শনির বচন | শূন্য থেকে শুরু

শব্দের মিছিল

সদ্য সমাপ্ত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের সামূহিক ভরাডুবির পর, ফ্রন্টের বড়ো শরিক তাদের সদর দপ্তর থেকে ভরাডুবির প্রধান কারণ হিসেবে নির্বাচনী প্রচারে পদ্মফুল শিবিরের বিপক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে না পারার কথাই স্বীকার করে নিয়েছেন। খুব ভালো কথা। এরপর দীর্ঘদিনের রাজনীতিবিদ সূর্যকান্ত মিশ্র সম্প্রতি স্বীকার করলেন, তাঁদের বিজেমূল তত্ত্বই একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল। কিন্তু নেতার এই কথা কর্মী সমর্থকদের একটা বড়ো অংশই এখনো স্বীকার করতে রাজি হচ্ছেন না। তাঁদের সাফ কথা, তাঁরা যে গ্রাউণ্ড রিয়্যালিটির সাথে যুদ্ধ করছেন প্রতিদিন, সেখানে বিজেমূল শক্তির বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হয় তাঁদের। ফলে নেতা ও কর্মী সমর্থকদের এক অংশের ভিতরে মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে বিজেমূল তত্ত্বকে নিয়েই। ২০২১’র রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও সদ্য গজিয়ে ওঠা আইএসএফ-এর সাথে যে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। সেই জোট গঠনকেই বহু মানুষ বামফ্রন্টের ভরাডুবির অন্যতম কারণ বলে ধরে নিয়েছেন। তাঁদের যুক্তির পিছনে যথেষ্ঠ কারণও রয়েছে। এবারের নির্বাচনে পদ্মফুল শিবিরের প্রচারের প্রধান অভিমুখ ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন। তাঁদের আশা ছিল রাজ্যের সমগ্র হিন্দু ভোটের একটা বড়ো অংশের উপরে কব্জা করে নেওয়া। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, বাকি হিন্দু ভোট তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের ভিতর ভাগ হয়ে যাবে। সাথে রাজ্যের মুসলিম ভোটের একটা বড়ো অংশই সদ্য গজিয়ে ওঠা আইএসএফের ঝুলিতে চলে গেলেই তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলিম ভোট ব্যাংকে ধ্বস নামবে। ফলে সামগ্রিক ভোট শেয়ারে তাঁরা বাজিমাত করে বাকি দলগুলির থেকে কয়েক কদম এগিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন। রাজ্যবাসী তাঁদের এই হিসাব মতো ভোট দিলে ফলাফল সত্যসত্যই তাঁদের আশানুরূপই হতো সন্দেহ নাই। কিন্তু এবারের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তাঁরা যতই রাজ্যবাসীকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন, রাজ্যবাসীর একটা বড়ো অংশ ততই নির্বাচনকে সম্প্রদায়িক বিভাজনের উল্টো মুখে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াইয়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই দেখেছে। অর্থাৎ, এবারের নির্বচনী লড়াইয়ে পদ্মফুল শিবির হিন্দু মুসলিম ন্যারেটিভে লড়তে চেয়েছিল। ঠিক যে কারণে ঘাসফুলের মুসলিম তোষণ নীতির বিরোধীতায় তাঁরা সবচেয়ে বেশি সরব হয়ে উঠেছিল। 
উল্টোদিকে, রাজ্যবাসীর একটা বড়ো অংশই এবারের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এই রাজ্যে প্রতিহত করতেই বুথে বুথে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কারণ তাঁরা জানতেন একবার রাজ্যের শাসনভার কোন সাম্প্রদায়িক শক্তির কব্জায় চলে গেলে, গোটা রাজ্যের পক্ষেই এক ঐতিহাসিক সর্বনাশ হয়ে যাবে।

