শেষ দুপুর থেকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে । তবে যতটা মেঘ করেছিল ততটা না । অবশ্য তাতেই চিটপিটে গরমের ভাবটা অনেকটা কমেছে । সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝেও এই দুপুরটুকু কুহেলীর নিজস্ব । কতগুলো বই এলোমেলো ছড়ানো রয়েছে বিছানায় , আজ কিছুতেই যেন মন দিতে পারছে না । এতদিন মা, মেয়েতে মিলেই পুজোর কেনাকাটাটা সারত । পুপলিটার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বড্ড অসুবিধা হয়েছে কুহেলীর । পাড়া প্রতিবেশী কারও সঙ্গে কেনাকাটা করতে যাওয়াটা কোনদিনই পছন্দের নয় কুহেলীর । নিজের বাজেট, রুচি, পছন্দ সবকিছুর সঙ্গে কেমন সেই সঙ্গীর মতামতের একটা সমঝোতা করতে হয় , মনের মতো করে কেনা যায়না কিছুই । এদিকে পুজোও আর এসে গেল , শপিংমল থেকে ফুটপাতের দোকান সব জায়গাতেই ভিড় এখন চরমে । বাসবের অফিসে কাজের এতো চাপ যাচ্ছে, প্রতিদিনই ফিরতে রাত হচ্ছে । একটা দিনও কেনাকাটা করতে যাওয়ার সময় হচ্ছে না । মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথমবার পুজোর তত্ত্বটা কি করতে যাবে মহালয়ার পর! কাল রাতেই বাসবের সঙ্গে এই নিয়ে একটু খুটোখুটি হয়েছে কুহেলীর। আজ বিকালে অফিস থেকে সোজা শপিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল । সেটুকুও ইচ্ছা করছে না কুহেলীর । পুপলির সঙ্গে কতবার বাড়িতে এসেছে ছেলেটা । পুপলির মুখে রাহুলের এত গল্প শুনত , কুহেলীই একদিন ওকে বাড়িতে আনতে বলেছিল । প্রথম যেদিন এই বাড়িতে এল একটু জড়তা ছিল , কিন্তু এত মিশুকে ছেলেটা অল্প সময়ে মিশে গিয়েছিল সবার সঙ্গে। বাসবের মত মানুষ , যে সবসময় এযুগের ছেলেমেয়েদের ভুল খোঁজে , সেও ভালোবেসে ফেলেছিল রাহুলকে । ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে মামাবাড়িতে মানুষ , বাবা আবার নতুন করে সংসার করেছে । ছেলেটার মনের গভীরের চাপা যন্ত্রণাটা বুঝতে পারত কুহেলী । ছেলেটা একটু ভালোবাসার কাঙাল । মনে মনে একটা সন্দেহও কেমন যেন হত কুহেলীর, পুপলির সাথে কি কোনও সম্পর্ক আছে রাহুলের! চুপিচুপি বাসবকে কথাটা বলেওছিল একদিন , বাসব তো হেসেই অস্থির । ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব মানেই বুঝি প্রেম! বাসবের মত অতোটা হেসে সব কিছু উড়িয়ে দিতে পারেনি কুহেলী । তবে বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও কোন আপত্তি ছিল না কুহেলীর । রাহুলকে বেশ লাগত তার । কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেপরেই একদিন কলেজ থেকে ফিরে পুপলি জানাল , রাহুল নাকি ইন্ডিয়ান আর্মির কোন একটা পরীক্ষা দিয়েছিল । তাতে চান্স পেয়েছে । আগামী সপ্তাহ থেকে পাঞ্জাবের জলন্ধরে ট্রেনিং । ট্রেনিঃয়ে যাওয়ার আগে দেখা করে গিয়েছিল কুহেলী আর বাসবের সঙ্গে । দেড় বছরের ট্রেনিংয়ের পর প্রথম পোস্টিং হয়েছিল অমৃতসর । পুপলির বিয়ের সময় একমাসের ছুটিতে এসেছিল রাহুল , চুটিয়ে আনন্দ করেছিল বন্ধুর বিয়েত। তারপরেই কাশ্মীরে পোস্টিং হওয়ার কথা ছিল ছেলেটার। পুপলি শ্বশুরবাড়িতে , পুপলির সঙ্গে কথা হয় প্রায় রোজই । কিন্তু রাহুলের খোঁজ আর নেওয়া হয়নি ।
আজ দুপুরে ভাত খেয়ে উঠে জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করছে কুহেলী , তখনি ফোন করেছিল পুপলি । দুপুরবেলা প্রায়ই ফোন করে মাকে । একা একা খেতে ভালো লাগে না বলে মাঝেমধ্যে না খাওয়ার বদঅভ্যাস আছে কুহেলীর । মেয়ে তাই ফোনে মাকে শাসন করে একটু আরকি! আজো তেমনটাই ভেবেছিল কুহেলী । কিন্তু ফোন ধরতেই মেয়ের হাউমাউ কান্নায় চমকে উঠেছিল কুহেলী ।
-কি রে সব ঠিক আছে তো ?
