কলিংবেলের আওয়াজে একটু অবাক হলেন সমীর। সবেমাত্র বাগানের গাছপালায় জল দিয়ে, গোড়া নিড়িয়ে, ঘন্টা দুয়েক পরিশ্রম করে , হাত-পা ধুয়ে গরম চায়ের কাপ নিয়ে আয়েশ করে বসেছেন। মায়ের ঘরে মা'কেও চা দিয়ে এসেছেন। অণিমা বাসন মেজে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে দিয়ে চলে গেছে। আজ শনিবার, আজ বিকেলে ছাত্রদের পড়তে আসার কথাও নেই। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজে। কে এল এখন? সহকর্মী অলক কিংবা শান্তুনু? নাকি পাড়ার কেউ?
দরজা খুলে সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে খানিকক্ষণ থমকে গেলেন সমীর। ততক্ষণে তাঁর অতিথি একগাল হেসে, একটু হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন,
"কেমন আছেন সমীরবাবু? চিত্রা কোথায়? দেখুন কেমন আপনাদের সারপ্রাইজ দিতে এসে গেলুম।"
সাময়িক থতমতভাব কাটিয়ে ,"আরে কী কান্ড..." ইত্যাদি বলতে বলতে যাঁকে ভেতরে আহ্বান জানালেন সমীর, তিনি কুন্তলা, সমীরের স্ত্রী চিত্রার স্কুলের বান্ধবী। বছর কয়েক আগে অনেক চেষ্টায় চিত্রার বাপের বাড়ির নতুন ঠিকানা যোগাড় করে আবার স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। ছোটবেলায় নাকি দক্ষিণ কলকাতায় একই পাড়ার বাসিন্দা ছিলেন , ক্লাসে পাশাপাশি বসতেন, টিফিনে ঝালমুড়ি ভাগ করে খেতেন। এর আগেও একবার এসে ঘুরে গেছেন সমীর -চিত্রার বাড়ি, কিন্তু সেবারে বাড়িতে চিত্রা উপস্থিত ছিলেন, মেয়ে ঝিমলি,ছেলে টুকাই উপস্থিত ছিল। হইহই করে কেটেছিল দুই-তিন দিন। এবারের পরিস্থিতিটা একেবারেই আলাদা।
চিত্রার মায়ের শরীরে বহুদিন ধরেই নানারকমের সমস্যা । দুইদিন আগে চিত্রার ভাই প্রণব ফোন করে জানিয়েছেন যে তাঁদের মায়ের শারীরিক অবস্থায় বেশ অবনতি হওয়ার ফলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই খবর পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই চিত্রা কলকাতায় যেতে চান। এখন গরমের ছুটি চলছে, তাই সমীর এবং চিত্রা, দুজনেরই স্কুল ছুটি। টুকাইয়ের তো ছুটি বটেই। ঝিমলি তো বছর দুয়েক হল সে শহরেরই বাসিন্দা। তাই টুকাইকে নিয়ে চিত্রা মাত্র গতকালই বিকেলের ভল্ভোতে কলকাতা গেছেন। এদিকে সেই কলকাতা থেকেই কিনা চিত্রার প্রিয় বান্ধবী আজ তাঁদের এই আসানসোলের বাড়িতে উপস্থিত। ইশ, আসার আগে যদি একবার চিত্রাকে ফোন করে নিতের কুন্তলা! - চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করার ফাঁকে ভাবতে থাকেন সমীর। ইতিমধ্যে সমীরের মা বেরিয়ে এসেছেন তাঁর ঘর থেকে। কথা বলছেন কুন্তলার সঙ্গে। ভাগ্যিস মা আছেন বাড়িতে, বুলিদের বাড়ি চলে যান নি। বুলি সমীরের বোন, শহরের আরেক প্রান্তে তার বাস। মা মাঝেমাঝেই মেয়ের বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিনের জন্য থেকে আসেন। মা না থাকলে,একা বাড়িতে এক স্বল্প-পরিচিতা, অনাত্মীয়া অতিথিকে কীভাবে আপ্যায়ন করতেন, ভেবেই গায়ে জ্বর এল সমীরের।
