শনির বচন | তালিবান তালিবান

শব্দের মিছিল sobdermichil

ধোঁকাবাজির বিশ্ব। একটা দেশ দীর্ঘ দুই দশক বিদেশী শক্তির পদানত। হাজার হাজার বিদেশী সৈন্য একটি দেশকে নিজেদের কব্জায় রেখে যেমন খুশি অত্যাচার করে গেল। একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্যের উপরে বিদেশী সংস্কৃতি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলো। দেশের স্বাধীনতা পন্থী নাগরিকদের পদানত করে বিদেশী সৈন্যের বেয়োনটের কাছে নতজানু থাকতে বাধ্য করা হলো। তারপরেও সেই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরই জয়জয়াকার এক পৃথিবীর মানুষের কাছে। কারণ দুইটি। এক, সব দেশের কেউ না কেউ আমেরিকায় গিয়ে নিজের মেধা বিক্রী করে জাগতিক সুখ সাচ্ছন্দের অধিকারী হয়ে বহাল তবিয়তে তথাকথিত নাগরিক স্বাধীনতা ভোগ করছে। ফলে এক পৃথিবী মানষের কাছে আমেরিকাই হলো সব পেয়েছি’র দেশ। তাই সব দেশের সাধারণ অসাধারণ সকল শ্রেণীর মানুষের চেতনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হলো সেই স্বর্গরাজ্য, যেখানে সকল সুখের ভাণ্ডার সকলের জন্যেই উন্মুক্ত। এবং দুই, পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রচারযন্ত্রে বিশ্বশুদ্ধ মানুষের ভিতরেই এই বার্তা ঢুকিয়ে দেওয়া গিয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র সুপার পাওয়ার। যার কথাই পৃথিবীর প্রথম ও শেষ কথা। যার বিধানই এক পৃথিবী মানুষের জন্য প্রধান আইন। ফলে সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু মানেই বিশ্বের প্রত্যেক নাগরিকের শত্রু। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাকে ভিলেন বানাবে, সেই এক পৃথিবী মানুষের কাছে ভিলেন। এই যে একটা মগজ ধোলাই করে রাখা হয়েছে বিশ্বশুদ্ধ মানুষকে। এর জোরেই আজ আর কেউ মনে করে না, একটি স্বাধীন দেশকে সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রের জোরে দখল করে রাখাটা মস্ত বড়ো অপরাধ। অথচ এই মানুষরাই একই কাণ্ডের জন্য আজও হিটলারকে অপরাধী মনে করে। কারণ হিটালারও বিভিন্ন দেশ সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রের জোরে দখল করেছিল। তাই সেই অপরাধী। কিন্তু সেই একই কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করলে সেটা কোন অপরাধ নয়। ২০০১ সালে তাই যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করলো আফগানিস্তানকে তালিবান মুক্ত করে সেই দেশের মানুষকে আধুনিক গণতন্ত্রের সুযোগ ও সুবিধে দিতেই তারা আফগানিস্তান দখল করছে। তখন বিশ্বশুদ্ধ মানুষের সে’কি উল্লাস। সে’কি আনন্দ। এইবার আফগানিস্তান তালিবান মুক্ত হবে। আফগানদের জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। সত্যিই তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো এমন সদাশয় মিলিটারি পাওয়ার থাকতে এক পৃথিবী মানুষের আর ভাবনা কি? ফলে ২০০১ সাল থেকেই বিশ্বশুদ্ধু মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল। মার্কিন শক্তি তার সহযোগী দেশগুলিকে পাশে নিয়ে আফগানিস্তান দখল করে তালিবানদের হাত থেকে আফগানবাসীকে মুক্ত করবে। তাদেরকে একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা উপহার দেবে। একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবে আফগানিস্তানে। মানুষ আধুনিক শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত হয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় বাকি বিশ্বের সাথে সামিল হবে। এবং বিশেষ করে আফগান রমনীরা তালিবানী অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়ে এক স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী জীবনের স্বাদ পাবে।

