১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন বাঙালির মনে যেমন নব-জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায়, ঠিক তেমনই সাহিত্যের পাতায় বিশেষত কবিতায় স্বদেশ ভাবনার পরিসরকে বেশ কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে। ঈশ্বর গুপ্ত কিংবা মধুসূদন দত্তের যে বঙ্গপ্রীতি বাঙালি বিশ শতকের পূর্বে পাঠ করে এসেছে; কিংবা হেমচন্দ্র, রঙ্গলাল, নবীনচন্দ্রের যে জাতীয়তাবোধ বাঙালিমানসে অনুরণন যুগিয়েছে তা স্বদেশী আন্দোলনের প্রাক্কালে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি নারীর সক্রিয় উপস্থিতিতে আরও জোড়ালো হতে থাকে। যদিও ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গকে ঘিরে বাঙালির মনে দ্বিবিধ ধারণা তৈরি হয়েছিল; যেখানে গিরিশচন্দ্র সেন (নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের নেতা), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (যদিও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্বদেশপ্রেমের প্রচুর চিহ্ন রেখেছেন তাঁর লেখায়) প্রমুখদের বঙ্গভঙ্গের স্বপক্ষ যুক্তির পক্ষে সওয়াল করতে দেখা যায়। তা সত্ত্বেও এই বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন আপামর বাঙালির একটা বড় অংশের আবেগের আন্দোলন হয়ে ওঠে। সেখানে ররীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সক্রিয়তা চোখে পড়বার মতো। 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি' থেকে 'ও আমার দেশের মাটি'র মতো আবেগান্বিত জাগরনের গান বা কবিতাই শুধু নয়; 'বঙ্গবিভাগ', 'বঙ্গব্যবচ্ছেদ', 'শোকচিহ্ন', 'করতালি'র মতো একের পর এক প্রবন্ধে যুক্তিপূর্ণ স্বদেশভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। সেখানে নাটকও কোনো অংশে পিছিয়ে পড়েনি। তাছাড়া গিরিশচন্দ্র ঘোষের 'সিরাজদ্দৌলা' (১৯০৫), 'মীরকাশিম' (১৯০৬), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়'এর 'প্রতাপসিংহ' (১৯০৫), 'দূর্গাদাস' (১৯০৬) প্রভৃতি অনেক নাটকই সময়-উপযোগী এবং চূড়ান্ত স্বাজাত্যবোধের মিলনক্ষেত্র রূপে প্রকাশিত হয়েছে তা লক্ষনীয়। তবে আন্দোলনমুখর স্লোগানের বীজভূমি 'স্বদেশপ্রেমের কবিতা এবং গান'এর মন্ত্রমুগ্ধতা এক্ষেত্রে বিশেষ হয়ে ওঠে। করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গমঙ্গল' (১৯০১) থেকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'সন্ধিক্ষণ' (১৯০৫) কাব্যগ্রন্থের দেশ-ভাবনার সরাসরি ঢেউ যেভাবে পরিলক্ষিত হয়, তা এক স্বতন্ত্র নতুন ধারা রূপে প্রতিস্থাপিত হওয়ার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে এই ধারা স্বতন্ত্র, কারণ প্রথমবারের মতো একঝাঁক সক্রিয় নারীকণ্ঠকে স্বদেশভাবনায় ধ্বনিত হতে দেখা যায়। বাংলা কবিতায় 'ঘর' থেকে 'বাইরে' বেরিয়ে এসে নারীর সক্রিয় স্বাজাত্যবোধ, জাতীয়তাবাদের দীপ্তি বিশ শতকের পূর্বে যেমন দেখা যায়নি, তেমনই একুশে এসে আমরা কতটা স্মরণে রেখেছি তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। স্বর্ণকুমারী দেবী থেকে হিরন্ময়ী দেবী, মানকুমারী বসু, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্তা, বেগম রোকেয়া শাখাওয়ায়ৎ প্রমুখদের গানে-কবিতায় স্বদেশ প্রেমের যে ছবি আমরা পাই তা ভীষণই অবদানযোগ্য। আর তাঁদের মধ্যেই এই ধারায় অন্যতম ছিলেন গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, যাঁর গোটা একটি কাব্যগ্রন্থই দেশভাবনা নিয়ে লেখা। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত গিরীন্দ্রমোহিনীর 'স্বদেশিনী' কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করা 'ভারতের স্বদেশভক্ত নরনারী করে'। 