শনির বচন | স্বৈরতন্ত্রের উত্থান

শব্দের মিছিল

রাষ্ট্র কি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার হরণ করে নিতে পারে? নিশ্চয় পারে। রাষ্ট্র যদি সামরিক শাসনের অধিকারে থাকে। রাষ্ট্র যদি স্বৈরাচারী শাসক শ্রেণীর অধিকারে চলে গিয়ে থাকে। কিন্তু সংবিধান সম্মত কোন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স‌ংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। কিন্তু বর্তমান ভারতে ঠিক সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একে একে প্রতিবাদী কন্ঠগুলিকে দেশদ্রোহের আইনে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে গারদে ঢোকানো চলছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিনা বিচারে প্রতিবাদীদের কারান্তরালে দিন কাটাতে হচ্ছে। এইরকম মানুষের সংখ্যা নাকি শতাধিক। অন্তত সংবাদমাধ্যমগুলির সূত্র অনুসারে। হ্যাঁ কেউ কেউ কখনো সখনো জামিন পাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু মূল বিচার পর্ব ঝুলিয়ে রাখা থাকছে দিনের পর দিন। কারণ খুবই স্পষ্ট। যাঁরা নির্দোষ। দেশের কোন আইনেই তাঁদের দোষী প্রতিপন্ন করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রশক্তি সেই কারণেই তার সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিচারপর্বকে ঝুলিয়ে রেখে নির্দোষদের বন্দী করে রাখতে চায়।

দেশর আইনকে সবচেয়ে বেশি কাঁচকলা কিন্তু রাষ্ট্রশক্তিই দেখাতে শুরু করে। যখন রাষ্ট্রশক্তি দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে দেয়। এই অঘোষিত যুদ্ধ যে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণের পক্ষে সবচেয়ে বড়ো বিপর্যয় স্বরূপ। রাষ্ট্র যে মুহুর্তে সংবিধানের বিধি ভঙ্গ করে আইন প্রণয়ন করতে শুরু করে। সতর্ক দেশবাসী তখনই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠবে। সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক দেশে সেটাই নিয়ম। এবং দেশবাসীর রক্ষাকবচ কিন্তু সেই সংবিধানই। ঠিক সেই ভরসাতেই দেশবাসী রাষ্ট্রশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ মুখর হবে, সেটাই স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। গণতন্ত্র মানে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের ভুয়ো প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে বুথে বুথে ভিড় জমানো এবং ভুল বোতামে আঙুল টেপাই নয়। গণতন্ত্র মানে মানুষের সকল মৌলিক অধিকারগুলির সংরক্ষণ এবং বিকাশ। গণতন্ত্র মানে রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশবাসীর সরাসরি অংশগ্রহণ। আর সংবিধান সেই অধিকারের রক্ষাকবচ। কিন্তু তাই বলে কোন রাজনৈতিক দল মানেই যেমন দেশবাসী নয়। তেমনি নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকারী ক্ষমতায় বসা মানেই দেশবাসীর উপরে যে কোন আইন চাপিয়ে দেওয়ারও অধিকার অর্জন নয়। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও শিবির ঠিক এই ভুলটাই করতে শুরু করে। একবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফেললে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা একটি সংখ্যা মাত্র। সেটি যা খুশি করার সাংবিধানিক অধিকার নয়। নির্বাচিত রাজনৈতিক দল ক্ষমতা লাভ করে রাষ্ট্রশক্তি রূপে যখন ঠিক সেই ভুলটিই করতে শুরু করে দেয়। তখনই দেশবাসীর সাংবিধানিক অধিকার জন্মায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার। এবং এইটি প্রতিটি নাগ‌রিকের মৌলিক অধিকারেরও বিষয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যা সম্পূর্ণ রূপে সংবিধান স্বীকৃত।

অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তি রূপে কোন নির্বাচিত সরকার দেশবাসীর উপরে যে কোন আইন চাপিয়ে দিতে পারে না। সেই আইনকে সংবিধানের সকল বিধি বিধান মেনেই তৈরী করতে হবে। এবং আইন যদি সংবিধানের কোন একটি ধারা উপধারাও লঙ্ঘন করে তৈরী করা হয়। তবে সেই আইন স্পষ্টতই বেআইনী। আইন প্রস্তুতকারী সরকার যত বড়ো নিরঙ্কুশ জনমতের অধিকারীই হোক না কেন। কোন সরকারই সংবিধান উল্লঙ্ঘন করে দেশের জন্য কোন আইন প্রস্তুত করতে পারে না। চাপিয়েও দিতে পারে না দেশবাসীর উপরে। দিলে দেশবাসীর সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে সেই আইনের সংবিধান লঙ্ঘনকারী দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করা এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠন করার। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠন করা মানেই দেশদ্রোহ নয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাও করা নয়। বরং সংবিধান ভঙ্গকারী আইন প্রণয়ন করাই রাষ্ট্রদ্রোহের নামান্তর। এবং সেই আইন বলপূর্বক দেশবাসীর উপরে চাপিয়ে দেওয়াই প্রকৃত পক্ষে দেশদ্রোহ। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। সেক্ষেত্রে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করার। সংবিধান লঙ্ঘনকারী আইন রদ করার ডাক দিয়ে দেশব্যাপী আন্দলোন গড়ে তোলার। সেই আন্দোলনের উপরে রাষ্ট্রশক্তি কতটা বর্বরোচিত আক্রমণ নামিয়ে আনবে। সেটি নিরঙ্কুশ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাচিত সরকারের বিষয় হতে পারে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দায়িত্ব, সেক্ষেত্রে সংবিধানের ধারা উপধারা অনুসারে দেশ ও দেশবাসীর রক্ষকবচ হয়ে ওঠার। আদালতও যদি সেই সময় কালক্ষেপ করতে শুরু করে দেয়। কিংবা সংবিধান অনুসারে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতে থাকে। তবে সে দেশের গণতন্ত্রের তখন সত্যিই বড়ো দুর্দিন।

