■ তপশ্রী পাল | বাংলার ঈশ্বর

শব্দের মিছিল

সামনেই আসছে একুশে ফেব্রুয়ারী, মানে বাংলা ভাষা নিয়ে একটা আবেগ। সেই আবেগ যা প্রথম জেগে উঠেছিলো ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্থানে, নিজের মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করে প্রাণ দিয়েছিলেন ভাষা শহীদেরা। অবশেষে শুধু বাংলাভাষাকে ভালোবেসে ১৯৭১ সালে তৈরী হয়েছিলো একটি দেশ, যার নাম বাংলাদেশ। সেই ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। কিন্তু যে বাংলা নিয়ে এতো কিছু, সেই বাংলাভাষার সত্যিকারের রূপকার কে এবং বাংলাভাষাকে গড়ে তোলার পিছনে তাঁর কী অবদান তা আমরা অনেকেই ভুলে যাই। তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। গত বছর, অর্থাৎ ২০২০ সাল ছিলো বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মজয়ন্তী বর্ষ। তাই আসুন ভাষাদিবসের প্রাক্কালে, বাংলাকে ভালোবেসে আরেকবার মনে করি সেই মণীষীকে যিনি না থাকলে বাংলাভাষা আজকের এই রূপে পৌঁছতো না, হয়ে উঠতে পারতো না এপার এবং ওপার বাংলার প্রায় চল্লিশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে একবার রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “One wonders of God, in the process of producing forty million Bengalis, produced a man”. ঈশ্বরচন্দ্রের ইচ্ছাশক্তি ছিলো লোহার মতো। ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের পদানত। কিন্তু তিনি তাঁদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে নিজের দেশের মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা নিজে তৈরী করার সক্ষমতা ভারতবাসীর আছে। তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন যে একমাত্র মাতৃভাষায় শিক্ষাই সর্বস্তরের দেশবাসীকে প্রকৃত শিক্ষিত করে তুলতে পারবে। তাঁর ছিলো বাঙ্গালী হৃদয়, কিন্তু একই সঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা সম্বন্ধে অসীম জ্ঞান। সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি, বর্তমান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে এবং বাংলা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

১৮৪৭ সাল। তখন দেশীয় পঠনপাঠনের একমাত্র মাধ্যম ছিলো সংস্কৃত। দেশের সাধারণ মানুষ কঠিন সে ভাষা বুঝতোই না, বলা বা লেখা তো দূরস্থান। তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রচলন ছিলো খুবই কম। বাংলা ভাষা ছিলো নেহাতই এক গ্রাম্য চলিত অঞ্চলভিত্তিক মৌখিক ভাষা । এই ভাষায় বর্ণ, ব্যাকরণ, সাহিত্য কোন কিছুই প্রায় সঠিক ছিলো না।  ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন মাত্র সাতাশ। সবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক পদ ছেড়ে, সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র দেখলেন ছোটদের মধ্যে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে হলে, সামাজিক সংস্কারের কথা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হলে এবং নিজেদের সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে, নতুন সহজ বাংলা ভাষার বিকাশ এবং সেই ভাষায় সাধারণের বোধগম্য বই লেখা অত্যন্ত জরুরী। তিনি ঠিক করলেন, সংস্কৃত ও ইংরাজী সাহিত্য থেকে বেশ কিছু বই বাংলায় অনুবাদ করবেন। সে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন, তারও আগে দরকার বাংলা ভাষার সহজ নতুন কাঠামো, যা শিশুরাও বুঝতে ও শিখতে পারবে। 

