমুখো হয়ে ভেসেই আছে।
-- শুয়োরের বাচ্ছাটাকে মনে হচ্ছে জুতিয়ে লম্বা করে দিই! ঘটে যদি একফোঁটা ঘিলু থাকে।
-- কার? আমার?
-- ঘেঁটি চড়াস না তো কালু। তোকে বলেছি? বলছি ওই বাঞ্চোৎটার কথা। শালা যা করবি, আঁটঘাঁট বেঁধে কর। তা না, গলা বাজিয়ে পোঙ্গা উঁচিয়ে কেত্তন গাইতে গেলো! রসের নাগর! জাঙ্গিয়া সামলাবার মুরোদ নেই, ফুলপ্যান্ট পরার শখ।
-- মাথা ঠাণ্ডা রাখো দাদা। ফেউ ঘুরছে চারদিকে। কখন যে ...
-- হ্যাঁ, তা যা বলেছিস, শালারা কুকুরের জাত, জিভ দিয়ে জল ঝরেই যাচ্ছে। তবে ওসব নিয়ে চিন্তা নেই। মোটামুটি সব ম্যনেজ করে ফেলেছি।
-- ওপরমহল?
-- সুতো ছেড়েছি, দেখা যাক।
কালু চলে যেতেই চারদিক ভালো করে দেখে নিয়ে, ফোনটা নিয়ে পড়লেন পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বিমল। আইফোনে এখনো তেমন সড়গড় না হলেও কালুর শেখানো বিদ্যে নাড়াঘাঁটা করে আপডেট হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তাঁর। এই তল্লাটের পাঁচটা গাঁ প্রধান নয়, উপপ্রধানের নামেই একঘাটে জল খায়। আর সেই তিনিই কিনা ....! না! যতই মুখে পাবলিককে উড়িয়ে দেওয়ার কথা বলুন, সেই পাবলিকই তো তাঁর আসলি হীরেমানিকের সিন্দুক। উঃ! একবার মুখ পুড়ে গেলে ... পুলিশ আর প্রশাসন নাহয় মুঠোয় আছে। কিন্তু এই খুচরোখাচরা খোচরগুলোকে থামানো যায় কীভাবে! একটা বেফাঁস কিছু হলেই ইমেজের বারোটা বেজে যাবে। কাউকে একটা ফোন করতে গিয়েও তাঁর হাত থেমে গেল। না! এই নম্বর থেকে কাউকে এখন ফোন করার দরকার নেই। শালার এই আন্তর্জালে কে যে কোথায় চোখ কান পেতে বসে আছে কে জানে। কারো আর গোপন বলে কিছু রইলো না!
# # #
করবীর চোখের ওপর ক’দিন ধরে একটাই দৃশ্য ভেসে চলেছে। চিতার লকলকে আগুন মেয়েটার ছেঁড়াখোঁড়া শরীরটাকে গিলে খাচ্ছে। নিথর হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে দুদণ্ড কাঁদারও সময় পেলো না সে। কোথা থেকে কারা এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গিয়ে আগুনে ছুঁড়ে দিল। কয়েকটা লাল চোখ ইতিউতি ঘুরতে লাগলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। কেউ কিছু জানতেও পারলো না। জানতে পারলো না? নাকি জেনেও না জানার ভান করলো সবাই। নইলে প্রকাশ্য রাস্তায় আধমরা করে ফেলে দিয়ে গেল, আশপাশের কেউ দেখলো না? করবীর বুকফাটা আর্তনাদ কেউ শুনলো না? দেখলো না, শুনলো না তো মরে যেতে না যেতে তুলে নিয়ে পোড়ালো কারা? একটা সাক্ষী পেলো না পুলিশ, যে মেয়েটাকে ওই অবস্থায় দেখেছে? এমনকি কে ভিডিও তুলেছে, কে প্রথম ফেসবুকে পোস্ট করেছে, কিছুই জানা গেল না? মিতুর বাবা আজ ক’বছর ধরে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। যা ছুটোছুটি তাকেই করতে হচ্ছে। সেও কি পারতো? না আছে তেমন বিদ্যে, না আছে পাকা মাথার বুদ্ধি। আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশি সবাই পাশ কাটিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস এন. জি. ও.