কৃষ্ণা কর্মকার | কী জাদু টুসুর গানে

ভাষা দিবস শব্দের মিছিল

চলন্ত ট্রেনের জানালার ধারে বসেও তপাই খোলা ডায়রির পাতায় বুঁদ হয়ে আছে দেখে সৈমন্তী একটু অবাকই হলো। আগে যে ক’বার ওরা একসাথে ট্রেনসফর করেছে, সে ক’বারই ও খেয়াল করেছে, ট্রেন যত ছোটে তপোব্রতর মুখ ছোটে তার বেশি। নানা জায়গার নানারকম গল্প এতই ওর ঝুলিতে আছে, যে জার্নিতে মুহূর্তের জন্যও বোর হতে হয় না। অথচ আজ – ! ও গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে কথা শুরু করতে চাইলো -


-- তপু, তুই কি কাজটা নিয়ে খুব টেনসড?

-- না, সেরকম কিছু না।

-- ট্রেন চলছে হু হু করে, দুপাশের ছবিগুলো দৌড়চ্ছে প্রাণপণে, তুই সেসব না দেখে ডায়রিতে বুঁদ হয়ে আছিস। এটা তোর পক্ষে খুব বেমানান না?

-- বেমানান? হবে। কিন্তু আজ আমার মনটা সত্যি ওই একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে সুমি। ‘বাঙালি ইতিহাস বিস্মৃত জাতি’, এই বদনামটা কি কখনো ঘুচবে না?

-- তুই এখনো ওটা নিয়েই পড়ে আছিস?

-- না রে, পড়ে থাকতে পারছি কোথায়?

-- দেখ, আমার মনে হয়, তুই এটা নিয়ে একটু বেশি ভাবছিস। আমাদের হাতে যেটুকু তথ্য এসেছে, তা দিয়ে একটা কমপ্লিট ডকুমেনট্রি দিব্যি নামানো যাবে। 
সুতরাং –

-- সুমি এটাই কি শেষ কথা? আমরা যা পেয়েছি, যা জেনেছি, তার বাইরে যে বিশাল একটা অজানা ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে, এটা নিয়ে তোর আফশোস হচ্ছে না?

-- তাতে তো আমাদের কোনো হাত নেই। আমাদের আগের জেনারেশনই তাকে ধরে রাখে নি তো আমরা কী করবো?

-- তুইও তো ঠিক ওই জেনারেশনটার মতোই দায় এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলছিস।

-- তাহলে তুই বল আমাদের কি করার আছে? ইমাজিনেশন?

-- রাইট। রাইট, ইমাজিনেশন। একটা পোল থেকে আরেকটা পোলের মাঝে যে গ্যাপটা আছে, তাকে জ্যামিতির মতো কল্পিত রেখা দিয়ে আমাদের জুড়তে হবে।

-- কল্পনা? সে তো সিনেমা হয়ে যাবে? কিন্তু ডকুমেনট্রি?

-- তথ্য ধরে ধরেই মাঝের ফাঁকগুলোয় একটা যুক্তিযুক্ত বুনন চাই সুমি, নইলে পরের প্রজন্মের কাছে আমরাও আমাদের আগের জেনারেশনের মতোই স্বার্থপর হয়ে যাবো।

-- রাহুলদা মানবে? প্রডিউস করবে তো আমাদের কাজটাকে? যদি করেও, পাবলিক ছেড়ে দেবে? মিডিয়া? অ্যাণ্টি-রিভিউ দিয়ে পেড়ে ফেলবে পুরো টিমটাকে।

-- ছেড়ে দেবো আমি কাজটা। করবোনা। তুই কর, যা পারিস।

-- আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি কি একা করবো বলেছি? নাকি তোকে বাদ দিয়ে আমি কিছু করতে পারবো?

-- তাহলে একবার আমার মতো করে ভাব। ফিরে যা মনে মনে ওই দিনগুলোতে – চোখ বন্ধ করে দেখ, সেই দিনগুলোর শ’য়ে শ’য়ে ছবি একের পর এক ধেয়ে আসছে মাথার ভিতরে। আসছে – তোলপাড় তুলছে বুকের ভিতর – তারপর সরে যাচ্ছে, আবার একটা আসছে, আবার একটা, আবার –একটার পর একটা ছবির মিছিল যেন। কান পেতে শোন, এই ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে আসছে সেই হাজার কণ্ঠের কলরোল ....