বিশ্বশুদ্ধু মানুষ তাই গত দুই দশক নিশ্চিন্ত ছিল। মার্কিন সৈন্যদের দাপটে আফগানিস্তানে বাঘে গরুতে এক ঘাটের জল খাচ্ছে। আফগানবাসীর জীবনে স্বর্গ নেমে এসেছে। নারীরা স্বাধীন ভাবে বিচরণ করছে। আফগানিস্তানের সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। ইসলামিক সন্ত্রাস ও মৌলবাদের কবল থেকে বেড়িয়ে এসে সে দেশের সমাজ আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোথাও আর কোন অভাব নেই। সদাশয় মার্কিনশক্তি আফগানিস্তানের ঘরে ঘরে আনন্দ শান্তি আর খুশির জোয়ার এনে দিয়েছে। ঠিক এই অবস্থায় হঠাৎ মানুষ ঘুম ভাঙতে জানতে পারলো তালিবানরা বিনা রক্তপাতে কাবুল দখল করে নিয়েছে। কি সর্বনাশ আবার সেই নৃশংস তালিবানরা ফিরে এসেছে? কিন্তু কি করে সম্ভব হলো এহেন অঘটন? না, পাশ্চাত্য মিডিয়া রয়েছে কি করতে? আবার মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো নতুন তথ্য। সেটা কি? পাকিস্তান আর চীনের মদতে অর্থ ও অস্ত্রসস্ত্রেই নাকি তালিবানদের আবারো এমন বাড়বাড়ন্ত। যাক, মানুষও নিশ্চিন্ত। ঠিকই তো। পাকিস্তান আর চীন থাকতে এই রকমই তো হওয়ার কথা। পাশ্চাত্য মিডিয়া তো আর মানুষকে শিখিয়ে দেয়নি যে আসল প্রশ্নটা হলো দুই দশক মার্কিন সৈন্যের পদানত থেকেও আফগানিস্তানে কি করে এই তালিবানী উত্থান সম্ভব হয়? যদি না মার্কিনশক্তির প্রত্যক্ষ মদত থাকে? পাশ্চাত্য মিডিয়া মানুষকে এটাও শিখিয়ে দেয় নি। গত বছর ট্রাম্প সরকার কেনই বা আব্দুল ঘানীর আফগান সরকারের বদলে তালিবানী নেতৃত্বের সাথেই ২০২১ সালের ভিতরেই আফগানিস্তানের মাটি থেকে সব মার্কিনসৈন্য সহ ন্যটো দেশগুলির সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার চুক্তি করে? চুক্তি তো করার কথা ছিল আব্দুল ঘানীর তথাকথিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের সাথে। তাদের সাথে সেই চুক্তি না করে মার্কিনশক্তি ঠিক কোন উদ্দেশে সেই তালিবানীদের সাথেই চুক্তি করে আফগানিস্তানের মাটি থেকে সমস্ত বিদেশী সৈন্য অপসারণের। না, পশ্চাত্য মিডিয়া মানুষকে এইসব প্রশ্ন করতে শেখায় না। উল্টে চীন পাকিস্তানের সাথে তালিবানী আঁতাতের গল্প শুনিয়ে এক পৃথিবী মানুষকে শিক্ষিত করে রাখে। তাই নতুন করে তালিবানী বিভীষিকার আতঙ্কে মানুষের রাগ গিয়ে পড়ছে পাকিস্তান আর চীনের উপরেই। এবং এক পৃথিবী মানুষই চাইছে, সেই সদাশয় মার্কিনশক্তি যেন তাদের প্রবল পরাক্রান্ত সৈন্য ও মারাত্মক সব মারণাস্ত্র সহ আরও কয়েক দশক আফগানিস্তান দখল করেই রেখে দেয়। না হলে ঐ তালিবানরাই হয়তো একদিন গোটা বিশ্ব দখল করে নেবে। কি সাংঘাতিক। পৃথিবীর সব দেশের স্বাধীনতার দরকার আছে। শুধু আফগানিস্তান ইরান ইরাক লিবিয়া সিরিয়া’র মতো দেশগুলিকে মার্কিন শক্তির পদানত করে না রাখলে এই বিশ্ব নিরাপদ নয়। এমনটাই এক পৃথিবী মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস। কাল্পনিক ঈশ্বর বিশ্বাসও এমন সুদৃঢ় নয়। কারণ ঈশ্বর আছেন কি নেই সেই প্রশ্নের এখনো মীমাংসা হয় নি। কিন্তু সদাশয় মার্কিনশক্তির অভিভাবকত্বে এবং বিশ্বের একমাত্র রক্ষকর্তা স্বরূপ ভাবমূর্তিতে কোন সংশয় নেই মানুষের। তাই সকলেরই সকরুণ প্রার্থনা মার্কিনশক্তি যেন আফগানিস্তানের মাটি ছেড়ে না চলে যায়। তারা যেন আফগানবাসীদের তালিবানদের কবল থেকে আবার উদ্ধার করে।