-র ছেলেদুটো নিজেরাই এগিয়ে এলো। নইলে ওকে তো প্রথমে পুলিশ ধর্তব্যের মধ্যেই আনে নি। ‘পুলিশ আসার আগেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’, ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নেই’, ‘অ্যাকসিডেণ্ট নাকি সুইসাইড কী করে বুঝবো’ – এইসব বলে পুলিশ দিব্যি এড়িয়ে যাচ্ছিল। ছেলেদুটো অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পুলিশকে নড়িয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত তদন্তে কিছুই জানা যায় নি।
করবীর বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ‘মিতু, মা আমার’, কত কষ্ট পেয়ে গেলি রে মা’ – হাহাকার করে উঠলো নিজের মনেই। ওই একটাই মেয়ে ছিল তার, শিবরাত্রির সলতে। সব আশা ভরসা। ক’টা টাকা মাইনের আশাকর্মী সে নিজে। মিতুর বাবা অচল। মেয়েটা কলেজ পাস করেই কাজের জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছিল। করোনা আর লকডাউনের জেরে কোথাও কিছু জুটছিল না। মাত্র মাসতিনেক আগে রেডিমেড জামাকাপড়ের গোডাউনে হিসেব রাখার কাজটা পেয়েছিল। কী খুশিই না হয়েছিল মেয়েটা। বাপকে জড়িয়ে ধরে সে কি সোহাগ! কত স্বপ্ন বাপবেটি মিলে। এই করবে – সেই করবে। হায় রে! সংসারের হাঁ-এর বহর তো আর কম নয়। দুটো বাড়তি পয়সার জন্যে প্রায়ই ওভারডিউটি করতো সন্ধ্যের দিকে। সেদিনও বিকেলবেলা করবী ফেরার পর ডিউটি করতে বেরলো মেয়েটা তার। সারাদিন ধরে ঘরে ঘরে ঘুরে গাঁয়ের মানুষের হাজারটা রিপোর্ট সংগ্রহ করে ঘেমেনেয়ে মা ঘরে ফিরেছে দেখে, একগ্লাস জল মুখের সামনে ধরে বললো,
-- জলটা খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে বোসো, আমি বেরোচ্ছি।
সময়ের এত টানাটানি যে, মেয়েটার তেমন করে খোঁজই নেওয়া হয় না। এইটুকু মেয়ে সংসারের চাপে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বুকটা টনটন করে করবীর। রোদেগরমে পোড়া ঘামে ভেজা মুখটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে জলটা মেয়ের হাত থেকে নিতে নিতে বললো,
-- আজও ওভারডিউটি করবি তো বাড়ি এলি কেন মাঝে? একবারে করে আসতে পারতিস। শুধু শুধু আসাযাওয়া।
-- আজ দুপুরে বাবার সঙ্গে খাবো বলেছিলাম যে। খুব দূর তো আর নয়। ঠিক আছে।
-- তাড়াতাড়ি ফিরবি। রাত করিস না যেন।
-- হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চলে আসবো। ভেবো না।
করবী ছটফট করে উঠলো। এই ওর সঙ্গে শেষ কথা। সেদিন রাত দশটা বেজে গেছে দেখে মিতুর বাবা অস্থির হয়ে পড়েছিল। বারবার ফোন করে সাড়া না পেয়ে করবীকে প্রায় জোর করেই বাইরে পাঠিয়েছিল মেয়ের খোঁজ করতে। গাঁ ঘরে দশটাতেই মাঝরাত। তারপরেও আসে না – আসে না। দেরি হচ্ছে দেখে ঘরবার করতে করতে টর্চটা নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। কিছুটা এগোতেই একটু দূর থেকে একটা খড়খড়ে শব্দ উঠে এলো। সঙ্গে ফিসফিসে কথা আর দুদ্দাড় করে দৌড়নোর শব্দ। করবী চিৎকার করে উঠলো,
-- কে? কে ওখানে?
