শনির বচন | বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা

শব্দের মিছিল

“For the judiciary to apply checks on governmental power and action, it has to have complete freedom. The judiciary cannot be controlled, directly or indirectly, by the legislature or the executive, or else the rule of law would become illusory.” – N.V Ramana. Chief Justice Supreme Court of India.


না, ভারতের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নতুন কোন কথা বলেন নি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা সম্বন্ধে সকলেই ঠিক যেমনটি আশা করে থাকে, সেই কথাই তিনি বলেছেন মাত্র। আর এইখানেই উঠে পড়ছে খুব স্বাভাবিক কয়েকটি প্রশ্ন। হঠাৎ করে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে এমন একটি সর্বজনবিদিত কথা নতুন করে বলতে হলো কেন? হ্যাঁ এটা ঠিক যে, বিচারপতি এই কথাগুলি সর্বোচ্চ আদালতে বসে বলেননি। বলেছেন একটি অনুষ্ঠানে। কিন্তু ভারতের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, তিনি যেখানেই কিছু বলুন না কেন। সে কথার গুরুত্ব কিন্তু অনেক। ফলে তাঁর এই কথাকে কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারব্যবস্থা যদি নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন না হয়। তাহলে গণতন্ত্রই বিপন্ন হয়ে পড়ে। তাই বিচারব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন রাখার দায় কিন্তু সকলের। বিচারব্যবস্থা একমাত্র সংবিধানের অধীনে থেকে দেশের আইন অনুযায়ী কাজ করবে। এমনটাই প্রত্যাশিত। সেখানে বিচারব্যবস্থার উপরে সরকার ও প্রশাসনের কোন প্রভাব থাকা কোনভাবেই কাম্য নয়। যদি থাকে, তবে বুঝতে হবে দেশের গণতন্ত্রই বিপন্ন। গণতন্ত্র এবং বিচারব্যবস্থার এই পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি যে কোন সাধারণ নাগরিকের চেতনাতেই স্পষ্ট থাকে। অন্তত থাকারই কথা। তার জন্য কাউকে আইন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে হয় না। ফলে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি যে কথা বলেছেন, সেই কথা যে কোন সচেতন নাগরিকেরও কথা। সাধারন মানুষ দেশের সুপ্রীম কোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু এই কারণেই। সুপ্রীম কোর্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের উর্ধে উঠে সরকার ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন রায় প্রদান করবে। দেশের সংবিধান নির্দেশিত পথরেখা ধরে। যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকই সেই দেশের সুপ্রীম কোর্টের কাছে এমনটাই প্রত্যশা করে থাকে। অন্যথায় অসহায় নাগরিকের কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর বোধহয় কিছু করার থাকে না। এবং রাষ্ট্রযন্ত্র যদি সংবিধান বিরোধী কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করে। তবে সুপ্রীম কোর্টই একমাত্র তার বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারে। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজকর্মের উপরেও সুপ্রীম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরী।

