সকালের সংবাদপত্র খুলে চোখ কপালে উঠে গেল। সুপ্রীম কোর্ট থেকে নাকি বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে এই কথা জেনে যে, ব্রিটিশ প্রবর্তিত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এখনো বাতিল করা হয় নি। দেশের সুপ্রীম কোর্ট, দেশে কোন কোন আইন চলছে আর কোন কোন আইন বাতিল করা হয়েছে সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়? এও কি সম্ভব? নাকি সংবাদপত্রের ছাপার ভুল? সুপ্রীম কোর্টের বিস্মিত হয়ে ওঠা সত্যিই এক সুপ্রীম বিস্ময় সন্দেহ নাই, যদি সংবাদপত্রের সংবাদ নির্ভুল হয়। ব্রিটিশ তার শাসনকালে, অবাধে ভারতবর্ষের সম্পদ লুন্ঠন যজ্ঞকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই এই রাষ্ট্রদ্রোহের আইন চালু করেছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। আজ ২০২১। দেশের সুপ্রীম কোর্টের কি জানার কথা নয়, আজও সেই রাষ্ট্রদোহ আইন শুধু চালুই রয়েছে তাই নয়। প্রায় নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই এই আইনের অপব্যবহার করা হয় রাষ্ট্র কর্তৃক? এবং বিগত আট দশকে দেশের কোন সরকারই এই আইন বাতিল করেনি? কোন রাজনৈতিক দলই এই আইনের বাতিলের দাবিতে দেশ জুড়ে গণআন্দোলন সংঘটিত করেনি কখনো। এখানে সাধারণ ভাবে একটি প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যায়। আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে। আমরা যাঁরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র নই। আমরা যাঁরা আইনের ছাত্র নই। আমরা যাঁরা দেশের সংবিধান কোনদিন পড়েও দেখিনি। সুপ্রীম কোর্টের কর্ম পরিধি কি কেবলমাত্র দাখিল করা মামলার ভিতরেই সীমাবদ্ধ? একমাত্র তখনই সুপ্রীম কোর্ট দেশের সংবিধান দেশের আইন নিয়ে মাথা ঘামাবে, যখন সেই বিষয়ে কোন মামলা দাখিল হবে কোর্টে? তার আগে নয়? না, এই বিষয়ে আমরা সত্যই অন্ধকারে। সাধারণ ভাবে আমাদের একটা আশা থাকে। দেশে প্রণীত আইনগুলি ঠিকঠাক সংবিধানের ধারাগুলি মেনে করা হচ্ছে কিনা অন্তত সেই বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টে একটি নজরদারীর ব্যবস্থা থাকবে। কোর্ট দেখবে, নির্বাচিত কোন সরকার দেশের সাংবিধানিক ধারাগুলির বিরুদ্ধে গিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করে কোন আইন প্রণয়ন করছে কিনা আদৌ। সুপ্রীম কোর্ট যদি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল না থাকে। তাহলে যেকোন দেশের নাগরিকই চুড়ান্ত অসহায় বোধ করতে বাধ্য। নির্বাচিত সরকার সবসময় শাসকদলের রাজনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করবে। সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষত ভারতবর্ষের মতো ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা আরোপিত গণতন্ত্রে। যে দেশগুলিতে স্বাধীনতা এসেছে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চলে গিয়েছে। তাদের জায়গায় শাসনক্ষমতার অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক শিবিরগুলি। এই শিবিরগুলি তাদের রাজনৈতিক গোষ্ঠীস্বার্থেই ব্রিটিশের প্রবর্তিত রাষ্ট্রদ্রোহের আইন আজও চালু রাখবে সেটাই স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটিই হয়েছে। না, দেশের সুপ্রীম কোর্ট এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়। এমনটা ভাবা কষ্টকর। তাহলেও কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছে বলেই মনে হয়। না হলে একটি স্বাধীন দেশে সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘনকারী কোন আইন দশকের পর দশক চালু থাকে কি করে? কি করে তার অপব্যবহারও সংঘটিত হতে থাকে দিনের পর দিন?
