নীলাঞ্জনা মল্লিক

শব্দের মিছিল

পুজোমন্ডপে ছোট বোন মিনির পায়ে মস্ত উঁচু হিল দেখে জুল জুল করে তাকিয়েছিল সুখী। পাড়ার সুকুদাদা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে বলেছিল- "তোর ওরকম জুতো চাই? পরের বার কলকাতা গেলে এনে দেব।" বছর বছর ফেল করে সুকুদাদা। কিন্তু মনটা বড্ড ভালো।

কিছুদিন পরেই কানাঘুষো শুরু হল... সুকু নাকি আজকাল চুরি করে, একেবারে পাক্কা চোর যাকে বলে। গত কয়েকদিন ধরে এপাড়ায় যে চুরি ছিনতাইয়ের উৎপাত শুরু হয়েছে, সব নাকি তারই কীর্তি। এখন ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। সবাই লাঠিসোঠা নিয়ে প্রস্তুত। ব্যাটাকে পাড়ায় ঢুকতে দেখলেই পিটিয়ে হাড় গুঁড়ো করে দেবে।

দিন যায়, বছর ঘোরে, সুকুদাদার আর দ্যাখা পাওয়া যায়না। সুখীর বুকের ভেতরটা চিনচিনে ব্যথা করে। লোকে বলে, সুকু মাঝরাতে লুকিয়ে তার মায়ের সাথে দ্যাখা করতে আসে। চুরি-চামারির পয়সা কড়ি যখন যা পারে দিয়ে যায়। তাহলে সুখীর কাছে আসেনা কেন? আসতে ভয় পায় হয়ত!

বাপ মা মরা সুখীর ক্ষণা গলা। কথা বললে লোকজন মিটি মিটি হাসে। দাদা বৌদি বিরক্ত হয়ে ওঠে। সেদিনের সেই সুখী এখন চোদ্দ থেকে চৌত্রিশ। বিয়ে হয়নি— সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। শরীরের তেমন বাড় বাড়ন্ত নেই। কে বলবে মেয়ে মানুষের শরীর? অন্য সব মেয়েদের সুডৌল স্তন দেখে হিংসে হয়, রাগও। দোকানে ব্রা কিনতে গেলে দোকানদার মলয় কাকু পান খাওয়া দাঁত বের করে বলে- "কার জন্যে মামুণি? তোমার তো ওসব..."

ক্ষণাগলার সুখী দাদা বৌদির ছাপোষা সংসারে খাটাখাটনি করে। দাদার মুদিখানার দোকানে বসে খরিদ্দার সামলায়। আর মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে সুকুদের রংচটা টিনের চালের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। ঐ সুকুদাদা এলো বুঝি? এলে তো লুকিয়ে আসবে। এখন কেমন দেখতে হয়েছে তাকে? আজকাল অনেক ছেলেরাই দাড়ি রাখে। সুখীর বেশ লাগে! সুকুদাও কি ওরকমই দাড়ি রেখেছে? দেখলে চেনা যাবে তো?

দাদার ঐ দোকানটুকুই যেন একচিলতে শ্বাস নেওয়ার জায়গা। খরিদ্দারদের ভিড় হলে খাটুনিও বাড়ে। তবু মন্দ লাগেনা। কতরকমের মানুষের আসা যাওয়া, খবর আদানপ্রদান, টুকরো হাসি গান কথা গল্পেরা ভেসে বেড়ায় আনাচে কানাচে।

শরীরের জৈবিক চাহিদাগুলো দিন দিন ধিকি ধিকি আঁচের মত জ্বালা ধরায় ভেতরে। কাউকে বলতে পারেনা সুখী। বলা যায়না। ছোটবোন মিনিটার’ও বিয়ে হয়ে গেল একবছর আগে। বিয়ের পরে এসে কত্ত সব রসসিক্ত আদুরে কথাবার্তা! ভারী রাগ হয় সুখীর। বুকের আগুন আরও বেশি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। কী করবে ভেবে পায়না। বড় অসহায় লাগে নিজেকে।

দাদার বন্ধু অখিল একদিন ছাদে সুখীকে একলা পেয়ে বলেছিল- ‘তোর এই কিম্ভূত মার্কা শরীরটায় ঠিক কী আছে বলতো? দেখতে বড্ড মন চায়। একদিন দ্যাখাবি?’

