শনিরবচন | হিজাব নিয়ে রাজনীতি

Michil শব্দের মিছিল ভাইরাল

রাজনীতির উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল। অন্তত উত্তরপ্রদেশ সহ বাকি পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের প্রাক্কালে গোটা দেশের অভিমুখ হিন্দু মুসলিমে ঘুরিয়ে দেওয়ায়। উত্তরাখণ্ড সহ উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী ভরাডুবি অনুমান করেই নির্বাচনের মূল বিষয়গুলিকে ধামাচাপা দিতে সুকৌশলে বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে হিজাব বিতর্ক উস্কে দেওয়া হয়েছে। ফলে সেই হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির পরিচিত ছকে গোটা দেশকে বেঁধে দেওয়ার পরিকল্পনাও সফল হয়েছে। মানুষ এখন দেশজুড়ে কর্মসংস্থান গড়ে না তোলার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মুখ খুলছে না। দেশের যুব সম্প্রদায় চাকরির দাবি ভুলে গিয়ে হিজাব ব্যান করার দাবিতে পথে নেমে পড়েছে। হিজাব ব্যান করা কেন প্রয়োজন, পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাসের মূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবি ত্যাগ করে জনসাধারণ সেই বিতর্কের পক্ষে বিপক্ষে ভাগ হয়ে গিয়েছে। কৃষকদের এমএসপি’র দাবি, লখিমপুর খিরি কাণ্ডে মুল অভিযুক্তের হঠাৎ জামিন পাওয়া। সেই বিষয়ও খবরের আড়ালে চলে গিয়েছে। সরকারী সম্পত্তি জলের দরে বিশেষ কয়েকজন ধনকুবেরর হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে জনগণের আর মাথা ব্যথা রইল না। জনগণের দায়িত্ব নেওয়া সরকারের, কর্পোরেট গোষ্ঠীর স্বার্থে জনগণকে বলির পাঁঠা করে রাখা নিয়েও জনতা আর ভাবিত নয়। গত সাত আট বছরে প্রতিদিনের জীবনযাপনে নাভিশ্বাস উঠে গেলেও। জনতার চিন্তা এখন হিজাব পরা না পরা নিয়ে।

সত্যিই তো। একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় পোশাক পরে শিক্ষার্থীদের ঢুকতেই বা দেওয়া হবে কেন? বিশেষ করে সেই ধর্ম যদি ইসলাম হয়। একই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখ ছাত্ররা অবশ্যই মাথায় পাগড়ি বেঁধে ঢুকতে পারবে। কারণ সেটি ইসলাম ধর্ম নয়। যুদ্ধটা শুধুই ইসলামের বিরুদ্ধে। আর শিখধর্মের মূল পরিচয়ই যেখানে মাথায় পাগড়ি। সেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেই ধর্মীয় পরিচয় বহন করতে দিতে হবে বই কি। কিন্তু তাই বলে একই যুক্তিতে তো আর মুসলিম ছাত্রীদেরকে মাথায় হিজাব পরে ঢুকতে দেওয়া যায় না। এই সোজা কথাটা বুঝে নিলেই আর বিতর্ক থাকে না। দেশটা ভারতবর্ষ। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ কারা? অবশ্যই সেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের হুকুমনামাই শেষ কথা। সেই কথাই যুক্তি। আর সেই যুক্তই তো আইন হওয়া উচিত নাকি? সেই আইন সকলের জন্যেই সমান। সেটাই তো অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হওয়া উচিৎ। আর সেই দিকেই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে শাসক এবং সরকার। আমাদের কাজ তাদের পরিকল্পনাকে সফল করে তোলা। অভিন্ন দেওয়ানিবিধি সেটাই। যেটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ঠিক করে বেঁধে দেবে। যার উপরে আইন থাকবে না। আদালত থাকবে না। সংবিধান থাকবে না। যুক্তি থাকবে না। তর্ক থাকবে না। নীতি থাকবে না কোন। সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসক শ্রেণীর ইচ্ছাই সংবিধান। তাদের লক্ষ্যই আইন। তাঁদের স্বার্থই আদালত। শিক্ষাঙ্গন থেকে হিজাব নিষিদ্ধ করা সেই পথেরই প্রথম ধাপ। না, আদালত যদিও এই বিষয়ে রায়দান করেনি এখনো। কিন্তু রায়দানের আগে পর্য্যন্ত ধর্মীয় পোশাক পড়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার উপরে নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে। ফলে আপাতত হিজাব পরে আর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা যাবে না। না, পাগড়িও এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ছে কিনা। সেই বিষয়ে নিশ্চুপ আদালত। দেশের মানুষও জানে পাগড়ি আর হিজাব এক নয়। একই নিয়ম কানুন আইন, পাগড়ি ও হিজাবের জন্য নিশ্চয়ই প্রযোজ্য নয়। তাই পাগড়ি নিষিদ্ধের দাবিতে কোন আন্দোলন নাই। আন্দোলন দানা বেঁধেছে হিজাব নিষিদ্ধের দাবিতে।

