নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

শব্দের মিছিল

■ ২৫

ডম্ ডম্ করে কি যেন বাজছে। বিন্নো এগিয়ে এল মুগার কাছে। খুব শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করে, মুগা কি এমন করেছে যার জন্যে তাকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছে। মুগা এই ভাষা বুঝতে পারে কিন্তু বলতে পারে না। তাছাড়া সে জানে না তাকে কেন নিয়ে আসা হয়েছে। তবে একটা অজগর সে মারতে পারতো সেটা সে বোঝানোর চেষ্টা করল। বিন্নো ছাড়াও অন্য অনেকে ওদের আলোচনায় এল।কেউ জল থেকে ভাই কে বাঁচিয়েছে কুমীরের হাত থেকে। কেউ বিষ ফল খেয়ে নিয়েও মরেনি। কেউ বহুদিন ধরে জঙ্গলে একা থেকেছে। মুগা বুঝল, সে এই খেলার খুব ভালো প্রতিযোগী নয়। তবে কেউ বিন্নোর মত বাঘ মেরে ফেলতে পারেনি। সবাই সেই জন্যে বিন্নো কে একটু আলাদা সম্মান করে। ডম্ ডম্ করে বাজনা টা ওদের দরজার কাছে বাজছে। দরজা খুলে গেল। সেই অদ্ভুত মানুষ ডিগা এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। পাশে সেই বাজনা গুলো বাজাচ্ছে চার জন লোক। অনেক মানুষ বাইরে। ডিগা ভেতরে এসে সবাইকে একটা সারিতে দাঁড় করায়। আরও কতক গুলো অস্ত্রধারী সবার পা আর শক্ত করে বেঁধে দেয়। সকল কে লম্বা একটা দড়ির সাথে বাঁধে। তাদের এক এক করে ঘর থেকে বার করা হয়। ডম্ ডম্ আওয়াজ হতে থাকে। আদোয়া তে উৎসব শুরু হল। মেয়েরা নতুন পোশাক পরে ঘুরছে। খাদ্যের সুঘ্রান পাচ্ছে মুগাদের দলের সবাই। কিন্তু সবাই বিষণ্ণ। ভয়াবহ এই খেলাতে তারা কি করবে ? শিস্ দিয়ে পাখীর ডাক দেয় যে লম্বা ছেলেটি সে হাঁটতে গিয়ে কেবল কেঁপে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যায়। একজনের প্রস্রাব হয়ে যাচ্ছে অসাড়ে। মুগা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এই দড়ি কেটে সে পালাবেই।

লিয়ামের হাঁদা ছেলে জানালা দিয়ে দেখতে পায় মুগা কে। মুগার শুকনো মুখ দেখে তার খারাপ লাগে। তার কাজ হয়েছে রাজা কে রাতে ঘুম পাড়ানো। সে কাজ টা তার খুব ভালো লাগে। রাজা রোজ ঘুমিয়ে পড়েন। লিয়ামের হাঁদা ছেলে তাই সকলের খুব প্রিয়। কিন্তু মুগাকে দেখে সে রাস্তায় নেমে আসে। মুগাদের দল কে সারি দিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। ডম্ ডম্ বাজনদার দের সাজ দেখতেও বেশ লাগছে। মুগা তার পাশ দিয়ে যাবার সময় লিয়ামের হাঁদা ছেলে তাকে ডাকে। মুগা কেবল মুখ তুলে চায়, কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেয় না। সকল কে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বড় মাঠের ধারে। ওখানে খেলা হবে। ডিগা কে লিয়ামের হাঁদা ছেলে একটু থমকে যায়। লোকটাকে সে ভয় পায়। একবার রাজাকে এই লোক টা খুব খারাপ করে কথা বলছিল।ডিগা রাজাকে ভয় পায় না। এমন লোক কেন মুগাদের এমন করে নিয়ে যাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে লিয়ামের হাঁদা ছেলের। কিন্তু সে যে সেদিন রাতে দেখেছিল মুগার কোন কষ্ট থাকবে না। কোন দুঃখ থাকবে। মুগা একটা বিরাট পাথরের ওপর উঠে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লিয়ামের হাঁদা ছেলে যা স্বপ্ন দেখে তা যে সত্যি হয়! তার বুক আজকে গুড়গুড় করছে। জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো সে। তার ভাঙা গলার আওয়াজে রাজার পরিচারিকারা হেসে অস্থির হয়। কেবল রাজা তার সাজগোজ করতে করতে অবাক হয়ে তার দিকে তাকান। কাছে ডাকেন। লিয়ামের হাঁদা ছেলে নাকের জলে চোখের জলে হতে হতে জানায় তার খুব দুঃখ হচ্ছে। রাজা তাকে খাবার খেতে দিতে বলেন। রাজা কে চারপেয়ে আসনের ওপর চাপিয়ে পরিচারক রা সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায়। লিয়ামের হাঁদা ছেলে সামনে প্রচুর খাবার নিয়েও কেঁদে চলে। ​ ​