"আসলে মাসীমা, আমার তো আসার প্ল্যান ছিল না...পাড়ার একটা দলের সঙ্গে বোলপুর গেছলুম শুক্রবার, রবিবার তো ফিরেই যেতুম...সেখানে আমাদের হোটেলে এই আপনাদের আসানসোলের পাঁচ ছয়জন ছেলে ছিল...ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই চিত্রার জন্য বড্ড মন কেমন করল, তাই ওদের সঙ্গেই আজ চলে এলুম...বল্লুম, ভাই আমাকে একটু চেলিডাঙ্গার মোড়ে নামিয়ে দিও...তো এই তো মোড়ের কাছেই দিব্যি নামিয়ে দিয়ে গেল..., কালকেই আবার দিনে বেরিয়ে যাব, পরশু আবার ওনার রাতে দিল্লি যাওয়া আছে কিনা...কিন্তু চিত্রাটাই যে থাকবে না কী করে জানব বলুন তো মাসিমা..." বলে হাহা করে হেসে ওঠেন কুন্তলা।
"একা একা অচেনা ছেলেদের গাড়িতে চড়ে চলে এলে তুমি? ভয় করল না?" খানিক অবাক স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন সমীরের মা।
"আরে মাসিমা, অত ভয় পেলে কি আর নিজের মনে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে পারব নাকি?... রুবুর বাবাও রাগারাগি করে মাঝেসাঝে, আমি পাত্তা দিই না... ওহ হো, এই যে, এটা আপনার জন্য মাসিমা" বলে ব্যাগ থেকে মিষ্টির এক বড়সড় প্যাকেট বের করে, রমার হাতে দিয়ে, আরাম করে সোফায় পা তুলে বসেন কুন্তলা।
এইজন্যই এই মেয়েটিকে বিশেষ পছন্দ করেন না রমা । এমনিতে আর কী...ফোনটোন করে মাঝে মাঝে, ফোন করলেই প্রণাম জানায়, জোর করে তাঁকে ফোনে ডেকে কথা বলে। কিন্তু বড্ড হই হই করছে যেন সবসময়ে। দুই ছেলে মেয়ের মা, স্বামী নাকি বিরাট ডাক্তার, একা একা কাদের বা সঙ্গে বোলপুর বেড়াতে গেছিল, আবার আরেক অচেনা দলের সঙ্গে আজ আসানসোল। আবার কাল ফেরত যাবে কলকাতা। বউ মানুষের এত হইহই, এত একা একা নিজের মত ঘোরাঘুরি একেবারেই মেনে নিতে পারেন না রমা। তাঁর শান্ত, বাধ্য ছেলের বউ-এর এমন একখানা বন্ধু ছিল, আবার এই এতবছর পরে হঠাৎ সে পুরনো বন্ধুকে খুঁজেও পাবে, সে আর কে জানত? এই যে চিত্রা বেয়ানের শরীর খারাপের খবর পেয়েই সমীরকে ছাড়া দৌড়াল, সেটা কি পারত আর কয়েক বছর আগে হলে? নেহাত এখন নাতনি নিজেই কলকাতায় হস্টেলে থাকে, নাতিটা ডাকাবুকো হয়েছে,সে তার কান্নাকাটি করা মা'কে বলল," আমি তোমাকে মামাবাড়ি নিয়ে যাব, বাবা আর ঠাম্মা থাক এখানে..." , আর বলেই বিকেলের ভল্ভো বাসের টিকিট কিনে এনে ড্যাং ড্যাং করতে করতে মা'কে নিয়ে চলে গেল। বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গভীর রাতে কলকাতায় যায় কেউ? তবে ছেলেও আজকাল অনেক নরম হয়ে গেছে বুঝতে পারেন রমা, তাই আর কিছুই বলেন নি। বললেও কি শুনত কেউ?
