শনির বচন | নাইন-ইলেভেন কুড়ি বছরের খতিয়ান

শব্দের মিছিল

অপপ্রচার মিথ্যাচার ধোঁকাবাজি লোকঠকানো ফেকনিউজ আর মানুষ খুনের কুড়ি বছর। যার গালভরা নাম নাইন-ইলেভেন। না, আজও বিশ্বের কোন তদন্তে কোন আদালতে কোন দেশের আইনে এটা প্রমাণিত হয়ে যায়নি যে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার বিন লাদেন ও তার সংগঠন আলকায়দাই ধ্বংস করেছিল। এটাও প্রমাণিত হয়নি যে বিন লাদেনের সাথে তালিবানদেরও এই ষড়যন্ত্রে কোন যোগ ছিল। এমনকি আজও প্রমাণ করা যায়নি, সত্যিই কোন প্লেন টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে আঘাত হেনেছিল কিনা। কিন্তু বিশ্বের বরেণ্য পদর্থবিদরা এটা বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কোন প্লেনের পক্ষেই টুইন টাওয়ারকে ঐরকম ভাবে তাসের ঘরের মতো ধূলিস্যাৎ করে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয় যদি না আগে থেকেই টাওয়ার দুইটির ভিতরে বিস্ফোরক মজুত রাখা থাকে। কিন্তু প্রায় শতাধিক বিজ্ঞানী যে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। সেই বিষয়টিকেও মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় চেপে যাওয়া হয়েছে। কোন আদালত কর্তৃকও কোন স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকেও সেই বিষয়ে কোন তথ্য সম্প্রচারিত হয়নি। ফলে আসল সত্যগুলি এই কুড়ি বছর পরেও সাফল্যের সাথে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।

না, কিভাবে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করা হয়েছিল। ঠিক কোন কোন দেশ সেই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগত ভাবে কতক্ষণ আগে থেকে জানতেন টুইন টাওয়ার ধ্বংস হতে যাচ্ছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মাস খানেক আগে টাওয়ার দুইটি’র মালিকানা কার নামে বদল হয়েছিল। তিনি টাওয়ার দুইটির বীমা বাবদ কত টাকা লাভ করেছিলেন। সেইসব বিষয় নিয়ে বিগত কুড়ি বছরে যত তথ্য উঠে এসেছে সেই বিষয়ে আজ আমাদের আলোচনা নয়। আগ্রহী পাঠক ইনটারনেট সার্চ করে বিভিন্ন প্রামাণ্যসূত্র থেকে আসল সত্য ও তথ্যগুলির সন্ধান করে নিতে পারেন। আমরা বরং দেখার চেষ্টা করি। দুনিয়া জুড়ে মিথ্যাচার ও ধোঁকাবাজির সিণ্ডিকেটের রকমসকম। টাওয়ার ধ্বংসের পরপরই ঘোষণা করে দেওয়া হলো বিন লাদেন ও তার সংগঠন আলকায়দা মার্কিন ভুখণ্ডে আত্মঘাতী বিমান হানা চালিয়েছে। না কোন তদন্তের পরে এই ঘোষণা করা হয়নি। ঘটনার আকস্মিকতার ভিতরেই সমস্ত প্রচার মাধ্যম একযোগ বিন লাদেন ও আলকায়দাকে কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছিল। কারা কারা বিমান হাইজ্যাক করেছিল। তাদের ঠিকুজিকুলুজি সমেত ছবি ফলাও করে প্রচারিত হয়ে গেল। কি নিখুঁত পরিকল্পনা। এতবড়ো কাণ্ড ঘটে গেল। পুরো টুইন টাওয়ার ভষ্মীভুত হয়ে গেল। অথচ মহম্মদ আটার পাসপোর্ট কুড়িয়ে পাওয়া গেল ম্যানহাটনের রাস্তায়। সেটি পুড়ে ছাই হয়ে গেল না। এবং অক্ষত অবস্থায় এসে উঠল মার্কিনদের হাতে। সারা বিশ্বকে বেকুব বানানোর অস্ত্র হিসাবে।

