(ক)
___'আজ কেমন ছিল? দুপুরে ঘুমিয়েছিল?'
__' হুঁ! ঘুমোবে!'
একরাশ বিরক্তির সাথে উত্তর দিয়ে রঞ্জনের হাত থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে সুধা ভিতরের ঘরে চলে গেল। রঞ্জনও অসহায় মুখে ক্লান্ত শরীর'টা চেয়ারে ফেলে জুতোর ফিতে'তে টান দিল। কী যে করবে? সুধাকে দোষও তো দেওয়া যায় না।বেচারি মাস কয়েক আগেই গল-ব্লাডারের অপারেশন সেরে ফিরেছে, সেইভাবে আরাম করার সময়টুকুও পেলো না। সংসারের পাহাড় সমান চাপ ওর উপর।আর এদিকে রঞ্জনের সমবেদনা জানানো ছাড়া কিছু করে দেওয়ার উপায়ও নেই। নতুন ব্রাঞ্চ, নতুন টার্গেট...সব মিলিয়ে ওর নিজেরও নাভিশ্বাস ওঠার মতো অবস্থা।
__"বাথরুমে গরম জল দিয়ে দিয়েছি, হাতমুখ ধুয়ে নাও, তারপর পারলে রাতের খাবারটা খাইয়ে দিও...আমার উপর রাগ! আজ আর আমার হাতে খাবে না।"
__"কেন?"
খুলে যাওয়া চুল আলগোছে খোপা করে সুধা মেঝে থেকে ছেলের খেলনাগুলো কুড়োতে লাগলো,
__"কেন আবার? রোজই তো নতুন নতুন বায়না হচ্ছে, আজকের বায়না ছিল ' ছাদে যাবো, রোদ খাবো, ঘুড়ি ওড়ানো দেখবো, ভোক্কাট্টা শুনবো'...কত বোঝালাম দুপুরে একটু ঘুমনো দরকার না হলে শরীর খারাপ করবে, কিছুতেই শোনে না। সারা দুপুর ঐ চলল। ফলের রসটা খাওয়াতে গেলাম, এমন করল পুরো রস'টা বিছানায় পড়ে যা-তা অবস্থা, শেষে ময়নাকে দিয়ে আবার বিছানা পাল্টালাম।"
কথাগুলো শেষ করে সোফায় বসল সুধা।
__" তুমি পেট খালি রাখছো না তো? জানি কাজের চাপ প্রচুর, তবুও খাওয়াটা সময় মত সেরে নিও সুধা, তা নাহলে আবার..."
সুধার জন্য রঞ্জনের তরফ থেকে এইটুকু মৌখিক মলমই অনেক,নিমেষে সুধার ভিতর'টা গলে গেল,
__"বাদ দাও আমার কথা, আমাকে নিয়ে অত ভাবতে হবে না... বলছি, আমি আজ থাকতে না পেরে খুব বকেছি জানো? পরে নিজেরই খুব খারাপ লাগছিল, বুঝি অধৈর্য্য হওয়া ঠিক নয়...আসলে রাগ উঠে যায় খুব।"
সুধার দু-চোখ ভিজে এলো, রঞ্জন কী বলবে বুঝতে পারলো না, সুধার মেজাজ হারিয়ে কড়া কথা বলাকে রঞ্জন এক্কেবারেই মেনে নিতে পারে না, কষ্ট হয় খুব, ওই অসহায় প্রাণটার জন্য... কিন্তু সুধাকেই বা কী বলবে? সেও তো সেই মানুষ, রক্ত মাংসের...ধৈর্যের সীমা তারও ছাড়াবে, স্বাভাবিক।স্থির চোখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো রঞ্জন, তারপর কাঁধে গামছা ফেলে বাথরুমে যেতে যেতে বলল,
__"খাবার'টা রেডি কর, ফ্রেশ হয়ে এসে খাইয়ে দেবো"।
রঞ্জন আর সুধার ছ' বছরের ছেলে মানি'টা যত বড় হচ্ছে তত ওর দৌরাত্ম্য আর বায়না বেড়ে চলেছে... আসলে ছেলেবেলা তো এমনই হয়! দুষ্টুমিতে ভরা। আর অন্যদিকে রঞ্জনের বাবা, তাঁরও তো এটা দ্বিতীয় ছেলেবেলা, আলহাদ- আব্দার তাঁরও কিছু কম নয় এখন। এদের চাহিদাগুলো মেটাতে গিয়ে মাঝখান থেকে সুধাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আজকাল কেমন যেন আলুথালু বেশে থাকে, ভালো করে চুলও আঁচড়ায় না। আগে কী সুন্দর সন্ধ্যে হলে সিঁদুরের টিপ পরতো, গা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ বেরোতো...কিন্তু এখন সাজগোজ তো দূরে থাক উল্টে সবসময় চোখেমুখে বিরক্তি আর খিটখিটে মেজাজ। এখন আর আগের মত কোনো আদুরে অভিযোগ, অভিমানী কান্না শোনা যায় না সুধার থেকে। সারাদিনে কথাই বলে না সেরকম, আর বললেও নিছক কাজের কথা। আর বিছানায় আসা মাত্রই এমন বেঘোরে ঘুম দেয় যে রঞ্জন কিছু চেষ্টাও করে না, বড় মায়া হয় ওই ঘুমিয়ে থাকা মুখটা দেখে।