সে যাকগে, এখন একে আবার রাতে কী খেতে দেবে সমীর, কোথায় শোয়ার ব্যবস্থা করবে কে জানে! সংসারের কাজকর্ম থেকে রমা অনেকদিন হল ছুটি নিয়েছেন। রান্না-বান্না একেবারেই করেন না। পুজো-আর্চা, বই পড়া, টিভি দেখা নিয়েই থাকেন। নিত্যদিনের আমিষ-নিরামিষ দুই রান্নার ভারই চিত্রার ওপর। চিত্রা একবেলারও কম সময়ের মধ্যে ছেলের জন্য ফ্রিজ ভর্তি রান্না করে রেখে গেছে, তাতে তার দিন তিনেক চলে যাবে। তাঁর রাতে বরাদ্দ দুধ-খই, আর দিনের নিরামিষ দুটো তরকারি চিত্রা করে রেখে গেছে। পরশু মেয়ে ঠিক জামাইয়ের হাত দিয়ে রান্না করে কিছু পাঠাবে বা নিয়ে আসবে। তাঁদের মা-ছেলের রাতের খাবার গোছানো আছে। এর জন্য তাহলে কি ভাত চাপানো হবে? চিত্রার বন্ধুর জন্য ভাবার খুব শখ নেই তাঁর। কিন্তু যখন এসেই পড়েছে, তাই যতক্ষণ না যায়, ততক্ষণ অবধি যাতে যত্ন আত্তি কম না হয়,সেটা না ভেবে আর পারছেন কই? ওদিকে অতিথি তো গরম চায়ের কাপ হাতে মোবাইল ফোন বাগিয়ে তার বান্ধবীকে ফোন করছে আর বকবক করছে। সমীর ও বসার ঘরেই চায়ে চুমুক দিচ্ছে, তার মুখ দেখে তো বোঝা যাচ্ছে না কী ভাবছে।
"আপনি কি রাতে ভাত খান, নাকি রুটি? ..." সমীরের প্রশ্ন শুনে , এই প্রথম মনে হল কুন্তলা একটু বিব্রত ।
"আপনাদের খুব অসুবিধায় ফেলে দিলুম না?... আমার ভাত-রুটি সব চলে ,আপনি ভাবছেন কেন সমীরবাবু...মাসিমা, আমি নিজেই একটু ভাত করে নেব...ঘি-মাখন আছে তো কিছু? ওতেই হবে, আমি রাতে খুব কম খাই, একেক দিন তো খাই ও না...স্কিপ করি..."
কুন্তলার কথা শেষ হওয়ার আগেই আবার কলিং বেল বাজার আওয়াজে দরজা খুলতে গেলেন সমীর।
একটু পরেই সমীরের পেছন পেছন অফিস ব্যাগ কাঁধে ঘরে ঢুকল বিশ্বজিৎ।
"কেমন আছেন দিদা?" একগাল হেসে রমাকে প্রণাম করল বিশ্বজিৎ, সম্পর্কে সে রমার মেয়ে বুলির ভাশুরপো,দমদমে থাকে, ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করে। কিন্তু বিশ্বজিৎ বুলিদের বাড়ি না গিয়ে এখানে কেন?
"ওমা, বিশ্ব...কেমন আছ তুমি?এখানে? ... তুমি জানতে না বুলিরা নেই?"
"আরে না না দিদা, জানলে কি আর আসি! আমার এদিকে ট্যুর ছিল, সকাল থেকে দুর্গাপুর হয়ে আসানসোলে এসেছি বিকেলের দিকে, কাজ সেরে বেরোতে দেরি হয়ে গেল, এখন আর কলকাতার দিকে ফিরব না ভেবে কাকার বাড়িই তো গেলাম প্রথমে...আগেও তো কত এসেছি এরকম...গিয়ে দেখি তালা...তখন ফোন করাতে কাকা-কাকিমা বলছেন ওরা বর্ধমান গেছেন, বরযাত্রী হয়ে, ফিরতে ফিরতে তো রাত পেরিয়ে যাবে...কাকিমাই বললেন আজ রাতটা আপনাদের এখানে থেকে যেতে...খুব অসুবিধা হল না?"