এখানে খুব স্বাভাবিক ভাবে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। অন্তত উচিত বলেই মনে হয়। কবে অসুখ করবে তবে ওষুধ খাবো। তখন চিকিৎসা করাবো ভেবেও শরীরের প্রতি কোনরূপ যত্ন না নিয়েও বসে থাকা যায় নিশ্চিন্তে। আবার যাতে অসুখ বিসুখ থেকে নিরাপদে থাকা যায়, সেই উদ্দেশে নিয়মিত শরীরের যত্ন নেওয়ার দিকে অধিকতর যত্ন নেওয়াও যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো কোনটি অধিকতর বাস্তবোচিত? যে কোন দেশের সুপ্রীম কোর্ট সম্বন্ধেও কি এই একই প্রশ্ন উঠতে পারে না? কবে রাষ্ট্র কর্তৃক সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘনকারী কোন আইনের অপপ্রোয়গ হবে। কবে রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ সুপ্রীম কোর্টে মামলা দাখিল করবে। তারপর সুপ্রীম কোর্ট নড়েচড়ে বসবে। সেরকমটি হওয়াই ঠিক? নাকি, সুপ্রীম কোর্টের নিয়মিত নজরদারীতেই নির্বাচিত সরকারের কাজকর্ম থাকা দরকার। বিশেষত সংবিধানের ধারাগুলিকে সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশে? প্রশ্নটির আসল উদ্দেশ্য হলো দেশের সংবিধানের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই। দেশের সংবিধান সুরক্ষিত না থাকলে দেশের জনগণ কখনোই নিরাপদ থাকতে পারে না। বিদেশী শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে যেমন দেশবাসীর সুরক্ষার প্রয়োজন। ঠিক তেমনই সংবিধান লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রশক্তির হাত থেকেও দেশের প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষার প্রয়োজন। আর সেই সুরক্ষা দিতে পারে একমাত্র দেশের সুপ্রীম কোর্টই। সুপ্রীম কোর্টই দেশের নাগরিকের সাংবিধানিক নিরাপত্তা দিতে পারে। সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব কি সুপ্রীম কোর্টের নয়? না, আমরা দেশের সুপ্রীম কোর্টের বিরুদ্ধে আঙুল তুলছি না আদৌ। আমরা নিশ্চিত হতে চাইছি। আমাদের নিরাপত্তার প্রধান অভিভাবকরূপে সুপ্রীম কোর্টের আশ্রয়ে থাকার। সংবিধনের আত্মরক্ষার নিজস্ব কোন সামর্থ্য থাকে না। সংবিধানের সুরক্ষা নিশ্চিত থাকে সুপ্রীম কোর্টের হাতেই। আর সেখানেই সাধারণ নাগরিকের শেষ আশ্রয়। সেই আশ্রয় নিশ্চিত হওয়া দরকার। এই মুহুর্তে যাঁরা যাঁরা রাষ্ট্রের রোষানলে পড়ে শাসক দলের রাজনৈতিক গোষ্ঠস্বার্থে বিনা বিচারে গারদের ওপারে পড়ে রয়েছেন দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। তাঁরা কিন্তু এই সংবিধান বিরোধী সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অপপ্রয়োগেরই শিকার। আশার কথা সুপ্রীম কোর্ট এতদিন পড়ে একটু নড়ে চড়ে বসতে চাইছেন। কিন্তু একথাও তো ঠিক। সুপ্রীম কোর্ট যদি সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘনকারী প্রতিটি আইনকেই বাতিল বলে রায় দিয়ে রাখতো। তাহলে কিন্তু শাসকদলগুলির রাজনৈতিক গোষ্ঠীস্বার্থের বলি হতে হতো না এত এত মানুষকে এত এত দশক ব্যাপী। এখানেই আমরা, সাধারণ দেসবাসী সুপ্রীম কোর্টকেই সুপ্রীম ভুমিকায় দেখতে প্রত্যাশী। কে কবে সংবিধান লঙ্ঘনকারী কোন আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়ে সুপ্রীম কোর্টে মামলা দাখিল করবে। তবে সুপ্রীম কোর্ট সামান্য নড়ে চড়ে বসার প্রয়াসী হবে। না, আমরা সাধারণ বুদ্ধির মানুষ। আমরা তেমনটি দেখতে চাই না। আমরা আশা করতে চাই। সুপ্রীম কোর্ট এমন ভাবেই সক্রিয় থাকুক। যাতে দেশের কোথাও সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘনকারী কোন আইন চালুই না থাকে। দেশের প্রতিটি আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়মিত ব্যবধানে বিচার করে দেখুক সুপ্রীম কোর্ট। এই কাজটি নিশ্চিত করতে পারলে। তবেই আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারগুলি খর্ব করার আর কোন সহজ উপায় থাকবে না কোন রাষ্ট্রশক্তির কাছে। শাসক দলগুলির রাজনৈতিক গোষ্ঠীস্বার্থে বলি হতে হবে না অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠা প্রতিবাদী কন্ঠগুলিদের। আজ যাঁদের অনেকেই আইনের অপপ্রয়োগে গারদের পিছনে। আজও যাঁদের কেউ কেউ সেই কারান্তরালেই মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন বিনা বিচারে।
