চিত্রাভানু সেনগুপ্ত

শব্দের মিছিল

বাঁকুড়ার জামবনী গ্রামের নির্মিয়মান আশ্রম "চিত্তে মায়া কাজল"। এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাত্রী আলো দাশগুপ্ত , এলাকার একজন প্রকৃত সমাজ সংস্কারক এবং একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। আলো আজ রামকানাই আর সরোজকে সঙ্গে করে চলেছেন আশ্রমের জমির উদ্দেশ্যে। কাকডাকা ভোরে আধো আধো দিনের আভা ফুটে আকাশটা যত উদ্ভাসিত হল, প্রকৃতি তার রূপের সম্ভার তত উজাড় করে দিলো চতুর্দিকে। বিস্তীর্ণ পলাশ আর ইউক্যালিপটাস গাছের জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট গ্রাম জামবনী, যেদিকে তাকাও কেবল সবুজের সমারোহ মনকে বড় আচ্ছন্ন করে তোলে। প্রত্যুষের প্রস্ফুটিত জৌলুসে , গৃহস্থের উঠোনে মোরগের ডাকে, কাঠবেড়ালির ইতিউতি চঞ্চলতায়, বিহগের কলতানে মুখরিত ধরনী যেন তার নুব্জ্য চোখ মেলে ক্রমশ জেগে উঠছে। সামনেই প্রসারিত প্রান্তর , প্রবেশ পথের ঝোলানো সাইনবোর্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আশ্রমের নামখানি। কাঁটা তার আর হেজ গাছ দিয়ে নির্ধারিত রয়েছে জমির সীমানা । জমির শেষ প্রান্তে আবার দাঁড়িয়ে আছে কিছু লাল আর হলদে পলাশ গাছ। এই মাগ্গি গন্ডার বাজারে আয় বুঝে ব্যয় আর প্রতিনিয়ত হিসাব কষে ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে চলা। মনে অদম্য জেদ আর আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর একটি সামান্য মানুষ রোজ নতুন উদ্যমে একটু একটু করে আপন স্বপ্নের উড়ান দেয় , তাকে সযত্নে লালন করে ভালোবেসে, পরম নিষ্ঠায় বাস্তবায়িত করতে বদ্ধপরিকর। এসব দেখে অবাক না হওয়া কার সাধ্যি? আলো বলে চলে

__" কলকাতার জমিটা বিক্রি করার চেষ্টা করছি জানো রাঙাদা। ওটা হয়ে গেলেই কাজটা বেশ খানিকটা এগোতে পারবো। আপাতত বারো কাঠা জমির উপর কাজ চলছে। তার মধ্যে চার কাঠায় হচ্ছে অনাথ আশ্রম যার নাম কলতান, চার কাঠায় হবে বৃদ্ধাশ্রম, নাম আলাপন। বাকি আরো চার কাঠায় থাকবে ছোট বড় সকলের জন্য একটা ছোট্ট লাইব্রেরী, একটা মন্দির, একটা প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র আর একটা কমিউনিটি হল। এখনো ছেলেটা পড়ছে, ও দাঁড়িয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। "

রামকানাই বিভোর হয়ে শুনতে থাকেন সবটা, বলেন....."এই এতোকিছু তুই একা কি ভাবে করে তুলছিস ভাবতে অবাক লাগে। আমার বোন তুই, ভাবলে বুকটা গর্বে ভরে যায়। দশ বছর হয়ে গেল জামাই গত হয়েছেন , একা হাতে ছেলে মানুষ করেছিস, এখন সে ডাক্তারি পড়ছে। তারপর এতো কিছু ভাবনা তুই ভেবে উঠিস কি করে?"


