শনির বচন | বলির পাঁঠা

শব্দের মিছিল sobdermichil

কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী হামলায় শতাধিক মানুষ আহত ও নিহত। আফগানিস্তান নিয়ে বিশ্ববাসী আতঙ্কিত। আফগানবাসী দিশাহারা। দিশাহারা আফগানীরা সকলে কাবুল বিমানবন্দেরের ভিতরে ঢোকার প্রয়াসে মরিয়া। ভাগ্যবানরা বিমানে করে দেশ ছাড়ছেন। ভাগ্যহতরা মাটি কামড়িয়ে পড়ে রয়েছেন বিমানবন্দরের বিভিন্ন গেটের বাইরে। মার্কিন মেরিন সৈন্যরা প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধার করে আফগানিন্তান থেকে বিভিন্ন দেশে পার করে দিচ্ছে। এদিকে কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে তালিবানী আতঙ্কে দিশাহারা আফাগানবাসীরা দিনের পর দিন অমানুষিক কষ্টে দেশ ছাড়ার প্রতীক্ষায় অপেক্ষারত। মানুষের সীমাহীন কষ্টের ছবি দেখে শিউরে উঠতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্ববাসী টিভির পর্দায় চোখ রেখে স্বাধীন আফগানিস্তানের কল্পনায় উৎকন্ঠিত এবং আতঙ্কিত। এখনো কাবুল বিমানবন্দর মার্কিনশক্তির কব্জায়। আগামী ৩১শে আগস্ট মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান ত্যাগ করলে কি অবস্থা হবে আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণের। সে কথা ভেবেই শিউরে উঠছেন বাকি বিশ্বের নাগরিকবৃন্দ। আর এর ভিতরেই সেই কাবুল বিমানবন্দরেই আত্মঘাতী হামলায় শতাধিক মানুষ আহত নিহত। প্রাণ গিয়েছে এগারো জন মার্কিন সৈন্যের। মার্কিন রাষ্ট্রপ্রতি প্রতিশোধের অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। আত্মঘাতী হামলায় যারা দায়ী। তাদের উপরে প্রতিশোধ নেবে মার্কিনশক্তি। বিশ্ববাসীও আশায় দিন গুনছে সেই প্রতিশোধের।

এখন কিছু প্রশ্নের দিকে তাকানোর সময় এসেছে। মার্কিনশক্তি আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার চুক্তি করেছে তালিবানদের সাথে। মার্কিনদের আফগানিস্তান ত্যাগে লক্ষ লক্ষ আফগানবাসী, যারা বিগত কুড়ি বছর মার্কিনশক্তির সাথে হাত ধরাধরি করে ছিল, তাদের বিষয়ে মার্কিন ও তালিবানদের ভিতর কি কোন চুক্তি হয়েছিল আদৌ? হলে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না কেন? আর না হলে সে দায়িত্ব কিন্তু সম্পূর্ণতই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের। কুড়ি বছর একটি দেশকে কামান বন্দুকের সামনে নত করে দখল করে রাখার পরে, যারা সেই দখলপর্বে মার্কিনদের সাথে সহায়তা করেছিল। তাদের সম্বন্ধে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দেওয়া নিশ্চয় মানবিকতার পরিচয়বাহী নয়। কাবুল বিমানবন্দরে উদ্ভুত পরিস্থিতির দায় নিলেই কিন্তু আসল দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তালিবানদের সাথে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার চুক্তির ভিতরেই সেই শর্তগুলি থাকা দরকার ছিল। যে শর্তগুলিতে বিগত দুই দশকে মার্কিন শক্তির মদতপুষ্ট পুতুল সরকারের সাথে সরাসরি সংযুক্ত আফগানবাসী থেকে শুরু করে, মার্কিন শক্তির সাথে বিভিন্ন কাজকর্মে যুক্ত সকল আফগানবাসীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার বিষয়গুলি থাকা উচিত ছিল। মার্কিনশক্তির সৈন্য অপসারণ শুরু করার পর্ব থেকে শুরু করে তালিবানদের কাবুল দখল পর্য্যন্ত সময়ে সেরকম কোন চুক্তির প্রতিফলন কিন্তু দেখা যায়নি। মার্কিনশক্তি নিশ্চয় জানতো, তাদের অবর্তমানে তালিবানরা ক্ষমতা দখল করে নিলে লক্ষ লক্ষ আফগানবাসী যারা বিভিন্ন ভাবে মার্কিনদের দুই দশক ধরে সাহায্য করে এসেছে, তাদের জীবন সংশয় হতে পারে। এবং তারা তালিবানদের আতঙ্কে দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়েও উঠতে পারে। তাহলে মার্কিনশক্তির প্রথম দায়িত্ব ছিল, সেই বিষয়টি নিয়ে তালিবানদের সাথে কোন একটি নিশ্চিত রফাসূত্রে আসা। এবং আফগানিস্তানে সেই মোতাবেক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যাতে মার্কিনদের অবর্তমানে যে সকল আফগানবাসী দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়, আগে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিংবা মার্কিনদের অবর্তমানে আফগানিস্তানে তাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখার বিষয়গুলি নিশ্চিত ভাবে কার্যকর করা। এবং তারপরেই আফগানিস্তান ত্যাগ করা। তার আগে নয়। না পেন্টাগন সেই বিষয়টি জেনে বুঝেই তালিবানদের সাথে করা তাদের চুক্তিতে নিশ্চিত করে নি। করলে আজকে কাবুল বিমানবন্দেরর পরিস্থিতি এই পর্যায় এসে পৌঁছাতো না।

