■ রাহুল ঘোষ | অন্তর্গত সংলাপের কাছে সারাক্ষণ

শব্দের মিছিল

প্রকাশ্য স্তব্ধতার কাছে কিছুক্ষণ বসে থাকি। বাকিটা অন্তর্গত সংলাপের কাছে। চারপাশে আলোর কোলাহল। এখানেই থেমে থাকা ছায়াঘন চুপকথা দেখছে না কেউ। অথচ এখানে এক নিবিড় যাতায়াত ছিল। তার বুকে জমে থাকা নতজানু বিষাদকে ওই কোলাহল চেনেনি। সেকথা বলতে গিয়ে কুড়িয়েছি কত অভিশাপ! কাছেই একটা নদী। হঠাৎ সন্ধ্যা এলে, ফেরিঘাটে নেমে আসে যে ম্লান অন্ধকার ; তার মুখ এখানে কে মনে রাখবে!​

তবুও জলের আর এক নাম জীবন। রাতের বয়স হলে, পৃথিবীও অর্ধনিমীলিত হয়। নদীর ছলাৎ-জলে কোথাও ঘাই দিয়ে ওঠে জলজ মায়া। সে কি শুধুই বিভ্রম? স্বভাবে ডুবসাঁতার নেই বলে, কবে যেন নিমজ্জিত মৃত্যু পেয়েছিল নৌকো। সে কি শুধুই শিকার? জলেরও তো নিজস্ব কলরোল আছে। সেই কলরোল যেন শুধু তামাশায় মুখর। সে কি নিছকই বিদ্বেষ?​

নাকি, আরও কোনো গভীরের খেলা?

আসলে, ছায়ার কাছে আর কী চাওয়ার ছিল? পাওয়ার মতো আর কী ছিল ওই আলোর কাছে? বাতাসে ভাসতে থাকা বেনামি পাতা হয়ে ঝুলে থাকে কিছু-কিছু জীবন। তারপর ঠিকানা হারিয়ে একদিন ফিরে আসে অনিশ্চিত পায়ে। যার নিচে পথের অজস্র ফুটিফাটা এঁকে দিয়েছে পাথর। সেই দাগ আজ আর কোন উপশমে মিলাবে! যাবতীয় দুঃখবিলাসকে এড়িয়ে, কখন নীরব আর্তনাদ চিনে নেবে উচ্ছ্বসিত নদীজল?​

এও এক অদ্ভুত স্থিরতা!

সময়ের ধুলোখেলার কাছে এবারেও হেরে যেতে চলেছে অসহায় কিনারা। নদীর পাড় ভাঙে এইভাবে, যেন সে নিজেই গিলে খায় তার জলে চাষ করা জমিন! নিরাময়-ঠোঁট নিয়ে এইখানে দাঁড়িয়েছে যে, তাকে আমি কোথাও দেখিনি। ডুবে যাওয়া জীবন কীভাবে অচেনা লালিত্যের কাছে চাইতে পারে বেঁচেবর্তে থাকার ঠিকানা!​

আলোর মুখোশ নিয়ে চলমান শবেরা হেঁটে যায় শ্মশানের দিকে। এছাড়া আর কোনো নিশ্চিত গন্তব্য নেই। কোনো এক দেবশিশুর আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছিল দুঃখী জনপদ। কিন্তু তারও তো অন্তিমে লেখা আছে আত্মহননের গহীন!​

তবুও প্রতারণার জন্য শুধু রঙ আর চিহ্নদের দায়ী করবেন না, মহামান্য। অন্যরা কম কোথায়! বাস্তবে তো যার যতদূর পরিধি, "কেউ কথা রাখেনি"। একদা এক সুনীল-কবিতায় লিখিত হয়েছিল এই অমোঘ। মানুষকে ব্যবহার করে নেওয়ার কৌশলে সবচেয়ে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে যারা, তাদের মুখেই সবচেয়ে বেশি মানবতা-গান উচ্চারিত হয়!​