নির্বাচিত সরকার সবসময়েই শাসক দলের রাজনৈতিক গোষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত হয়। এটাই গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা। এক একটি নির্বাচিত সরকারের এক এক রকমের গোষ্ঠীস্বার্থও থাকতে পারে। কিছু কিছু গোষ্ঠীস্বার্থ সমাজের কোন কোন অংশের মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে দেয়। গণতন্ত্রের নামে নির্বাচিত সরকার যে দিকে সম্পূর্ণ চোখবুঁজে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই সেই অংশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান করতে থাকে। সেই সময় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কার আশ্রয় খুঁজবে? অবশ্যই আইন এবং আদালতের। সবসময়েই যে আইন ও আদালত নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারে তাও নয়। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশেই তার ভুরি ভুরি নিদর্শন রয়েছে। সেই সময়ে সাধারণ মানুষের একমাত্র রক্ষাকবচ কিন্তু দেশের সংবিধান। আর সেই সংবিধানের একমাত্র রক্ষাকবচ, দেশের সুপ্রীম কোর্ট। ফলে যে কোন গণতান্ত্রিক দেশেই সুপ্রীম কোর্টের ভুমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সুপ্রীম কোর্টকেই সাধারণ মানুষ শেষ আশ্রয় হিসাবে দেখতে প্রত্যাশী। কিন্তু আইনের অপপ্রোয়গের পরে নয়। অপপ্রয়োগের আগেই প্রতিটি আইনের সাংবিধানিক বৈধতার বিচার করার পরিসর সুপ্রীম কোর্টে থাকা দরকার। আমাদের মূল প্রশ্ন ঠিক এইখানেই। আমরা যাঁরা সাধারণ মানুষ। যাঁরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র নই। যাঁরা আইনের ছাত্র নই। যাঁরা কোনদিন দেশের সংবিধানের পাতা উল্টিয়েও দেখিনি। তাঁরা তো আশা করবোই। কোন মামলা দাখিলের পরে নয়। সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘনকারী কোন আইনের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে যাতে কাউকে মামলা দাখিল করতেই না হয়, সেইটুকুই নিশ্চিত করুক বরং দেশের সুপ্রীম কোর্ট। যেকোন দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। না হলে গণতন্ত্র এইভাবেই শাসকদলের রাজনৈতিক গোষ্ঠীস্বার্থেই পরিচালিত হতে থাকবে।
১৬ই জুলাই’ ২০২১
নির্বাচিত সরকার সবসময়েই শাসক দলের রাজনৈতিক গোষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত হয়। এটাই গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা। এক একটি নির্বাচিত সরকারের এক এক রকমের গোষ্ঠীস্বার্থও থাকতে পারে। কিছু কিছু গোষ্ঠীস্বার্থ সমাজের কোন কোন অংশের মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে দেয়। গণতন্ত্রের নামে নির্বাচিত সরকার যে দিকে সম্পূর্ণ চোখবুঁজে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই সেই অংশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান করতে থাকে। সেই সময় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কার আশ্রয় খুঁজবে? অবশ্যই আইন এবং আদালতের। সবসময়েই যে আইন ও আদালত নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারে তাও নয়। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশেই তার ভুরি ভুরি নিদর্শন রয়েছে। সেই সময়ে সাধারণ মানুষের একমাত্র রক্ষাকবচ কিন্তু দেশের সংবিধান। আর সেই সংবিধানের একমাত্র রক্ষাকবচ, দেশের সুপ্রীম কোর্ট। ফলে যে কোন গণতান্ত্রিক দেশেই সুপ্রীম কোর্টের ভুমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সুপ্রীম কোর্টকেই সাধারণ মানুষ শেষ আশ্রয় হিসাবে দেখতে প্রত্যাশী। কিন্তু আইনের অপপ্রোয়গের পরে নয়। অপপ্রয়োগের আগেই প্রতিটি আইনের সাংবিধানিক বৈধতার বিচার করার পরিসর সুপ্রীম কোর্টে থাকা দরকার। আমাদের মূল প্রশ্ন ঠিক এইখানেই। আমরা যাঁরা সাধারণ মানুষ। যাঁরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র নই। যাঁরা আইনের ছাত্র নই। যাঁরা কোনদিন দেশের সংবিধানের পাতা উল্টিয়েও দেখিনি। তাঁরা তো আশা করবোই। কোন মামলা দাখিলের পরে নয়। সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘনকারী কোন আইনের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে যাতে কাউকে মামলা দাখিল করতেই না হয়, সেইটুকুই নিশ্চিত করুক বরং দেশের সুপ্রীম কোর্ট। যেকোন দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। না হলে গণতন্ত্র এইভাবেই শাসকদলের রাজনৈতিক গোষ্ঠীস্বার্থেই পরিচালিত হতে থাকবে।
১৬ই জুলাই’ ২০২১
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
সুচিন্তিত মতামত দিন