__" কেন হবেনা রাঙাদা? আমাদের বাড়ির সবাই তো তাই। পাশের ঘরে কেউ না খেয়ে থাকলে তাদের ফেলে নিজের মুখে অন্ন কখনো তুলেছে আমার পরিবার? এই যে তুমি আমার রাঙাদা, ওই বুধখালি গ্রামটা তোমার প্রাণ, কি ভাবে বুকে আগলেছ গ্রামের মানুষকে তা কি জানি না আমি? তাছাড়া আমি একা কেন? বাবু( ছেলে) তো আছেই সবসময় আপদে-বিপদে। এই চিকিৎসা কেন্দ্রটা ওকেই তো চালাতে হবে, ওর সহযোগিতা ছাড়া আমি একা কি করে যে এগোতাম। আমার ভাবনাতে কোথাও ভুল হলে, সঠিক চিন্তাটা সে আমার জন্ম করে দেয়। বলতে গেলে ওর উৎসাহ-ই তো বেশি। আমাদের দেশের মা-বোনেদের এখনো বড় কষ্ট রাঙাদা। এসব দিকে তো আরো বেশি। মানুষগুলো সহজসরল হলেও সমাজ কুসংস্কারে কলুষিত হয়ে আছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা ও খুব কম। পড়াশুনা, রোজকার পাতি সবদিকে মহিলারাই পিছিয়ে। একটা জাতির একদিক কেবল এগিয়ে যাবে, অন্য দিকটা পেছনে পড়ে থাকলে জাতির উন্নতি কখনো সম্ভব বল? তারপর আমাদের দেশে কত সন্তান তার বৃদ্ধ বাবা-মা কে অবহেলা করে ফেলে চলে যায়, বড় অসহায় লাগে আমার ওদের কথা ভেবে। চোখের সামনে এতো বড় কটা ঘটনা দেখেছি, মনটাকে বড় ভাবিয়েছিলো। আমার এই আশ্রম সবার জন্য হবে রাঙাদা। কত অনাথ শিশু বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত, আমার এই আশ্রমে সেই সব শিশুরা বৃদ্ধাশ্রমের মানুষের কাছে বাপ-মায়ের স্নেহ পাবে এই কি কম বল? আর ওই বৃদ্ধরা শেষ বয়সে তাদের পালিত ছেলে মেয়েকে পেয়ে আবার হাসবে খেলবে, বল......সম্ভব হবেনা? আমি ওদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবো না? "

হঠাৎ বড় আবেগ প্লাবিত হয়ে পড়লো রামকানাই-এর হৃদয় । আলোর মাথায় হাত রেখে বললেন...."কেন পারবি না? আশীর্বাদ করি, তুই নিশ্চই একদিন সফল হবি। সৎ ভাবনার জয় সব সময় হয়। "

এই অল্প কটা দিনে কত কিই না নতুন করে তৈরি হয়েছে। জমির চারিদিকে ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ এক অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়লো সরোজের। জমির এক কোনায় একটা ইটের গাঁথুনিতে একটা ঘর, ছাদটা যদিও পাকা নয় , সাময়িক একটা টিনের ছাউনি দিয়ে দিব্যি এখনকারমত কাজ চলে যাচ্ছে। বেশ ক'জন গ্রামীণ মহিলা জড়ো হয়ে বসে এক মনে কত কি করে চলেছে। ঘরের পাশে একটা আলগা চাতালে সারি দিয়ে রাখা বেশ কয়েকটি কাঁচের বোয়াম। সরোজ জিজ্ঞাসা করলো....."ওখানে ওরা কি করছে পিসিমনি?"

__"অনেক কিছু। ওরা এই গ্রামেরই মেয়ে বউরা, হাতের কাজ শিখছে, করছে। এগুলো বাজারে বিক্রি করবে। এখানে মেয়েরা ঘরে বসে থাকে না। হাতের কাজ করে সংসারে সাহায্য করে।"

__"কি কি করে ওরা?"

__"যা, ওখানে গিয়ে দেখ, অনেক কাজ করে ওরা । বড়ি বানায়, ধূপকাঠি, আচার, পাঁপড়, মাহরুম চাষ করে, তারপর খেজুর পাতা আর সাবাই ঘাসের তৈরি বিভিন্ন সৌখিন হাতের কাজ। আরো একটা মজার জিনিস হল....বেল ফলের মালা।"

__"বেল ফলের? ফল দিয়ে কেমন করে মালা হয় পিসিমনি? ওই বড় বড় ফল গেঁথে?"

__" না রে, যা গিয়ে দেখ! এই মালা বিয়ে অথবা কোন শুভ কাজে ওরা ব্যবহার করে। বেল ফলের খোসা থেকে ছোট্ট ছোট্ট পুঁতি বানায়, ওসবের জন্য আলাদা ছেনী আছে। ওদের দেখাতে বল, ওরা দেখাবে। "