পাগড়িতে হিন্দুধর্ম বিপদগ্রস্ত নয়। হিন্দুধর্ম বিপদগ্রস্ত হিজাবে। তাই হিন্দুধর্মকে রক্ষা করতে গেলে। হিজাব নিষিদ্ধ করতে হবে বইকি। ভারতবর্ষে থাকবে। আবার হিজাব পড়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে যাবে সরকারী অনুদানে। না, সেটি তো আর হতে দেওয়া যায় না। 
এই সোজা কথাটা ভারতবাসীর দেশভক্ত জনগণ সকলেই বুঝে গিয়েছে। বাকি যারা তর্ক করছে হিজাবের পক্ষ নিয়ে। তারা কেউই দেশভক্ত নয়। তারাই বিদেশী শক্তির মদতদাতা। তারাই বিধর্মী ইসলামের সমর্থক।
 তারাই দেশের পয়লা নম্বর শত্রু। ফলে ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে হলে শিক্ষাঙ্গন থেকে হিজাব নিষিদ্ধ তো করতেই হবে। কে দেশভক্ত। আর কে দেশদ্রোহী। আজকে সেটি চিনে নেওয়ার সময়।

হিজাবের সমর্থনে তর্ক করার একটাই অর্থ। নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার হরণ। যেটি ইসলাম ধর্মের মূল বৈশিষ্ট। নারীকে বোরখা পড়িয়ে রেখে তাকে পুরুষের দাসানুদাসে পরিণত করে রাখার সংস্কৃতি নিশ্চয় ভারতীয় সংস্কৃতি হতে পারে না। হ্যাঁ অনেকেই হিন্দু রমণীর ঘোমটা দেওয়ার প্রথা নিয়ে তর্ক শুরু করতে পারেন বইকি। এই নিয়ে তারাই তর্ক শুরু করবেন। যারা দেশভক্ত হিন্দু নন। ঘোমটা আর হিজাব এক হলো? ঘোমটা সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি। নারীর শোভা। নারীর শালীনতা রক্ষার রক্ষাকবচ। আর হিজাব মুসলিম রমণীকে পরাধীন করে রাখার অস্ত্র। একটি অপসংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতিকে সেকুলারিজমের ধ্বজা উড়িয়ে প্রশ্রয় দেওয়ার দিন শেষ। ভারতবর্ষ এখন হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিমুখে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফিরে তাকানোর আর দরকার নেই।

ঠিক এইভাবেই অধিকাংশ মানুষকে একসাথে ভাবতে বাধ্য করার আর এক নাম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সর্বোত্তম পীঠস্থান ভারতবর্ষ। এরই প্রতিক্রিয়ায় দেশবাসীর সংখ্যালঘু অংশ যত তীব্রভাবে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে পারবে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এইখানেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জীয়নকাঠি। আর সেই জীবনকাঠিকে নিয়মিত সঞ্জীবনী সুধা জুগিয়ে তোলাই শাসক শ্রেণীর সর্বপ্রধান কাজ। সেই কাজের সাফল্যের উপরেই আবার নির্ভরশীল কর্পোরেট স্বার্থ। ভারতবর্ষের সম্পদের উপরে মালিকানা প্রতিষ্ঠার এমন সুবর্ণ পথ আর নাই। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিভেদ ও হিংসায় জনগণকে বেঁধে রাখতে পারলেই কেল্লাফতে। সদর দরজায় গৃহস্থকে ব্যস্ত রেখে খিড়কি দিয়ে ঘর সাফ করে দাও।