এদিকে সুধা জানে অভিযোগ, অভিমান করে লাভ নেই। কার কাছে করবে? যার কাছে করবে সে নিজেই তো অসহায়! বাড়ির একমাত্র রোজগেরে সদস্য। শ্বশুরের যা পেনশন তা শ্বশুরের ওষুধেই চলে যায়। মানি বড় হচ্ছে, খরচা বাড়ছে, আরও বাড়বে। একটাই ছেলে, কোনো রকম খামতি রাখতে চায় না দুজনে। রঞ্জন সাধে ওভারটাইম করে না। আর তাই হাড়ভাঙা খেটে রাতে যখন বাড়ি ফেরে তখন সুধার আর কিছু চাওয়ার থাকে না রঞ্জনের কাছ থেকে, সারাদিন ধরে বুকের মধ্যে জমতে থাকা অভিযোগ আর ক্ষোভগুলোকে একপ্রকার জোর করেই গিলে নেয়। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে কোথাও যদি চিরকালের মত হারিয়ে যাওয়া যেতো! কিন্তু উপায় যে নেই! খানিক চেঁচামেচি করে নিয়ে নিজেই নিজেকে সামলে নেয়, ভাবে জীবন তো লাটাইয়ের সুতোয় বাঁধা, চাইলেই তো হারিয়ে যাওয়া যাবে না, ভেসে বেড়াতে হবে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না সূতো কাটছে, মুক্তি আসছে।
(খ)
বাথরুম থেকে বেরিয়ে রঞ্জন চায়ের কাপ'টা নিয়ে কোণের দিকের ঘরটায় গেল, বিছানার কাছে একটা চেয়ার টেনে বসল। কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
___"দুপুরে ঘুমিয়েছিলে?"
সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুয়ে থাকা প্রাণটার অভিমানী চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। উত্তর এলো,
___" নাহ! কত করে বললাম ছাদে যাবো, আমায় ছাদে নিয়ে চল, নিয়ে গেল না, বকে দিল"।
__"ওহ, আচ্ছা আমি দেখছি...তা তুমি ছাদে গিয়ে কী করবে?"
রঞ্জন বুকে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল।
__"কত সুন্দর রোদ থাকে ছাদে, আমি দুপুরে ছাদে গিয়ে বসবো!"
__"তা তুমি দুপুরবেলা রোদ চাও তাই তো? তা ঠিক আছে এই উঠোনে তক্তা পেতে দেবো, তুমি সেখানে রোদ খাবে, দাঁড়াও আমি কথা বলে নিচ্ছি আর কাল সকালেই তক্তার ব্যবস্থা করছি!"__
__"না উঠোনে হবে না, ছাদে যাবো, আমি ছাদেই যাবো... কেউ না নিয়ে গেলে আমি একাই যাবো, আমি কি একা যেতে পারি না?"___
রঞ্জনের ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি, ছেলেমানুষি জিদ দেখে।মায়াও হয় খুব রকম। পুরো ব্যাপারটাই খুব স্পর্শকাতর।আর তাই খুব সন্তপর্ণে একটু একটু করে মনের কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে রঞ্জন, মন'টা ঠিক কী চাইছে।
__"কে বলল তুমি একা একা ছাদে যেতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। কিন্তু আমায় বল তো, ছাদে কি শুধু রোদের জন্যই যেতে চাও, না আরও অন্য কিছু?"__
রঞ্জনের এই প্রশ্নটারই যেন অপেক্ষা করা হচ্ছিল।প্রশ্ন শুনেই বুকের মধ্যেকার অদম্য ইচ্ছেটার বাঁধ ভেঙে ঝরঝর করে উত্তর এলো।
___"ঘুড়ি দেখবো বলে, আকাশে হরেক রঙের ঘুড়ির মেলা, ভোক্কাট্টা শুনবো, ঘুড়ি কেটে যখন ভেসে অনেক দূরে চলে যাবে সেটা দেখবো... নিয়ে যাবি? চল্ না!"
