ইন্দ্রাণী দত্ত | আলোচনা -"ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প"



খোকা মাকে শুধায় ডেকে,
'এলেম আমি কোথা থেকে
কোন্ খেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে?'
মা শুনে কয় হেসে  কেঁদে
খোকারে তার বুকে বেঁধে--
ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে ।৷

আমরা অনেকেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জ­ন্মকথা 'কবিতার এই লাইনগুলির সাথে পরিচিত­,যেখানে খোকার প্রশ্নে মা জানিয়েছেন তার পরম আদরের খোকা যেন মনের মাঝে ইচ্ছে হয়ে ছিলো ,পরে সেই ইচ্ছের আত্মপ্রকাশ হয় সকলের সম্মুখে খোকার উপ­স্থিতির মাধ্যমে ৷আচ্­ছা এই প্রসঙ্গ টেনেই যদি বলি একজন লেখক কি­ংবা লেখিকা হচ্ছেন মা আর তার সৃষ্টি বইটি হচ্ছে সন্তান তাহলে খুব একটা অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না ৷ এক­জন লেখক বা লেখিকার মনের মধ্যে ইচ্ছে হয়ে জমে থাকা তার জীবনের টুকরো কথা,কিছু অভিজ্­ঞতা,দীর্ঘ উপলব্ধি এবং তার চারপাশে ঘটে যা­ওয়া কিছু ঘটনার প্রকাশ  হয় তার  সন্তানতুল্য বইটিতে,তাই সন্তান­সম বইটি যে লেখক বা লেখিকার জীবনধারার কিং­বা চিন্তাধারার প্রতি­ফলন তা বলার অপেক্ষা রাখে না ৷

পড়া শেষ করলাম কলকাতা বইমেলা ,২০২২ দিয়ে সদ্য প্রকাশিত সাহিত্য অনুরাগী কবিতা নন্দী চক্রবর্তীর প্রথম গল্পের(ফিকশনাল) বই "ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প" ৷ বইটি পড়ার শুরুতে ভেবেছিলাম দিন সাতেকে শেষ করবো কিন্তু  বিশ্বাস করুন লেখ­িকা তার সন্তাটিকে এত­টাই সমৃদ্ধ করে তুলেছেন  নিজ কলমের গুনে যে আমার মত বইপোকার কাছে বইটি শেষ করতে খুব বেশি দিন তিনেকই যথেষ্ট ছিল ৷ ওই ধরুন ব্যাপারটা  অনেকটা একজন খাদ্যরসিকের সামনে এক হাড়ি বিরিয়ানি ফেলে রাখলে যা হয় আরকি !




"ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প" আলোচনার শুরুতে লেখিকার সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়,লেখিকা কবিতা নন্দী চক্রবর্তী একজন নির্ভেজাল মানুষ , মানুষটির শিকড়টিও কিন্তু মাটির খুব গভীরে​ কারন উনি তো বেড়েই উঠেছেন প্রকৃতির কোলে ,বাঁকুড়া জেলার একটি গ্রামে ,মাটির কাছে ৷ দীর্ঘ পরিচয়ের দরকার নেই, ওনার মধ্যে যে সাহিত্য রস আছে তার আঁচ খুব সহজেই যে কেউ অনুভব করতে পারবেন ,তিনি শুধু একজন লেখিকা নন,একজন দরদী শিক্ষিকাও বটেন ৷ বইটি পড়ার সময় লেখিকার বাংলা সাহিত্যে যে অগাধ জ্ঞান সে বিষয় নিঃসন্দেহে পরিচয় পাওয়া যায় ৷এছাড়াও তিনি যে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী তা তর্কাতীত৷

এবার আসি " ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প" বইটির প্রসঙ্গে ,আশাদীপ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটিতে রয়েছে মোট উনিশটি গল্প ৷লেখিকার​ চারপাশের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সুন্দর মেলবন্ধন ঘটেছে প্রতিটি গল্পে যা অনায়াসেই পাঠককুলকে পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টাতে বাধ্য করবে ৷সহজ সরল ভাষার সমাগমে "ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প" অচিরেই পাঠকের ঘরের সদস্য হয়ে উঠবে যাকে মনখারাপের দুপুরে,কিংবা মধুর স্মৃতিচারনে অথবা ক্লান্ত বিকেলে এক কাপ চায়ের সঙ্গী করা যায় ৷

১...ফুল ফোটানো...