ঘটনাক্রমের সঠিক পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, মার্কিনশক্তি প্রকৃতপক্ষে সাধারণ আফগানবাসীর সাথে লুকোচুরি খেলেছে। মার্কিনশক্তির লক্ষ্যই ছিল তারা থাকতে থাকতেই কাবুলের ভার তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসা। কারণ তালিবান ছাড়া অন্য কোন শক্তির হাতে আফগানিস্তান ছেড়ে দিতে পারে না পেন্টাগন। তাহলে তাদের আম ও বস্তা দুইই খোয়াতে হতে পারে। সেই ঝুঁকি নিশ্চয় নেবে না তারা। মার্কিনশক্তি আফগানিস্তানে তাদের বসানো পুতুল সরকারের উপরে কোন ভরসা করতে পারেনি। পারেনি বলেই সৈন্য অপসারণ চুক্তি সেই পুতুল সরকারের সাথে না করে করেছে তালিবানদের সাথে। যাদেরকে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসিয়ে তবেই আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চাইছে তারা। এখন মার্কিনশক্তি সরাসরি তালিবানদেরকে অন ক্যামেরা নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে লাইভ টেলিকাস্ট করে তো আর ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে না। কারণ আফগানিস্তানের পুতুল সরকার তাদেরই বসানো। সেই কারণেই তাদেরকে আফগানিস্তানের জনগণ এবং বিশ্ববাসী, সকলের সাথেই এই লুকোচুরির খেলাটা খেলতে হলো। তারা দেখাতে চাইলো। তারা আফগানিস্তানের পুতুল সরকারের ভরসায় তাদের হাতেই আফগানবাসীর ভার তুলে দিয়ে দেশটি ছেড়ে চলে আসছিলো। কিন্তু সেই পুতুল সরকার যে বিনা প্রতিরোধে তালিবানদের হাতে আত্মসমর্পণ করবে, এটা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। গোটা বিশ্বকেই এইভাবে বোকা বানাতে চাইছে পেন্টাগন। এবং এইভাবেই আফগানবাসীকেও বোকা বানানোর কার্যক্রমে তালিবানী আতঙ্কে দেশত্যাগে মরিয়া আফগানীদের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতে চেয়েছিল মার্কিনশক্তি। মার্কিনশক্তি’র অজুহাত একটাই। তারা আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। জনগণ নির্বাচিত সরকার আছে একটা। সেই সরকারের তিন লক্ষ সৈন্যের সেনাবাহিনী রয়েছে। তারাই আফগানবাসীকে তালিবানদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ঠ। তাদের ভরসাতেই মার্কিনশক্তি আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চেয়েছিল। এখন সেই গণতন্ত্র, সেই পুতুল সরকার, সেই তিন লক্ষ সেনাবাহিনীর সামরিক শক্তি মাত্র এক দিনেই ভ্যানিশ হয়ে গেলে মার্কিনশক্তিই বা কি করতে পারে আর? তারপরেও তো তার ৩১শে আগস্ট পর্য্যন্ত হাজার হাজার আফগানবাসীকে গরু ছাগলের মতো প্লেনের ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে বিদেশে পার করে দিচ্ছে। এরপরেও নিশ্চয় পেন্টাগনের মহানুভবতার বিষয়ে কোন প্রশ্ন ওঠা উচিত নয়।

