চুপচাপ বসে আছে মধুজা। রাত এখন বারোটা । একটা চেয়ার নিয়ে ব্যালকোনিতে বসে আছে।তিনতলার উপরে ওদের ভাড়ার ফ্ল্যাট। পাশে একটা বিশাল মাঠ। তাতে দুর্গাপুজো হয়, কালিপুজো হয়, মিটিং ও হয়, মেলাও হয়। আবার সকালে বাচ্চারা খেলে। বিকেলে বড়রা ক্রিকেট খেলে। মাঠটা বেশ বড়। এ অঞ্চলে এত বড় মাঠ আর নেই।এত রাতে দূরে একজন মা আর মেয়ে হাঁটছেন। রাত হওয়ার কারণে দূরে হলেও গল্পের শব্দ ভেসে আসছে। আলাদা করে কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না যদিও। মেয়েটির পরনে একটা টী শার্ট আর বারমুডা। মায়ের পরনে শাড়ি। মা নাও হতে পারে। মধুজা ভেবে নিয়েছে উনি মা ই। মধুজা বসে বসে ভাবছে এখনো এত রাতে দুজন মা মেয়ে হাঁটছেন মাঠে, ধুরন্ধর কিছু শকুন বাংলার দখল নিতে চাইছে, তারা এলে কি এরকম নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারবেন ওঁরা? মধুজা নিজে একটা কেয়ার ফ্রি লাইফ লিড করে। অনুষ্ঠান করে অনেক সময় দেরি করে বাড়ি ফেরে। কখনো অফিস ট্যুরে গেলে ফেরার ফ্লাইট তো রাতেরই হয় । কত রাত করে ফেরে।একা বেড়াতে যায়, একা খায়, একা সিনেমা দেখে। দক্ষিণ কলকাতার এই জমজমাট অঞ্চলটিতে কোনদিন রাস্তাঘাটে মারামারি দেখেনি ও। এমনকি ভয়ানক তর্কাতর্কি ও না। পাড়ায় পাড়ায় বরং গল্প, সবজিওয়ালার সঙ্গে বেশ আন্তরিক সম্পর্ক গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর, ফুলের দোকানের ছেলে থুতু ফেলতে বারণ করলে তখনকার মতো হেসে গিলে নেয়, তর্ক করে না। এ অঞ্চলের ভোট করাতেও এসেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এখানে গত বারো বছরে কখনো বুথ দখল, মারামারি দেখেনি ও ভোটের দিন।এই অঞ্চলে মধুজারা আছে বারো বছর। ওদের ভোট অবশ্য ভবানীপুরে। সেখানে ও দেখেনি কোনদিন ভোটে গন্ডগোল বিয়ে হওয়া ইস্তক।
ওই মা-মেয়েকে দেখে আশঙ্কার একটা ছায়া পড়লো মধুজার মনে। রাস্তার কুকুরগুলো তেড়ে চিৎকার করছে। ওদের সারারাতই কনসার্ট চলে। মা-মেয়ে চলে গেলেন। মধুজা বসে আছে। অলস। ফোন বন্ধ। এই যে দরজা জানলা খুলে মাঝরাত অবধি বসে রয়েছে এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র ঘরের মানুষটি নেই বলে। সে ট্যুরে গেছে। সুপ্রতিম থাকলে ননস্টপ টিভি চলে বাড়িতে। সুপ্রতিম থাকলে এখন তেড়ে ঝগড়া করতো দরজা খোলা রাখলে মশা ঢুকে যাবে বলে।সুপ্রতিম থাকলে এই নিরবচ্ছিন্ন অলসতা, এই ভাবনার অবসর কোথাও নেই।
