শনিরবচন | হাঁসখালির উপকথা

বাংলায় ধর্ষন বাংলায় গণ সেক্স

তিনি আমাদের সকলের মুখ্যমন্ত্রী! আমরা যাঁরা কদাচ কোনদিন তাঁকে ভোট দিইনি, এবং দেবোও না কখনো‌। তিনি তাঁদেরও মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক যেমন আমরা যাঁরা একবার নয়। দুই বার নয়। তিন, তিন বার তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসাতে তাঁর সাধের দলকে বুথে বুথে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছি। তিনি তাঁদেরও মুখ্যমন্ত্রী। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধী এবং সমর্থক। সকলেরই মুখ্যমন্ত্রী তিনিই। সেই তিনিই যখন কোন কথা বলেন। সেকথার ওজন থাকবে বইকি। রাজ্যের নির্বাচিত প্রধান বলে কথা। কিন্তু সেকথার ওজন থাকবে বলেই যে সেকথার সমালোচনা করার অধিকার থাকবে আমাদের। তেমনটাও নয়। 
আমরা যাঁরা তাঁকে ভোট দিইনি। তাঁরা তো সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুদের সমালোচনায় তাঁর কি যায় আসে? আর আমরা যাঁরা তাঁর সমর্থক এবং ভক্তবৃন্দ। অন্ধই হই আর না হই। তাঁদের তো কোন অধিকারই নাই তাঁর কথার সমালোচনা করার। ফলে হাঁসখালির ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে তিনি মিলন মেলায় কি বললেন তাই নিয়ে এত হই এবং চই করার অধিকার তো কারুর নাই। 
আমরা মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধী হই কিংবা সমর্থক হই। তাঁকে তো আমরা নতুন দেখছি না! তাঁকে তো আর নতুন করে চেনার কিছু নেই। তিনি কখন কোথায় কি বলবেন। আর কখন কোথায় কি বলবেন না। আমরা রাজ্যবাসী হিসাবে সকলেই তা জানি। জানি বলেই, কেউ কেউ তাঁকে কোনদিনই ভোট দিই না। আর কেউ কেউ তাঁকে বারংবার ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে থাকি। ফলে ভোটও দেবো না। আবার সমালোচনা করবো। এ কেমন কথা? আর সমালোচনা করার থাকলে ভোট দেওয়াই বা কেন? ফলে ভোট দিয়ে তো আর সমালোচনা করার কোন অর্থ হয় না।