আসল গল্পের শুরু তার পর থেকেই। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেই শতাব্দীর সেরা বাণী। হয় আমাদের সঙ্গে থাকো। নয় আমাদের আক্রমণের শিকার হও। অর্থাৎ মার্কিনশক্তির বশংবদ হয়ে তাদের দাসত্ব স্বীকার করে না নিলে মার্কিনশক্তির মিসাইল ও বোমারু বিমানের সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে হবে। তা সে, যে দেশ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন। ফলে শুরু হয়ে গেল আক্রমণের অশ্বমেধ ঘোড়ার দৌড়। আফগানিস্তান আক্রমণের সময়ে মার্কিনশক্তি বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিল। পৃথিবী থেকে তালিবানদের সমূলে বিনাশ করার কথা। জানিয়েছিল আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা। জানিয়েছিল গোটা বিশ্ব থেকে টেররিজম নির্মূল করার কথা। ইরাক আক্রমণের সময়েও সেই একই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বাঁধা গত। সাথে সাদ্দাম হোসেনের গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের কারবার ধ্বংসের গল্প। লিবিয়ার গদ্দাফীর বেলাতেও একই কথার এপিঠ আর ওপিঠ। অর্থাৎ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের একটি ঘটনায় এই মার্কিনশক্তি বিশ্বের যেকোন দেশকে যেকোন সময়ে ধ্বংস ও পদানত করে দখল করার অধিকার পেয়ে গেল। আর বাকি বিশ্ব দুইবাহু তুলে মার্কিনশক্তির সেই অন্যায্য অধিকারকেই স্বীকৃতি দিয়ে দিল। একটা ধোঁকাবাজি সারা বিশ্বকেই মার্কিন শক্তির পদনত করে ফেলল। ফলে এক অনবদ্য ধোঁকাবাজিকেই প্রোপাগাণ্ডা হিসাবে চালিয়ে যাওয়া হল দুই দশক ধরে। বিশ্ব টেররিজমের বিরুদ্ধে বিশ্বের একমাত্র রক্ষাকর্তা না’কি মার্কিনশক্তি। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস কেন, গোটা মানব জাতির ইতিহাসে এর থেকে বড়ো ধোঁকাবাজি আর নাই।

বিশ্বরাজনীতির ণত্ব ষত্ব যাঁদের কিছুটা হলেও জানা আছে। তাঁরা জানেন। মার্কিন অর্থনীতি বিগত তিন দশক জুড়ে এই একটি ধোঁকাবাজির উপরেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে টেররিজমের চাষই মার্কিন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখে। বিশ্বের নানা প্রান্তে যত বেশি টেররিজমের জুজু কায়েম হতে থাকবে। মার্কিন সমরবাণিজ্য তত বেশি ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকবে। আর সেই টেররিজমকে যদি ইসলামিক টেররিজম নাম দেওয়া যায়, তবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের খনিজতেলের বাণিজ্যকে মার্কিনশক্তির নিয়ন্ত্রণে ও স্বার্থে কায়েম রাখা যায় একদিকে। অন্যদিকে গোটা বিশ্বে ইসলামিক টেররিজমের জুজু দেখিয়ে অস্ত্র ব্যাবসার বাজার বাড়িয়ে তোলা যায়। আর এইখানেই নাইন-ইলেভেনের ধোঁকাবাজির আসল কার্যকরিতা। গোটা পৃথিবীকে বেকুব বানিয়ে রেখে দুই দশক ধরে একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুঠের কারবার। আর অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে টেররিজমের চাষ চালিয়ে অস্ত্রবাণিজ্যের বাজার বৃদ্ধি করে মার্কিন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখা। আর গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ক্রমাগত আত্মপ্রচার আর অপপ্রচার। ক্রমাগত ধোঁকাবাজি আর মিথ্যাচার।

