শনির বচন | প্লেয়িং ইলেভেনে থাকা না থাকা

শব্দের মিছিল

কবি গান বেঁধেছিলেন, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’। কবি জানতেন কিনা জানি না। সেই সোনার হরিণ কালে কালে রূপ বদলাতে থাকে। রামায়ণের যুগ থেকে আজকের রামরাজত্বের যুগেও। এই যুগে সোনার হরিণ যে অবতারে আবির্ভুত, সেই অবতারের হাল ফ্যাশনের নাম কিন্তু ‘প্লেয়িং ইলেভেন’। এতদিন নামটি ঠিক প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয় নি তেমন ভাবে। অন্তত কোন সাংসদ বিধায়ক নেতানেত্রী প্রকাশ্যেই অন ক্যামেরা প্রেস কনফারেন্সে প্লেয়িং ইলেভেনে থাকার জন্য ঝোঁক বায়নাক্কা দরকষাকষি করার কথা স্বীকার করেননি এমনভাবে। প্লেয়িং ইলেভেনে থাকা না থাকা নিয়ে রাজনৈতিক দরকষাকষির বিষয়টি বহু পুরানো‌ যদিও। অন্তত সংসদীয় গণতন্ত্রে আয়ারাম গয়ারামের যুগপর্ব জুড়েই। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে সেই প্লেয়িং ইলেভেনে থাকার বিষয়টি নিয়ে এমন অভুতপূর্ব স্বীকারক্তি কিন্তু এই প্রথম। প্রায় ঐতিহাসিক। মন্ত্রীত্ব, তাও আবার পূর্ণ মন্ত্রীত্বও নয়। হাফ মন্ত্রীত্ব। যে মন্ত্রীত্বে সরকারী ফাইল নাড়াচাড়া করারও শিকে ছেঁড়ে না সহজে। সেই হাফ মন্ত্রীত্বও চলে যাওয়ার বিষয়টি যে আসলেই রিটায়ার্ড হার্টের মতো গুরুতর সমস্যা। সেটিও জানা গেল এই প্রসঙ্গেই। না চোট যে গুরুতর সে কথা মাস খানেক ধরেই মালুম হচ্ছিল আম জনতার। হাফ মন্ত্রীত্ব থেকে ফুল মন্ত্রীত্ব পাওয়া তো দূর। একেবারে এপ্রিলফুল করে রিটায়ার্ড হার্ট করে দেওয়ার মতো আঘাত সামলানো সকলের পক্ষে সম্ভব নাই হতে পারে। সকলের পক্ষে সম্ভব হয়ও না। তাই দলবদলের একেবারে সূচনাপর্বেই প্লেয়িং ইলেভেনে থাকার বিষয়টি পাকা করে ফেলারও দরকার ছিল বই কি। অনেকটা বিয়ের আগে পাকা দেখার মতোনই আনুষ্ঠানিক হলেও গুরুত্বপূর্ণ। সুখের কথা, বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পথেই বিষয়টি আমজনতার কাছে পরিস্কার করে দেওয়ার ভিতর বাহাদুরী আছে বলতে হবে। হ্যাঁ এবারে প্লেয়িং ইলেভেনে ঠাঁই পাওয়া নিয়ে আর রাতের ঘুম বরবাদ করতে হবে না। উল্টে সমর্থক থেকে ফ্যানেদের ভিতরে জনপ্রিয়তার পারদকেও বেশ কিছুটা চড়িয়ে রাখা গেল। ফলে জননেতা না হোক সেলেব্রিটি হিসেবেও খবরের শিরোনাম থেকে নতুন দলের অলিন্দে রাজনৈতিক ফোকাসের কেন্দ্রবৃত্তেও নিজের একটা পাকা আসন তৈরী করে নেওয়ায় সুবিধে হলো বইকি। একেই বলে সোজা ব্যাটে খেলা। আয়ারাম গয়ারামের রাজনীতিতে, কে জানে একটা নতুন ট্রেণ্ড তৈরীর পথরেখা হিসেবে এই ঘটনা একটা স্থায়ি অভিঘাতও তৈরী করতে পারে বইকি।