আমরা প্রায় প্রতিটি সচেতন নাগরিকই এই বিষয়গুলি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। প্রধান বিচারপতির এই কথাগুলি আমাদেরও কথা। তা সত্ত্বেও কেন তাঁকে এই কথা স্মরণ করতে হচ্ছে? বা স্মরণ করাতে হচ্ছে? প্রশ্ন তো এইখানেই। তাহলে কি আমাদের ধরে নিতে হবে। প্রধান বিচারপতি মনে করছেন। বর্তমান ভারতবর্ষে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার উপরে সরকার ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জারি করা শুরু হয়ে গিয়েছে? বিচারব্যবস্থা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছে না? বাধা আসছে সরকার ও তার প্রশাসন থেকেই। বিচারব্যবস্থাকে সরকারী প্রশাসনের স্বার্থরক্ষা করে চলতে হচ্ছে? আমরা জানি না, প্রধান বিচারপতি তাঁর ভাষণে ঠিক এই কথাগুলিই বলতে চেয়েছেন কিনা। আমরা জানি না, এমনটাই তিনি নিজে বিশ্বাস করেন কিনা। কিন্তু এ কথা ঠিক। তাঁর বলা কথার ভিতরে এই না বলা কথাগুলিই কিন্তু উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আমরা সেদিকে নজর দিতে নাও চাইতে পারি। কিন্তু আমরা নজর দিই আর না দিই। সত্য কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না তাই বলে। যাঁরাই একটু খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা জানেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে এনডিএ সরকার ন্যাশানাল জুডিশিয়্যাল এপয়েনমেন্ট কমিশন তৈরী করে। সারা দেশের সকল আদালতের বিচারপতি নিয়োগ করার জন্যে। খুব স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। উদ্দেশ্য, সরকারের কিছু ইয়েসম্যানকে বিভিন্ন আদালতে নিয়োগ দিয়ে বিচারব্যবস্থার মাথায় বসিয়ে দেওয়া। কিন্তু এর আগে আমাদের সংবিধানের নির্দেশিত পথে সুপ্রীম কোর্ট কলেজিয়ামই বিভিন্ন আদালতে বিচারপতি নিয়োগ করতো। সেই ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্টের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সদ্য নির্বাচিত এনডিএ সরকার নিজের হাতে নিয়ে নিতেই এই কমিশন গড়ে তোলে। যে কমিশনের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ ভাবেই নির্বাচিত সরকার তথা শাসকদলের হাতে থাকার কথা। আর এই কমিশনের মাধ্যমেই শাসকদল তার পছন্দ মতো বিচারপতিদের নিয়োগ করে দেশের আইন আদালত বিচারব্যবস্থাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছিল ২০১৪ সালে শাসন ক্ষমতা দখল করেই। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় নির্বাচিত হয়ে প্রথমেই সেই গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলার ব্যবস্থার প্রথম ধাপ রচিত হয়েছিল এই কমিশন সৃষ্টির ভিতর দিয়েই। সুখের কথা, ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এই অসাংবিধানিক ন্যাশানাল জুডিশিয়্যাল এপয়েন্টমেন্ট কমিশনকে আইনসিদ্ধ ভাবে বাতিল করে দেয়।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়। সরকারের পরিকল্পনা কোন অভিমুখে এগোতে চাইছে। সরকার সর্বতো ভাবেই দেশের বিচার ব্যবস্থার উপরে একটা সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে প্রত্যাশী। সুপ্রীম কোর্ট নয়। একটা সুপ্রীম সরকার গঠন করাই সরকারের লক্ষ্য। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের উপরে এমন চরম আঘাত এর আগে এসেছে বলে আমাদের জানা নেই। বিচারপতি রামানা কি তাহলে তাঁর ভাষণে এই পরিস্থিতির দিকেই ইংগিত করেছেন? তাই কি তিনি তাঁর ভাষণে খুব সুস্পষ্ট করেই বলতে চেয়েছেন, সরকারের ক্ষমতা ও কর্মকাণ্ডের উপরে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যেই বিচারব্যবস্থার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা বজায় থাকা জরুরী? কারণ বিচারব্যবস্থাই যদি সরকার ও প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রীত হতে থাকে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে। তাহলে সত্যিই তো আইনের শাসন কথাটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকের পক্ষে সে বড়ো সুখের সময় নয়। আর তখনই একাধিক প্রশ্ন ঘিরে ধরে। একটা সরকার যখন দেশের বিচারব্যবস্থার উপরে সার্বিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে স্বচেষ্ট হয়ে ওঠার প্রয়াস করে। তখন বুঝতে হবে, সেই সরকার একটা পথে এগোতে না পারলে আরও দশটি পথ খুঁজে নেবে। আর এই আলোতে যদি আমরা ভাবতে শুরু করি। যদি বিগত সাত বছরের সময়কে বুঝতে চেষ্টা করি। তাহলে আরও ভালোভাবে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে উঠতে পারে। আমরা দেখেছি সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে কর্ম থেকে অবসর গ্রহণের পরপরই একজন ভুতপূর্ব বিচারপতিকে রাজ্যসভার সদস্য হয়ে যেতে শাসকদলের প্রার্থী হিসাবে। এটও ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে বেশ অভিনব। এখন যিনি এইভাবে রাজ্যসভার সদস্য হয়ে গেলেন। শাসকদলের বদান্যতায়। তিনি যে শাসকদলের স্বার্থরক্ষায় পূর্বে কিছু করেন নি। তার নিশ্চয়তা কি? এই প্রশ্নগুলি ধামাচাপা পড়ে গেলে গণতন্ত্রের পক্ষেই অশনিসংকেত। ফলে সরকার যদি যে কোন ভাবেই হোক তার পছন্দের মানুষদেরকেই বিচারব্যবস্থার শীর্ষপদে বসাতে সক্ষম হয়ে যায়। তবে ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারের বিষয়টিই প্রহসনের পর্যায়ে চলে যেতে পারে। বিচারব্যবস্থাকে তাই সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখা ও স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে দেওয়ার বিষয়টিকে নিশ্চিত করা একান্ত জরুরী।