ফলে মিলন মেলায় হাঁসখালির ধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কি বললেন। সেই কথা তুলে দুইবেলা সমালোচনার ধুনুরিতে তাঁকে তুলোধনা করার তো কোন মানে হয় না। আমরা যাঁরা তাঁকে তিন তিন বার মুখ্যমন্ত্রী করে ছেড়েছি। তাঁরা কি তাঁকে এই প্রথম দেখছি? তাঁর কথা ও বার্তা। তাঁর আদব ও কায়দা। তাঁর চলন ও বলন। তাঁর বোধ ও বুদ্ধি। তাঁর নীতি ও নেতৃত্ব। কোনটিই তো আমাদের কাছে নতুন নয়। একই রকম ভাবে নতুন নয়। যাঁরা থাকে কস্মিন কালেও ভোট দেওয়ার কথা ভাবেন না। তাঁদের কাছেও। ফলে তিনি, যে কথাই যেখানে সেখানে বুলন না কেন। সেকথা রাজ্যবাসীর কারুর কাছেই নতুন নয়। অজানা কোন কথা নয়। তিনি তো এমন সব কথাই বলবেন। যা কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখেই শোভা পায় না। তাঁর আগে আমাদের রাজ্যের কোন মুখ্যমন্ত্রীর মুখেই কি আমরা এমন সব কথা শুনতে অভ্যস্থ ছিলাম কোনদিন? ছিলাম না বলেই না, আমরা পরিবর্তনের জন্য একেবারে হাঁসফাঁস করে উঠেছিলাম। এমন নিদারুণ ভাবেই হাঁসফাঁস করে উঠেছিলাম, যার ঠেলায় পরপর তিন খেপে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়েও আমাদের সেই খ্যাপামি খান্ত হয়নি এখনো। আর হবেই না কেন? প্রতিদিন টিভির পর্দায় চোখ রেখে তাঁর কথা ও বার্তা। চলা ও ফেরা। কাজ ও কর্ম। রকম ও সকম। এবং রীতি ও পদ্ধতি দেখে ও শুনে আমাদের প্রতিটি দিন সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। বাংলার রাজনীতির যে ইতিহাস। সেই ইতিহাসে প্রতিদিনই তিনি তাঁর আসন পাকা ও পোক্ত করে নেওয়ার কাজে ক্লান্তিহীন। আশা করি এই সত্যটুকু তাঁর অতি বড়ো নিন্দুকও অস্বীকার করতে পারবেন না।
পার্কস্ট্রীট কাণ্ডে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্যাতিতার পক্ষ না নিয়ে কথা বলায়। কামদুনি কাণ্ডে বাকিদের অনেকেরই বন্ধ চোখ খুলে গিয়েছিলো। তারপর থেকে রাজ্যবাসী মাত্রেই জানে। শাসকদলের চুনোপুটি নেতাই হোক। কিংবা নেতার ডান হাত কি বাঁ হাত হোক। কিংবা শাসকদলের ঝাণ্ডাবাহিনীই হোক। কিংবা সমর্থক হোক। তাঁদের নজর পড়লে রাজ্যের মেয়েরা আর নিরাপদ নয়। 
এটা কোন লুকানো কিংবা গুপ্ত তথ্যও নয়। রাজ্যের ঘরে ঘরে মায়েরা বোনেরা - দিদিমা কিংবা ঠাকুমারা, কাকিমা জেঠিমা থেকে মাসিমা পিসিমারা সকলেই এই সত্যটুকু জানেন। অথচ বর্তমান শাসকদলের সমর্থকদের ভিতরে এঁরাই কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ। দুয়ারে সরকারের লাইনে দাঁড়িয়ে এঁরাই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে পাঁচশো টাকায় নাম ও ধাম নথিভুক্ত করে রেখেছেন। ঘরে ঘরে ঢুঁ দিলেই সেই ছবিটি পরিস্কার হয়ে দেখা যাবে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর কথার সমালোচনা করার আগে. এই সত্যটুকু নিয়ে কথা বলা জরুরী নাকিঁ? আবার এটাও কিন্তু স্মরণে রাখা জরুরী। প্রতিটি ধর্ষণ কাণ্ডের সাথে জড়িত কুশীলবদের বাড়িতেই মা থেকে বোন। জেঠিমা থেকে কাকিমা। মাসিমা থেকে পিসিমা। ক্ষেত্র বিশেষে ঠাকুমা থেকে দিদিমাও বর্তমান। তাঁরা কি নিজ ঘরের ধর্ষকদের ধরে নিয়ে গিয়ে থানায় থানায় জমা দিয়ে আসেন? না আসবেন কোনদিন? ফলে মুখ্যমন্ত্রীর মুখের কথাই যে তাঁদেরও মুখের কথা নয়। তারও তো কোন প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। এখানে কে কার প্রতিনিধি। বলা মুশকিলই শুধু নয়। বলা অসম্ভবও।