(গ)
রথীন্দ্র পালের বয়স সাতাশি ছুঁইছুঁই। শরীর বরাবরই একটু রুগ্ন ছিল তবে এখন বয়সের ভারে প্রায় অথর্ব। স্ত্রী কল্পনা চলে গেছে আট বছর। কল্পনার অভাব রথীন্দ্রের মনস্তাত্ত্বিক দিকটার উপর প্রভাব ফেলেছে বেশ। বিস্মৃতি, ছেলেমানুষী জিদ, অভিমান ইত্যাদি দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। ওদিকে শরীরও হাল ছেড়ে দিচ্ছে। এখন বাথরুম যেতে হলেও হাত ধরার জন্য লোক লাগে। ময়নাকে সেই জন্যই রাখা।
___" চলো বাবা, ময়নার কাছে তাড়াতাড়ি গা মুছে নাও, দিয়ে চল আমরা..."
রঞ্জন কথাটা শেষ করল না, তাকিয়ে রইল রথীন্দ্রের কৌতূহলী দু-চোখের দিকে, চোখদুটো সত্যি জ্বলজ্বল করে উঠলো, মুখটা হাঁ করা, যেন কিছু বলবে কিন্তু দাঁতহীন মাড়িদুটো শব্দ খুঁজে চলেছে শুধু।
__"ছাদে যাবো,তুমি আর আমি... যাবে তো? ঘুড়ি ওড়ানো দেখবে তো?"
__"ভোক্কাট্টা!"
একগাল হাসি নিয়ে রথীন্দ্র অস্ফুটে বলল। তারপর কাঁপাকাঁপা হাতে রঞ্জনের কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে,
__"ওনাকে বলেছ?"
__"কাকে?"
__"মা মনসা'কে?"
ফোকলা মুখে অস্পষ্ট উচ্চারণে বলেই রথীন্দ্র জিভ কাটলো। রঞ্জন হো হো করে হেসে উঠে,
__"সুধার কথা বলছ! তা ওই তো বলল 'আজ ছুটি নিয়ে নাও, দিয়ে দুপুরে বাবাকে ছাদে ঘুরিয়ে আনো...।"
রথীন্দ্রের মুখটা নিমেষে লজ্জায় ছোট হয়ে গেল।
__"সত্যি বলছিস?"
__"একদম সত্যি। বলল, আমরা তো আর বাবাকে সামলে ধরে ছাদে নিয়ে যেতে পারবো না, তুমি বরং থাকো আজ।আমিও ভেবে দেখলাম ছুটি যখন হাতে আছে তখন একটা নিয়েই নিই... আমার বাবার ভোক্কাট্টা দেখার শখ জেগেছে!"
রঞ্জন দেখলো তার বাবার মুখ জুড়ে তখন দ্বিতীয় শৈশবের উচ্ছ্বাস।
(ঘ)
পৌষ মাসের মাঝামাঝি। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। একটা হিমেল হাওয়া থেকে থেকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তবে ঝলমলে সোনালি রোদে চারপাশটা বেশ প্রাণবন্ত। আর আকাশজুড়ে ঘুড়ির মেলা আর সেই নিয়ে ছেলে-ছোকরাদের তুমুল হুল্লোড়। সব মিলিয়ে যেন চারিদিকে একটা উৎসবের আমেজ।
__"কেমন লাগছে তোমার বাবা?"
ফোল্ডিং ইজি চেয়ারে বসা রথীন্দ্রের দু-চোখ তখন আকাশে, দাঁতবিহীন মাড়ি দুটোয় হাসির বন্যা। ছেলের প্রশ্নে ঘাড় নেড়ে,
