শুভ্র শোভন রায় অর্ক

শব্দের মিছিল

আব্বা বশিরের হাত ধরে রেখেছিলো।​ আম্মা হাউমাউ করে কাঁদলো৷​ কিন্তু বশির অনড়৷​ ওকে থাকতে হবে।​ কাজ যে বাকী৷​ যা যা পেরেছে তুলেছে নৌকায়।​ নৌকা অনেকদূর ঘুরে ঘুরে তারপর ওদের একটা চড়ে নামিয়ে দিবে। ওখান থেকে পরিচিত লোক ঠিক করা আছে, ওরা আব্বাদের নিয়ে যাবে।​ ওখান দিয়ে নদীর হাঁটুজল ভেঙে ইন্ডিয়ায় ঢোকা যায়। বাঁচার জন্য যেতেই হবে। সারাদেশে হানাদারদের তান্ডব, সব ওদের দখলে। ইন্ডিয়ার এদিকে সাধারনত বিএসএফ থাকে না​ জঙ্গলী এলাকা বলে ।​ কিমি দুয়েক হাঁটতে হবে প্রত্যন্ত চড়ের মাঝ দিয়ে, তারপর​ সারি সারি শুধু কলাবাগান। সেসব পার হয়ে ডিঙ্গি দিয়ে আবার কিছুটা নদী পার হয়ে তারপর চড়ের ভেতর কাশবন, তার ভিতর দিয়ে গিয়ে তারপর হাঁটুজল ভেঙ্গে নদী পার হলেই ইন্ডিয়ার মাটি , একবার ওপাশে পৌঁছালে আর চিন্তা নেই।​ ভিতরে অনেকটা গেলেই একটা না একটা ব্যবস্হা হয়ে যাবে। সেখান থেকে মাইল তিনেক দূরে শরনার্থী ক্যাম্প আছে।​ আব্বুকে সব বুঝায় দিয়ে বশির হাত ছাড়ায় নেয়৷​ ওকে থাকতে হবে, অনেক কাজ বাকী এখনো। ছোটভাইটা ওদের সাথে আছে, তাই আর চিন্তা নাই যদিও ভাইটা ওর সাথেই থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু কাউকে একজন তো থাকতে হবে আব্বু আম্মুর সাথে।​ ​ দিনে দিনে পৌছে যেতে পারবে ওরা। আব্বা-আম্মার কান্না থামছিলো না।​ আব্বার মাথা থেকে টুপিটাও কখন পানিতে পড়ে গেলো যেনো অলক্ষ্যে ।​ ঋষির মত সাদা দাড়িগুলো ভিজে গেলো চোখের পানিতে৷​ ​

মাঝিকে ডেকে বশির বললো " চাচা জানি আরেকবার ফিরে আসা তোমার জন্য রিস্ক হয়ে যাবে কিন্তু তোমাকে এটা করতেই​ হবে "​

মাঝি বশিরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।​ ফিরে আসা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। কিন্তু বশিরের অনেক ঋণ ওর উপর। ওর দরকারে আজ এটুকু করতেই হবে৷​ ​

"ঠিক আছে তুমার জন্যই আসমু,​ চিন্তা কইরো না "​

বশির কানে কানে বলে দেয় কাকে নিয়ে যেতে হবে। সাথে হাতে জোর করে অনেকগুলা টাকা গুঁজে দেয় ৷ "ভুইলো না কিন্তু "।​

যতক্ষণ বশিরের কাছে দৃশ্যমান হয় নৌকা ও শুধু দেখতে পায় বাবার অসহায় মুখ... আর মায়ের মুর্ছিত দেহ.....​

নৌকা নদীর বাঁকে অদৃশ্য হতেই কাজে নেমে পড়ে ও। পাশের গ্রামে যেতে হবে।​ যতটা দ্রুত সম্ভব। কিছু কলাগাছ কেটে নদীর পাড়ের ঝোপের পাশে নিয়ে আসে।​ এগুলো পড়ে​ কাজে লাগতে পারে পালাতে। ও রওনা দেয়।​ অস্ত্র আনতে হবে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালায় দিছে কুত্তার বাচ্চারা।​ কাউকে ছাড়ে নাই।​ আগে যারা বর্ডার ক্রস করে ওপাশে গেছে বেঁচে গেছে৷​ যারা যায় নাই ভিটেমাটির টানে কচুকাটা হইছে।​ হিন্দু-মুসলমান বাচবিচার করে নাই ।​ কিন্তু এবার ওরাও ছাড়বে না ; রক্তের বদলে রক্ত বইবে।​