প্রথম গল্প বইটির নামকরণের অংশবিশেষ,'ফুল ফোটানো' গল্পটিতে আমরা শিউলি নামে একজন নারী চরিত্রকে দেখতে পাই,যিনি গাছের ব্যাপারে যথেষ্ঠ আগ্রহী,আসলে তিনি আদ্যোপান্তে​ একজন গাছপ্রেমী মানুষ নাহলে বলুন তো বই মেলাতে গিয়ে কেউ বই এর সাথে গাছ ,না না ভুল বললাম গাছের সাথে কেউ বই কিনে আনে ! তবে এই বিষয়ে তার একজন দোসর হলেন​ স্বামী সন্দীপ,ছোট্ট ছেলে শিখরও হয়েছে ঠিক মা বাবার মতো,কিন্তু ব্যতিক্রমী হলেন মেয়ে কথাকলি ৷ মায়ের এই গাছ নিয়ে যে সকল কর্মকান্ড চোখে পড়ে তা কথাকলির কাছে বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয় ,কিন্তু হঠাৎ একদিন ব্যালকনিতে থাকা বেলি ফুলের সুগন্ধ তাকে​ পরিবর্তন করে দেয়,এখান দিয়েই গাছের প্রতি তার ভালোবাসার সূত্রপাত তবে এই পরিবর্তন আকস্মিক মনে হলেও মায়ের ভালোলাগা,অভ্যাস যে সন্তানের ভিতর দেরিতে হলেও একি রক্তধারার মতো প্রবাহিত হবে তা বলাই বাহুল্য ৷কথাকলি ,যে শুধু গাছের প্রতি অনীহাই ফুটিয়ে তুলতো সে এখন হোস্টেল জীবনে বাড়ির বাইরে থেকে ফুল ফোটায় ৷ গল্পের সারল্যতা পাঠককুলকে আপ্লুত করবে,এছাড়াও গল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী লাইন​ " উপহার দেওয়া তো কর্তব্য সারা নয়,সেখানে দাতাকে গ্রহীতার ভালো লাগা,পছন্দ,প্রয়োজন ইত্যাদির কোনও একটা বেছে নিতেই হবে " যার দ্বারা লেখিকা বোধহয় একটি সমাজিক, জীবনমুখী নৈতিকশিক্ষা দিতে চেয়েছেন যা সত্যিই প্রশংসনীয় ৷

২......সুবর্ণজয়ন্তী...

বইটির দ্বিতীয় গল্প' সুবর্ণজয়ন্তী',এই গল্পে আমরা দেখবো একটি বিদ্যালয়ে সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে একজন সৎ,নির্ভীক,খেটে খাওয়া মানুষের দায়িত্ববোধ ৷ কাহিনী শুরু হয়​ বিদ্যালয়ে সুবর্নজয়ন্তী অনুষ্ঠান পালনের জন্য বিভিন্ন আলোচনা,খুনসুটি ও বড়দির দায়িত্ব ভার ভাগ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ,এ যেন যে কোন বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান পরিকল্পনার এক চেনা চিত্র ,কিন্তু গল্পটি মোড় নেয় একটি অযাচিত ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেখানে অনুষ্ঠানের দিন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী মিলন ব্যাঙ্কে সুবর্ণজয়ন্তীর একলক্ষ টাকা জমা করতে গিয়ে তা টোটোতে ফেলে আসেন​ ,কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছু পরে থানায় ডায়েরি করার জন্য গেলে জানতে পারেন টোটোচালক ব্যাগটি থানায় দিয়ে গেছেন,এই ঘটনা গল্পের সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে,অভাবে স্বভাব নষ্ট -কথাটি যে সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় তা এই গল্পে সার্থক ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বলে আমার মনে হয় ৷

৩..ফেরা...