তারপরেই মোটর সাইকেলের শব্দ। পাশ দিয়ে পেরনোর সময় কে একজন শাসিয়ে গেল,
-- মুখ খুললে ফরসা হয়ে যাবি।
হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে করবী যখন এগোতে যাবে, তখনই পাশের ঝোপ থেকে চাপা গোঙানির আওয়াজ ভেসে এলো। একটু কাছে গিয়ে টর্চ জ্বেলে ঝুঁকতেই জামাটা দেখতে পেলো। ওর গলা থেকে একটা চেরা আওয়াজ বেরিয়ে রাতের নিঃশব্দতা খানখান হয়ে গেল। তারপর আর কিছু খেয়াল নেই ওর। শুধু মনে আছে, কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটা ওর বুকের ওপরেই আস্তে আস্তে নিথর হয়ে গেল। আর তড়িঘড়ি করে কারা যেন সব ব্যবস্থা করে সেই রাতেই তুলে নিয়ে গেল শ্মশানে। ও! মেয়েটাকে শেয়াল কুকুর মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছিল গো! রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। গোটা গায়ে আঁচড় কামড়ের দাগ। তার ওপর মদ ঢেলে দিয়েছিল ওর গোটা গায়ে। ভক করে ঝাঁঝালো গন্ধটা নাকে এসে ঝাপটা মেরেছিল করবীর। ওরে বাবারে! কী জ্বালাই না জ্বলেছে মেয়েটার শরীরটা!
ও দুটো তিনটে দিন শুধু একজায়গায় বসেছিল, কাঁদার কথাও ভুলে গিয়েছিল। খাওয়া ঘুম তো দুরস্ত, পেচ্ছাবটুকুও যেতে পারে নি। মিতুর বাবার দিকেও তাকাতে পারেনি। পাড়া প্রতিবেশি কেউ আসে নি খোঁজ নিতে। ক’দিন পরে দুটো ছেলে এলো দেখা করতে। বললো নাকি ফেসবুক থেকে জেনেছে। ওরা আসল সত্যিটা ধরেও ফেলেছে। আর সত্যি! পুলিশ তো বলেই দিলো, এরকম আধাখামচা অস্পষ্ট ভিডিও দিয়ে কিছুই প্রমাণ হয় না, কাউকে চেনাই যাচ্ছে না। ওটা আসলে বানানো। ছেলেগুলো তবু ছুটছে। সঙ্গে সে-ও। ছুটছে বটে, কিন্তু কদ্দুর যাবে কে জানে! কেউ কি কোনোদিন সত্যিটা জানবে? না আছে সাক্ষী, না আছে প্রমাণ। ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম ছুটছে সর্দার হতে। গরীবের আবার সুবিচার। কারা আবার রটাচ্ছে, মেয়েটা নাকি একসঙ্গে চার পাঁচটা ছেলেকে নাচাতো। একে তাকে সঙ্গ দিয়ে টাকা আদায় করতো! কী মিথ্যে কী মিথ্যে! গরীব বলে এত অপমান? হে ভগবান, তোমার চোখ কান যদি থাকে, সত্যিটা তুমি দেখো। মা রে! কেন জন্মালি এই পোড়া গব্বে? এই পোড়া দেশে?