কেন এরকম হয়? ধুপ করে একটা শব্দে চমকে ওঠে মধুজা। নাহ্। একটা বিড়াল লাফ দিয়ে পড়েছে। নিচের গ্যারেজের ছাতে। মিয়াঁও মিয়াঁও বলে এগিয়ে যায় সে।মধুজার হঠাৎ মনে পড়ে অর্পণের কথা। বহুদিন ধরে অর্পণ বলেছিল, ও মধুজাকে ভালোবাসে। মধুজা তখন একটিমাত্র সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। পাত্তা দেয়নি অর্পণকে। তারপর একদিন যেমন সবাই ই চলে যায় , ওটাই ভবিতব্য, তেমন ই চলে গেল সুহৃদ। মধুজা পড়েছিল সাংঘাতিক ক্রাইসিসে। অনেক দিন দোলাচল চলার পর একদিন মধুজা অর্পণের প্রস্তাবকে গ্রহণ করার কথা ভেবেছিল। ওরা অনেকে মিলে গিয়েছিল একটি অনুষ্ঠানে। প্রথমদিন অর্পণ ওকে যত রকম ভাবে প্রেম নিবেদন করা যায় ,করেছিল । দ্বিতীয় দিন পৌঁছেছিল ভাস্বতী। মধুজার বন্ধু।ওরা দুজনে মিলে অনুষ্ঠান করেছিল । তারপর রাতে অর্পণের জন্য মধুজা যখন অপেক্ষা করছিল গল্প করবে বলে, তখন প্রচুর মদ খেয়ে এসে অর্পণ বলে, " এই তোর বান্ধবী টা কিন্তু হেব্বি ডবকা। আলাপ করিয়ে দিবি।" লাথি মেরে বের করে দিয়েছিল ঘর থেকে অর্পণকে মধুজা।এরা এত নিষ্ঠুর কেন জানা নেই মধুজার।
এই যে ওর চারপাশে ফ্রিজে কী খাবার রেখেছে তাই নিয়ে গণপ্রহারে মরে যায় মানুষ, এই যে ডাইনি বলে আজ ও জ্যান্ত পুড়িয়ে দেয় মেয়েদের, এই যে অ্যাসিড অ্যাটাক, এই যে লাভ জিহাদ বলে জলজ্যান্ত বাঙালি ছেলেটিকে পুড়িয়ে দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে তার ভিডিও করলো মানুষ, তাদের নৃশংসতা নিয়ে লেখা হয়, কথা হয়,হওয়া জরুরি। আর এই যে একজনের মনকে দলে পিষে যাওয়া ক্রমাগত, এই নৃশংসতা নিয়ে কোথাও লেখা হয়না, রেকর্ডেড হয়না এ অপরাধ।
কুকুরের ডাক ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে নিস্তব্ধতা। 'নাহ।শুই। রাত হল অনেক।'
মধুজা ঘরে আসে। রজনীগন্ধা সুবাস ছড়াচ্ছে। ঘরের প্রতিটি কোণ ও আজ ফুল দিয়ে সাজিয়েছে। এমনটা করতে ওর ভালো লাগে। সুপ্রতিম থাকলে রেয়ারলি সাজানো হয়। ফুলদানি কোথায় রাখা হবে নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়।আজ তিনটে ফুলদানিতে তিন রকমের ফুল সাজিয়েছে মধুজা। ড্রেসিং টেবিলে রাখা আছে গোলাপ । নানা রঙের গোলাপ গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ও। মনটা ভোটের বাজারেও ভালো লাগে।ভোট , ভোট, ভোট। বিক্রি হওয়ার ভোট। কিনে নেওয়ার ভোট। মানুষের আস্থা জিতে তারপর তার সঙ্গে প্রতারণার ভোট। বাজার সরগরম। ঠিক এমনটাই হয় সংসারে, সম্পর্কে।প্রথমে আস্থা জিতে নিয়ে দলবদল করতে দেখেছে ও কত প্রেমিককে। ওই অর্পণের মতো। তোমার সঙ্গে সব কাজ ভাগ করে নেবো, বাচ্চা কে তোমার সঙ্গে আমিও দেখবো সমানভাবে এসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে করে নিজের বাবা-মায়ের সুবোধ বাচ্চা হয়ে থাকে কতশত শুয়োরের বাচ্চা! তারপর মধুজার মতো তারা ঘরে বাইরে খেটে খেটে ফুরিয়ে যায়।আর মাঝে মাঝে নানা বক্তব্যে শুনতে পায় , তেমন কিছু করেনা ও।