এমনটাই দেখাতে চাইছে মার্কিনশক্তি। এমনটাই বোঝাতে চাইছে পেন্টাগন। এমনটাই প্রচারে ব্যস্ত মিডিয়া। আর এমনটাই বিশ্বাস করছে বিশ্ববাসী। আর তাই চারিদিকে এই গেল গেল রব। বিশ্বজুড়ে নতুন করে তালিবানী আতঙ্ক! মার্কিনরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তালিবানরা যে কি শুরু করবে, সেই ভেবেই আবিশ্ব মানুষের উৎকন্ঠা। আর বিগত দুই দশক যারা আফগানিস্তানের পুতুল সরকারে ছিল, যারা সেই সরকারের সাথে সবরকমের সহযোগিতা করেছে। যারা গত দুই দশক জুড়ে মার্কিনীদের সাথে দুইবেলা ওঠাবসা করেছে। মার্কিনশক্তির সাথে সবরকম সহযোগিতা করেছে। মার্কিনদের আফগানিস্তান ত্যাগের পরে তালিবানদের হাতে তাদের নিয়তি কিভাবে পরিবর্তিত হবে ভেবে তারা এখন দেশত্যাগের জন্য মরিয়া। তাদের ভাগ্য এখন একটা সরু সুতোয় ঝুলছে। যে সুতোটি হলো ৩১শে আগস্ট ২০২১। তার ভিতরে যারা দেশত্যাগ করতে পারলো। তারা ভাগ্যবান। আর যারা পড়ে থাকবে। তাদের কি হবে স্বয়ং আল্লাহও জানেন কিনা সন্দেহ। এদিকে তালিবানদের সাথে মার্কিন সরকার কি চুক্তি করেছে। সেই চুক্তির শর্তগুলি কি কি? কেউই কিন্তু জানে না। চুক্তিতে যাই থাক। তালিবান ও পেন্টাগন মিলে যে নাটকটা মঞ্চস্থ করছে। তাতে বিশ্ববাসী মজেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু বলি হচ্ছে সেই আফগানিস্তানীরা। যারা বিগত দুই দশক মার্কিনশক্তি ও তাদের হাতে ধরা পুতুল সরকারের সাথে সবরকমের সহযোগিতা করেছিলো। না, যারা এর ভিতরে মার্কিন মেরিনের বদান্যতায় দেশত্যাগে সফল হয়েছে। বলি তারাও। নিজের মাতৃভুমি থেকে প্রাণের ভয় পালিয়ে যাওয়া কোন সুখের কথা নয়। কেউই সেইভাবে পালিয়ে যেতে চায় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলায় এক বা একাধিক শক্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থেই তাদেরও বলি হতে হল। ঠিক যেমন, যারা পড়ে থাকবে আফগানিস্তানে। যারা প্রতিটি দিন তালিবানী আতঙ্কে দিন কাটাতে বাধ্য হবে ৩১শে আগস্টের পর থেকে। যাদের আর কোনভাবেই দেশ ছেড়ে পালানোর উপায় থাকবে না। বলি তারাও। বলি সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনশক্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কাছে। যে স্বার্থের কারণেই দুই দশক আগে তারা আফগানিস্তানকে দখল করে পরাধীন করে রেখেছিল দুই দশক। আবার আজ যে স্বার্থের কারণে তারাই তালিবানদের হাতে ঘুর পথে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চলেছে। সেই স্বার্থের কারণেই গোটা আফগানিস্তান এবং প্রতিটি আফগানবাসী বলির পাঁঠা হয়ে কালাতিপাত করছে দুই দশক। এবং করবে আরও কয়েক দশক। না, শুধুমাত্র আফগানিস্তান ত্যাগে মরিয়া আফগানীরাই নয়। প্রতিটি আফগানিস্তানীকেই বলি হতে হলো। হয়েছে। এবং হবে। হবে সেই সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনশক্তির স্বার্থেই।

২৮শে আগস্ট’ ২০২১
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.