# # #
সুরমা থম মেরে গেলেন একেবারে। অঘটন যে একটা কিছু ঘটেছে, তিনি আন্দাজ করতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু আজ চন্দনা যা বললো, সেটা ঘুণাক্ষরেও বোঝেন নি। এখন যত ভাবছেন, ততই যেন দুইয়ে দুইয়ে চার হচ্ছে। ছেলে হুট করে কোথায় চলে গেল, রুমকির মুখ গম্ভীর, রুমকির বাবার কপালের ভাঁজ মরচে না, বাপ-মেয়েতে চুপিচুপি কীসব কথাবার্তা চলছে, তার আড়ালে আড়ালে নানাজনের সঙ্গে ফোনাফুনি করছে, ছেলেটার কথা জানতে চাইলেও ধমকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে – এসবই মনে কু ডাকছিল। এমনিতেই ছেলেটার কোনো খবর না পেয়ে অন্নজল ত্যাগ করেছেন তিনি। তার ওপর আবার ...। শেষে আর থাকতে না পেরে বাড়ির কাজের লোক চন্দনাকে ধরলেন। আর যারা আছে, তারা সব কর্তাবাবুর মর্জিমাফিক চলে। এই চন্দনাই যা তাঁকে একটু গ্রাহ্য করে। তাও ভয়ে কিছুতেই মুখ খুলছিল না প্রথমে, কাউকে ওর নাম বলবেন না শপথ করে, সঙ্গে শাড়ি আর টাকা পয়সা দিয়ে মুখ খুলিয়েছেন। না খোলালেই হয়তো ...! বুকটা আবার তোলপাড় করে উঠলো। কী বললো ও! মেয়েটা নাকি ওদের কাপড়ের গুদামেই কাজ করতো! সেখানেই কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ...! উ! ভাবলেই ... আচ্ছা কেউ কলকাঠি নাড়েনি তো? ফাঁসানোর মতলবে? স্বামীর প্রতিপত্তি যত বেড়েছে, শত্তুরও তো বেড়েছে তার বেশি। তাই বা কী করে হয়? চন্দনা তো বললো, অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা, মেয়েটির ওপর আদৌ কোনো অত্যাচার হয়েছে কিনা তারই কোনো প্রমাণ পায় নি পুলিশ। যারা মেয়েটাকে থেঁতলানো অবস্থায় দেখেছে, তারা কেউ সাক্ষী দেবে কী, টুঁ শব্দটাও করেনি। চন্দনাও দেখেছে – ও দেখে বুঝেওছে, অনেকে মিলে না খাবলালে ওইরকম হাল হতেই পারে না। কিন্তু ওরও তো ছেলেপুলে নিয়ে সংসার। ওর এতো বুকের পাটা নেই যে ওই বুনো বাঘের হাঁমুখে যেচে গলা বাড়িয়ে দেবে। চন্দনা আকারে ইঙ্গিতে ওর স্বামী আর তার দলবলের দাপটের কথাই বলে গেল। ওঃ! শেষকালে কিনা ...। কাকে বলবেন কষ্টের কথা? কার পরামর্শ চাইবেন? তাঁর এখন কী করা উচিত? সামনে যেদিকে তাকান, শুধু চাপ চাপ অন্ধকার। এতদিনের এত লড়াই – সব ফাঁকা! কেবল শূন্য! কেবল শূন্য! তাঁর গর্ভের এতো দোষ ছিল? এতো?