বাংলা বর্ণমালা সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য ১৯৫১ সালে বিদ্যাসাগর “বর্ণপরিচয়” লেখেন, যেখানে বাংলার ১২টি স্বরবর্ণ এবং ৪০ টি ব্যঞ্জনবর্ণ, তাদের ব্যবহার করে একস্বর ও বহুস্বর শব্দ, যুক্ত-অক্ষর ও তার ব্যবহার এবং অবশেষে এই সব শব্দ সহযোগে সহজ সরল বাক্যে ছোটদের জন্য নীতিমূলক গল্প বিখ্যাত গোপাল ও রাখাল ইত্যাদি আছে। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ব্যাকরণের বই “সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা” এবং “ব্যাকরণ কৌমুদী” রচনা করেন। এ ছাড়া ছোটদের জন্য “কথামালা”, “চরিতাবলী”, “ঋজুপাঠ ১, ২ ও ৩” বইগুলি লেখেন, যা ছোটদের বাংলাভাষা শেখানোর পাশাপাশি সহজ গল্পে নীতিশিক্ষা দেয় এবং জীবনবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সেই থেকে শত সহস্র শিশু আজও এই বইগুলি পাঠ করে বাংলাভাষা শেখে।

১৮৪৭ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে বিদ্যাসাগর যে বইগুলি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, তার মধ্যে ছিলো সংস্কৃত “কথাসরিতসাগর”-এর অনুবাদ বিক্রমাদিত্য ও বেতালের পঁচিশটি গল্প নিয়ে “বেতালপঞ্চবিংশতি”, “বাংলার ইতিহাস” যেটি জন মার্শালের “History of Bengal” এর বঙ্গানুবাদ, “জীবনচরিত” অর্থাৎ “chamber’s biography”র বঙ্গানুবাদ, যেখানে অনেক পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীর জীবনকথা বিধৃত ছিলো, এমনকি শেক্সপীয়রের “comedy of errors” এর বঙ্গানুবাদ “ভ্রান্তিবিলাস”ও ছিলো। এ ছাড়া সংস্কৃত রামায়ণ ও মহাভারত এবং কালিদাসের “অভিজ্ঞান শকুন্তলম” অবলম্বনে তিনি সীতার বনবাস, বাংলা মহাভারত ও শকুন্তলা লেখেন।  

এরপর তিনিই প্রথম বাংলা পত্রিকা “তত্ত্ববোধিনী” ও “সোমপ্রকাশ” এর জন্ম দেন। সমাজসংস্কারের জন্য লেখেন “বহুবিবাহ” ও “বিধবাবিবাহ” বইদুটি যা অনেক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলো এবং ঈশ্বরচন্দ্রকে অনেক সমালোচনা ও আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়। 

এই বইগুলি রচনা করার সময় তিনি বিশেষভাবে দৃষ্টি দেন সংস্কৃত তৎসম শব্দ কম ব্যবহার করে, বাংলায় নতুন শব্দ সৃষ্টির দিকে এবং ভাষার সৌন্দর্য, মসৃণতা ও নমনীয়তা বৃদ্ধির দিকে। তিনিই প্রথম বাংলা গদ্য রচনা করতে গিয়ে, বাংলা বাক্যে কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়ার মধ্যে সহযোগিতা ও পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি এমনভাবে বাংলা লেখেন যাতে পাঠক বাক্যের অর্থ অনুযায়ী ও পড়ার সময় নিশ্বাস নেওয়ার অবকাশ অনুযায়ী সঠিক স্থানে থামতে পারেন । তার আগে বাংলায় punctuation mark বা যতি চিহ্ণ বলে কোন কিছুর ব্যবহার প্রায় ছিলো না, অথবা তা ছিলো শুধুই ইংরাজীর অন্ধ অনুকরণ। 

বিদ্যাসাগর বাংলা লেখার সময় কখনোই একটি মাত্র স্টাইল বা ধরণ ব্যবহার করেন নি। লেখা অনুযায়ী বিভিন্ন স্টাইল ব্যবহার করেছেন। ১৮৪৭ থেকে ১৮৬৩, এই দীর্ঘ সময় তাঁর অত্যন্ত ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও তিনি এই বিশাল কাজ সম্পন্ন করেন এবং এইভাবেই তিনি আধুনিক বাংলা ভাষার ভিত রচনা করে দিয়ে যান। তাই তো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলা গদ্যের পিতা বলা হয়। তাঁর এই আরব্ধ কাজকেই পরবর্তীকালে আরো এগিয়ে নিয়ে গেছেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ।   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.