পারুক বা না পারুক। সে ভবিষ্যতের কথা। আপাতত বঙ্গরাজনীতির রঙ্গমঞ্চ জুড়ে একজন রিটায়ার্ড হা্র্ট সেলেব্রিটি সাংসদের প্লেয়িং ইলেভেনে থাকা না থাকাই বঙ্গ রাজনীতির শিরোনাম। না, সবাই যে এমন সোজা ব্যাটে খেলতে দক্ষ তাও নয়। তাই বলে প্লেয়িং ইলেভেনে ঠাঁই পাওয়ার দীর্ঘ লাইনে রাজনৈতিক মুখের কোন অভাব নেই। এখন প্রশ্ন একটাই। প্লেয়িং ইলেভেনে ঠাঁই পাওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট দীর্ঘ লাইনে বহু আগে থেকেই যাঁরা মানত করে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছে। তাদেরকে টপকিয়ে এমন সোজা ব্যাটে খেলে দিয়ে বেলাইন করার বিষয়টি সকলেই কি মুখবুঁজে মেনে নেবে? অবশ্য সেটা দলীয় নেতৃত্বের মাথাব্যথার বিষয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক কিংবা ভোটার, কারুরই নাক গলানোর মতো বিষয় নয় সেটি। তবে এমন সোজা ব্যাটে বেলাইন করার ঘটনা সচারচর দেখা যায় কম। সব দলেই সব সরকারেই প্লেয়িং ইলেভেনে ঠাঁই পাওয়া নিয়ে দলীয় নেতানেত্রীদের ভিতর তীব্র রেষারেষি প্রতিযোগিতা থাকে। থাকবে। কিন্তু বিপক্ষ দলের কোন সৈন্য হঠাৎ রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে সহানুভুতির আবেগকে কাজে লাগিয়ে লাইন টপকিয়ে প্লেয়িং ইলেভেনে ঢুকে পড়বে সিং বাগিয়ে। সেটা হয়তো অনেকের কাছেই ততটা অভিপ্রেত ছিল না। থাকার কথাও নয়। কিন্তু নিন্দুকের কথা মতো যে দলে একটাই পোস্ট বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। সেদলে টিকে থাকার একটাই মন্ত্র, ধৈর্য্য ও সহ্যশক্তি। একটাই পথ, পদলেহন আর তৈলমর্দন। একটাই কর্ম, বাধ্যতা আর মোসাহেবি। তারপর ‘সকলই তোমার ইচ্ছে। ইচ্ছাময়ী তারা তুমি। তোমার কর্ম তুমি করো মা। লোকে বলে করি আমি’। ‘আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী। আমি রথ তুমি রথী। যেমন চালাও চলি আমি’। হ্যাঁ সেইভাবেই, তেমন করে চলতে পারাই টিকে থাকার একমাত্র পথ। দলীয় কর্মীদের জন্য যে অনুশাসন। বিপক্ষ দলের রিটায়ার্ড হার্ট সৈন্যের জন্যও সেই একই অনুশাসন চালাতে গেলে তো আর আয়ারাম গয়ারামের রাজনীতি চালানো যায় না। ফলে আয়ারাম গয়ারামদের জন্য অনুশাসন কিছুটা শিথীল তো করতেই হয় সময় অসময়ে। না হলে চলবেই বা কি করে? আর সেই আয়ারাম যদি আবার সেলেব্রিটি তরুণ তুর্কী হন। যদি এমন সোজা ব্যাটে খেলার দক্ষতা ধরেন। তখন সত্যিই তো আর বলার কিছু থাকে না। সোজাসুজি সরাসরি প্লেয়িং ইলেভেনের নামের লিস্টে নাম টুকে নেওয়া ছাড়া। রাজনীতির নিয়মই যে সেরকম। কোন নিয়মই পরম নয়।