কোনটা ধর্ষণ। আর কোনটা দুষ্টু দুষ্টু ছেলেদের খুনসুটি। সত্যি কি বলা সহজ? সেই খুনসুটি থেকে খুনখারাপি হলেই ‘দঁড়ি ধরে মারো টান’? এ কেমন কথা। এত জনবহুল একটি রাজ্য। সেখানে কে কোথায় কখন যৌন নির্যাতনের শিকার হবে। তখনই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কথা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে যাবে। এ কেমন কথা? তিনি একা মানুষ। দশভুজাও নন। অন্তর্যামীও নন। তাঁর একার পক্ষে সব সামলানো সম্ভব? প্রতিটি ঘটনার দায় কেউ একা নিতে পারে নাকি? প্রতিটি ঘটনার সাফাই দিতে গেলে যেকোন মানুষেরই মুখ ফস্কে বেফাঁস কথা বেড়িয়ে যেতে পারে। আর এখানে একটা গোটা রাজ্য চালানো। দুইশোর উপরে বিধায়ক নিয়ে রাজ্যের রাজনীতিতে করে কম্মে খেতে গেলে শাসকদলের ক্ষমতা বিন্যাসকে একেবারে নীচুতলা অব্দি পৌঁছিয়েই দিতে হবে। না দিতে পারলে তো জনগণের ভোটের উপরে শাসকদলের আর কোন নিয়ন্ত্রণই থাকবে না। আর সেটি না থাকলেই চৌদ্দোতলা থেকেই ধপাস! সে তিনিও জানেন। জানেন বলেই তাঁকে দুইদিক সামলিয়ে চলতে হয়। জনতাকে হাতে রাখতে হয়। আবার ভোটারকেও বুথে বুথে বেঁধে রাখতে হয়। জনতাকে হাতে রাখতে চৌদ্দোতলাই যথেষ্ঠ। কিন্তু বুথে বুথে ভোটারকে বেঁধে রাখতে শাসকদলের চুনোপুঁটিদেরও স্বাধীনতা দিতেই হয়। তারাই শাসকদলের প্রাণভোমরা। তারাই দিনের শেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নিশ্চিত করতে পারে। ফলে তাদেরকে দরকারে লাই দিতে হবে বইকি। আস্কারা না দিলে তাদের কি দায়। শাসকদলকে চৌদ্দোতলায় পৌঁছিয়ে দেওয়ার? সেই কাজও করবে আবার শরীর তেতে উঠলে শরীর ঠাণ্ডা করতে মেয়ে ধরে আনবে না। সে কেমন কথা?

সত্যিই এই এক স্বভাবদোষ আমাদের। ধর্ষণও নতুন কোন ঘটনা নয়। হাঁসখালি কাণ্ডও এই প্রথম নয়। কিন্তু একটা ঘটনা ঘটলেই হোল। কাজ নেই। কর্ম নেই। একেবারে হইহই রব। যেন এই প্রথম কোন অন্যায় ঘটনা ঘটলো। এর আগে যেন কোনদিন কোথাও এমন কিছু ঘটনি। মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখলে মনে নয়। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। আর বিরোধীদের তো কথাই নেই। সান্ধ্যটিভিতে সেজে গুজে বসে পড়লেই হলো। নয়তো রাস্তায় নেমে পড়ো দলীয় পতাকা হাতে। আরে বাবা। চৌদ্দোতলায় যে দলই গিয়ে বসুক না কেন। বুথে বুথে ভোটার বেঁধে রাখতে গেলে। সেই যাঁদেরকে দিয়ে রাজনীতি করতে হবে। তাদের শরীর গরম হলে সামলাবে কে? এই সোজা কথাটা জানে না কয়জন? সবাই সব জানে। অথচ দেখো। ভিজে বেড়ালটি সেজে কেমন মোমবাতি মিছিলে অংশ নিয়ে সেল্ফি দেবে সোশ্যাল সাইটে। এই হলো জনতা। সব ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ধর! চৌদ্দোতলায় গিয়ে বসলেই হলো? দল আর ক্ষমতা সামলানো সোজা কথা নয়। তাও আবার দশকের পর দশক। আগের সরকার জানতো না? কি করে কি হয়? মুখ্যমন্ত্রীর দিকে একটা আঙুল তুললে যে তিনটি আঙুল নিজের দিকে থাকে। সেকথা ভুলে গেলে হবে? আর আজকের প্রধান বিরোধী দল? তাদের শাসনের নমুনা কে না জানে? তাঁদের রাজ্যে রাজ্যে হাঁসখালি তো জলভাত। ফলে গণতন্ত্রের চর্চা হবে। নির্বাচনে জিততে হবে। বুথে বুথে ভোটারদের দখল নিতে হবে। আর নেতাকর্মীদের শরীর গরম হলেও মেয়েরা নিরাপদে থাকবে। সোনার পাথরবাটি আর কি?


১৬ই এপ্রিল’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.