একটু পরে ধাতস্ত হয়েছিল পুপলি।
-জানো মা রাহুল আর নেই।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কোনরকমে কথাকটা বলেছিল পুপলি । আঁতকে উঠেছিল কুহেলী , সকালে খবরে শুনছিল কাশ্মীরে পাকিস্তানী সেনার হামলায় মৃত সাত ভারতীয় সৈনিক । তখন একটিবারও রাহুলের কথা মনে হয়নি । ওই সাতজনের মধ্যে রাহুলও আছে!
মেয়েকে কি সান্তনা দেবে নিজেরই গলাটা বুজে আসছিল কুহেলীর । মোবাইলটা রেখে টেবিল থেকে বোতলটা তুলে ঢকঢক করে জল খেয়েও যেন শুকনো লাগছে গলাটা । তরতাজা হাসিখুশি ছেলেটা আর নেই একথাটা যেন ভাবতেই পারছে না কুহেলী । পাকিস্তানের মানুষগুলো কি মানুষ নয়! তাদের কি পরিবার নেই , ভালোবাসা, মায়া, দয়া কিছুই কি নেই ওদেশের মানুষগুলোর মনে! কিভাবে শেষ করে দিচ্ছে এই তরতাজা তরুণ প্রাণগুলোকে!
সন্ধে হয়ে গেছে , চোখ বন্ধ বিছানায় শুয়ে আছে কুহেলী। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে রাহুলের মুখটা । কিচ্ছু ভালো লাগছে না , উঠে ঘরের লাইটটা জ্বালাতেও ইচ্ছা করছে না । আনমনে বিছানা থেকে মোবাইলটা তুলে নেটটা অন করতেই আবার রাহুলের কথা মনে পড়ে যায় । পুপলি সারাদিন মোবাইল নিয়ে খুটখুট করে বলে বকাবকি করতো কুহেলি । রাহুলই একদিন কুহেলীকে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে বলেছিল,
-এবার বুঝবে আন্টি এ কেমন নেশা ।
তেমন নেশাগ্রস্ত না হলেও সারাদিনে এক দুবার ফেসবুকে আসে কুহেলী । অচেনা মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলতে মন্দ লাগেনা । বিলকিস মেয়েটা পুপলির বয়সীই হবে , কুহেলীর ফেসবুক ফ্রেন্ড । কুহেলীরা ছোটবেলায় যখন জলঙ্গীতে থাকত , ওর বিলকিস নামে একটা বন্ধু ছিল । সেই ছোটবেলার বন্ধুর নামটাকে মনে রেখেই বোধহয় এর সঙ্গে বন্ধুত্ব । কথায় কথায় একদিন বিলকিসের কথা বলেছিল পুপলিকে । পুপলি তো অবাক ,
-মা তুমি দেশের বাইরে বন্ধু করে ফেলেছ ? তবে সাবধান , দেখো আবার জঙ্গী না হয় ।
-পাকিস্তানের মানুষ মানেই কি জঙ্গী নাকি!!
নাহ আজ বিলকিসকে বাদ দিয়ে দেবে বন্ধু তালিকা থেকে । ভীষণ রাগ হচ্ছে ঐ দেশটার প্রতি , ঐ দেশের মানুষগুলোর প্রতি । আমাদের দেশের ওপর ও দেশের মানুষগুলোর কিসের এতো হিংসা!
বিলকিসকে আনফ্রেন্ড করতে গিয়ে ওর শেষ পোস্টটা চোখে পড়ে কুহেলীর ।
মেরে একলৌটা ভাইয়া....কাল চলে গ্যায়া মুঝে একেলে ছোড় কর....ভারতীয় সেনা কি বন্দুক কি গোলি উসে লে গ্যায়ে....উয়ো দেশপ্রেমিক থা....ইয়ে উসকা পুরস্কার!
ইস দুনিয়া মে অব মেরে আপনা কোয়ি নেহি রাহা.....
এতক্ষণের রাগ, অভিমান সব যেন দুচোখের জলের ধারায় ধুয়ে যাচ্ছে । দেশ, জাতি, ভাষার গন্ডী ছাড়িয়ে অন্তরের অনুভূতিগুলো কোথায় যেন এক । কোথায় যেন এক দুদেশের মানুষগুলোই । ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কুহেলীর । সবটুকুই হয়ত রাহুলের জন্য নয় , কিছুটা কষ্ট যেন একমাত্র দাদাকে হারানো বিলকিসের জন্যও....
সুচিন্তিত মতামত দিন