এত কিছুর পরেও, এত ধোঁকাবাজির পর ও মানুষ ভালোবাসতে চায়। অস্থির , উনুন জ্বলা মাথাটাকে রাখতে চায় কারো বুকে। "সব ঝুট হ্যায়" জেনেও বিশ্বাস করতে চায়, নাহলে ওই মাথার উনুনটা আরো গনগনে হয়ে জ্বলে, আর পুড়িয়ে খাক করে। শোভনের চোখ দুটো দেখে নড়ে গেছে ওর ভিত।শোভন ওর চেয়ে অনেক ছোট। পাপ পূণ্য বোধ নেই মধুজার। বেঁচে থাকতে তঞ্চকতা করতে চায়না , নিষ্ঠুরতা দেখাতে চায় না, এই অবধি। ওর কাছে মানুষকে অকারণে পীড়া দেওয়াটাই পাপ। মানুষ কেন যে কোন জীবকেই। শোভন আর ও দুজনে জানে যে ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে না। তবু ওই চোখের তারাটুকুতে উঁকি দেবে বলে কিছু অবাধ্য বিকেল এসে পড়ে ওদের মধ্যে। মধুজা প্রথম দিন থেকেই জানে শোভনের প্রেমিকা আছে। শোভন ও জানে সুহৃদের প্রতি আজ ও মধুজা কতটা দুর্বল। তবু নড়বড়ে একটা সেতু তৈরি হয়। কোথাও ভিত্তি প্রস্তর নেই তার। কোথাও ওয়ারেন্টি নেই।বিনি পয়সায় ওটুকুই পাওয়া যায়। তবু মধুজার খুব অস্থির লাগে মাঝেমাঝে। শোভনের প্রেমিকা বহুদিন ধরে ই আনস্টেবল। ও ও মধুজার মতো একবগ্গা হয়ে ভালোবাসে সেই মেয়েকে। সে মেয়ে সুহৃদের মতোই চলে যায়।
শোভন দুদিন মনখারাপ করে থাকে। তিনদিনের দিন মধুজার সঙ্গে দেখা করে চুমু খায়। মধুজা জানে এটাও একটা টেম্পোরারি ক্রাইসিস।তবু একটা আশ্চর্য মমত্ব জাগে মানুষটার কষ্ট পাওয়া মুখটা দেখে। ও জানে ,ওর বান্ধবীরা শুনলেই বলবে প্রেমিকা আজ ধোঁকা দিলো, কাল তোর কাছে চলে গেলো ,এ কেমন ভালোবাসা? আবার মধুজা এটাও জানে একটা সম্পর্ক একদিনে ভাঙে না, কতদিনের কত রক্তাক্ত ইতিহাস থাকে তার মধ্যে। ধীরে ধীরে মানুষের মন বিমুখ হয়। আবার মন ই পড়ে থাকে। এই যে ও জানে যে ওই মেয়েটির প্রত্যাখ্যান শোভনকে এখানে নিয়ে এসেছে তাও ও শোভনকে প্রত্যাখ্যান করছে না, তার পিছনে কোন যুক্তি নেই।ওর ভালো লাগে, কিছুক্ষণ ভুলে থাকে ওই উনুনের আঁচ টা। ঘুমিয়ে পড়তে চায় মধুজা।এসিটা সতেরোতে সেট করে। আজ সকালে ফোন এসেছিল শোভনের। প্রেমিকার জন্য ভারি মনখারাপ, তাই ফোন করেছে। মধুজা যখন নিজের মনখারাপের কথা বলতে শুরু করলো ,ও ফোন রেখে দিল, আর শুনলো না। ওর কাছে মধুজা কয়েক মুহূর্তের রেফিউজ আর মধুজা একটা বড় গনগনে উনুনকে নিবিয়ে একটু জল চাইছে শোভনের কাছে , হাউ সিলি! ফোন করেনি আর মধুজা।শোভন ও করেনি। এভাবেই একদিন এই বিরতিগুলো অ্যাবসোলিউটের দিকে হেঁটে যাবে উদাসীন। এসব জানা মধুজার।
প্রচন্ড ঠান্ডা ঘরে, কম্বলের তলায় শীতল হতে হতে মধুজা স্বপ্নে দেখে একটা বিশালাকার গিলোটিন, তার মাথা কেটে নেওয়া হচ্ছে প্রশ্ন করার জন্য, রাষ্ট্রকে প্রশ্ন, সংসার কে প্রশ্ন। জল্লাদের মুখটা সুপ্রতিমের মতো, নির্দেশ দিচ্ছে সুহৃদ। আর ও শেষবার চিৎকার করে বলছে; "আমি যে বারান্দায় বসে বসে ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে কেন এভাবে বসে থাকা যায় না বারান্দায় গ্রিলের উপরে পা তুলে, কেন হাতটা ধরা যায়না স্বাভাবিক? বিশ্বাসঘাতক!"
সুচিন্তিত মতামত দিন