কিন্তু গোড়ায় গণ্ডগোল। ২০০১ সালে যে মার্কিনশক্তি বিশ্ববাসীর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, তারা আফগানিস্তানকে তালিবানদের কবল থেকে মুক্ত করবে। আফগানিস্তানে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। এবং তালিবানদের এমন ভাবেই নিকেশ করবে যে গোটা বিশ্বই তালিবানী আতঙ্কের হাত থেকে চিরদিনের মতো নিষ্কৃতি পাবে। সেই মার্কিনশক্তিই দুদিন আগে ঘোষণা করে দিয়েছে। তারা আফগানিস্তানে কোন জাতি বা দেশ গঠন করতে যায় নি। সেটা তাদের দায় নয়। তারা গিয়েছিল, যাতে কোনদিনই আফগানীদের আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করার সামর্থ্য না হয়, তারই বন্দোবস্ত করতে। কি কাণ্ড! ভুতের মুখে রামরাম! না, তাই বলে এক পৃথিবী মানুষের মার্কিন প্রীতিতে ভাটা পড়বে বিষয়টা তেমনও নয়। কয়েক প্রজন্মের জলন্ত বিশ্বাস একদিনের এক ঘোষণায় দূর হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু আজকে মার্কিনশক্তি দ্ব্যর্থহীন ভাবেই জানিয়ে দিয়েছে। আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায় তাদের নয়। আফগানিস্তানকে শক্তিশালী একটি দেশ হিসাবে গঠন করার দায়ও তাদের নয়। আফগানিস্তানকে তালিবান মুক্ত করার দায়ও তাদের নয়। বরং তারা প্রকাশ্যে যেটা বলবে না। সেটা হলো আফগানিস্তান যাতে তলিবানী মৌলবাদী শক্তির অধীনেই থাকে, সেটাই নিশ্চিত করার দায় মার্কিনশক্তির। আর সেই কারণেই ট্রাম্প সাহেবের সরকারের সাথে গতবছরই সেই মর্মে চুক্তি সম্পাদিত হয়ে গিয়েছিল তালিবানীদের। যে চুক্তির দৌলতেই দখলদার মার্কিনশক্তির হাতে গড়ে তোলা আফগান সরকারের তিন লক্ষ সৈন্যের সামরিক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও তালিবানীরা প্রায় বিনা প্রতিরোধে বিনা বাধায় কাবুল সহ গোটা আফগানিস্তান দখল করে নিতে পেরেছে খোদ মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতিতেই।

না, না সাধারণ মানুষ, বিবিসি সিএনএন এর ক্লাসে পড়া মানুষ এত সবের ভিতরে যাবেই বা কেন? তারা যেই জেনে গিয়েছে চীন আর পাকিস্তানের মদতেই তালিবানরা আবারো আফগানিস্তানের দখল নিয়ে নিয়েছে। তখনই তারা যেটা তাদেরকে বুঝতে বলা হয়েছে, সেটাই বুঝে নিয়েছে। আর তাই তারা আবার বিবিসি সিএনএন এর সিলেবাস মুখস্থ করে রাখা জ্ঞান ভাণ্ডার নিয়ে তারস্বরে তালিবান তালিবান বলে সরব হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তানের মেয়েদের কি হবে ভেবে সকলেরই রাতের ঘুম নষ্ট। সকলেই তাই আজ কায়মনবাক্যে প্রার্থনা করছে মার্কিনশক্তি যেন আফগানিস্তান ত্যাগ না করে। পেন্টাগন থেকে যেন তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হয়। এবং ঠিক এই মুহুর্তে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি একবার ঘোষণা দেন। মার্কিনরা আফগানিস্তানেই থাকবে এবং তালিবানদের হঠিয়ে আবার দেশটাকে নিজেদের বেয়োনেটের কব্জায় নিয়ে আসবে। তাহলই বিশ্বশুদ্ধু এক পৃথিবী মানুষের কাছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনই ঈশ্বরের অবতার রূপে আবির্ভুত হবেন নতুন করে। মানুষ দুই হাত তুলে বাইডেনের নামে জয়ধ্বনি দেবে। আমেরিকার নামে জয়ধ্বনি দেবে। আফগানিস্তানকে পরাধীন করে রাখার জন্যে। হিটালারের সময়ের পৃথিবী থেকে বর্তমান পৃথিবীর এইখানেই পার্থক্য। এই পৃথিবী পাশ্চাত্য মিডিয়ার হাতে গড়ে ওঠা। তাই তার ণত্বষত্ব এইরকমই তো হবে। জয় হোক তাই আমেরিকার। সেটাই এক পৃথিবী মানুষের কায়মনবাক্যের প্রার্থনা।


১৯শে আগস্ট’ ২০২১
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.