"এহে...তুমি যাওয়ার আগে ফোন করনি?"
"করেছিলাম মামা, কিন্তু ওরা কেউ ফোন তোলেনি তখন...বিয়েবাড়ি তো, বুঝতেই পারছেন...আমি কাল ভোরেই বেরিয়ে যাব মামা..." কুন্ঠিত স্বরে জানায় বিশ্বজিৎ। তারপরে আরও মৃদুস্বরে জানতে চায়,"মাইমা? টুকাই...ঝিমলি ...কেউ নেই?"
"না হে, কেউ নেই... বলছি তোমায়...আগে হাত মুখ ধোও...দাঁড়াও তোমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিই..." ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সমীর দেখলেন প্রায় রাত আটটা।
বাকি সময়টা হুশ হুশ করে কেটে গেল। সবার জন্য আরেক কাপ করে চায়ের জল বসিয়ে চিত্রাকে ফোন করলেন সমীর। সংসারের কাজে তিনি খুব অপটু নন, চা-ভাত-ডাল করা কিংবা দুধ ফোটানো, পাঁউরুটি সেঁকে নেওয়া গোছের কাজ তিনি করে নেন, কিন্তু এই হঠাৎ জোড়া অতিথির প্রায় নাটকীয় আগমনে চিত্রার সুনিপুণ উপস্থিতির অভাব বোধ করছেন সমীর। একজন স্বয়ং চিত্রার বন্ধু, একজন বোনের শ্বশুরবাড়ির মানুষ। একজন প্রাণের টানে এসেছেন, একজন প্রয়োজনে। এমন যেন মনে না হয় যে চিত্রা নেই, তাই যথেষ্ট আদর যত্ন হল না। রাতের খাওয়া হতে হতে প্রায় এগারোটা বাজল। সমীর এক ফাঁকে বেরিয়ে গিয়ে গিয়ে কিছু দরকারি বাজার করে এনেছিলেন। চিত্রার কথামত ফ্রিজের মাপা খাবার আর বের করলেন না। ডাইনিং টেব্ল্ ঘিরে বসে মহা উৎসাহে সবাই চায়ের কাপ হাতে গল্প জমালেন। আলু ছুলে, পেঁয়াজ কুচিয়ে দিলেন কুন্তলা। ডিমসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ, পেঁয়াজ -কাঁচালংকা দিয়ে মুসুর ডাল সেদ্ধ আর মাখন দিয়ে গরম ভাত খাওয়া হল সবাই মিলে। শেষ পাতে পাড়ার 'সুমধুর মিষ্টান্ন ভান্ডার'-এর টাটকা তৈরি ভাপা সন্দেশ। রমা দুধ-খই-এর সঙ্গে সন্দেশ খেলেন। কুন্তলার আনা চমচম রেখে দেওয়া হল জলখাবারের জন্য। সঙ্গে দেওয়ার জন্য পাউরুটি, কলা নিয়ে এসেছেন সমীর।
খাওয়ার পরেও সবার গল্প আর শেষ হতে চায়না। বিশ্বজিতের সঙ্গে ততক্ষণে কুন্তলার খুবই ভাব জমে গেছে। আগামিকাল রবিবার, তাই ভোরের কোলফিল্ড ধরার বদলে একটু বেলায় জলখাবার খেয়ে দুজনে ভল্ভো বাসে করে কলকাতা ফিরবেন স্থির হয়েছে। বিশ্বজিৎ ঢাকুরিয়ার দিকে গেলে তাঁর বাড়ি যেন সে অবশ্যই যায়, ঠিকানা-ফোন নম্বর নেওয়া হয়ে গেছে। কুন্তলা রমাকেও ঘুমাতে যেতে দেন নি। বলেছেন,"আজ চলুন মাসিমা, আমরা সারারাত আড্ডা মারি,রোজই তো নিয়ম করে ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যান, একদিন নাহয় রুটিন বদলালেন...!" অন্যদিন সমীরদের বাড়িতে সাড়ে দশটার মধ্যে সব আলো নিভে যায়, আজ রাত বারোটার পরেও প্রায় সব ঘরে আলো জ্বলছে। জোরে জোরে কথা শোনা যাচ্ছে। চিত্রা সাড়ে এগারোটা নাগাদ একবার ফোন করেছিলেন। তাঁর স্বামী অনভ্যস্ত হাতে কেমন যত্ন করেছেন অতিথিদের, জানতে চেয়েছেন। আগামিকাল দুজনে কখন বেরোবেন, কী খেয়ে বেরোবেন ,কাকে কোথায় শুতে দিতে হবে, ধোয়া চাদর-বালিশের ঢাকা কোথায় আছে, ভালো বিস্কুটের প্যাকেট কোথায় রাখা সেসবের খোঁজ নেওয়া, খোঁজ দেওয়া হল।
