চিন্ময় ঘোষ | একুশের দাবি

ভাষা দিবস মিছিল শব্দের

'একুশ'
এই শব্দটার সঙ্গে যেন হৃদয়ের এক গভীর সংযোগ আছে। দিনটা বছর পেরিয়ে ঘুরে ঘুরে আসে। আমরা আবেগমথিত হই, ভাষা শহীদদের স্মরণ করি, শ্রদ্ধায় শপথে আনুষ্ঠানিকতার শেষে সেই আবেগটুকু আবার দেরাজের মধ্য ভরে রেখে দিই, পরের বছরের জন্য তুলে রাখি। ভুলে যাই একুশ শুধু ভাষা শহীদদের স্মরণ দিবসই নয়, একুশ মানে আত্মাভিমান --​ স্বাধীনতাকামী চেতনার দ্যোতক। যাবতীয় অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে যুঝে যাওয়ার রসদ। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রেরণা, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার দীপশিখা।​

​শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঘটনা সমূহই নয়, মনুষ্যকৃত কতরকম​ ঝড়ঝঞ্ঝাই প্রতিনিয়ত আমাদের​ সমাজ জীবনে নানান বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই প্রসঙ্গে সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশ ও আমাদের রাজ্যের কথাই ধরা যাক। উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের প্রবল প্রতিপত্তির কারণে অনেক সময় নিজস্ব রাজনৈতিক ইচ্ছা ও কর্মসূচিগুলোর রূপায়ণের তীব্র তাগিদে মত্ত। দেশ বা রাজ্যের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর​ অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদা, সমাজ সম্পর্কের​ ভিত্তিভূমি, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ভাবনার বিষয়গুলোকে সুদূরপ্রসারী এক ভয়াবহ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ তা নিয়ে দেশের বা রাজ্যের মানুষের মধ্যে কোথাও বিশেষ কোনো হেলদোল নেই। সবকিছুই ইদানিং​ যেন গা সওয়া হয়ে গেছে।​ এই অদ্ভুত নিস্পৃহতার পিছনে একটা কারণ অবশ্যই হতে পারে বিগত শতকের নব্বই দশকে আহূত পুঁজিসর্বস্ব বাজার অর্থনীতির প্রণয়নের প্রভাব। উদ্যোগপতি, ব্যবসায়িক ও​ শিল্পপতিদের কাছে বাজার সর্বস্ব অর্থনীতির মূল মন্ত্রই হলো যে কোন মূল্যে শুধু মুনাফা -​ মুনাফা আর মুনাফা অর্জন। ঠিক এখানেই​ নয়নলোভনীয় ও মনোমুগ্ধকর বিজ্ঞাপনের​ চক্করে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম নিয়েছে ভোগবাসনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।​ নিজে খাও ভোগ কর আর নিজে বাঁচো, অপরের জন্য ভাবনার প্রয়োজন নেই। এই বোধের জাগরণই আমাদের দেশীয় সমাজ চেতনার ভিতকে ক্রমাগত ধাক্কা দিতে দিতে, বিশেষ করে, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাপনের প্রচলিত​ ভাবনাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। ভোগবাদী আকাঙ্ক্ষার স্বার্থপর চিন্তা ব্যক্তি মানুষকে সমাজ চেতনা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। মানুষের লোভ, লালসা এবং ভোগের তীব্র বাসনা তার চরিত্রের প্রতিবাদী মননের অবক্ষয় ঘটিয়ে তাকে শাসক এবং বেনিয়া সম্প্রদায়ের হাতের পুতুল করে গড়ে তুলেছে। বদলে শাসকের ছুঁড়ে দেওয়া নানান প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে মানুষ যেন বড় স্বস্তিতে আছে। রাজ্য সরকারের দান-খয়রাতির সাময়িক মোচ্ছব যে রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চরিত্রের বাস্তব কোন উন্নতিই ঘটাতে পারবেনা বরং তাকে ভীষণরকম সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একথা রাজ্যের বিরাট সংখ্যক মানুষ যেন ভাবতেই চায়না। শিল্প নেই, কৃষির জন্য​ সুপরিকল্পিত কোন ব্যবস্থা নেই। ফলত বর্তমানে তো বটেই, অদূর ভবিষ্যতেও নতুন নতুন কাজ সৃষ্টির কোন সদিচ্ছা বা প্রচষ্টাই দেখা যাচ্ছেনা সরকারের পক্ষ থেকে। এই অবস্থায় রাজ্য সরকার যে সমস্ত সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্কীম বা সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচির নামে আর্থিক দান খয়রাতি বা ডোল প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করছে, সরকারের পক্ষ থেকে তাকেই রাজ্যের উন্নয়ন বলে ঢালাও বিজ্ঞাপন দিয়ে গালভরা প্রচার চালানো হচ্ছে। সরকারি উন্নয়ণ মূলক কর্মকাণ্ডের সাফল্য বলে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে।
সংবিধানগতভাবে স্বীকৃত চতুর্থস্তম্ভের ভূমিকা এখানে ভীষণ নক্কারজনক। বৃহত্তর অংশের সংবাদ মাধ্যম কি কেন্দ্রর কি রাজ্যের - দুই​ সরকারেরই ধ্বজাধারী সেজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বলতে গেলে একরকম প্রহসনে পরিণত করে দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের প্রচার ও কর্মসূচীতে জনগণের ভূমিকা ও চাহিদার কোন স্থান নেই। 
মূলত বিজ্ঞাপনের লোভেই বেশিরভাগ ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সংবাদপত্র সরকারের কাছে তাদের মস্তিষ্ক, বিবেক এবং শিরদাঁড়া বন্ধক রেখেছে। দেশের নাগরিকদের জন্য সংবাদ মাধ্যমের যেন কোন দায়ই নেই। এইমত অবস্থায় দেশ ও রাজ্যের বেশ ভাল সংখ্যক মানুষও তাদের শিরদাঁড়াকে নুইয়ে দিয়ে দিব্যি দিনযাপন করছে। কোথাও তা অন্ধ ভক্তের মত আবার কোথাও​ ভিখারির ভূমিকায়।​ এক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যের অসংখ্য মানুষের মধ্যেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি অতুল বিশ্বাস আর অন্ধ আনুগত্যের জ্বলন্ত ছবি বিরাজমান!​ অগণিত যুবসমাজের ভবিষ্যৎ কি হবে, পড়াশোনার পর একটা চাকরির সন্ধানে তারা​ কোথায় যাবে অথবা সামগ্রিকভাবে রাজ্যের সামাজিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ কি হবে এইগুলো নিয়ে সরকারের যেমন হেলদোল নেই তেমনি টগবগে যুবশক্তির মধ্যেও যেন ততটা আলোড়ন নেই। কোথাও কোথাও স্থানীয়ভাবে বা টোকেন কিছু লড়াই আন্দোলন দেখা যায়, কিন্তু একুশকে হৃদয়ে রেখে সেই জোশ কোথায়? একুশ তো প্রত্যয়ের বয়স, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেবার বয়স। একুশের রক্তে যে তুফান ছোটে, আজকের সমগ্র যুবশক্তির চেতনায় তার প্রতিফলন কোথায়?​ একুশের চেতনা কেন যুবশক্তির মধ্যে প্রেরণা হয়ে উঠবেনা!