আমাদের মনে রাখা দরকার সংবিধান তৈরীর মূল উদ্দেশ্য কি। মূল উদ্দেশ্য দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত রেখে রাষ্ট্রের কর্ম পরিচালনার রূপরেখা প্রস্তুত করা। রাষ্ট্রশক্তিকে তাই সংবিধান মেনেই দেশ চালাতে হয়। এবং রাষ্ট্রশক্তি সংবিধান মানতে বাধ্য। যে কোন সরকারকে এই কারণেই সংবিধানের নামে শপথ নিয়েই ক্ষমতার ভার নিতে হয়। কোন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে কোন অসাংবিধানিক আইন প্রণয়ন করা যায় না। করা গেলে, তখন আর সেই প্রজাতন্ত্র গণতান্ত্রিকও থাকে না। প্রজাতন্ত্রও থাকে না। হয়ে ওঠে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি। বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে সমগ্র দেশের উপরে দখলদারিত্ব কায়েম করার ব্রুটাল ফোর্স। বিশ্বের ইতিহাসে যার ঝুরি ঝুরি নমুনা রয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব ইউরোপের ইতিহাসে। ও পরে লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে। এশিয়ার ইতিহাসেও সেই ঘটনা কম ঘটে নি। কোন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের দেশে দেশবাসী যখন টের পেতে শুরু করে। রাষ্ট্রশক্তির স্বৈরাচারী মুখ তার গণতান্ত্রিক মুখোশের আড়াল থেকে অল্প অল্প করে বেড়িয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে। তখনই সচেতন নাগরিক মাত্রেরই আশু কর্তব্য। প্রথমেই বিড়াল কাটার চেষ্টা করা। অর্থাৎ সাংবিধানিক শক্তিতে সংবিধানের বিধিবিধানকেই হাতিয়ার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই রাষ্ট্রশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে পথে নামা। দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা। রাষ্ট্রশক্তিকে ক্রমাগত চাপে রেখে বাধ্য করা, তার স্বৈরতান্ত্রিক রিপুকে দমন করতে। না হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পূর্বের নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো। এই সবই যে কোন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধান স্বীকৃত ও প্রদত্ত নাগরিক অধিকার। দেশবাসী সেই নাগরিক অধিকারের প্রয়োগ করতে গেলে রাষ্ট্রশক্তি তাকে আইনের পথে মোকাবিলা করতে পারে না। আর পারে না বলেই তখন আরও বেশি করে বেপরোয়া হয়ে উঠে বেআইনী পথে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করতে উদ্যত হয়। সেটাই গণতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে বড়ো দুঃসময়। প্রজাতন্ত্রের পক্ষে মস্ত বড়ো বিপর্যয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ দেশেই এই ধরণের সংকট বহুবার এসেছে। মানুষই তার প্রতিরোধ করেছে। ফলে এই সংকটে মানুষকেই পথে নামতে হবে। কোন গোষ্ঠী ভিত্তিক স্বার্থহানীর উপলক্ষ্যে নামলে হবে না। রাষ্ট্রশক্তি ঠিক সেটাই চায়। চায় বলেই তার সকল রাজনৈতিক ছল বল কর্মকাণ্ডের অন্যতম দিশাই থাকে দেশের জনসাধারণকে নানা রকম গোষ্ঠীতে ভাগ করে রাখা। যাতে সমগ্র দেশ জমাট বাঁধতে না পারে। একতাই শক্তি। যেকোন রাষ্ট্রশক্তি অপশক্তি হয়ে উঠলে সেই একতার শক্তিকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। ফলে সে সদা সতর্ক থাকে দেশবাসী যেন কোনভাবে জমাট বাঁধতে না পারে। সেই লক্ষ্যে তার ছলেরও কোন অভাব হয় না। বিশেষ করে রাষ্ট্র যদি বহুভাষিক নানান জাতিভিত্তিক হয়। রাষ্ট্র যদি একাধিক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমাবেশ হয়। তাহলে ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ কখনোই সামগ্রিক ভাবে এক হয়ে উঠতে পারবে না। ফলে দিনের পর দিন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়া যায় নিশ্চিন্তে। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের রাজনীতি যদি ঠিক এই অভিমুখেই একবার পা বাড়িয়ে দেয়। দিতে পারে। তখন দেশবাসীর পক্ষে কাজটি সত্যিই বড়ো দুরূহ হয়ে ওঠে। আর ঠিক সেই কারণেই যে কোন দেশের বিশেষ করে কোন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের উচিত সদা সতর্ক থাকা। রোগের প্রথম লক্ষ্মণ দেখা দিলেই যেমন সুচিকিৎসা শুরু করা উচিত। এও ঠিক তেমনই এক রোগ। গণতন্ত্রকে মই বানিয়ে ক্ষমতা দখল করে স্বৈরতান্ত্রিক স্বরূপ ধারণ করা। সেই রোগের প্রথম লক্ষ্মণগুলি দেখামাত্র যদি দেশবাসী সচেতন না হয়ে ওঠে। যদি প্রথমেই সংঘবদ্ধ না হতে পারে। যদি প্রথমেই প্রতিবাদে গর্জে উঠে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়াস না নেয়। তবে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি প্রতিদিন শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে থাকায় তার হাতে যেহেতু সামরিক শক্তি, প্রশাসনিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি থাকে এবং পাশে থাকে শিল্পমহল। তার পক্ষে তখন শক্তির অপপ্রয়োগ করা অত্যন্ত সহজ হয়ে দাঁড়ায়। আবার শিল্পমহলের সমর্থন ছাড়া গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম হওয়া সম্ভব হয় না কোনদিন। সে অবশ্য অন্য ইতিহাস। আর এক আলোচনা।


১৮ই জুন’ ২০২১
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.