দুঃখের বিষয়। এবং অত্যন্ত পরিতাপের কথা। রাজ্য বামফ্রন্ট এই সহজ কথাটি সময় মতো বুঝতে পারেনি। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল একদশকের তৃণমূলী অপশাসনের অবসান। যেভাবেই হোক সেই অপশাসনের অবসানের লক্ষ্যেই তাঁরা যাবতীয় লড়াই জারি রেখেছিলেন। ঠিক যে সময়ে, রাজ্যবাসীর একটা বড়ো অংশই উপলব্ধি করেছিলেন, এক দশকের তৃণমূলী অপশাসনের অবসানের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যকে সাম্প্রদায়িক শক্তির কব্জা থেকে রক্ষা করা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচন একটি বড়ো মাইলস্টোন হয়ে থাকলো। রাজ্য বামফ্রন্টের ভ্রান্তনীতির পক্ষে ঠিক এই কারণেই রাজ্যাবাসীর একটি বড়ো অংশই সমর্থন জ্ঞাপন করতে পারেননি। তাঁরা জানতেন, তৃণমূলী অপশাসনে রাজ্যের সমূহ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেই ক্ষতিও একসময়ে সামাল দেওয়া হয়তো সম্ভব হবে। কিন্তু গোটা রাজ্যের শাসনভার একটি সাম্প্রদায়িক শক্তির কব্জায় একবার চলে গেলে যে মহাসর্বনাশ ঘটে যাবে। বহু দশক এমনকি শতাব্দীও লেগে যেতে পারে। সেই সর্বনাশের হাত থেকে বাংলা ও বাঙালিকে উদ্ধার করতে। ফলে ছোট সর্বনাশকে মেনে নিতেও তাঁরা দ্বিধা করনেনি। মহা সর্বনাশের হাত থেকে বাংলা ও বাঙালিকে রক্ষা করতে। ঠিক এই কারণেই নির্বাচনী পর্বে লেসার ইভিল তত্ত্বের আমদানি করা হয় এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে। রাজ্যের জনগণেরও একটা বড়ো অংশ এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়েই নির্বাচনে রায় দান করেছেন। না, রাজ্য বামফ্রন্ট এই গ্রাউণ্ড রিয়ালিটি রিয়্যালাইজ করে উঠতে পারে নি। উল্টে নিজের পায়ে কুড়ুল মারার মতোই ফ্রণ্টের এক শ্রেণীর কর্মী সমর্থকরা ২১শে রাম ২৬শে বাম তত্ত্বকে নির্বাচনী হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো তাঁদের নির্বাচনী কৌশল এটাই ছিল যে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। পদ্মফুল চাষ করে ঘাসফুল সাফ করা। অনেকটা যেন পাড়ায় পাগলা কুকুরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাঘ ডেকে আনার মতো বিষয়। হয়তো তাঁদের আশা ছিল, রাজ্যবাসী তৃণমূলের অপশাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তিকে একবার রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বসালে রাজ্যজুড়ে যে তাণ্ডবলীলা চলতো পাঁচ বছর ধরে, তাতে জ্বলে পুড়ে ২৬শের নির্বাচনে রাজ্যবাসীর পক্ষে বামফ্রন্টের কোলে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকতো না। অর্থাৎ বামফ্রন্টের একটা অংশের কর্মী সমর্থকবৃন্দ রাজ্যবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন। ২০১১ সালে রাজ্যবাসী বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে কোন কোন সর্বনাশ ডেকে এনেছে! এবং সেটি তাদের পুরোপুরি বোঝার দরকার রয়েছে। সোজা বাংলায় যাকে টাইট দেওয়া বলে। তাঁরা ঠিক সেটিই চেয়েছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল রাজ্যবাসীকে সম্পূর্ণ টাইট দিতে অন্তত একবার সাম্প্রদায়িক শক্তির শাসনের তাপে ও চাপে রাখা দরকার। তাই কি তাঁরা ২১শে রাম ২৬শে বাম তত্ত্বকে বাজারে ছেড়েছিলেন?