তৃতীয় গল্প 'ফেরা' বেশ অন্য স্বাদের একটি গল্প যা হাঁপিয়ে যাওয়া শহুরে জীবন থেকে পাঠককে নিয়ে যাবে গ্রামবাংলার নিখাদ সৌন্দর্য উপভোগ করতে,গল্পের নায়িকা অনুশ্রী বহুদিন পর গ্রামে বাবার বাড়িতে আসেন এবং গ্রামে তার কাটানো কয়েকটা দিনের ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমেই গল্পটি এগিয়ে যায় শেষভাগে,তবে লেখিকার ছোটোবেলাটা গ্রামে কেটেছে যখন জানবেন পাঠক,তখন তাদের কোথাও একটা মনে হতে পারে যে লেখিকা ও গল্পের নায়িকা অনুশ্রী যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ৷

৪..সমান্তরাল...

চতুর্থ গল্প 'সমান্তরাল',
পরপর তিনটি জমজমাট ভিন্ন স্বাদের গল্পের পর 'সমান্তরাল 'কোথাও যেন একটা মনখারাপের আবেশ আনে ,একটি অসহায় নারী বাধ্য হয়ে ইতি টেনে ছিলেন তার দাম্পত্য জীবনে,রেখে এসেছিলেন কোলের সন্তানটিকে শ্বশুরবাড়িতে,আসলে নিজের সন্তানকে কেই বা অনিশ্চিত জীবন দিতে চায় বলুন তো !তারপর কেটে গেছে বেশ কিছু বছর,মায়ের মন ছুটে গেছে মাতৃত্বের পরিচয় নিয়ে মেয়ের ইস্কুলে,কিন্তু প্রমান কি!মেয়েও যে ভুলে গেছে মায়ের সেই মুখ ,শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়েছে মা রমলাকে, এখন মা -মেয়ে যেন দুটি সমান্তরাল রেখা,পাশাপাশি থেকেও এক হওয়া যাবে না ৷


৫...জিজ্ঞাসার উত্তর....

'জিজ্ঞাসার উত্তর ' খুব সম্ভবত বই এর সবথেকে বড় গল্প ৷বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজোর ডেকরেশন থেকে শুরু করে মিতুন আর অরণ্যর​ আলাপ,তারপর এক সময় পড়া শেষে হোস্টেল জীবনের চির সমাপ্তি ঘটিয়ে ফিরে যায়​ যে যার​ গন্তব্যে,বর্তমানে এই না পাওয়ার যুগে লেখিকা খুব সুন্দর ভাবে কয়েকটা বছরের তফাতে মিতুন ও অরণ্যের সুপ্ত ভালোবাসার একটা পরিণতি দিতে পেরেছেন,তাছাড়া এই সেলফোনের জামানায় নাইনটিসের চিঠির আদান প্রদান মনে করিয়ে দেয় ডাকবাক্সের কথা ৷

৬)...চেয়ার.....

'চেয়ার' গল্পে আমরা সৈকত নামে এক মধ্যবয়স্ক যুবককে পাই যিনি স্ত্রী নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছেন পূর্বপুরুষের ভিটায়,যেখানে রয়েছে তার বাবার পরিবার ,কাকা,কাকি ভাইরা ,বোনেরা ৷ কাজের সূত্রে অন্যত্র থাকলেও আগেরবার পিতৃহারা সৈকত নিজের বাড়িতে দেখে এসেছেন বাবা বসে থাকতেন যে চেয়ারে সেই চেয়ারে বসা মানুষটির অনুপস্থিতির উপস্থিতি ৷কিন্তু এইবার পৈত্রিক বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে সৈকত দেখলেন তার বাবার চেয়ারটি মেজকাকা অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছেন,আর এই চেয়ারটির অনুপস্থিতি সৈকতের বাবা হারানোর যন্ত্রণা কে আরো একবার উস্কে দিলো,তার শূন্যতাকে যেন কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলো ৷কিন্তু এই গল্পটি পড়ে আমার মতো হয়তো কিছু পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে বাবা মায়ের আসন যেখানে চিরকাল সন্তানের হৃদয় মাঝে সেখানে বাহ্যিক একটা আসনের অনুপস্থিতিতে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সৈকতকে এতটা মর্মাহত করা কি লেখিকার সত্যিই উচিত ছিলো ?

