শনিরবচন | প্রম্পটারের কারসাজি

শব্দের মিছিল michil sobdo

দেশের মানুষকে আত্মনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে দেশের সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি একের পর এক জলের দরে বেচে দেওয়ার পর্ব চলছে জয়শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে। এখন রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি কাদের রক্ত জল করে উপার্জন করা অর্থে গড়ে উঠেছিল গত সাত দশক ধরে? রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি গড়ে ওঠে কাদের অর্থে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও তো বাতুলতা। যাদের উপার্জিত অর্থ থেকে সরকারী কর আদায় করে রাষ্ট্রূ একের পর এক সরকারী সংস্থা গড়ে তোলে। সেই নাগরিকদেরকেই বলা হচ্ছে আত্মনির্ভর হতে। আর তাদের সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিকে বেচে দেওয়া হচ্ছে কয়েকজন শিল্পপতিকে। তাও আবার জলের দরে। আত্মনির্ভর নাগরিকের সম্পত্তি লুঠের এমন নির্মম প্রহসন অভুতপূর্ব সন্দেহ নাই। বিশেষত ভারতবর্ষের মত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে। এবং যিনি এই আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার পাঠ দিয়েছেন। আজ কিন্তু পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে তিনি নিজে কতটুকু আত্মনির্ভর। টেলিপ্রম্পটার বিকল হলেই তাঁর মুখের বোল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। টেলিপ্রম্পটারে ইংরেজিতে লেখা ‘মিসেস’ কে তিনি উচ্চারণ করছেন এম আর এস বলে। বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও স্লোগান টেলিপ্রম্পাটারে পড়ে বলতে গিয়ে বলে ফেলছেন বেটি বাঁচাও বেটি পটাও। এই যখন আত্মনির্ভরতার নমুনা। তখন দেশের আত্মনির্ভর নাগরিকদের আর জেগে ঘুমানোর সময় নাই।

মেঠো যাত্রাপালায় দেখা যায়, অভিনেতার অনুপস্থিতে যাকে তাকে দিয়েও কাজ চালিয়ে নেওয়া হয় দক্ষ প্রম্পটারের মাধ্যমে। যাত্রাপালাই হোক আর থিয়েটারের নাটকই হোক। প্রম্পটারের পারদর্শীতার উপরে নাটকের সাফল্য নির্ভর করে অনেকটাই। দক্ষ অভিনেতাদেরও প্রম্পটার লাগে। অনেক সময়েই সংলাপের খেই হারিয়ে যায়। তখন প্রম্পটারের দায়িত্ব সেই খেইটুকু ধরিয়ে দেওয়া। এখন এমন কোন অভিনেতাকেই যদি নাটকের প্রধান চরিত্রে নির্বাচিত করা হয়। যিনি না জানেন কিছু বলতে। না জানেন নিজের বুদ্ধিমত্তায় স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতে। এবং না জানেন সংলাপ মুখস্থ করতে। তখন সেই অভিনেতা সম্পূ্র্ণতই প্রম্পটার নির্ভর হয়ে পড়বেন। এ আর বেশি কথা কি। মঞ্চের আলো শব্দযোজনা সঙ্গীত এবং সহ অভিনেতাদের পারদর্শীতার সাহায্য নিয়ে প্রধান অভিনেতার অদক্ষতা অনেকটাই ঢাকা দেওয়া যেতে পারে প্রম্পটারের দক্ষতায়। বহু যাত্রাপালাতেই মূল অভিনেতার হঠাৎ অনুপস্থিতিতে এই রকম ঘটনা ঘটানোর নজির কম নাই। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এইরকম ঘটনা সম্পূ্র্ণ অভুতপূর্ব।