রাজ্যবাসীর একটা বড়ো অংশই এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়ে রাজ্যকে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতেই বরং লেসার ইভিল তত্ত্বকেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। না, বামফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচার রাজ্যবাসীর এই অংশের কাছে আদৌ ভরসা যোগ্য বলে মনে হয়নি। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, বামফ্রন্টের পক্ষে ভোট দিলে সেই ভোট সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হবে। এবং তাঁরা জানতেন বরং ঘাসফুলের পক্ষ ভোট দিলে সেই ভোট সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আপাতত ভাবে প্রতিহত করতে সফল হবে। ২১শের নির্বাচনী ফলাফলে তাই স্পষ্ট, রাজ্যবাসীর একটা বড়ো অংশই লেসার ইভিলকে মেনে নিয়েও রাজ্যকে সাম্প্রদায়িক শক্তির কবল থেকে রক্ষা করতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এবং তাঁদের প্রয়াসই সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদেরকে হিন্দু মুসলিমে ভাগ করার অপপ্রয়াস। উল্টে এই নির্বাচনে রাজ্যের ভোটাররা মূলত সাম্প্রদায়িক শক্তির পক্ষে ও বিপক্ষে ভাগ হয়ে গিয়েছেন। পক্ষে রয়েছেন রাজ্যবাসীর প্রায় ৩৮% ভোটার। আর বিপক্ষে প্রায় ৪৮% ভোটার। ফলে বাম ও কংগ্রেস এবং সদ্য গজিয়ে ওঠা আইএসএফ বিধানসভায় সম্পূর্ণ ভাবেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। রাজ্যবাসীর সচেতন অংশের নাগরিকরা বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন রাজ্যের সামনে সবচেয়ে বড়ো সঙ্কট সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান। অথচ রাজ্য বামফ্রন্ট সেই সত্যকে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন এবারের বিধানসভা নির্বাচনে। তাঁদের আশা ছিল, নিরন্তর বিজেমূল তত্ত্বের প্রচার করতে পারলেই রাজ্যবাসী পদ্মফুল ঘাসফুল ছেড়ে কাস্তে হাতুরি হাতে তুলে নেবে। তাঁরা অনুধাবনই করতে পারেন নি রাজ্যের ভোটারদের একটা বড়ো অংশই সাম্প্রদায়িক শক্তির সমর্থনে চলে গিয়েছেন। যাঁরা রাজ্যের যত বড়োই সর্বনাশ হয়ে যাক। রাজ্যকে দিল্লীর হাতে তুলে দিতেই বদ্ধপরিকর ছিলেন। যাঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শরিক। যাঁরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত শক্ত করতেই ২১শের নির্বাচনকে হাতিয়ার করতে ঝাঁপিয়েছে। উল্টো দিকে লেসার ইভিল তত্ত্বে বিশ্বাসীরা এই আসল গ্রাউণ্ড রিয়ালিটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সঠিক সময় মতোই। তাই তাঁরা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না হয়ে যায়, তারই জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন লাগাতার। বিফলে যায়নি তাঁদের সেই প্রয়াস। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজ্যবাসী সকলে মিলেই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভোগ ভাগ হতে দেয় নি। মূলত তাঁদের প্রজ্ঞাতেই ২১শের নির্বাচন দ্বিমুখী নির্বাচনে পরিণত হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িক শক্তি বনাম অসাম্প্রদায়িক শক্তি। ঠিক যখন পদ্মফুল শিবিরের প্রয়াস ছিল ভোটারদের সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে হিন্দু মুসলিমে বিভক্ত করার।

নির্বাচনে ভরাডুবি হওয়ার পর, নির্বাচনী ফলাফলের দিকে নজর রেখে বামপন্থীদের অনুধাবন করতে হবে। ইতিমধ্যেই রাজ্যের ভোটারদের ৩৮% সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত ধরে ফেলেছে। ফলে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভোট যে ভাগ হয়ে যায়নি। সেটা গোটা রাজ্যের পক্ষেই আশীর্বাদ স্বরূপ। আপাতত কিছুটা সময় হাতে পাওয়া গিয়েছে। রাজ্যব্যাপী সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণআন্দোলন সংগঠিত করতে না পারলে বামফ্রন্ট কিন্তু অচিরেই রাজ্য রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। রাজ্যবাসী যেখানে অনুধাবন করতে পেরেছে, রাজ্যের সামনে আশু বিপদ সাম্প্রদায়িক শক্তির এই বিপুল উত্থান। ৩৮% ভোটারের সমর্থন পাওয়া মানে ত্রিমুখী চতুর্মুখী লড়াই হলে পদ্মশিবিরই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সফল হয়ে যেত। কপাল ভালো নির্বাচনের অভিমুখ দ্বিমুখী করতে সফল হয়েছিল সচেতন রাজ্যবাসী। এই সত্যটুকু বামফ্রন্ট শিবিরের বোঝা দরকার। আর দেরিতে হলেও সেই অনুধাবনটুকু করতে পেরেই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জোরালো অবস্থান না নিতে পারার কারণকেই নির্বাচনী ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই। রাজ্যের ভোটারা যে বিজেমূল তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। নির্বাচনী ফলাফল কিন্তু তারই প্রমাণ। পদ্মফুল আর ঘাসফুলের ভিতর তলায় তলায় যে সম্পর্কই থাকুক আর নাই থাকুক। রাজ্যের ভোটারদের কাছে সাম্প্রদায়িকতার সমর্থন আর বিরোধীতাই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল একুশের নির্বাচনে।