৭...প্রথম বেদনা...

​ জীবনের​ সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও,ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ো না,সাফল্যের শীর্ষ ছুঁতে ব্যর্থতাকে অতিক্রম করতেই হয়,সত্যিই তো 'প্রথম বেদনা' গল্পে ছোট্ট অঙ্কনের শুভাকাঙ্ক্ষীর লেখা এই বার্তাটি যেন লেখিকার অন্তরের কথা যা তিনি পাঠকদের উদ্দেশ্যেই ব্যক্ত করেছেন ৷ ইস্কুলে অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট হওয়া ছোটো ছেলেটা যখন ক্লাস ওয়ানের বার্ষিক পরীক্ষায় অংক ভুল করে আসে আর যখন তা জানতে পারে তখন সে চিৎকার করে কাঁদে,এই ছিলো তার​ প্রথম বেদনা​ কারন সে যে তখনও উপলব্ধি করত পারেনি সাফল্যের শীর্ষ ছুঁতে আমাদের সকলকে ব্যর্থতাকে অতিক্রম করতে হয় ৷


৮..গ্রন্থি...

ইংরেজি প্রথম বর্ষের ছাত্রী লিপিকার সাথে পরিচয় হয় বছর বাইশ তেইশের মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া অয়নের ৷ দুজনের বিষয় ভিন্ন​ হলেও কাছকাছি থাকার কারনে দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সখ্যতা কিন্তু একদিন পড়া শেষে যে যার মত ফিরে যায় নিজ বাড়িতে ৷ কিন্তু এই সাময়িক বিচ্ছেদের পর আসে গল্পের টার্নিং পয়েন্ট যা চমৎকার ভাবে একটা উপসংহারে পৌছায় যখন দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া অসুস্থ লিপিকাকে অয়ন নিজের একটি কিডনি দেয়,এ যেন একপ্রকার মনের সন্ধির সাথে দেহের সন্ধি,গ্রন্থি ৷


৯...পরিযায়ী...

'পরিযায়ী' গল্পের আবিরা ও কিংশুকের কর্মসূত্রে ও বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য স্থায়ী বসবাসের অপ্রতুলতা তাদেরকে করে তুলেছে পরিযাযী,তবে এই পৃথিবীতে একপ্রকার আমরা সবাই হয়তো পরিযাযী ৷

১০..সেই বিকেলে,সেই দুজনে....

'সেই বিকেলে,সেই দুজনে'গল্পে​ পরিস্থিতি নামক শব্দটা আমাদের অভ্যাসকে মনের অজান্তেই কিভাবে বদলে দেয় তা বহুদিন পরে প্রিয়া ও শ্রুতি দুই বন্ধুর গল্প গুজবের​ মাধ্যমে লেখিকা খুব সুন্দর ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন,আমরা পরিস্থিতির দাস,কথাটি​ কি ভীষণ ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এই গল্পে ৷

১১..উত্তরণ....

'উত্তরন ' গল্পে শ্রীতমা​ একজন সঙ্গীত শিল্পী যিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারা নিয়ে জীবনে এগোতে চাইলেও দর্শকদের মনোরঞ্জন, বলাবাহুল্য দর্শক টানতে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও হিন্দি ও আধুনিক গান গাইতে শুরু করেন,শিল্পীর জীবিকার জন্য দর্শক এর চাহিদার মূল্য যে দিতেই হয়,কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার গানের প্রতি দর্শকের আগ্রহ ,উচ্ছ্বাস তাকে অনুভব করায় তিনি যে ধারার গান করুক না কেন হয়ে উঠতে পেরেছেন একজন সার্থক শিল্পী আর এখানেই শ্রীতমার উত্তরন ৷

১২..ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট...