অখিল বাড়িতে এলে দমবন্ধ হয়ে আসে সুখীর। মাথা ঝিমঝিম করে। কখনও দোকানে পালিয়ে বাঁচে, কখনও বা পালাতে পথ পায় না। লোকটা সুযোগ পেলেই ওর বুকে পেটে আঙুলের খোঁচা দেয়। নাইটির ওপর দিয়ে প্যান্টির ইলাস্টিক টেনে ধরে। বিকৃত হেসে বলে- ‘কি রে দ্যাখাবি না? আমি ছাড়া আরও কেউ দেখতে চায় নাকি?’

রাগে বিরক্তিতে কান মাথা গরম হয়ে যায় সুখীর। চাইলেও কিছু করতে পারে না। দাদা বৌদির কাছে এসব বলে কোনও লাভ নেই। আরে বাবা- সে হল তাদের বোঝা, আর অখিল হল বন্ধু। যে সে বন্ধু নয় আবার! দাদার সবচাইতে কাছের বন্ধু, আর বৌদির দখিনা বাতাস। দাদা বাড়ি থাকলে অখিল অন্য মেজাজ নিয়ে আসে। নিজে হাতে পাঁঠার মাংস রান্না করে। বন্ধ দরজার ভেতর থেকে কাচের গ্লাসের ঠুংঠাং শোনা যায়। সুখীর দাদা সেসব দিনে বেজায় খুশি। আর বৌদি একা থাকলে তিনি আসেন দুপুরবেলা। উগ্র পারমিউম গায়ে মেখে ঘরে ঢোকেন। বৌদি পরম যত্নে কাচের শার্সি বন্ধ করে পর্দা টান টান করে ঢেকে দেয়।

কান্না পায় সুখীর। আজকাল আর কোনওকিছুই ভালো লাগেনা। অপমানে, অবসাদে গোটা জীবনটাই ঘন আঁধারে ছেয়ে গ্যাছে। বাঁচতেই ইচ্ছে করেনা। ঘুম আসেনা সারা রাত। এজীবন রেখে আর লাভ কী? বাবা মা’র ছবির সামনে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তাঁরা কি ওকে কাছে টেনে নিতে চান? না চাইলেই বা! সুখী তো যেতে চায় তাঁদের কাছে। অস্ফুটে বলে ওঠে- ‘কেন চলে গেলে তোমরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে?’

আজ বেশ ফুরফুরে হাওয়া বইছে। মাঝরাতে চারদিক শুনশান। সুখী ছাদে উঠে ভালো করে দেখে নেয় পারিপার্শ্বিক। কেউ কোথাও নেই। একসময় অন্ধকারকে খুব ভয় পেত সে। এখন আর পায়না। কালো আঁধারের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই তো এখন ওর দিনযাপন!

আলতো পায়ে পাঁচিলের কাছে গিয়ে ঝুঁকতেই সারা শরীর হিম হয়ে যায়। কীসের ভয় লাগছে এখন ওর? জীবন থেকেই যে ছুটি চায়, তার আবার ভয় কেন? একবার ঝাঁপ দিলেই তো এই কুৎসিত শরীরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে বেরিয়ে যাবে প্রাণ। তারপরে তার অপার অবসর। আর ঘুম থেকে জাগবেনা কোনওদিন। কতকাল যে ভাল করে ঘুমোয়নি!

আবার পাঁচিলের ধারে যেতে গিয়েও পারেনা। পা’দুটো ভারী হয়ে আসছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? মৃত্যুকে কাছে টানতে গিয়েও পারছে না কেন? চোখ বন্ধ করে সুখী। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। কুড়ি বছর আগের সেই সুকুদা’র সহজ পবিত্র হাসিটা ভেসে উঠছে। ঠিক সেদিনের মতই সুকুদা যেন ওর কানের কাছে এসে বলছে-"তোর ওরকম জুতো চাই? কলকাতা গেলে এনে দেব।"​

সত্যিই যদি সুকুদা তার কথা রাখে? সাহস করে ওর জন্যে জুতো নিয়ে সত্যিই যদি আসে কোনওদিন? ওকে না দেখতে পেলে কষ্ট পাবে যে! চোখের জল মুছে নেয় সুখী।

অপেক্ষা কত রঙিন! কত মোহময়!! এই অপেক্ষাকে অবলম্বন করেই তো বেঁচে থাকা যায়। পাঁচিলের ধার থেকে নিজেকে অনেকটা দূর সরিয়ে আনে সে। তারাগুলো আজ যেন একটু বেশিই ঝলমল করছে! এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি তো! অনেক অনেকদিন পর, ঠোঁটের কোণে অমলিন হাসি ফোটে সুখীর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.