__"ভালো, ভালো লাগছে রে!"
__"ঘুড়ি ওড়াবে? আনবো নাকি?"
জিভ কাটলো রথীন্দ্র। তারপর শুকনো মুখে,
__"আর কি পারি? বসে বসেই দেখি বরং..."
রঞ্জন তার বাবার বুকে-পিঠে বার কয়েক হাত বুলিয়ে তার পা'য়ের কাছে বাবু হয়ে বসল।
__'তোর মা আর আমি এরম ছাদে বসে ঘুড়ি ওড়ানো দেখতাম জানিস! তুই তখন হস্টেলে।শীতে ছুটির দিন গুলোয় দুপুরের ভাত'কটা খেয়ে রেডিও নিয়ে ছাদে চলে আসতাম, তোর মা উল কাঁটা নিয়ে বসতো। গল্পগুজব করতাম...বেশ ছিল সেইসব দুপুরগুলো।'
একটানা অনেকগুলো কথা বলে একটা লম্বা শ্বাস নিল রথীন্দ্র। আজকাল খুব হাঁফ আসে কথা বললেই।
রঞ্জন বুঝতে পারলো বাবার মন'টা ভারি হয়ে আসছে। সেই মনে কিছু আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করে, বিষ্টুদের ছাদের দিকে হাত দেখিয়ে,
__"ঐ দ্যাখো ওখানে লেগেছে, পেটকাটিটা এবার গেল বোধহয়।"
আরাম চেয়ারে রাখা বালিশে মাথা দিয়ে নীল আকাশে এক্কেবারে উপরে উড়তে থাকা পেটকাটিটার দিকে চোখ রেখে ধীরস্বরে রথীন্দ্র বলল,
__"জানিস বাবু আমরা মানুষেরা হলাম এক একটা ঘুড়ি! লাটাইয়ের মাঞ্জাটা আমাদের ভাগ্য, যেদিকে যখন টেনে নিয়ে যায় যেতে হয়, ভেসে বেড়াতে হয় জীবনের আকাশে। কখনো উপরে ওঠা তো কখনো নিচে নামা..কখনো স্থিরতা তো কখনো চরম অনিশ্চয়তা, আর লাটাই হাতে আমাদের চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের বিধাতা...আমরা ঘুড়ি নই তো আর কী? ঘুড়ির মতই তো সামনে আসা বিপত্তিগুলোর সাথে লড়ি, টিকে থাকি। আর যখন দম ফুরিয়ে যায় তখনই ভোক্কাট্টা! গল্প শেষ...।"
কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ। রঞ্জন জানে এইসব মুহুর্তগুলো নীরবতা দাবী করে, শব্দ বা ভাষা সেখানে অনাঙ্ক্ষিত। জীবনের সায়াহ্নকালে এসে একটা সঙ্গীহারা অথর্ব মানুষের বুকে কী কী অনুভূতি জাগে তা রঞ্জনের হয়তো নিজের জীবন দিয়ে বোঝার মত সময় হয়নি, তবে সন্তান হিসেবে এতটাও অক্ষম নয় যে বাবার অভিমানগুলোকে সে আঁচ করতে পারবে না! অথর্বতা সত্যিই বড় করুণ বাস্তব! যে মানুষ'টা একদিন গোটা সংসারটাকে টেনেছে আজ তাকেই টেনে নিয়ে চলা যেন অতি বড় দুষ্কর কাজ!...যে মানুষ'টার কাঁধে আর পাঁচটা মানুষের ভবিষ্যৎ ছিল আজ তার ভবিষ্যৎ বলতে শুধু একটা ক্ষণের অপেক্ষা...কারণ আর তো কিছু দেওয়ার নেই এই মানুষ'টার, তাই যেন আর কিছু পাওয়ারও নেই! কী অদ্ভুত এই সংসার আর সংসারের রীতি! এক ছাদ রোদ আর এক আকাশ হুল্লোড়ের মাঝেও রঞ্জনের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
__"বাবা, তোমার মা'কে খুব মনে পড়ছে, তাই না?"
__"তাকে আর ভুললাম কই রে? কিন্তু সে যে বড্ড বেইমান, উলকাঁটা'টা রেখে হুশ করে উড়ে গেল! একবার ভাবলোও না এই বুড়োটার কথা!...মহা পাজী মহিলা!"
রথীন্দ্রের গলায় এবার ভাঙন শোনা গেল যেন।রঞ্জন তার হাতদুটো নিজের হাতে চেপে ধরে হৃদয়ের নিখাদ উষ্ণতা তার শরীর-মনে ছড়িয়ে দিয়ে,
__" আমরা আছি তো বাবা!"।
রথীন্দ্র চেয়ে দেখলো একবার, তারপর ঘাড়'টা আবার বালিশে রেখে,
__'জানিস রঞ্জু, ভোক্কাট্টা শব্দটায় অদ্ভুত একটা আবেশ আছে...যেন একটা দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর মুক্তি, চরম মুক্তি। ভোক্কাট্টার পর ঘুড়ির সেই হেলতে দুলতে দূরে, অনেক দূরে চলে যাওয়াটা, যেন অজানা কোনো দেশে...! অদ্ভুত সেই দৃশ্য!"