'বন্ধু 'কথাটি আমাদের সকলের জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত,তাই তো গানে আছে 'বন্ধু বিনা প্রান বাঁচে না '!কিন্তু কত বন্ধুত্ব ভেঙে যায় অকারনে,অগোচরে ৷ সুমেধা আর উদিতার বন্ধুত্ব টাও শেষ হয়ে গেছিলো উদিতার একটা ভুল বোঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে ,তবে আবার অনেকটা বছর পর​ উদিতা সুমেধাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়,সুমেধাও সব ভুলে​ উদিতার পুনরায় বন্ধুত্ব হওয়ার অনুরোধ গ্রহণ করেন ৷লেখিকা এখানে প্রমাণ করে দিয়েছেন অন্তরের টান থাকলে এভাবেও ফিরে আসা যায় ৷


১৩..স্বপ্নদীপ....

'স্বপ্নদীপ'গল্পটি ছোটো হলেও​ এ এক গভীর সত্য বহন করে,লকডাউনে স্বামীদের কাজ চলে যাওয়া,আর্থিক অনটনে ডুবে যাওয়া পাঁচ পাঁচটা প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের সংসারকে বাড়ির বউরা কি ভাবে সচ্ছল করে তুললো তার চিত্র উঠে এসেছে ,গল্পের শেষ আমরা জানবো স্বপ্নদীপ হল মহিলা দ্বারা পরিচালিত একটি ক্যাটারিং​ সার্ভিসের নাম ৷আমরা নারী আমরা পারি কথাটি যেন তার সার্থকতা খুঁজে পায় স্বপ্নদীপ গল্পে ৷

১৪...পর্দানসীন...

পর্দানসীন গল্পটি সোহিনী নামে একজন পেসেন্টের​ অপারেশনের কাহিনী দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় ওই অপারেশনের দায়িত্বে থাকা একজন বদমেজাজী ম্যাডামের মানবিকতার পটভূমিতে ৷ আপাতত দৃষ্টিতে ম্যাডামটিকে রাগী,ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলে মনে হলেও সোহিনীর কেবিনে দেখাশোনার জন্য থাকা ডলির মেয়ের বিয়ের জন্য ডলিকে যখন তিনি সাহায্যের কথা বলেন তখন বোঝা যায় আমরা মানুষ কে উপর উপর বিচার করি,ভিতর বুঝি কজন !

১৫...প্রাণের কথা....

জেঠতুতো,খুড়তুতো বোনের প্রানের কথা গ্রুপে সময় করে চার বোনের​ মন খুলে গল্প করা এক কথায় মনে করিয়ে দেয় বর্তমান প্রযুক্তির যুগে দূরে থেকেও কত কাছাকাছি থাকা যায়,তাদের মধ্যে যে কথোপকথন চলতো তা যেন বাস্তব জীবন থেকেই নেওয়া ৷

১৬ ও ১৮...আনন্দাশ্রু ও আনন্দময়ী পাঠশালা...
'আনন্দাশ্রু' ও 'আনন্দময়ী পাঠশালা 'বইটির শেষের দিকের গল্প গুলির মধ্যে এই দুটি গল্প অন্যতম ৷এই দুই গল্পের দুটি প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র যথাক্রমে রাজু ও সুবিনয়বাবুর মানুষের জন্য ভালো কিছু করার উদ্যোগ সকল পাঠক কে উদ্বুদ্ধ করবে ৷সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে কথাটির সার্থক প্রকাশ দেখা যায় এই গল্পে ৷

১৭..সান্নিধ্য...