বহুদিন ধরেই অনেকের ভিতরে একটা বড়ো সন্দেহ দানা বাঁধছিল। কেন বিগত সাত বছরে একটিও সাংবাদিক বৈঠক করেননি বর্তমান দেশপ্রধান। এর একটা উত্তর এই হতে পারে। টেলিপ্রম্পটারের সাহায্য নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করার মতো প্রযুক্তি এখনো হাতে আসেনি নিশ্চয়। অর্থাৎ সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর তৎক্ষণাত টেলিপ্রম্পটারে ভেসে উঠবে। আর দেশের প্রধান সেই ভেসে ওঠা উত্তর উচ্চারণ করে সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকবেন। অথচ কেউ কিছু টের পাবে না। এখানে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন একটাই। টেলিপ্রম্পটারে যে লেখা ভেসে ওঠানো হচ্ছে। সেই স্ক্রিপ্টের মূল রচয়িতা কে? মূল রচয়িতা যদি বক্তা নিজেই হন। তাহলে তো কোন অসুবিধা নাই। টেলিপ্রম্পটার ঠিক মতো কাজ না করলেও, বক্তার মস্তিষ্ক ঠিক মতোই কাজ করতে থাকবে। এবং তিনি তাঁরা নিজের বক্তব্যই বলে যেতে থাকবেন। টেলিপ্রম্পটার কাজ করুক না করুক। থাকুক আর নাই থাকুক। সেক্ষেত্রে সাংবাদিক বৈঠকে অংশ নিতে ভয় পাওয়ার তো কোন কারণ থাকে না। মুশকিল হয় তখনই। যখন বক্তা আর টেলিপ্রম্প্টারে লেখা স্ক্রিপ্টের রচয়িতা ভিন্ন মানু্ষ হন। সেক্ষেত্রে টেলিপ্রম্প্টার বিভ্রাটে বক্তাকে থেমে যেতেই হবে। এবং বক্তার মস্তিষ্ক যদি তেমন ভাবে সক্রিয় না থাকে। কিংবা বক্তার বলার মতো নিজের কোন কথাই যদি না থাকে। তাহলে তো তাকে পুরোপুরি টেলিপ্রম্পটারের উপরেই নির্ভর করতে হবে। সে, আন্তর্জাতিক সেমিনারের অনলাইন আয়োজনই হোক আর মন্দির উদ্ঘাটনের ভাষণ দেওয়াই হোক।
যাত্রাপালায় অভিনেতা দিয়ে কাজ চলে। কিন্তু গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিনেতা দিয়ে কাজ চলে না। সেখানে নেতার প্রয়োজন হয়। এখন নেতার জায়গায় যদি একজন অভিনেতাকেই বসিয়ে রাখা হয়। তাও আবার সম্পূর্ণ অদক্ষ এক অভিনেতা। তবে আজ হোক আর কাল হোক মুখ আর মুখোশ আলদা হয়ে ধরা পড়বেই।
 ধরা যেদিনই পড়ুক। আসল কথা হলো। দর্শক জনতার অন্ধ বিশ্বাস আর অটল ভক্তি মুখ আর মুখোশের পার্থক্যটুকু ধরতে রাজি আছে কিনা। অন্ধবিশ্বাস আর অটলভক্তির কিছু দায় ও দায়িত্ব থাকে। তার ভিতরে প্রধান যেটি। সেটি হলো প্রশ্ন তোলার শক্তিকে অসাড় করে রাখা। কায়মনবাক্যে বিনা প্রশ্নে মুখোশনৃত্যেই ভরসা করে যাওয়া। নির্বাচনের পর নির্বাচন ধরে। তাতে নোট বাতিলের লাইনে দাঁড়াতে হোক। নাগরিকত্ব বাতিলের লাইনে দাঁড়াতে হোক। হাজার টাকার রান্নার গ্যাসে ভাত চড়াতে হোক। আর একশ টাকা লিটারে পেট্রল কিনে গাড়ি চালাতে হোক। ব্যাংকে গচ্ছিত সঞ্চয়ের উপরে প্রাপ্ত সুদের হার কমতে কমতে প্রায় শুন্য হয়েই যাক। আর ছেলে মেয়েদের কর্মসংস্থানের পথ দিনে দিনে অবরুদ্ধ হতে থাকুক। কোন কিছুতেই কিছু এসে যায় না। যতদিন মুখোশনৃত্য চলতে থাকবে ততদিনই মুগ্ধ নেত্রে নির্বাচনের পর নির্বাচনে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে মুখোশনৃত্যের অনুষ্ঠান সচল রেখে যাওয়া। সেখানেই অন্ধবিশ্বাস আর অটলভক্তির দায় ও দায়িত্ব।