# # #
রাত প্রায় একটা। অন্ধকার হাতড়ে নাছদুয়ার দিয়ে বেরোলেন সুরমা। শেষমেষ চন্দনাই ভরসা। সে-ই মেয়েটার পক্ষের ছেলেদুটোকে খবর দিয়ে সব ব্যবস্থা করেছে। পেটকাপড়ের নিচে লুকনো থলিটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে আরেকবার পরখ করে নিলেন, হ্যাঁ নিয়েছেন। প্রচণ্ড দোটানায় কেটেছে ক’দিন। গতকাল রাতে সিদ্ধান্তটা পাকাপাকি নেওয়ার পর তাঁর মন এখন আশ্চর্য শান্ত। ঘষাঘষা চাঁদের আলোয় বেশ খানিকটা হেঁটে এসে দেখলেন একটা ঝোপের আড়াল থেকে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ, চন্দনা একটা ছেলেকে নিয়ে সামনে এলো এবং কথামতো ওকে দেখিয়ে দিয়ে চন্দনা ফিরে গেল। চুপিচুপি ছেলেটা জানতে চাইলো ভোরের জন্য অপেক্ষা করবে কিনা। সুরমা ছটফট করে উঠলেন,
-- না না, একমুহূর্ত সময় নষ্ট নয়। সব ভেস্তে যেতে পারে।
আরো খানিকটা গিয়ে ছেলেটা সুরমাকে একটা গাড়িতে তুললো, ড্রাইভারের সীটে বসে থাকা অন্য ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।
ভোর ছুঁইছুঁই, থানায় বড়বাবুর সামনের চেয়ারে বসে আছেন সুরমা দেবী। বড়বাবু তাঁর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। পাশে ছেলেদুটো এবং ওদের এন. জি. ও.–রই নিযুক্ত করা উকিলবাবু বসে আছেন। থমথম করছে চারপাশ। বড়বাবু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললেন,
-- আপনি ঠিক বলছেন, এই ভাঙা ঘড়ি আর জামা-প্যাণ্টটা –
-- আমার ছেলে বিকাশের। আমি নিজে গতবছর পুজোর আগে দোকানে গিয়ে জামা প্যাণ্ট দুটো কিনে এনেছিলাম। ঘড়িটা ভাইফোঁটায় ওকে আমার মেয়ে দিয়েছিল।
-- সেদিন বিকাশ ওইগুলোই পরেছিল, আপনি নিশ্চিত?
-- আমি তার আগের দিন আয়রন করে রেখেছিলাম, আমার কাছ থেকেই চেয়ে পরেছিল। বেরনোর আগে এই পারফিউমটাই লাগিয়েছিল। রাতে ফিরে এসেই তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরে ঢুকে এই জামাপ্যাণ্টটা ছেড়ে অন্য জামাপ্যাণ্ট পরে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বেরোবার আগে জুতো পরতে পরতে আমাকে এই ভাঙা ঘড়িটা খুলে দিয়ে ওর ঘর থেকে অন্য অন্য একটা হাতঘড়ি এনে দিতে বললো, আমি আনতে গিয়ে জামা থেকে মদের গন্ধ পেলাম। ওর বাবা জানতে পারলে যদি অশান্তি করে, তাই জামা প্যাণ্টটা ওর বিছানার তলায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। পরে নানা তালেগোলে কাচতে দিতে ভুলে গেছি – ভাগ্যিস ভুলেছি।
-- আপনি বুঝতে পারছেন, কী বলছেন?
শান্ত স্থির গলায় সুরমা বললেন,
-- পারছি।
-- আপনি যা বলছেন, যদি সত্যি হয় ...
-- যদি নয়, সত্যি, সত্যি আমি একজন ধর্ষকের মা – হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ধর্ষকের মা। আমার ছেলে আর তার বন্ধুরা সেদিন ওই কচি মেয়েটাকে ধর্ষণ করে খুন করেছে। আমি বলছি, আমি বলছি, আমি, আমি ওর মা – ওকে দশমাস দশদিন গর্ভে ধরেছি, তিলতিল করে মানুষ করেছি – সেই আমি বলছি – আমার ছেলে ধর্ষক – খুনী। ওকে ওর বাবা লুকিয়ে রেখেছে। হ্যাঁ ওর বাবা – বিমল গুঁই – নেতা বিমল – উপপ্রধান। দয়া করে আপনারা ওকে খুঁজে এনে শাস্তি দিন। আমি ধর্ষকের মা হয়ে থাকতে চাই না – চাই না। ওকে শাস্তি দিন। দয়া করুন দয়া করুন আমাকে।
বলতে বলতে, কাঁদতে কাঁদতে, নিজেকে খামচাতে খামচাতে জ্ঞান হারালেন সুরমা।
Tags
সুচিন্তিত মতামত দিন