জীবনে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকম সান্নিধ্যে থাকতে চায়,কিন্তু মানুষের জীবনের সব থেকে বড় সান্নিধ্য বোধ হয় বাবা মায়ের সান্নিধ্য,খুব বড় বয়সে, বিবাহিত জীবনে একদিন বীথি যেন আনমনেই অতীতের স্মৃতিচারণ এ বিভোর হয়ে পড়েন,তার মনে পড়ে পূজোর সময় মা তাকে নিয়ে যেতেন মামাবাড়ি,পরক্ষনেই আচমকা উপলব্ধি করেন ছোটোবেলা মামাবাড়ি পুজো না থাকলেও মা কেন যেতেন,"আসলে পুজো দেখতে নয়,এই উপলক্ষ্যে মা যেতন তার মায়ের সান্নিধ্যে ৷

১৯...সংশয়...

"ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প" এর শেষ গল্প 'সংশয়',এই গল্পে লেখিকা খুব বুদ্ধিদৃপ্ত ভাবে গল্পের প্রধান নারী ও পুরুষ চরিত্র​ যথাক্রমে পৌষালি ও সৌগতকে বিষ্ণুপুর ঘুরতে নিয়ে গিয়ে পাঠকদেরও ঘুরিয়ে এনেছেন শ্যামরায় মন্দির,গুমঘর,রাসমঞ্চ আরো কত কি !

কিন্তু গল্পের শেষে সৌগতর মনের সংশয় যেন লেখিকা ইচ্ছে করেই পাঠকের মনে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন,এ যেন শেষ হইয়া হইলো না শেষ....!

বাস্তব জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ,কিংবা​ বাস্তব জীবন থেকেই নেওয়া উনিশটি গল্প পড়ার শেষে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে প্রতিটি গল্পই​ সুখপাঠ্য ৷গল্পের বিষয়ভাবনা ও গল্পের বুনন যথেষ্ট সন্তোষজনক ৷

বইটি হার্ড বোর্ড বাইন্ডিং ও প্রচ্ছদ শিল্পীর অনবদ্য রঙিন প্রচ্ছদ চিন্তা বইটিকে মনোগ্রাহী করে তুলেছে ৷ ফুলদানি তে রাখা অন্যান্য ফুলের মধ্যে " ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প" অচিরেই হয়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠ ফুল,সকলের মধ্যমণি ৷ তবে লেখিকা ও প্রকাশকের চিন্তাভাবনার কোন রকম বিরোধিতা না করেই সমালোচনার খাতিরে বইটির মাপ সংক্রান্ত একটি নিজস্ব অভিমত পোষন করছি ৷ বইটির​ পৃষ্ঠা সংখ্যা যদি কমিয়ে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের দিক থেকে সাধারণ বই এর যে মাপ সেই মাপ অনুসারে করা হতো তাহলে বইটি সাইজের দিক থেকে বুক সেল্ফে রাখা সকল বই এর সাথে একি উচ্চতায় থাকতে পারতো,এছাড়াও ছয় পাতার গল্প তিন পাতায় শেষ করা যেত তাহলে পাঠকদেরও ঘন,ঘন পৃষ্ঠা উল্টানোর প্রয়োজন হতো না ৷

সবশেষে " ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প" পুস্তকটির সমালোচনার রাশ টেনে লেখিকাকে জানাই একরাশ তৃপ্তির শুভেচ্ছা,আশা রাখি এরকম আরো বেশ কিছু বই লেখিকা কবিতা নন্দী চক্রবর্তী আমাদের উপহার দেবেন,আপনার কলম পৌছে যাক শত সহস্র পাঠকের ঘরে ...


আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে
ফুটেছে যে ফুল,
গন্ধ তাহার ছড়িয়ে পড়ুক
ভাসাক আজ দুকূল ৷
নব নব ফুল ভরে উঠুক
রুদ্ধ হৃদয় জুড়ে,
খ্যাতির সুবাস মুখরিত হোক
দূর বহুদূরে ৷


পুস্তক :"ফুল ফোটানো ও অন্যান্য গল্প "
লেখিকা: কবিতা নন্দী চক্রবর্তী
প্রকাশক :আশাদীপ​ প্রকাশনী
প্রকাশকাল:কলকাতা বইমেলা,২০২২




সমালোচনায় : ইন্দ্রাণী দত্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.