ফলে দেশের মানুষ কি করবে। সেটা মানুষেরই দায়। মানুষ যদি টেলিপ্রম্প্টার নির্ভর দেশপ্রধান চায়। তবে সেটি মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু গণতন্ত্রের মুশকিল হলো অধিকসংখ্যক মানুষের চাওয়ার গ্যারান্টি না থাকা। বিষয়টা হলো এই। ষাট শতাংশ মানুষ না চাইলেও একজন দেশের প্রধান হতে পারে। বিশেষ করে বহুদলীয় গণতন্ত্রে। এমনকি মাত্র এক তৃতীয়াংশ জনগণের সমর্থন নিয়েও একজন দেশের প্রধান হয়ে যেতে পারে। যাকে দুই তৃতীয়াংশ জনগণ অপছন্দ করলেও দেশের প্রধান হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য। সংসদীয় গণতন্ত্রে বেশির ভাগ সময়েই এই ঘটনা ঘটে। আর সেই কারণেই বলা হয়। যিনি দেশের প্রধান নির্বাচিত হবেন। তাঁকে শুধু তাঁর সমর্থকদের স্বার্থ দেখলেই হবে না। তাঁকে দেশের আপামর জনসাধারণের স্বার্থ পূরণ করতে হবে। আর সেটাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। এখন নির্বাচিত দেশপ্রধান যদি সেই দায়িত্ব পূরণে ব্যর্থ হন। তাহলে ক্ষতিটা কিন্তু গোটা দেশেরই। যাঁরা তাঁকে ভোট দেয়নি, ক্ষতিটা শুধুমাত্র তাঁদেরই নয়।

জনগণের সমানে এখন আরও একটি প্রশ্ন উপস্থিত। দেশপ্রধানের টেলিপ্রম্পটারের মূল স্ক্রিপ্টের রচয়িতা কে? তিনি কি কোন একজন ব্যক্তিবিশেষ? যদি তাই হয়। তবে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে বাধা কোথায়? ও কেন? দেশের ভিতরে তাঁর কি এতটুকুও জনপ্রিয়তা নেই? তিনি আদৌ ভারতীয় তো? না হলে সেটা দেশের পক্ষে খুবই সাংঘাতিক বিষয়। সেই আশঙ্কার কোন ভিত্তি না থাকলেই মঙ্গল। না’কি স্ক্রিপ্ট রচয়িতা কোন একজন ব্যক্তি বিশেষও নন। বেশ কয়েকজনের একটি কমিটি বা একটুকরো গ্যাং। যাঁদের প্রয়োজন একটি মুখের। যে মুখ দিয়ে তারা যা বলাতে চাইবে। সেই মুখ সেই সেই কথাই শুধু বলে যেতে থাকবে। যার বাইরে অন্য কোন কথা বলার স্বাধীনতা বা বৌদ্ধিক ক্ষমতা সেই মুখের থাকবে না। ঘটনা যদি ঠিক তেমনটিই হয়। তবে সেও একটি দেশের পক্ষে খুবই বিপদজনক। আর সত্যি সত্যিই কোন দেশের অবস্থা যদি ঠিক তেমনটিই হয়। তবে জনগণের জেগে ঘুমানোর দিন শেষ হওয়াই উচিত।

অবস্থা সেইরকম হলে তার কিছু কিছু সিমটম দেখা দেয়। যাত্রাপালায় যেমন অভিনেতার অদক্ষতা ঢাকতে চড়া সুরে ঢাক ঢাল বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দর্শকের মনকে অভিভুত করে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। জমকালো পোশাক পড়িয়ে ফকিরকেও রাজা সাজিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়। যাত্রাপালার সংলাপ দিয়ে অভিনেতাকে হিরো বানিয়ে তোলা হয়। ঠিক তেমনই কোন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর এক টুকরো গ্যাং যদি তেমনই কোন এক মুখকে সামনে দাঁড় করিয়ে পেছনে নিজেদের কাজ হাসিলের বন্দোবস্ত ফেঁদে বসে। তখন সেই মুখকে হিরোর মুখোশে ঢেকে চড়া সংলাপে তোতাপাখির মতো কথা বলিয়ে নিতে টেলিপ্রম্পটার নিয়ে ঘুরতে হয়। আর গোটা অনুষ্ঠানের নিরন্তর সম্প্রচারের জন্যে টিভি থেকে খবরের কাগজের সব কোম্পানি একের পর এক কিনে নিতে হয়। শস্তায় নেটের নেশা ধরিয়ে দিয়ে নেটের ভিতর দিয়ে মুখোশনৃত্যের স্বপক্ষে নিরন্তর প্রচার চালিয়ে যেতে হয়। একের পর এক ফেক নিউজকে ভাইরাল করে জনগণের অবচেতনে সত্য বলে উপস্থিত করতে হয়। না হলে জনতার বন্ধ চোখ খুলে যেতেই পারে এক আধবার টেলিপ্রম্টার বিভ্রাটে। ভয় তো একটা থাকেই। জনতার ঘুম একবার ভেঙ্গে গেলেই তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়তে পারে সাতবছরের সাতমহলার রাজপ্রাসাদ।


২২শে জানুয়ারী’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.