চিত্রার বুদ্ধিমতই সমীর নিজেদের শোবার ঘরে কুন্তলার শোবার ব্যবস্থা করলেন। বিশ্বজিতের বিছানা হল বসার ঘরের ডিভানে। দুটো বিছানার জন্য দেওয়াল আলমারি খুলে ধোয়া চাদর- বালিশ ঢাকা বেরোলো, বক্স খাটের ভেতর থেকে মশারি বেরোলো। দুই অতিথিকে জলের বোতল, বাথরুমের আলোর সুইচের অবস্থান বুঝিয়ে সমীর নিজে শুতে গেলেন মায়ের ঘরে থাকা ফাঁকা চৌকিটাতে। মেয়ে ছুটিতে বাড়ি এলে ওটা ব্যবহার করে। চৌকিটা লম্বায় ছোট, একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু এক রাতের ব্যাপার, থাক। অতিথিদের আরাম যত্ন আগে। কুন্তলা অবশ্য মায়ের ঘরে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাছে সারারাত গল্প করতে হয়, সেই ভয়ে রমা সেই প্রস্তাব নাকচ করেছেন।
চিত্রা-সমীরের যুগল শয্যার একপ্রান্তে শুয়ে সারাদিনের ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে কুন্তলা ভাবলেন, তাঁদের তিনতলা বাড়িতে দুটো আলাদা গেস্ট রুম আছে। এমন করে নিজেদের বেডরুম অতিথিদের জন্য ছেড়ে দিতে হয় না। দিতে হলে তাঁর রাশভারী, প্রখ্যাত চিকিৎসক স্বামী, টুবু-রুবুর বাবা সেটা মেনে নিতেন ? চিত্রাটা স্কুলে পড়ায়, শাশুড়ি আর স্বামীর নিয়ন্ত্রনে থাকে, কিন্তু আজ তিনি আড্ডার মাঝে মাঝে লক্ষ্য করেছেন, দূরে থেকেও এই সংসারটার চাকাগুলো চলছে চিত্রার নির্দেশেই। তাঁর সংসারে চারজন মানুষের হুকুম তামিল করতে সর্বদা তিন জন মানুষ হাজির। বাড়িতে তাদের প্রতাপ কুন্তলার থেকে বেশি। কুন্তলা তিন দিন বাড়ি না থাকলে কারোর বিশেষ হেলদোল হয় কি? হেলদোল না হল তো বয়েই গেল,আমি বাপু অত ভাবতে পারব না, ইচ্ছে হলেই বেড়াতে বেরোব...একটু আগে মাসিমাকে বললাম যদিও, রুবুর বাবা রাগারাগি করে...কিন্তু সে মানুষটা তো সত্যি রাগারাগি করে না। যদি করত, তাহলে কি আমি নিজেকে আটকে রাখতাম? কে জানে । ... বিশ্ব ছেলেটা ভালো, ওর সঙ্গে রুবুকে বেশ মানাবে, কিন্তু রুবু তো আর শুধু আমার মেয়ে না, ওর ডাক্তার বাবা কি মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভ জামাই মেনে নেবে?...লোকটা মন্দ না, কিন্তু এইরকম পরিস্থিতিতে পড়লে সমীরের মত কাউকে রেঁধে ডাল-ভাত খাওয়াবে না, বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে কাজ চালিয়ে দেবে...আমি কি সমীরের সঙ্গে বিজনের তুলনা করছি?...