উত্তরপ্রদেশ উত্তরাখণ্ডের মসনদ ধরে রাখতে না পারলে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে দেশজুড়ে সাফল্যের সাথে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যে মোটেই সহজ হবে না। সেটি সাম্প্রদায়িক শক্তির অক্ষ খুব ভালো করেই জানে। আর জানে বলেই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে ভরাডুবির আশংকায় তারা মরিয়া হয়েই কর্ণাটকে হিজাব তাস খেলে দিয়েছে। এবং অত্যন্ত কুশলী ভাবে সেই তাস খেলা হয়েছে। যাতে মানুষের ভিতরে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে ধুমায়িত করে দেশব্যাপী একটা আলোড়ন তুলে দেওয়া যায়। যে আলোড়নে শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত। ধনী থেকে দরিদ্র্য। সকলেই মাঠে নেমে পড়তে পারে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ যত বেশি মন্থন করা হতে থাকবে। ভোটের বাক্স ততই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকবে সাম্প্রদায়িক শক্তি অক্ষের সমর্থনে। বিধনসভা নির্বাচনের ফলাফলে যার প্রমাণ পাওয়ার বিষয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির অক্ষ বিশেষ ভাবে আশাবাদী।

হ্যাঁ, নির্বাচনী ফলাফলে তাদের যদি আশাভঙ্গ হয়ও। পরবর্তী লড়াইয়ে তাদের রাজনৈতিক শক্তিতে কোন ঘাটতি পড়ার সম্ভাবনাই থাকবে না। একটি হিজাব বিতর্কে যে পরিমাণ সাম্প্রদায়িক জলঘোলা হচ্ছে, তাতে পরবর্তী রাজনৈতিক লড়াইয়ে তারাই কয়েক কদম এগিয়ে থাকবে। বাকিদের থেকে। একুশ শতকের ভারতবর্ষে সেই নিশ্চয়তাটুকু তারা তৈরী করে নিতে পেরেছে। বিগত এক দশকে।

হিজাব বিতর্ককে ঘিরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত কোন দিকে এগিয়ে চলবে। সেটি ভবিষ্যতই ঠিক করবে। কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একটি বড়ো অংশই যে বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর ক্রীড়নকে পরিণত হয়েই সমাজদূষণের কাজ চালিয়ে যেতে থাকবে, সেকথা নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যায়। এই কথা বলার যথেষ্ঠ কারণ যে রয়েছে। সেকথা পূর্বেই আলোচনা করে দেখানো হয়েছে। সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা চিরকালই বীভৎস রূপ ধারণ করে থাকে। দেশ কাল গোষ্ঠী নিরপেক্ষ ভাবে মানুষের ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়। এখন প্রশ্ন মূলত একটি। ভারতবর্ষ তার চিরন্তন আদর্শকে ভুলে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতার কাছে নতজান হবে কি হবে না। তার উপরেই ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ভর করছে। নতজানু হলে তার ফল যেমন মারাত্মক হবে। নতজানু না হলে দুই পক্ষের ভিতরে গৃহযুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি গড়ে ওঠাও বিচিত্র নয়। যদিও ভারতবাসী প্রকৃতিগত ভাবেই যুদ্ধবাজ নয় ইউরোপীয়ানদের মতো। ফলে গৃহযুদ্ধের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়িয়েও সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে যে জনজাগরণের প্রয়োজন। ভারতবর্ষকে অগ্রসর হতে হবে সেই অভিমুখে। সেখানেই ভারতবর্ষের আসল পরীক্ষা। সাফল্য ব্যর্থতা সবটাই ভারতবাসীর হাতে। বাকিটা সময়ই উত্তর দেবে।


১২ই ফেব্রুয়ারী’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.