একসাথে এতো বৈচিত্র্যের মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সরোজ। এই ক্ষণিক পলে পেছনে ফেলে আসা জীবনের কথা একটি বারও আর ভাবাতে পারেনি তাকে। বড় হালকা লাগছে সব। গ্রামীণ মহিলাদের মাঝে বসে কত সময় যে কেটে গেল টের পেল না সে।​

****

দুপুর গড়িয়ে এলো। মধুসূদনের (আলোর রাঁধুনি) আজ রান্না নামাতে বেলা হয়েছে ঢের। আলোর সামনে দাঁড়িয়ে মধু বলে চলল....."আজ মেলা দেরি হয়ে গেল মা। সরোদিদির সাথে সকাল থেকে কথা বলতে বলতে সময় খেয়াল হয়নি। কাল আর এমন হবেনা। খালি বলে, মধুদাদা তোমাদের ভাষা শিখবো।"

আলো হেসে বললেন...."ভালোই তো! তোমার ও কথা বলার একটা লোক হল। সরোজ বড় কাজের মেয়ে মধু। একটু ভাষা শিখিয়ে দিলে , তোমার কত কাজ করে দেবে।"

__"না মা, সে নাহয় আমি এমনিতেই ভাষা শিখাবু, তার জন্য দিদিকে কাজ করতে হবে কেন?"

সরোজ পেছন থেকে এগিয়ে এসে বলল....."একি! মধু দাদা, তুমি আমার নামে নিন্দে করছো? "

মধুসূদন __"ছিঃ ছিঃ দিদি! কি যে বল? আমি তোমায় নিন্দে করবো কেন? তোমায় দুটো রান্না করে খাওয়াবো তাতে তোমার থেকে কাজ করাতে হবে? তাই বলছিলাম......"

__"আর বলতে হবে না। এবার বল, আজ তুমি কি কি রান্না করলে।"​

__" গরম ভাত , মাছ বানালাম.....আর"

__"আ-আ, তোমাদের ভাষায় বলা..."

মধুসূদন হেসে বলল..." দাকা, হাকো, উতু...."

__"আর সেইটে বলো! আমি যদি বলি.... তুমি আজ কি কি রান্না করলে?"

__"আম তেহেন দ চেদ ই সিন নাম?"

আলো মধুসূদনের কথাগুলো মনে মনে আওরে চলল।

***

আজ অনেক দিন পর আলোর বাড়িটা বেশ হাসিঠাট্টায় সরগরম হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যে নাগাদ সবাইকে জুটিয়ে নিয়ে ছোটবেলার ফেলে আসা হাসি মজার গল্পগুলো একে একে বলে চলেছে ওরা। বিভিন্ন কথার জালে উঠে আসছে আরো কত কথা। সরোজ অধির হয়ে এখানকার গল্প শুনছে। স্থানীয় এক আদিবাসী জঙ্গলে গিয়ে একটা ডিম কুড়িয়ে এনেছিলো। কেউই ধারণা করতে পারেনি ওটা কিসের ডিম। তারপর মুরগির ডিমের পাশে সেটা রেখে দিয়েছিলো। মুরগির তায়ে তখন সেটা ফুটলো তখন জানা গেল, সেটা একটা ময়ূরের। স্থানীয় মানুষের দাবি সেটা আলো দিদির আশ্রমে থাকবে, ওদিকে বাবু( আলোর ছেলে) নারাজ। বহু বুঝিয়েও বাবুকে রাজি করোনো যায়নি। অগত্যা তা নিয়ে গেছে বনদপ্তরের লোক। সরোজ হঠাৎ ভারি উৎকন্ঠিত হয়ে উঠে বলল....."দাদা কখন আসবে পিসিমনি?"

__"কেন রে?"

__" বল না, আমি কথা বলবো। আমি বললে দাদা কখনোই অমত করবে না।"

__"না রে মা, পরে ভেবে দেখলাম, কে দেখবে? থাক ওসব।"

__"হবে, হবে, অনেক কিছু হবে। তুমি আমার উপর ছাড়ো না পিসি, দাদাভাই এলে আমি কথা বলবো।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.