একটানা কথা বলতে বলতে তপাই হঠাৎ খেয়াল করলো, ট্রেনের যাত্রীরা ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। কেমন অবাক হওয়া চাউনি ওদের চোখে। একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল বেচারা। সৈমন্তীও কেমন চুপ করে গেছে, ও কি লজ্জা পেলো ওর তপুকে নিয়ে? ও সৈমন্তীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

-- সরি সুমি, আমি তোকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাই নি।

-- কীসের অস্বস্তি? আমি তো ছবি দেখছিলাম এতক্ষণ –

-- ঠাট্টা করছিস? তুই বুঝবি না, খেটে খাওয়া মানুষের মন নিয়ে খেলা করার যন্ত্রণা, ইচ্ছে আর স্বপ্ন নিয়ে লোফালুফি করার যন্ত্রণা, মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার যন্ত্রণা। আসলে ...

-- থামলি কেন? বল, আমি শহুরে শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান! তোর মতো দলিত সম্প্রদায়ের দুঃখ আমি কি বুঝবো? আমি তো তোর মতো ছোটবেলায় দিনমজুরি করে লেখাপড়া করি নি, ঠাণ্ডা ফেনাভাত খাই নি, টুডু পদবীটা পেছনে টানতে টানতে সরকার কিংবা এন. জি. ও.-র দয়ার প্রত্যাশায় হা পিত্যেশ করি নি। বল, বল, বলে যা – আজ দু আড়াই বছর ধরে যা বলে যাচ্ছিস!

-- যা সত্যি, তা কী করে ভুলে যাই সুমি? আমার ভাষা সাঁওতালি, না পারলাম সেটা ভালো করে শিখতে, না পারলাম বাংলা ভালো করে শিখতে। না পারলাম নিজের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে থাকতে, না পারলাম তোদের সংস্কৃতির আপন হতে।

-- না পারলি আমাকে বুঝতে, না পারলি তোর নিজেকে বোঝাতে। শোন তপু, এসব আমি তোর মুখে হাজারবার শুনে ফেলেছি। আর তারপরেও তোকে ভালোবেসেছি, ভালোবাসি। সে তুই আমাকে ভালোবাস আর নাই বাস।

-- না রে সুমি, এভাবে বলিস না। অন্যে বিদ্রূপ করলে করুক, কিন্তু তুই বিদ্রূপ করলে আমার বুকটা ফেটে যায়। শিল্পাশ্রমে যখন ভুবন মাহাতো বলছিলেন সেদিনের মানভূমের আদিবাসি আর বাঙালিদের ভাষা কেড়ে নেওয়ার যন্ত্রণার দিনগুলোর কথা, তখন আমি আমার মা-দিদিমা বাপ-ঠাকুর্দাদের অসহায় মুখগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম।

-- আমি বিদ্রূপ করি নি তপু, সত্যিই আমি তোর বর্ণনায় লাবণ্যদের দেখতে পাচ্ছিলাম। তুই তোর মতো করেই ডকুমেন্ট্রিটা কর তপু, রাহুলদা রাজি না হলেও কর। আমি যেভাবে হোক টাকার ব্যবস্থা করবো।

-- সুমি! কী বলছিস তুই জানিস? আমার ছবির জন্য তোর বাবা-মা আই মিন, বাড়ির লোকের কাছে হাত পাতবি? আমার জন্য দয়া ভিক্ষা করবি?

-- আমি কী করবো, সেটা তুই আমার ওপরেই ছাড়। শুধু বিশ্বাসটা রাখ, তুই অপমানিত হবি, এমন কাজ আমি করতে পারি না।

* * *

প্রৌঢ়া লাবণ্যদেবী বসে আছেন তক্তাপোশে। পাশে একটা হাতলভাঙা চেয়ারে বৃদ্ধ অতুলচন্দ্র। শিল্পাশ্রমের অতি সাদামাটা একটি ঘর। এটিতেই চলে লাবণ্য আর অতুলচন্দ্রের তিনসন্তানসহ সংসার। মধ্যবয়সী সাঁওতাল রমণী ভাবিনী একটা কলাইকরা থালায় তিন গ্লাস চা নিয়ে ঢুকলো,

-- কেনে চিন্তা কইরচো মা, জেল কি আমাদের এই পেত্থমবার হবে? এই তো মাত্তর ক’দিন আগেই টুসুর দল থিকে আমাদের ক’জনাকে জেল দিল। রাইখতে পারলেক? আবার নিবে জেলে, তা নিক না। তাই লিগে লইড়বো নাই?