'নর'র পাশাপাশি 'নারী'র এই 'কর' নারীকে সহধর্মিনী থেকে সহকর্মিনীতেও যে রূপান্তরিত করে তখনই, আর তা যে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মঞ্চ থেকে নারীকণ্ঠে উচ্চারিত বাংলাকেও দৃপ্ত করে তোলে গিরীন্দ্রকাব্যে তা সমুজ্জ্বল— "এস শিরে লয়ে আশিস মাতার/ পর আঁটি অঙ্গে বর্ম একতার/ ধরহ একতা কিসের ভয়/ সাহস যাহার তাহারি জয়। —(আশীর্বাদ)" বলিষ্ঠ কথনের এই সাহসী কবিতা ঐক্যবদ্ধতার কথা বলে, সংগ্রামের কথা বলে। মানবপ্রেম কীভাবে সময়ান্তরে স্বদেশপ্রেমে পরিণত হতে পারে তা গিরীন্দ্র-কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলেই অনুমান করা যাবে। ইতিপূর্বে লেখা 'কবিতাহার' (১৮৭২), 'ভারতকুমসুম' (১৮৮২), 'অশ্রুকণা' (১৮৮৭), 'আভাষ' (১৮৯০), 'শিখা' (১৮৯৬), কিংবা 'অর্ঘ্য' (১৯০২) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে ব্যক্তিপ্রেমের মিলন-বিরহের যে মূর্ত প্রকাশ তা দেশভক্তিতে রূপান্তরিত হয়। যদিও সমাজ-পরিস্থিতির বাস্তব রূপায়নের কবিতা (বঙ্গমহিলাগনের হীনাবস্থা প্রভৃতি) তিনি লিখতে অভ্যস্থ, তবুও এভাবে দেশপ্রেমের কাব্যগ্রন্থ প্রণয়ন তাঁকে স্বতন্ত্র করে তোলে। আর বাংলা কবিতায় নারীকণ্ঠের নিরিখে তা বিরলও বলা চলে। আসলে বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে বাংলার গিরিবালা বসু, অবলা বসু, হেমাঙ্গিনী দাস, কুমুদিনী মিত্র, লীলাবতী মিত্র, সুবলা আচার্য, নির্মলা সরকার প্রমুখদের 'অরন্ধন' ও 'উপবাস' পালন (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে); বিলাতি পণ্য 'বয়কট' করে মিছিল, পিকেটিং-এ সক্রিয় অংশ নেওয়া; মিলনের প্রতীক হিসাবে 'রাখিবন্ধন উৎসব' (রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে) এবং কলকাতায় 'মিলন মন্দির'-এর ভিত্তি স্থাপন যেন এই জাগরণের উদ্রেক ঘটায়। নিম্নবর্ণের হিন্দু বা মুসলিম নারীদের এই আন্দোলনে খুব বেশি সক্রিয়তা চোখে না পড়লেও একথা সত্য যে স্বদেশি আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ মূলত বাংলা নির্ভরই। তাই নারীর একতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন সংগঠন। সরলাদেবী চৌধুরানির 'লক্ষীর ভাণ্ডার' কিংবা 'ভারত-স্ত্রী মহামণ্ডল' এক্ষেত্রে স্মরণীয়। বিল্পবীদের আশ্রয়দান থেকে সংবাদ সরবরাহ, অস্ত্র সরবরাহ প্রভৃতি বিষয়ে নারীরা সহায়ক হয়ে ওঠে। তবে সরলা দেবী চৌধুরনির মা স্বর্ণকুমারী দেবীর কথা ভুলে গেলে চলবে না। গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী স্বীকার করেন স্বর্ণকুমারীর স্বদেশ ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে ওঠার কথা। 'সখি সমিতি' থেকে 'মহিলা শিল্পমেলা'র প্রতিষ্ঠাতা স্বর্ণকুমারী ছিলেন ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনের একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি। 'ভারতি' পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে তাঁর ভূমিকা নারী জাগরণের পক্ষে যে কতটা বেশি তা অনুভব করেন কবি গিরীন্দ্র। আর তাছাড়া দুজনের মিতালী সম্পর্ক এবং বন্ধুত্বের একাত্মতা থাকায় গিরীন্দ্রের কবি-মনে যে প্রভাব পড়বে সে তো স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে গিরীন্দ্রের এই 'স্বদেশিনী' কাব্যগ্রন্থ শৌর্য্য ও সাহসের ধারক এবং বাহক হয়ে ওঠে। তিনি আহ্বান করেন ছাত্রসমাজকে, যুবককে, তরুণ প্রজন্মকে— "জাগিয়া উঠেছে বঙ্গ-হৃদয়ে তরুণ আশা।/ ভেঙেছে ঘুমের ঘোর/ … তবে ঘৃণিত বিলাসবাস চরণে দলিয়া সই/ কল্যাণী নবীন সাজে সাজালো মঙ্গলময়ি।" বঙ্গহৃদয়ে তরুণ আশার সঞ্চার শুরু হয়েছিল স্বদেশি আন্দোলনের কিছু সময় আগে থেকেই। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের 'ডন সোসাইটি'র (১৯০২) তরুণ-নবীনদের একত্রিত করবার উদ্যোগ, 'সন্ধ্যা' পত্রিকার ডাকে কলকাতা-পূর্ববঙ্গের যুবাসমাজের বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা কার্যত 'ঘুমের ঘোর' কাটারই নামান্তর হয়ে ধরা পড়েছে গিরীন্দ্র কবিতায়। আবার মুর্শিদাবাদের গিরিজাসুন্দরী, ঢাকার ব্রহ্মময়ী সেন কিংবা বীরভূমের দু'কড়িবালা দেবীর স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণ নারীশক্তির মুখ হয়ে ওঠে। তাই তরুণ সমাজের পাশে কল্যাণী সাজে বঙ্গনারীর শক্তিময়ী দিককে তুলে ধরে আন্দোলনের পথকে দৃঢ় করেছেন কবি। আর শেষ অবধি জ্বালিয়ে রেখেছেন 'আশাবাদ'কেও— 'মায়ের আশিসে হবে গৃহে গৃহে সুমঙ্গল।'
মোট আঠেরোটি কবিতা নিয়ে গ্রন্থিত 'স্বদেশিনী' কাব্যগ্রন্থ। কাব্যের নামকরণেই নারীভাবনার দীপ জাগ্রত। উনিশ শতকে নারীর কলমে যে হীনমণ্যতাবোধ বা পিতৃতান্ত্রিক ছায়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদহীন কবিতা কিংবা ঐতিহ্যাশ্রয়ী কবিতা দেখি তা বিশ শতকের প্রথম থেকেই কাটিয়ে ওঠার সক্রিয় প্রয়াস লক্ষ করা যায়। দেশাত্মবোধের নিরিখে পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার কবিতা লিখতে শুরু করেন নারীরা, যা নারীকণ্ঠের ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতার পথকে সুগম করে তোলে। এর জন্য সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের যে বিরাট গুরুত্ব আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 'রাখীমন্ত্র' কবিতায় দেখি—
"অনুপমা আর্যবমা করহ স্মরণ!
কর মনে দ্রৌপদীর বেণীবাঁধা পণ।
কঠিন পনের গুণে
সাবিত্রী শমনে জিনে
কেমনে দানিয়াছিল মৃতের জীবন"
শুধু স্বদেশ ভাবনা নয়, যেন নারীজাগরণের পথকে আরও সুগম করে তোলার কবিতা লিখলেন গিরীন্দ্রমোহিনী। সমাজমনস্কতা যে নারীকণ্ঠের মূল ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে তা উপলব্ধ করাতে চেয়েছেন কবি। বলা বাহুল্য, এই কাব্যে তাঁর রবীন্দ্রপ্রভাব সক্রিয় থেকেছে, তবুও কবিতার আস্তিক্যের দ্বীপ, স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবকবিত্ব তাঁর কবিতাকে স্বতন্ত্র মাত্রার করে তুলেছে— "ঐ ভরা গাঙে এসেছে জোয়ার/ ও ভাই ঝট চলে আয়, আয় কে যাবি পার।—(বঙ্গভঙ্গে কৃষকের গান)" কবিতায় 'মরা গাঙ' নয় বরং 'ভরা গাঙ'-এ জোয়ারের ইতিবাচক শক্তিকে প্রতিস্থাপন করেছেন কবি। আবার কখনো শাক্তপদে প্রভাব মিলেছে, যা সাহসের শক্তিমন্ত্র হয়ে উঠেছে এই কাব্যে—
"মা বলে কে ডাকবে তোরে
করলিনী তুই রে কালি!
মা হলে সন্তানের বুকে
ঢেলে দিতিস এমন কালী!
গত ১৮-ই আগস্ট ছিল কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর জন্মদিন। ১৫-ই আগস্টের ঠিক তিন দিন পরেই। ক'জনই তাঁর জন্মদিনের স্মরণে রেখেছি! স্বদেশ ভাবনার নিরিখে নারী প্রণিত এই মূল্যবান কব্যগ্রন্থের কথা ক'জনই বা মনে রেখেছি! এভাবে ব্রাত্য থেকে যাওয়া গিরীন্দ্রমোহিনীরা যে শুধুমাত্র অন্তঃপুরচারিনী কবি নন, তা উপলব্ধির সময় যেমন এসেছিল পঞ্চাশের কবিতা সিংহদের হাত ধরে, ঠিক তেমনই সেই উপলব্ধির ধারক'এর পাশাপাশি বাহক হয়ে ওঠার সময় এসেছে আজকের প্রজন্মের। তা না হলে মাত্র একশো পনেরো বছরের ইতিহাস থেকে মুছে যাবে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়া আসা নারীর বিপ্লবময় পদক্ষেপ, হারিয়ে যাবে হিরন্ময়ী দেবী, মানকুমারী বসু, অনুপমা দেবী, সরোজিনী দেবীরা। এ দায়িত্ব এই প্রজন্মেরই।
গ্রন্থঋণ ও কৃতজ্ঞতা— বাংলা সাহিত্যে পঞ্চ অনন্যা, ড. স্বপনকুমার মণ্ডল।
বঙ্গভঙ্গ ও বাঙালিসমাজ, স্বপনকুমার মণ্ডল (সম্পাদনা)।
সুচিন্তিত মতামত দিন