মুগাদের দলটা এসে দাঁড়ায় মাঠের পাশে। প্রচুর লোকজন সেখানে। মাঠে বেশী ঘাস নেই। রুক্ষ জমি। একদিকে বাঁশের তৈরি মাচা। সেখানে রাজা এসে বসবে। ​ ​
ডিগা সকল কে শান্ত হয়ে দাঁড়াতে বলে। দুজন লোকের হাতে চাবুক। তাদের দেখে রাগ হচ্ছে মুগার। বিন্নো বেশ কয়েকজনের আগে দাঁড়িয়ে আছে। সে মুগাকে ইশারা করে। অন্য ছেলেগুলিও সচেতন হয়ে যায়। বিন্নো নানা ভাবে বোঝাতে থাকে, খেলা শুরু হলে সে যা বলবে সবাই যেন শোনে। সবাই মাথা নাড়ে। মুগা জিজ্ঞাসা করে কেউ আহত হলে তখন কি হবে। লম্বা ছেলেটা জানায়, “যে আহত হবে, বা পারবে না, তাকে মেরে ফেলা হবে। যেমন করে হোক জিততে হবে।” বুকের মধ্যে হাতুরি পিটতে থাকে।মরে গেলে আর মা, বাবা কারো সাথে দেখা হবে না। বাঁশের মাচাতে রাজাকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। ডম্ ডম্ আওয়াজ আরও বেড়ে গেল। একটা খরগোস বলি দেওয়া হল। লাল রক্তে সাদা পশু ভেসে গেল।মুগাদের ওপর সেই রক্ত ছড়িয়ে দেওয়া হল। বিন্নো চোয়াল শক্ত করে আছে। অনেক গুলো চাবুক হাতে করা লোক।সকলের দড়ি খুলে দেওয়া হল। এক ঢোঁক করে জল পান করতে দিল ডিগা। মুগা বিন্নোর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বিন্নো হালকা হাসি এনে মুগাকে বলে, “ভয় পাবি না, আমরা তিন হাতের আঙুলের(৫ আঙুল এক হাতে থাকে ,মানে ১৫ জন) সমান , ঠিক সবাই বেঁচে থাকবো। তুই ভয় পাবি না।” মুগা মাথা নাড়ে । কিন্তু বুঝতে পারে না খেলা টা ঠিক ভাবে হবে। শিঙ্গা বেজে ওঠে।​

■ ২৬

খুয়াদের গুহা পরিস্কার করতে অনেকদিন লেগে গেল। থিয়াম্মার মৃতদেহ নদীর ধারে বড় বড় পাতা ওয়ালা গাছের নীচে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। মা প্রায় সেই খানে গিয়ে বসে বসে কাঁদে। খুয়ার শরীর ভালো নেই। কিরির খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে মন খারাপ,অন্যদিকে পায়ের ক্ষতটা গভীর হয়েছে। সে আগের মত আর সবল নেই। পূষনের মত ওষধি কেউ জানে না। তাই এই ক্ষত নিয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে সে। খুয়ার কেবল কান্না পায়। কিরি যদি বেঁচে আছে ,তাহলে কোথায় । ওকে ঐ লোক গুলো খুব মারবে। কিরি বড্ড নরম।বারিক অনেক খুঁজেছে কিন্তু কিরি কে খুঁজে পায়নি। পূষন আদৌ বেঁচে আছে কিনা কে জানে। বিষবাণ কিছু বানাতে হবে। যদি আদোয়া থেকে আবার কোন দল তাদের ধরতে আসে ,তখন যুদ্ধ করার জন্যে অস্ত্র সে রকম নেই। বারিক রোজ রাতে জেগে থাকে। মা ভোরবেলা তাকে ঘুমাতে পাঠায়। মা জাগে শেষ রাতে। কিরির জন্যে কাঁদে। অন্য যে মেয়েরা আছে তারা সবাই রোগা হয়ে গেছে। বাচ্চারাও আগের মত যেখানে খুশি চলে যায় না। কিরি একটা শুওরের ছবি অর্ধেক এঁকে চলে গিয়েছে। সেই শেষবার খুব বড় ভোজ হয়েছিল। তারপরেই এই বিপদ। ভাবতে গেলেই মন খারাপ হয়ে যায় খুয়ার।