এরই সাথে আমরা আরও একটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে চাইবো। বিচারব্যবস্থা শুধুমাত্র স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হলেই হবে না। তাকে ঠিকমত কাজও করতে হবে। অবশ্য এও ঠিক। বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন না হলে ঠিকমত কাজই বা করবে কোন পথে। আমরা দেখেছি, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রক্রিয়া নিয়ে সুপ্রীম কোর্টে দায়ের করা মামলার শুনানী আজও শুরুই হয়নি। ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রক্রিয়া সংবিধান সম্মত ভাবে করা হয়েছিল কিনা। আজও সেই প্রশ্নের কোন মিমাংসা হলো না। অথচ চলে গেল প্রায় দু দুটি বছর। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ কতটা সংবিধান সম্মত। সেই বিষয়েও দায়ের করা মামলা আজও ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে সুপ্রীম কোর্টেই। কেটে গিয়েছে দেড় বছরের বেশি সময়। উল্টোদিকে এই আইনের বিরোধীতায় পথ নামা বহু মানুষকে আজও বিনা বিচারে আটক থাকতে হচ্ছে। সুপ্রীম কোর্টে ঝুলছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তিন কৃষি আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও প্রায় এক বছর হতে চলল মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু মামলা এখনো কোর্টে ওঠেনি। আন্দোলনরত কৃষকরা পড়ে রয়েছেন দিল্লীর সীমানায় রাজপথে। একটানা সাত মাস। দেশের আইন দেশের আদালত যদি ঠিক মতো কাজই করতে না পারে, তাহলে আইনের শাসন কথাটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেকোন সংবিধান বিশেষজ্ঞরাই জানেন। সুপ্রীম কোর্ট যদি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে উপরিউক্ত মামাল দুইটির বিচার করে। তবে ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ অসাংবিধানিক বলে বাতিল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন মাসের পর মাস মামলা দুইটিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কোনরকম শুনানী শুরু হয় না ঠিকমত। তখন সত্যিই সন্দেহ জাগে। সত্যিই কি সুপ্রীম কোর্ট স্বাধীনভাবে কাজ করার মতো অবস্থায় রয়েছে? না কি তার উপরে সরকার ও তার প্রশাসনের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোন চাপ রয়েছে। যে কারণে মামলাগুলি এইভাবে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে? আর ঠিক এইখানেই জাস্টিস রামানার বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ হয়ে দেখা দিচ্ছে। আমরা দেখি আর না দেখি। তাঁর কথাগুলিকে এড়িয়ে যাওয়ার সত্যিই কি আর কোন উপায় রয়েছে?

আবার এই সুপ্রীম কোর্টকেই আমরা দেখেছি সঠিক প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র লোক পরম্পরায় জনশ্রুতি ও বিশ্বাসের উপরে নির্ভর করেও রায় দান করতে। যে রায় বর্তমান শাসকদলের অন্যতম প্রধান ও ঘোষিত এজান্ডার পক্ষে গিয়েছে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাসে যে রায় সত্যিই অভিনব। অর্থাৎ ভারতবর্ষের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার বিষয়টি আজ আর প্রশ্নের উর্ধে নয় কিন্তু। প্রশ্নের উর্ধে যে নয়। সেকথা সুপ্রীম কোর্টেরই প্রধান বিচারপতির দেওয়া ভাষণেই সুস্পষ্ট। অর্থাৎ আশনিসংকেত কিন্তু দেখা যাচ্ছে। আমরা দেখি বা না দেখি। এরই ভিতর আশার আলো একটিই। দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের প্রধান নিজেই এই অশনিসংকেত আমাদের সমানে তুলে ধরেছেন। এর একটা সদর্থক প্রভাব, আমদের সমাজে পড়া উচিৎ। মানুষের সচেতন প্রজ্ঞার একটা সমন্বিত ঢেউ ওঠা আবশ্যক। নাগরিক সমাজের অন্তর থেকে। না হলে এত বড়ো দেশের গণতন্ত্র আর বেশিদিন টিকবে বলে আশা করা কষ্টকর। গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ সংবিধান নিজে কোন কাজ করতে পারে না। তাকে নির্ভর করতে হয় দেশের বিচারব্যবস্থার উপরে। সেই বিচারব্যবস্থাই সংবিধানের হয়ে সংবিধানের অধীনে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হয়ে কাজ করতে থাকে। আর সেই কাজের জন্যেই বিচারব্যবস্থার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা একান্ত জরুরী। জাস্টিস রামানা হয়তো ঠিক এই কথাটিই আমাদের অনুধাবন করতে বলছেন। কিন্তু আমরা কি শুনছি আদৌ? শুনবো তো? কারণ আমাদের হাতেই কিন্তু সঠিক সরকার নির্বাচনের দায় ও দায়িত্ব।


৩রা জুলাই’ ২০২১
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.