​বামপন্থী যুবসমাজ সমগ্র সমাজের একটা সংক্ষিপ্ত অংশ মাত্র। তবুও বিশেষ বিশেষ সময়ে বিভিন্ন সংকটে সেই দুর্বার যুবশক্তি তার পূর্ণ সদিচ্ছা ও অপর্যাপ্ত রসদ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। এমন দৃষ্টান্ত আমরা বারবার দেখেছি। টেট আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ানো, কোভিভ-১৯ অতিমারীর কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার দাবিতে আন্দোলন এবং চাকরির দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করা এইসব ক্ষেত্রে বামপন্থী ছাত্রযুব সংগঠনগুলোর বিচ্ছিন্ন কিছু ভূমিকা আছে। কিন্তু এই যে রাজ্যের অচল অবস্থা এবং কেন্দ্রের বিভিন্ন জনবিরোধী কর্মকাণ্ড -​ যেমন ধর্মীয় বিভেদ ও ধর্মান্ধতাকে চাগিয়ে তুলে দেশের মানুষের মধ্য ভেদাভেদ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা। উল্টোদিকে দেশীয় সম্পদ মুষ্টিমেয় দু'একজন বন্ধু ব্যবসায়িক বা শিল্পপতির হাতে তুলে দেওয়া, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো ব্যক্তিমালিকের হাতে তুলে দিয়ে দেশের বনিয়াদকে ধ্বংস করা - এই সবের​ জন্য দেশ যে ভয়াবহ সামাজিক আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে, মানুষের জীবনকে খোলামকুচির মত ছুঁড়ে ফেলার যে রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচার চলছে এই সমস্তর​ বিরুদ্ধে রাজ্য ও দেশ জুড়ে তীব্র এবং সার্বিক আন্দোলন গড়ে তুলতে বামপন্থী চিন্তাচেতনায় ঋদ্ধ যুবসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ বৃহত্তর যুবসমাজ এই বিষয়ে উদাসীন, সরকারি ক্ষমতার প্রতি অন্ধ আনুগত্যে এবং বিশ্বাসে মাতোয়ারা। সরকারি আর্থিক অনুদান, মেলা-উৎসব আনন্দ-স্ফূর্তিতেই বুঝি জীবন চলে যাবে। এই যৌবন জলতরঙ্গের প্রবাহ শুকিয়ে গেলে অগণিত যুবশক্তির ভবিষ্যৎ কি হবে এই নিয়ে​ তারা সরকারের কাছে কোন প্রশ্ন করতেই​ ভুলে গেছে। চেতনাবিমুখ বিপথগামী বিশাল​ যুবশক্তিকে সঠিক পথে টেনে আনার দায়িত্ব শিক্ষিত, চেতনা সমৃদ্ধ, সৎ ও উদ্যমী ছাত্রযুবদেরকেই নিতে হবে। সরকারের চোখে চোখ রেখে বলতে হবে, দান-খয়রাতি-ভিক্ষা নয়। আমাদের হাতে কাজ দাও! নিজের যোগ্যতা আর পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দাও!​

​শ্রেণিগত অবস্থানের জন্যই যে বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা দেশের ও রাজ্যের আপামর সাধারণ মানুষের পক্ষে নয়, ক্ষমতার অলিন্দে থেকে অল্পসংখ্যক বড়লোকদের বা অন্যদিকে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই যে এই সরকারগুলো মশগুল,​ তা সাধারণ মানুষ ও বিপথগামী বিশাল যুবসম্প্রদায়কে বোঝাবার দায়িত্ব সচেতন-সাহসী-সৎ এবং প্রকৃত শিক্ষিত যুবকদেরই নিতে হবে। একুশ শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলনের স্মারক হয়েই​ বেঁচে থাকবেনা। একুশ একটা আকাঙ্ক্ষা​ একটা জেহাদ -- তার আবেদন বহুমাত্রিক। তাকে হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত রেখে মর্যাদার উচ্চ শিখরে বসিয়ে রেখেই সমস্তরকম অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মশাল জ্বালিয়ে তুলতে হবে।

​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.