-- না রে ভাবিনী, তোর আমার কথা ভাবছি না। ভাবছি এই মানুষটার কথা। বয়সটা তো কম হলো না। আর কতবার জেল খাটবে বল দেখি।

অতুলচন্দ্র চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

-- যতদিন না বিহার সকারের শুভবুদ্ধি হয়, যতদিন না দেশের সরকার আমাদের যন্ত্রণা বুঝতে পারে, ততদিন আমাকে লড়ে যেতে হবে লাবণ্য। মানভুমের মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে ওরা হিন্দি চাপাবে আর আমি জেল খাটার ভয়ে হাত গুটিয়ে নেবো, তা হতে পারে না।

ভাবিনী অতুলচন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে বাঘিনীর মতো গর্জে উঠলো,

-- ঠিক বইলেচ কেশরী বাবা। আমরা মইরে যাবো তবু ভয় পেইয়ে লড়াইয়ের মাঠ ছেইড়ে পালাবো না।

লাবণ্যদেবী স্মিতমুখে বললেন,

-- সে আমিও জানি। হাত গুটিয়ে নিলে চলবে না, পালালে চলবে না, ‘মুক্তি’র পাতায় আমার মানভূমি-সন্তানদের লড়াইয়ের কথা লেখা না হলে যে ইতিহাস মিথ্যা বলবে একদিন, সে কি আমি জানি না? কিন্তু তোমার শরীর?

-- শরীরের কথা ভুলতে দাও লাবণ্য। অনেকগুলো বছর এ মাটির ভাত খেয়েছি, সেই ভাতের ঋণ শুধতে হবে বৈকি। নইলে এতো দেনা রেখে মরেও শান্তি পাবো না আমি। ভাবিনী, কাল তোরা টুসুগানে মানভূমে ঝড় তোল, পুলিশ যত পারে নির্মম হোক। গান বন্ধ করবি না। পরশু সকালেই ‘মুক্তি’র পাতায় হাজারে হাজারে লোক পড়বে তোদের ঘাম ঝরানো, কান্না ভেজা টুসু সত্যাগ্রহের কথা। লাবণ্য, তুমি এ মাটির মানুষগুলোর মা, যাও ওদের সাজিয়ে দাও কালকের জন্য। ওদের গানযাত্রার রাস্তা ঠিক করে দাও।

-- যদি আবার তোমাকে গ্রেপ্তার করে ওরা .... ভালো করে হাঁটতেও তো পারছো না তুমি।

এই পর্যন্ত পড়ে সৈমন্তী ছলোছলো চোখে তাকালো তপাইয়ের দিকে। তারপর ঘরের জানলা দিয়ে সামনের বুড়ো বটগাছটার দিকে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়েই বললো,

-- সারাজীবন অহিংস আন্দোলন করা একজন পঁচাত্তর বছর বয়সের অসুস্থ মানুষকে ওরা পারলো কী করে খোলা ট্রাকে চাপিয়ে একশো পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার ছুটিয়ে নিয়ে যেতে? এ তো ইংরেজ সরকার নয়, স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকার। নিজের নাগরিককে ...

-- যারা শাসন করে তারা কখনো নিজের হয় না সুমি। যখন যে ক্ষমতায় থাকে, সেই তখন ইংরেজ কিংবা পাঠান-মোগল, কিংবা অহংকারী আর্য। তাদের কাজ মানেই রাজকার্য, তাদের ভাষা মানেই রাজভাষা, তাদের গোষ্ঠী মানেই বামুনের জাত।

-- ব্রাহ্মণদের ওপর তোর খুব রাগ নারে?

-- না সুমি, ব্রাহ্মণদের ওপর রাগ নয়, রাগ ব্রাহ্মণত্বের অহংকারের ওপর। আমি কি জানি না, কতশত দরিদ্র ব্রাহ্মণ পয়সার অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ হয়ে যাচ্ছে? এই টুসু সত্যাগ্রহে তো ওখানকার সর্বহারা ব্রাহ্মণ কম ছিলেন না। আদিবাসীদের হাতে হাত রেখে তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষার লড়াইটা দাঁতে দাঁত চেপেই করেছিলেন।

-- অবাক লাগছে খুব, ভজহরি মাহাতো সে সময় এম.পি.। লাবণ্যদেবী তো ওখানকার মানুষের চোখের মণি, তবু সরকারের দ্বিধা হতো না!