ভুল ভ্রান্তির অনুধাবন যত শীঘ্র হয় ততই মঙ্গল। কিন্তু সেটুকুই সব কথা নয়। মাত্র একদশক সময়সীমায় যতখানি রাজনৈতিক জমি ও গ্রহণযোগ্যতা হারাতে হয়েছে বামফ্রন্টকে। ততখানি রাজনৈতিক জমি ও গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পেতে অনেক মেহনত করতে হবে। অনেক ঘাম ও রক্ত ঝরাতে হবে। অনেক খোলনলচে বদলাতে হবে। এবং সকলের আগে নিজেদের ভিশন ঠিক করে নিতে হবে। মিশনে পৌঁছাতে গেলে এই সুস্পষ্ট ভিশন থাকাটা সবচেয়ে বেশি জরুরী। ক্ষমতায় ফিরতে গেলে আগে তাঁদের প্রধান বিরোধী দলের জায়গাটির দখল নিতে হবে। ঘাসফুলের অপশাসনের বিপ্রতীপে একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে গেলে এই প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠাই এক এবং একটি মাত্র পথ। বিগত এক দশকে বামপন্থীদের সবচেয়ে বড় ব্লাণ্ডার হয়েছে রাজ্যের বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদের দেখতে না চাওয়া। চৌঁত্রিশ বছরব্যাপী শাসন ক্ষমতায় থাকার দম্ভে ও অভ্যাসে ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও তাঁরা নিজেদেরকে শাসক বিরোধী শক্তিতে দেখতে চাননি। মুখ আয়নায় প্রতিদিন শাসকের মুখ দেখতে থাকার অভ্যাসকে তাঁরা এক দশকেও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এইখানেই তাঁরা আটকিয়ে রয়েছেন। এই শাসকশ্রেণীর মনস্তত্ত্ব থেকে বেড়িয়ে না আসতে পারলে, রাজ্য বামফ্রন্টের পক্ষে রাজ্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা মুশকিল হয়ে যাবে। শুরু করতে হবে একে বারে শূন্য থেকেই। কিন্তু তার আগে প্রধান বিরোধী দলের জায়গাটি দখল করার লড়াইটা শুরু করাই আসল কথা। রাজ্য বামফ্রন্ট কি সেই পথ বেছে নিতে রাজি হবে? ফলে লড়তে হবে দুইটি ফ্রন্টে। একদিকে শাসক দলের দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরোধীতা। অপর দিকে রাজ্যবাসীর চেতনায় প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। আর সেইটি করতে গেলে সমান ভাবে কেন্দ্র সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠতে হবে। কেন্দ্রের দুর্নীতি ও জনবিরোধী নীতি ও আইনগুলির বিরুদ্ধে সরব হতে হবে মাঠে ময়দানে। সংগঠিত করতে হবে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণআন্দোলন। কিন্তু এসব কোনকিছুই অনলাইনে ঘরে বসে মিম তৈরী করে হবে না। তার জন্যে মানুষের ভিতরে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপদে বিপদে। রেড ভলেন্টিয়ার্সের মতো। কান্তি গাঙ্গুলির মতো। ভোট পাওয়া না পয়াওয়ার হিসেব ভুলে মানুষের দরজায় গিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। মানুষ কি চাইছে। তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যাগুলি কি কি। মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলির পাশে গিয়ে দাঁড়াতে না পারলে, সমষ্টিগত সমস্যার কথা বলে জনসমর্থন পাওয়া সহজ নয়। এই সত্যটুকু বামপন্থীরা যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে। তত লাভ।