কিন্তু সেখানেই শেষ নয়।​

এর সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে চোরা-আক্রমণ। হীন ষড়যন্ত্র এবং স্থূল বিদ্রুপের চলমান। নগ্ন উল্লাসের ধারাবাহিক।​

ও হ্যাঁ, ব্যতিক্রমও থাকে। ব্যতিক্রম ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রম-ই।​

যারা পৃথিবীর আসল সংখ্যালঘু।​

তাহলে রঙ ও চিহ্নদের সেই বিরলের মধ্যে পাবেন কী করে! ওরা তো স্বভাবতই বৃহতের প্রতিনিধি! ওরা তো এই মাটিরই ফসল। এই তঞ্চক সমাজের সন্তান। ওদের ক্ষমতা বেশি, সুযোগও। তাই প্রতারণা বড়ো। সমাজকেন্দ্রিক। বাকিদের ক্ষমতা যতটা করে কম, প্রতারণাও ঠিক ততটা করেই ছোটো। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ব্যাপার এইটুকুই। সহজ এবং সরল। ওই যে বললাম, যার যতদূর পরিধি!​

এই যে এত অনিশ্চয়তা, এই মহামারী, এত আক্ষেপ, হাহাকার এবং সর্বনাশ; তবুও এখানে তাই ক্রোধের কোনো কমতি নেই! এত ক্রোধ নিয়ে মেদে এবং মদ্যে, উৎকোচে ও পদ্যে, ধান্দায় ও পানিতে, মিথ্যা রাহাজানিতে মানুষেরা কীভাবে সাবলীল বেঁচে থাকে? এমন ক্রোধের শীর্ষে তো চোখ থেকে ঘুম উড়ে যাওয়ার কথা!

ঠিক যেমন বিপরীতে, মায়ার শীর্ষদেশে, বেপাত্তা হয় ঘুম। এই যে ক্ষোভ ও ক্ষুণ্ণতার এত উপাদান, তবু্ও আশ্চর্য এক মায়া এখানে জমে আছে! অথচ কোনো মায়াকে অনিবার্য হতে না-দিলে, সবকিছু কত অনায়াস!​

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে নেমে আসছে অসম্ভব গম্ভীর একটা দুপুর। গাঙ্গেয় অববাহিকার উপর গাঢ় হচ্ছে একটা নিম্নচাপ-রেখা। ঝড় তো আসছেই। সঙ্গে বৃষ্টিও আসবে তো?

অসমাপ্ত ধূসর ফ্লাইওভারের কাছাকাছি নেমে আছে লেভেল ক্রসিং। থেমে আছে সারি-সারি চাকা। এখন একটা আপ-ট্রেন যাবে। খুব তাড়াতাড়ি আর একটা, ডাউন। দুইপারে থমথমে মুখে অপেক্ষা করছে একগাদা অধৈর্য চেহারা। অথচ কারও মুখে কোনো কথা নেই! ঠিক এইরকম সময়ে বিদ্যুৎনীল চলভাষ বেজে উঠতেই পারে। যেন প্রায় নিয়মমাফিক! ভেসে উঠতে পারে দুই-একটা রিংটোনের ঠিকানা।​

এই সময় বধির হয়ে যাওয়া ভালো।

অন্তর্গত সংলাপের কাছে প্রায় সারাক্ষণ বসে থাকি। জীবনরেখা থেকে খোঁজ দৃশ্যত মুছে গেলে, এখনও বিষণ্ণতা আসে। নামের লুকোচুরিতেই যদি গৃহহীনতা বরাদ্দ থাকে, জীবন আর কীভাবে পেতে পারে আশ্রয়ের দীর্ঘ আলিঙ্গন! তবুও অন্তর্গত সংলাপ আবার কখনও উচ্চারিত হলে, এই স্তব্ধতা নিশ্চিত ভেঙে দেওয়া যাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.