আজ বাতাসে একটুও জলের ভাব নেই। খুব শুষ্ক। চামড়া ফেটে যাচ্ছে। একটা গাছের পাতার রস গালে মেখে নেয় খুয়া। আজ কাল আর তার চামড়া দিয়ে আলো বার হয় না। সে খুব কষ্ট করে গুহার মাথায় উঠে এল। গুহার ছাদে প্রচুর পোকা হয়েছে। নানান রঙের। একবার নদীর দিকে তাকাচ্ছিল একবার পোকা দেখছিল। লাল আর কালো পোকা বেশী। মাঝে মাঝে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছিল। পূষন আর কিরি দুজনের জন্যেই মন খারাপ।আচমকা দূরে নদীর ধারে একজন কে দেখতে পায় খুয়া। বিরাট লোমশ চেহারা। ধীর গতিতে বালির ওপর দিয়ে শুকনো নদী খাত পার হয়ে আসছে।বুকের মধ্যে গুম গুম আওয়াজ। এতো রোগা হয়ে গেছে পূষন। হেঁটে আসতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কোলে একটা চারপেয়ে জন্তু। খুয়া চিৎকার করে সবাই কে ডাকে। গুহার ভেতর থেকে বারিক আর মা দ্রুত বার হয়। আর যারা ছিল তারা দ্রুত নদী খাতের দিকে দৌড় লাগায়। খুয়ার পায়ের ক্ষতের ব্যাথা না থাকলে সেও দৌড় দিত। সে দেখতে পায় পাঁচ ছয়জন পূষন কে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসছে। সেই চারপেয়ে জন্তু টাও কোলে নিয়ে আসছে উমি। খুয়া ধীর পায়ে নেমে আসে গুহার মাথা থেকে। এবার কিরি কে খুঁজে পেলেই আবার সব আগের মত হয়ে যাবে। পূষন এসে গেছে এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। পূষনের বিরাট দেহ সবাই নিয়ে এসে শুইয়ে দেয়। ঠোঁট ফেটে রক্ত বার হয়ে গেছে। গোটা গায়ে নানান ক্ষত চিন্হ।এতো রোগা হয়ে গেছে যে বুকের হাড় বোঝা যাচ্ছে। পায়ের পাতা নীল হয়ে আছে। মা আর বারিক পরিচর্চা করতে শুরু করে। উমি চারপেয়ে জন্তুটাকে মাটিতে ছেড়ে দেয়। সেটা খুয়ার পায়ের কাছে এসে বসে। গোলাপি জিব দিয়ে খুয়ার পায়ের আঙুল চেটে নেয়। খুয়া জন্তু টাকে কোলে তুলে নেয়।

সন্ধ্যেবেলা ঘুম ভাঙে পূষনের খুব ঝরঝরে লাগছে তার । কেবল পিঠের আঘাতটার এখনো ব্যাথা আছে। তবে বেশ ভাল লাগছে। খুয়া এগিয়ে এল।খুয়ার পায়ের ক্ষত দেখে পূষন চিন্তিত হল। সে হাত বাড়িয়ে তার মাথায় আদর করে। “কিরি কোথায়? খুয়া...দ্যাখ তোদের জন্যে আমি কেমন জন্তু এনেছি” খুয়া কেঁদে ফেলে।‘কিরি কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না’​ এই খবরটা বারিক আর মা দিল। পূষন উঠে বসতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। জন্তু টা পায়ে পায়ে ঘুরছে। একটুকরো পাখীর মাংস খাচ্ছে অনেক ক্ষন ধরে। খুয়া কে আরও কাছে ডাকে পূষন। “এই জন্তু বিরাট চেহারার হয়।আর কয়েক মাসের মধ্যে বিরাট হয়ে উঠবে। তুই এর পিঠে চেপে ঘুরে বেড়াবি। কাউকে ভয় পাবি না খুয়া। থিয়াম্মার পর তুই সবার খেয়াল রাখবি। বারিক আর তোর মা তোকে শিখিয়ে দেবে।এই জন্তু ভয়ানক। এক থাবার মানুষের মাথা ছিঁড়ে নিতে পারে।” এক সঙ্গে এত কথা বলে হাঁপায় পূষন। মা কাঁদতে কাঁদতে মুখে জল দেয়। বারিক পায়ের নীল হয়ে থাকা জায়গায় প্রলেপ লাগায়।খুয়ার অদ্ভুত লাগে। সে পূষনের পাশে বসে থাকে। জন্তু টা তার কোলে এসে বসে। চাঁদের আলো নেই আকাশে। তাদের আগুন জ্বালানো হয়েছে বড় করে।সকলেই পূষন কে ঘিরে জেগে আছে। পূষন তন্দ্রার মধ্যে বিড়বিড় করে।