-- ভয়, বুঝলি, ভয়। সেই সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত রাজার দল, শাসকের দল, সাধারণ মানুষের সাধারণ দাবিদাওয়াকেই ভয় পায় সবচেয়ে বেশি। ভজহরি মাহাতো টুসুগানে বাংলায় কথা বলার দাবি তুলেছিলেন, লাবণ্যদেবী সেই টুসুগান গাওয়ার দলকে সাহস যুগিয়েছিলেন। অতএব ... এখনও কি সেই ট্রাডিশান সমানে চলছে না? আমরা কি পরাধীন দেশের বাসিন্দা? কিন্তু কোথায় আমাদের বাক-স্বাধীনতা, ভাবনার স্বাধীনতা? আমি তো নাহয় দলিত হয়েই জন্মেছি, অপমান আমার পিছু ছাড়বে না জেনেই অস্তিত্ব টেকানোর জন্য ছুটছি, কিন্তু তুই তো তা নোস। তুই পারছিস তোর নাকউঁচু সমাজটার ভোল পাল্টাতে? পারছিস, সরকারের মুখের ওপর সোজা কথাটা সোজা ভাষায় বলতে? আসলে স্বাধীনতা শব্দটাই একটা ভেক। তার পরতে পরতে কেবল বন্দীত্বের খিস্তি-খেউড়।

-- তুই এতো গভীর করে ভাবিস তপু? আমি তো পারি না।

-- আমার মতো তোর শরীরের চামড়া খসে কাঁচা রক্তমাংস বেরোয় নি তো তাই।

-- আবার?

-- আচ্ছা ছাড়। পড়লি তো, এবার বল, দাঁড়াচ্ছে কিছু?

-- তুই এর একটা বর্ণও বদলাবি না তপু, এইটাই থাকবে হুবহু।

* * *

লাবণ্যদেবী খাটে আধশোয়া হয়ে একটা খাতায় জমাখরচের হিসেব টুকতে টুকতে ভাবিনীকে ডাকলেন,

-- ভাবিনী, একবার এদিকে আয়। হ্যাঁ রে, টুসু অভিযানে আমাদের সঙ্গে কাল কতজন যাচ্ছে, তার হিসেব পেলি কিছু? ‘মুক্তি’-র পাতায় কাল তার বিবরণ থাকবে, উনি চাইছিলেন।

-- মা, সি যে কত্যজন কী কইরে গুনি বলো দিনি? যাকে জিগুচ্চি, সেই বইলচে যাবে। ছেল্যাবুড়ো সব্বাই যাবার লিগে মুকিয়ে রইচে। তুমাকে আমাকে নিয়ে মেয়্যামানুষই রইচে জনাদশেক। ইবার আমাদের জয় হবেই, দেকে নিও। বিনোদ ঝা-এর মুকের উপরি টুসুগান করে লেচে ভাসাবো। বলে কিনা, ‘মানভূম বঙ্গালমে নেহি জায়েঙ্গেঃ জানে পর খুনকে নদী বহা দেঙ্গে’। আয়, খুন কর, দেকি কত বুকের পাটা। এই মানভূম্যেতে যতগুলান বাংলা ইস্কুলকে হিন্দি ইস্কুল কর‍্যেচে না উরা, তার দুগুন বাংলা ইস্কুল কর‍্যে আমরা মানভূমকে লিয়ে যাবো পশ্চিমবাংলায়।

-- না রে ভাবিনী, এতো বড়ো স্বপ্ন এখনি দেখিস না। তোদের কেশরী বাবা কী বলেছে? বিহার বাংলা দুই রাজ্যের সরকারের কেউ তো মানভূমের এই সমস্যাটাকে নিজের বলে ভাবছে না। নাহলে দুটো রাজ্যকে জুড়ে মার্জার স্টেট বানিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চায়? যেন দুটো রাজ্য এক করে দিলেই মানভূমের বাঙালির মুখের ভাষা ফিরে আসবে, যেন হিন্দির দাপট কমে যাবে, মানভূম ফিরে পাবে তার আগের মান। তাছাড়া হিন্দিভাষার লোকেরা তো আমাদের শত্রু নয়, তারা তো আমাদেরই ভাইবোন, কিন্তু সরকার তার নিজের জেদে সেই সম্পর্কটাও নষ্ট করে দিচ্ছে? এ কষ্ট কোথায় রাখি?