হ্যাঁ, আফগানিস্তানে গণতন্ত্র আনাও সেইরকমই একটা ধোঁকাবাজি ছিল। আফগানিস্তানের মাটি থেকে তালিবানদের নির্মূল করে বিনাশ করাও সেই রকমই একটা ধোঁকাবাজি ছিল। বিশ্ব থেকে টেররিজম উৎখাত করাও সেই রকমই একটা ধোঁকাবাজি। ঠিক যেমন সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের কারবারের অভিযোগও একটা ধোঁকাবাজি ছিল। এবং সব শেষে আফগানিস্তানে তিন লক্ষাধিক সৈন্যসহ আধুনিক সমারাস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী সামরিক বাহিনীও একটা বিপুল ধোঁকাবাজি ছিল। এত বড়ো ধোঁকাবাজি ছিল যে, কেবলমাত্র গাদা বন্দুকধারী হাজার ষাটেক তালিবানী পথে নামতেই সেই তিন লক্ষাধিক সৈন্যের সামরিক বাহিনী বেমালুম ভ্যানিশ! এবং আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র। সেও আর এক ধোঁকাবাজি। ধরে ধরে মার্কিনশক্তির বশংবদ কজনকে একটা পুতুল সরকারে বসিয়ে দিলেই একটা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না। মার্কিন বন্দুকের ডগায় নকল নির্বাচন সংঘটিত করলেই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় না। না, আফগানিস্তান বা ইরাক। লিবিয়া বা সিরিয়া। কোথাও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা মার্কিনশক্তির লক্ষ্য নয়। প্রতিটি দেশেই একটা বশংবদ পুতুল সরকার স্থাপন করাই তাদের আসল এজেন্ডা। যে সরকার পেন্টাগনের কথায় দুইবেলা ওঠবোস করবে। মার্কিন অর্থনীতিকে পুষ্ট করতে থাকবে স্বদেশের অর্থনীতিকে শোষণ করে। এটাও মার্কিনশক্তির মূল এজেণ্ডা। সেই এজেণ্ডা সফল করে তুলতে গেলেই ধোঁকাবাজি অপপ্রচার মিথ্যাচার এবং ক্রমাগত ফেকনিউজ ছড়িয়ে লোকঠকানো সবচেয়ে কার্যকরি এক পথ। আর সেই পথের শ্রেষ্ঠ পথিক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ঠিক এইদিনে যে যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। আজ তার কুড়ি বছর পরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রাখলেই মার্কিন যড়যন্ত্রের বিষয়টি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে।

না, আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি। মার্কিনদের বসানো পুতুল সরকার একদিনেই ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। না, মার্কিনশক্তি আফগানিস্তান থেকে তালিবানদের নিঃশ্চিহ্ন করে দিয়ে যায়নি। উল্টে সেই তালিবানদের সাথেই চুক্তি করে আফগানিস্তান ছেড়েছে। ছাড়ার আগে তালিবানদেরকে বিনারক্তপাতে কাবুলের মসনদে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এবং সেই দিপাক্ষিক চুক্তি মতোই বর্তমান তালিবান সরকার মার্কিন স্বার্থ পুরণে বাধ্য থাকবে। না, কোন দেশ থেকেই ইসলামিক টেররিজম নির্মূল করা হয়নি। বরং বিশ্বজুড়েই টেররিজমের জাল আরও বিস্তৃত হয়েছে। আর যত বিস্তৃত হয়েছে তত মার্কিন অস্ত্রবাণিজ্য বছর বছর ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ফলে শুধুমাত্র মার্কিনশক্তির স্বার্থে আফগানিস্তান সহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যই আজ প্রায় বিদ্ধস্ত। বিপর্যস্ত জনজীবন। বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বিপর্যস্ত শিশুদের ভবিষ্যৎ। এবং বিপদগ্রস্ত নারীদের জীবন ও জীবিকা। ইসলামিক মৌলবাদ আরও বেশি করে শিকড় বিস্তার করেছে। নারী স্বাধীনতার পরিসর আরও বেশি করে সংকুচিত হয়েছে। শিক্ষা বিস্তার রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ধর্মীয় উন্মাদনা ও মৌলবাদের উত্থান হয়েছে, ঠিক যেমনটা চেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইসলামিক দেশগুলিতে ধর্মীয় উন্মাদনা ও মৌলবাদের বিস্তার না ঘটালে তাদেরকে শতকের পর শতক ধরে পাশ্চাত্যের স্বার্থের কাছে বশংবদ করে রাখা যাবে না। ফলে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ঠিক এই দিনে যে ষড়যন্ত্রের শুরু হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসি’র হেডকোয়ার্টার থেকে। বিগত কুড়ি বছরে তারই ফসল ঘরে তুলে ফেলেছে মার্কিণশক্তি ও তার দোসরেরা।

১১ই সেপটেম্বর’ ২০২১

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.