তারপর খানিক চুপ থেকে,
___" জানি তোরা সকলেই আছিস, কিন্তু আমি ভাবি আমি কেন আছি!"
(ঙ)
আকাশজুড়ে ধীর পায়ে বিকেল নেমে আসছে , হাওয়া ঠান্ডা হতে শুরু করেছে, পাখিদের অল্পস্বল্প কিচিরমিচির শোনা গেলেও তা আশেপাশের ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেদের উল্লাসে ফিকে পড়ে যাচ্ছে প্রায়।যদিও এবার লাটাইগুলো সব উল্টো দিকে পাক খেতে শুরু করেছে। ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসবে যে। শীতকালের এই এক অদ্ভুত রূপ... ঝলমলে, উষ্ণ দুপুর পেরিয়ে যখন বিকেল নামে তখন কেমন একটা থমথমে, মন ভারী করা আবহাওয়ায় চারপাশটা ছেয়ে যায়।কেমন জানি একটা পুরনো মনখারাপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।কী যেন হারিয়ে গেছে, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে...এইরকমই একটা অনুভূতি হয়। শীতের দুপুরে ফুরফুরে হয়ে থাকা মনটা বিকেল এলেই হঠাৎই কেমন উদাস হয়ে যায়।
রঞ্জনের মন'টা বেশ ভাবুক। রথীন্দ্রও দূর আকাশে চোখ মিলে ঘুড়ির গতিপ্রকৃতি দেখছে, আর মনে মনে নিজেকেও লাটাইয়ের সূতোয় বাঁধা জীবনের আকাশে উড়তে থাকা এক ক্লান্ত অবসন্ন ঘুড়ি মনে করছে বোধহয়...এখন তো শুধু মুক্তির অপেক্ষা, ভোকাট্টার অপেক্ষা।
এমন সময়ই ছাদের বাঁদিকের বাড়িটা থেকে তুমুল শব্দ ভেসে এলো। কানফাটা উল্লাসে চারপাশ কেঁপে উঠেছে প্রায়। রঞ্জন উঠে গিয়ে রেলিঙের কাছটায় দাঁড়ালো।
__"ঐ দ্যাখো বাবা ভোক্কাট্টা হয়েছে! আমাদের রমেশদা'দের বাড়ির ছেলেগুলো কেটেছে, মজুমদারের নাতির ঘুড়িটা মনে হচ্ছে... হ্যাঁ হ্যাঁ মজুমদারের নাতিরই।যাক তোমার অপেক্ষা সার্থক হল, ভোক্কাট্টা হল, এবার নাও দ্যাখো কেমন হেলতে দুলতে ঘুড়ি চলল অজানা দেশে"।
কথাগুলো বলেই একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে পিছন ঘুরে তাকালো। রথীন্দ্রর মাথাটা বালিশ থেকে ঝুলে পড়েছে সামান্য, চোখ তখনও আকাশে, ফোকলা মুখ হাঁ করা, যেন মনেপ্রাণে প্রাণবায়ু আহরণ করছে। রঞ্জন কাছে এলো, স্থির চোখে কিছুক্ষণ দেখলো, তারপর দাবা গলায়__
__"চল বাবা, ঠান্ডা পড়ছে, নিচে যাই"।
রথীন্দ্রের মাথাটা বালিশে তুলে রাখলো রঞ্জন।তারপর চটি দুটো রথীন্দ্রের পায়ে পরিয়ে দিতে যাবে অমনি রথীন্দ্রর মাথাটা আবার বালিশ থেকে কাত হয়ে ঝুলে পড়লো। রঞ্জনের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো, কী যেন একটা আশঙ্কায় সে আরাম-চেয়ার থেকে দু'পা সরে দাঁড়ালো। আর ঠিক তখনি আরও একবার কোথাও দূর থেকে 'ভোক্কাট্টা' শব্দটা আকাশ ফুরে রঞ্জনদের ছাদে এসে আছড়ে পড়লো। রঞ্জন তাকিয়ে দেখলো দূরে একটা ঘুড়ি ভেসে চলে যাচ্ছে, অজানা দেশে...মুক্তি পেয়ে।
Tags:
গল্প