-- জুড়বো বইললেই হলো? এতদিন শুধু বাংলা গান গেইয়ে গিরেপ্তার হয়েচি আমরা, ইবার যদি না মানে রক্ত ঝরাবো নিজেদের। জানো মা, ওই ছুটো বাদলটা পজ্জন্ত পা বাড়িয়ে রইচে অভিযানে যাবার জইন্য। পুণু, তারিণি, নকুল, এই আশ্রমের সব ছেলেপুলে গামচায় মুড়ি বেঁদে পহর গুইনচে কালকের ভোরের লিগে।

-- কেউ যেন বাড়াবাড়ি না করে, টুসু গাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো অস্ত্র নেই, এটা যেন সবাই মনে রাখে। আমি যখন যেভাবে রাস্তা দেখাবো, সেভাবেই যেন সবাই হাঁটে।

-- কতদিন লাইগবে কোলকেতায় যেতে?

-- আমরা যেমন হাঁটতে পারবো। পনেরো দিন, কুড়ি দিন কি একমাস ...

-- সে যাই লাগুক, সরকারের টনক নড়ানোর লিগে আমরা জীবনভোর হাঁইটতে পারি। কিন্তু মা তোমার গায়ে যে জ্বর?

-- আর জ্বর! শরীরের জ্বর সইতে পারবো, যদি ওদের মনের জ্বর তাড়াতে পারি।

* * *

প্রখর রোদ মাথার উপর। সূর্য যেন জ্বলছে দাওদাও করে, কিন্তু মানুষগুলোর ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে। বুকের ভেতরে তার চেয়ে শতগুণ আগুন বয়ে তারা হেঁটে যাচ্ছে – হাঁটছে তো হাঁটছেই। পাকবিড়রাকে ইতিহাস বানিয়ে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ হেঁটে চলেছে হাজার মানুষ। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৭৪ বছরের অতুলচন্দ্র ঘোষ। সামনে সামনে পথ দেখিয়ে চলেছেন প্রায় ষাট বছর বয়সী মানভূম জননী লাবণ্যদেবী। পাশে পাশে চলেছেন ভাবিনী দেবী। সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে ভূতনাথ মাহাতো, পূর্ণচন্দ্র মাহাতো, নারায়ণ মাহাতো, তারিণি মাহাতোদের মতো ঝাঁক ঝাঁক তরুণ। দাবি তাদের একটাই, ‘মায়ের ভাষায় বলবো কথা, অন্য ভাষায় হিংসা নাই। / কিন্তু কাড়ছো কেন মাকে আমার, জীবন দিয়ে ফেরত চাই’। ঘামে ভিজে যাচ্ছে সমস্ত শরীর, পায়ে পা জড়িয়ে যাচ্ছে। শুধু বুকটা জ্বলছে – প্রাণের সমস্ত ইচ্ছেটুকু এক করে টুসুগান গাইতে গাইতে তারা চলেছে। তাদের নিজস্ব অস্ত্র বলতে তো ওইটুকুই শুধু – টুসু গান। সুরে-বেসুরে সেই গানে গানে ঝরছে তাদের চোখের জল – আমার মনের মাধুরী / সেই বাংলাভাষা করবি তোরা কে চুরি! ওই তারা বেলেট পেরিয়ে চলে এলো বাঁকুড়া, রাস্তার দুধারে সাধারণ মানুষের ঢল নামছে, পদব্রজীদের আতিথ্য দিচ্ছে অন্তর দিয়ে। রাত পেরিয়ে ভোর না হতে গলায় টুসুগান নিয়ে আবার হাঁটা, এভাবেই তারা পেরিয়ে যাচ্ছে বেলেতোড় – খণ্ডঘোষ – বর্ধমান –পাণ্ডুয়া – চুঁচুড়া – চন্দননগর – শ্রীরামপুর – পক্ষকাল পেরিয়ে গেল। ওই তো ওরা এসে পড়লো হাওড়ায়। ব্রীজের দুপাশে মানুষের মেলা। সবাই দেখতে চায় এই হতদরিদ্র জেদী ভাষাযোদ্ধাদের। ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে দেহ, কিন্তু জীবন যে নিরুপায়। মুখের ভাষা কেড়ে নিচ্ছে ক্ষমতালোলুপ অহংকারী সরকার। কোলকাতার মহাকরণ তাদের লক্ষ্য। ওরা জানে সরকারের লোক হাতকড়া আর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে রেডি। কিন্তু কীইবা যায় আসে তাতে! সমস্ত প্রাণশক্তিকে একজায়গায় করে তারা চললো বিবাদিবাগ। হাসতে হাসতে হাতকড়া পড়ে নিচ্ছে সবাই। হাজার মানুষকে জেলে ভরতে গিয়ে সরকারের সে কি নাজেহাল অবস্থা।