■ ২৭

একচোখ লুলুর দুই ছেলে জাকু, আর জাকুজাকু। জাকুজাকু তার সাথেই ছিল। ফিরে এসেছে তরাই এর গ্রাম থেকে । মাত্র দুটো ছেলে তাদের সাথে এসেছে। জাকুকে নির্দেশ দেওয়া ছিল গুহাবাসী মানুষদের নিয়ে আসার। ওখানে মেয়েরা খুব ভয়ানক। লুলু চিন্তায় আছে। জাকু এখনো ফিরে আসেনি। সে সাবুকের আশে পাশে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু বলতে পারে না। সাবুক অন্য সর্দারদের সাথে কথা বলছে। লুলু দাঁড়িয়ে থাকে। জাকুজাকু বাবার চিন্তার ব্যাপার বুঝতে পারে। সে জানে তার বাবা তার চেয়ে জাকু কে বেশী নির্ভর করে।তার হিংসে হয়। সে সাবুকের মনোযোগ পেয়েছে তাই আত্মবিশ্বাসী। তাকে যা কাজ দেওয়া হয়েছিল সেটা করতে সক্ষম।লুলুর দিকে সাবুকের নজর পড়ে। সাবুক গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে , “ গুহাবাসী মানুষ দের নিয়ে আসা হয়েছে ? তোমার বড় ছেলে জাকু কই?” লুলু তার চিন্তা গোপন না করে নতমুখে জানায়, “এখনো আসেনি। আমার মনে হচ্ছে কোন বিপদ ঘটেছে।” “আমি তোমার ছেলে কে বিশ্বাস করেছিলাম। গুহাবাসী দের আনতে হবে। ওরা যে বিষবাণ বানায় সেটা আমাদের দরকার। ওদের মেয়েদের দরকার। তারা খুব ভাল যুদ্ধ করে। পশুদের ভয় পায় না।জাকু পারবে না জানলে আমি নিজে যেতাম...” সাবুক খুব কঠোর ভাবে লুলু কে জানায়।জাকুজাকু খেলা দেখতে গেল অন্য বন্ধুদের সাথে। সে আশ্বস্ত হল, জাকুর প্রতি সাবুক অসন্তুষ্ট। গুহাবাসী দের ধরে আনতে অসফল হলে জাকু কে আর বেশী ভালবাসবে না বাবা। একচোখ লুলু তখন সবাই কে জাকুজাকুর কথা বেশী বলবে। কতদিনের আশা। তাছাড়া সাবুকের একমাত্র মেয়ের জন্যে নিশ্চয় এবার জাকুজাকুর কথায় চিন্তা করা হবে।সুখচিন্তায় বুঁদ হয় জাকুজাকু। ​ ​

লুলু বিমর্ষ ভাবে বসে আছে। একটু ঝিমুনি আসছে। নিজের ছোট ঘরে একপাত্র বাড়ির তৈরি মদ দিয়ে গেছে তার তৃতীয় বউ। আচমকা কান্নাকাটির আওয়াজ ভেসে আসে। উঠোনে নেমে এসে দ্যাখে জাকুর মা জাকুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। জাকুর সারা গা ফুলে গেছে। পায়ের জোর খুব কম। সে ধপ করে বসে গেল। ‘যাক ফিরে এসেছে’ এটা তে বড্ড আনন্দ হল লুলুর। সে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারে জ্বর আছে। “জাকু আর সবাই কোথায়?” প্রশ্ন করে ছেলেকে। জাকু না-বাচক মাথা নাড়ায়।​


আগের পর্ব পড়ুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.