অন্ধকারের মধ্যে ফেসবুকে ঝিমলির প্রোফাইল চেক করতে করতে বিশ্ব মনে মনে অনুযোগ করল, তোমার বাড়িতে একটা আস্ত রাত কাটিয়ে গেলাম, আর তুমি নেই, ভাবা যায়? তুমি এই সামার ভ্যেকেশনে স্পেশাল টিউশন করবে বলে কলকাতায় বসে আছ? জানো, তোমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ডস রিকোয়েস্ট পাঠাব ভাবি, কিন্তু সাহস করে আর পাঠাই না...কে জানে, তুমি যদি ব্যাপারটা খারাপভাবে নাও, কাকিমাকে খারাপ কিছু বল, সেটা খুব অস্বস্তিকর হবে... নাহয় বলব না কোনো দিন, তোমাকে ঠিক কতটা চাই, কিন্তু আজ তো দেখা হতে পারত, তাই না?
আজ ও সারারাত জাগতে হবে, এমনিতেই ঘুম আসে না, তারপরে এতই দেরী হয়েছে শুতে, ভেবে শ্রান্ত এবং অল্প বিরক্ত অনিদ্রার রোগী রমা কপালে মাথা ধরার মলম ঘষতে ঘষতে ভাবলেন, ছেলেটার ওপর দিয়ে সন্ধ্যেটা খুব যাহোক গেল। কীভাবে কী হবে ভাবতে গিয়ে আমারও আধকপালীটা ফিরে এল। কুন্তলা মেয়েটা বড্ড কথা বলে,বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। চিত্রা স্কুলে কী করে জানা নেই, বাড়িতে তো তার কথা কইবার ফুরসত নেই। মা'কে দেখা অনেক হয়েছে, সে মেয়ে এখন ফিরলেই পারে। চিত্রা-টুকাই দুজনেই নেই, বাড়ি ফাঁকা লাগছে।
পাশের বিছানায় , ছোট চৌকিতে, একটু অসুবিধার মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে সমীর ভাবলেন, কাল সকালে চিত্রাকে বলে দেবেন, আরও কয়েকটা দিন কলকাতায় থেকে আসতে। কুন্তলা এতদূর এসেছিলেন , চিত্রার উচিত ওঁর সঙ্গে দেখা করে তবেই ফেরত আসা। সমীরকে ফেলে, ঝিমলি-টুকাইকে ফেলে, শাশুড়ির অনুমতির তোয়াক্কা না করে , বোলপুর তো দূর অস্ত, বাপের বাড়িও কোনোদিন যান নি চিত্রা। এবার নাহয় নিয়মের অল্প বদল হোক। তেমন অসুবিধা হলে সমীর নাহয় মা'কে বুলির কাছে রেখে আসবেন। ছেলেমেয়েও আছে সঙ্গে, ওদের বলে দেবেন ওদের মাকে নিয়ে অন্যান্য আত্মীয়, চিত্রার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে আসবে। ততদিন সমীর ঠিক কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন।
সুচিন্তিত মতামত দিন