* * *

‘মুক্তি’র প্রুফ চেক করছেন লাবণ্যদেবী। পুরনো একটা আর্টিকেলের পুনর্মুদ্রণ হবে, সেটাতেই চোখ বোলাচ্ছেন তিনি। কী একটা ভাবলেন, তারপর লাঠিতে ভর করে উঠে কাঠের আলমারিটা থেকে পুরোনো কাগজ বের করলেন। কাগজে চোখ রেখে হারিয়ে যাচ্ছেন যেন, অন্য কোথাও। কতকাল আগের হলুদ হয়ে যাওয়া একটা কাগজ। তাও নয় নয় করে অতুলচন্দ্রের মৃত্যুই হয়ে গেল কুড়ি বছর। তারও বছর পাঁচেক আগের একটা সংখ্যা। পুরুলিয়ার জন্মকথা। কাগজ থেকে চোখ তুলে বাইরে তাকালেন। কানে যেন এখনো বেজে রেডিওর সেই সংবাদপাঠ। মানভূম কাঁদছে, কাঁদছেন লাবণ্যদেবী, কাঁদছে ভাবিনী, চশমার কাঁচ ঘনঘন মুছে যাচ্ছেন অতুলচন্দ্র, শরৎ সেনের চোখ চিকচিক করছে। আনন্দ ধরে রাখতে পারছেন না কেউ। রেডিওতে সংবাদপাঠক পড়ছেন, ‘মানভূমের বাঙালিদের পদযাত্রা বিফলে যায় নি। বিফলে যায় নি টুসু সত্যাগ্রহ। অভিযাত্রীর দল কোলকাতা পৌঁছনোর তিনদিন আগেই সরকার মানভূমকে বাংলার সঙ্গে জোড়ার কথা বলেছেন। পুরুলিয়া নামে হবে নতুন জেলা। মানভূম হবে তার ভরকেন্দ্র। তবে স্থির হয়েছে, চাণ্ডিল, ইচাগড়, পটমাদা এই তিনটি থানা থেকে যাবে বিহারেই’। দীর্ঘশ্বাস পড়লো লাবণ্যদেবীর। গোচোনাটা রয়েই গেল দুধের পাত্রে।

ডকুমেণ্ট্রির এই পর্যন্ত দেখে সৈমন্তীর চোখ থেকেও দু ফোঁটা জল টসকে পড়লো। তপুর কাঁধে মাথাটা রেখে বললো,

-- এই যে লাবণ্যদেবী, ঘরে বসে প্রাথমিক শিক্ষার্জনটুকু পুঁজি করে এতোবড়ো আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর ‘মুক্তি’-র দায়িত্ব নিলেন, এম. পি. হলেন। দীর্ঘজীবী মানুষটা আমৃত্যু শিল্পাশ্রমের অনাথ দরিদ্র শিশুদের দেখভাল করলেন, অথচ তাঁর নামটা বেশিরভাগ মানুষ জানেন না! আমরাও ক’দিন আগে পর্যন্ত জানতাম না। কম দিন তো বাঁচেন নি। একশো ন’ বছর! সামান্য পেনশনের টাকায় কী ভীষণ দারিদ্র্যে এই অমূল্য জীবনটা কাটলো। দেশের মানুষ কাটতে দিলো! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া কেউ তাঁকে একটা সম্মান পর্যন্ত জানালন না?

-- বলেছি না, আমরা ইতিহাস বিস্মৃত জাতি। কারো কোনো অবদান আমরা মনে রাখি না, যদি কেউ নিজে বিজ্ঞাপিত না হন।

-- নারে তপু, এই ডকু-ছবিটা রাহুলদা কিছুতেই বাতিল করতে পারবেন না দেখিস।

ম্লান হাসলো তপু, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সুমির মনে হলো, এই ছবিটার জন্যে ওকে লড়তেই হবে। শেষ পর্যন্ত। এ যে তারও স্বাধীনতার লড়াই। ওর পরিবার পরিজনদের কাছে ও হেরে যাবে না। তপুকে সামনে দাঁড় করিয়ে বুক ফুলিয়ে ওকে বলতেই হবে, ‘এ ছেলে ইতিহাস ধরে রাখতে জানে’।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.