রাজনীতির পরম নীতি একটিই। প্লেয়িং ইলেভেনে থাকা। জনসেবা বা দেশসেবা একটা সাংবিধানিক পরিভাষা মাত্র। আসল কথা একটাই। যেভাবেই হোক আর যেমন ভাবেই হোক। প্লেয়িং ইলেভেনে থাকতে হবে। না, সাইডলাইনে অপেক্ষা করা সকলের জন্য শোভন নাই হতে পারে। বিশেষ করে যারা নিজ কৃতিত্বেই জনপ্রিয় সেলেব্রিটি। যে জনপ্রিতাকেই রাজনীতিতে ইনভেস্ট করে সাংসদ বিধায়ক হওয়া। সেই ইনভেস্টারকেই যদি সাইডলাইনে বসিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তবে সে বিশ্বের যত বড়ো বৃহৎ দলই হোক না কেন। জীর্ণবস্ত্রবৎ পরিত্যাজ্য। ফলে যে সেলেব্রিটি এক দলের সাইডলাইন থেকে দলত্যাগ করে অন্যদলে লাইনবদল করবেন। তিনি তো সকলের আগে নতুন দলের প্লেয়িং ইলেভেনে থকার বিষয়টি নিয়ে সঠিক ভাবে দরকষাকষি করে নেবেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। অন্তত ভারতীয় রাজনীতিতে এর বাইরে অন্য কিছু ভাবা যায় কি? ভাবা সম্ভব আদৌ? ফলে এটা নতুন কোন ঘটনাও নয়। নতুন ইতিহাস গড়াও নয়। নতুন যেটি সেটি হলো একটা ওপেন সিক্রেটকে প্রকাশ্য দিবালোকে স্বীকৃতি দেওয়া। হ্যাঁ সেটা একটা বাহাদুরী বটে। সেকথা স্বীকার করতে হবে বইকি। কিসের জনসেবা। কিসের দেশসেবা। জনতার জন্য জনতা নিজেই যথেষ্ঠ। যার যেমন বুদ্ধির দৌড়। সে তেমন আখের গুছিয়ে নিক না। ক্ষতি কি। দেশনেতার কাজ একটাই, প্লেয়িং ইলেভেনে নিজের জায়গাটা পাকা করে নেওয়া। তবেই না জননেতা। তবেই না দেশনেতা। যে নেতা দলের ভিতরেই প্লেয়িং ইলেভেন থেকে ছিটকিয়ে যান। যিনি নিজ দলের প্লেয়িং ইলেভেনেই নিজের জায়গা ধরে রাখতে পারেন না। তিনি যত বড়ো সেলেব্রিটিই হোন না কেন। জনতার কাছে কিন্তু তিনি একটি বাতিল ঘোড়া। জনতার কাছে তাঁর তখন কোন মূল্য নেই। ফলে জননেতা হোক কিংবা দেশনেতা হোক। সেই পর্যায় উঠতে গেলে দল বা সরকার। দুইয়েরই প্লেয়িং ইলেভেনে নিজের জায়গা পাকা করে নিতে হবে। যতদিন সেই জায়গা পাকাপোক্ত। ততদিনই সেই দলের একনিষ্ঠ সেবক রূপে নিজেকে তুলে ধরাই আসল রাজনীতি। যেদিন সেই জায়গা হাতছাড়া হবে। সেদিন আর পিছন ফিরে তাকালে হবে না। যতই ট্রোল শুরু হোক না কেন। যত রকমই মিম তৈরী হোক না কেন। সেসব ভেবে লজ্জার মাথা খেয়ে বসে থাকলে আর জননেতা কিসের? লজ্জা ঘেন্না ভয় তিন থাকতে নয়। নীতি আদর্শ মানবিকতা তিন থাকতেও নয়। রাজনীতি এক অন্য ময়দান। এখানে লক্ষ্য একটাই প্লেয়িং ইলেভেন। সেই বৃত্তে থাকতে পারলেই রাজনীতি। করজোড়ে ভোটারের বাড়িতে দৌড়। আর সেই প্লেয়িং ইলেভেন থেকেই ছিটকিয়ে গেলে আর কোন মুখে জনতার কাছে মুখ দেখানো যায়? না, একবার প্লেয়িং ইলেভেন থেকে ঘাড় ধাক্কা খেয়ে সাইডলাইনে বসে গেলে। একজন জননেতার পক্ষে সেটাই তার রাজনৈতিক মৃত্যু। কে’ই বা তেমন মৃত্যুর মুখোমুখী হতে চায়? আর আয়ারাম গয়ারামের সংসদীয় রাজনীতির হাঠ যতদিন খোলা থাকবে। ততদিন তো কোন কথাই নেই। দলেরও কোন অভাব নেই। দরকষাকষিরও কোন শেষ নেই। ফলে আয়ারাম গয়ারামদের জন্য সব দরজাই খোলা। সঠিক সময়ে সঠিক দরজায় একটা নক করা শুধু। তারপর ঝালমুড়ির স্মৃতি ঝাপসা হয়ে না গেলে তো আর কথাই নাই। ঝাপসা হয়ে গেলেও অসুবিধা নাই। নতুন করে একবার ঝালিয়ে নেওয়া যেতেই পারে ঝালমুড়ির সুখস্মৃতি।


১৯শে সেপটেম্বর’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.