সেই সাথে মনে রাখতে হবে। বিশ্বায়নের হাত ধরে পরিবর্তিত জনমানসে স্থান পাকা করে নিতে গেলে পঞ্চাশ ষাট সত্তর দশকের বামপন্থী লড়াইয়ের মকশো করলে কোন লাভ হবে না। ফল হবে শূন্য। সময় বদলিয়ে গিয়েছে। যুগমানস পাল্টিয়ে গিয়েছে। এই সময়ের সমস্যা ও সঙ্কটকে অর্ধ শতাব্দী পূর্বের সমাধান দিয়ে দূর করা সম্ভব নয় আর। ফলে বামপন্থীদেরকে নতুন করে পথ খুঁজে নিতে হবে। সেটাই সময়ের দাবি। কিন্তু সে কাজ পাকা চুলের মাথাদের দিয়ে আর হবে না। কোনভাবেই। তাঁরা থেমে গিয়েছেন। নতুন দিনের কথা নতুন মানুষের ভাষা অনুধাবন করার শক্তি তাদের থাকার কথা নয় আর। সেটাই যুগধর্ম। ফলে পথ দেখাতে হবে নতুন প্রজন্মদেরই। তাতে ভুল হবে অনেক। কিন্তু সংশোধনবাদী মনকে সজীব ও সতেজ করে রাখলে, দ্রুত সঠিক পথ খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে। এবং আরও একটি বিষয়ে পরিস্কার ধারণা রাখার দরকার রয়েছে। রাজ্যের সমস্যা একান্ত ভাবেই রাজ্যের। সেই সমস্যাকে সবসময়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে বিচার করতে গেলে, জনসমর্থন পাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ জনগণ সব কিছুর গভীরে গিয়ে পৌঁছানোর শক্তি ধরে না। তাঁর পাশে গিয়ে পৌঁছাতে গেলে তাঁর ভাষাতেই সংযোগ করতে হবে। এই একটি বিষয়ে অধিকাংশ বামপন্থীদেরই বিশেষ কোন ধারণা থাকে না। অর্থাৎ সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার যে ঝুঁকি থাকে। সেটি আসে সমস্যার তাত্বিক বিশ্লেষণ থেকেই। জনগণ তত্ত্বকথার ধার ধারে না। ফলে আগে জনমানসের ভাষার সাথে অভ্যস্থ হতে হবে নিজেদের। না হলে জনমানসের আশা আকাঙ্খার পাশে দাঁড়ানো সম্ভব নয় কখনোই। বামপন্থীদের আজকে বুঝতে হবে। তাঁরা কি বুঝছেন সেটা তত বড়ো কথা নয়। জনমানস কি বুঝছে সেটাই আসল কথা। জনগণকে বোঝাতে পারার দায় নিতে হবে না। জনগণের দাবিকে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিতে হবে কাঁধে। জনমানসের সেই দাবির সাথে কত তাড়াতাড়ি ফাইন টিউনিং করে নেওয়া সম্ভব হয়, সেটাই মুখ্য। না হলে তাঁদের পক্ষে কখনোই আর জনমানসের সামনে প্রকৃত একটা বিকল্প পথ মেলে ধরা সম্ভব হবে না। জনগণ একটি অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে আরও একটি অপশাসনের খপ্পরে পড়ে তখনই। যখন প্রকৃত একটা বিকল্প পথ কোন রাজনৈতিক শিবির প্রস্তুত করে দিতে পারে না। বিগত এক দশক সময়সীমায় বামফ্রন্ট ঠিক এই কাজটি করতেই ব্যর্থ হয়েছে ধারাবাহিক ভাবে। আর সেই পথ দিয়েই রাজ্যে উত্থান ঘটিয়েছে এক সংগঠিত সাম্প্রদায়িক শক্তি।

তাই যে কথা জনগণ বুঝে গিয়েছে, সেই কথা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব এবারে বামপন্থীদেরই। একদশকের তৃণমূলী অপশাসনের থেকেও বড়ো সমস্যা, এই সম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানই। ফলে আশু বিপদের হাত থেকে আগে উদ্ধার করতে হবে রাজ্যকে। মনে রাখতে হবে রাজ্যের ৩৮% ভোটারই এই সাম্প্রদায়িক শক্তির খপ্পরে পড়ে গিয়েছে। ফলে যুদ্ধটা কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন যুদ্ধেই অংশ নিতে হবে। না হলে রাজ্য রাজনীতিতে সম্পূর্ণ ইতিহাস হয়ে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। সেই সাথে মানুষের সামনে সুশাসনের একটা বিকল্প রাজনৈতিক পথরেখাও প্রস্তুত করে তুলতে হবে। সরকারী স্তরে প্রশাসনিক অদক্ষতার বিরুদ্ধে শাসকদলের প্রতিটি দূর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের প্রতিদিনের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে। জনগণ দায় পড়ে ভোট দেবে তবে বামপন্থীরা ক্ষমতায় ফিরবেন। এমন কষ্টকল্পনা থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই ভালো। আজকের জনগণের সম্যসার উত্তর খুঁজে পেতে হবে আজকের সময় বাস্তবতার শর্তাবলী থেকেই। এই রাজ্যের বিপদের হাত থেকে রাজ্যকে উদ্ধারের উপায় খুঁজে নিতে হবে রাজ্যের সমাজ বাস্তবতার ভিত্তিমূল থেকেই। আজকের বামপন্থীদেরকে গিয়ে পৌঁছাতে হবে রাজ্যের মর্মমূলে। না হলে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের তত্ত্ব আউড়িয়ে ভারতব্যাপী সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে কাজের কাজ কিছুই হবে না। মাঝখান থেকে শাসক বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরের দখল নিয়ে রাখবে চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অক্ষগুলিই। জনগণকে তখন তাদের পাতা ফাঁদে আজ না হোক কাল ঠিকই পড়তে হবে।


৯ই জুলাই’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.