নদীর পাড়ে​ কাঁপতে কাঁপতে এলো সাবরিনারা৷​ একজন দাঁড়িয়ে ছিলো ঝোপের পিছনে।​ ওদের নাম জেনে পাড়ের​ নিচে মাটির খাঁজে রাখা নৌকৌতে জলদি উঠার তাগাদা দিলো।​ ​

মোটা মহিলা দুজন কে ঠেলেঠুলে উঠিয়ে ছোট মেয়েটাকে উঠালো,​ বয়স্ক লোকটা কাঁপছিলো বেশি;তাকে ধরে উঠিয়ে সাবরিনা একটু থমকে ফাঁকা কাচা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো। পাড়ের নিচ থেকে রাস্তা আসছিলো না নজরে তবে অনেক দূর পর্যন্ত গাছের মাথাগুলো উঁকি দিচ্ছিলো,​ গাছ বেয়ে শীতল ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছিলো, গেরুয়া আলো আসছিলো পাতার ফাঁক গলে ; বেলা শেষের দিকে।​ পিনপতন নীরবতায় শুধু নদীর​ জলের কলকল শব্দ, আর বাড়ি ফেরা দুএকটে পাখির ডাক হঠাৎ কানে ভাসছিলো ।​ ​

কেউ কি আসবে আদৌ?​ কারো কি আসার কথা.......?​

সাবরিনার অন্তঃআওয়াজ শোনার কেউ ছিলো না তখন।​

মাঝি তাগাদা দিলো৷​ ও উঠে বসলো। মহিলা দুজন অঝরে কেঁদে চলেছেন৷ ছোট মেয়েটা বয়স্ক লোকটিকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলো, লোকটি মাথা নিচু করে কাঁপছিলো শুধু, ভেজা চুল থেকে পুরো মাথার জলগুলো গড়িয়ে পড়ছিলো সময় নিয়ে, টপ...টপ।​ একটু আগের ঝিরঝিরে বৃষ্টি ওদের ভিজিয়েছে, বিহারী কুকুরগুলো ওদের কাঁদিয়েছে ,​ আর এখন ওরা দেশছাড়া হচ্ছে।​

মাঝি দুজন জোরে জোরে নৌকা বাইতে লাগলো। আর একটু পর পর পিছনে ফিরতে লাগলো৷​ দাঁড় বাইতে বাইতে ওদের হু হু শব্দ এই চরম অনিশ্চিত যাত্রায় একমাত্র মানুষের অস্তিত্ব বহন করতে লাগলো।​

সাবরিনা সবার দিকে পিঠ ফিরে নৌকার শেষ মাথায় বসে ছিলো। কাপড় ভিজে এমনভাবে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে যে শরীরের পুরো আবয়ব টাই বোঝা যাচ্ছে এই আবছা সন্ধ্যেতে।​ কিন্তু ওর​ যৌবনভরা রূপ দেখার কেউ নেই এখানে। এমন কি ওই অচেনা মাঝিদেরও না।​ জীবন যেখানে অনিশ্চিত, কামনা সেখানে বাসা বাধতে পারে না।​

সাবরিনার চোয়াল শক্ত হতে হতে ব্যাথা করতে থাকে তবুও ও স্বাভাবিক হয় না।​ পাড়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুধু,​ একটা বাড়ির ভাঙা টিনের অংশ দেখা যায় ,বিশাল বিশাল​ নারকেলের পাতার দোলন দেখতে পারে,​ জংলি কাশের বন দেখতে পারে,​ নিরুপায় দাঁড়ানো কুকুরটার​ দৃষ্টিও চোখে পড়ে ওর ; সব ঘোলাটে।​

নৌকাটা শুধু দূরেই সরে যেতে থাকে পাড় থেকে।​ নদীর জলের রঙ কালো দেখায় ততক্ষনে, তার মাঝেও শেষ আলোটুকু ঢেউয়ের ভাজে ভাজে কখনো রূপোলী কখনো সোনালী আভার মত ভেলকি দেখায়।

সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে আসতে হলো ওদের।​ সবাই ঘর বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে লাগলো।​ ওরা থাকলে হয়ত বাকীদের মত ওদেরও কচুকাটা করতো ধর্মান্ধ হানাদারেরা । মুসলমান বলে ওদের কাছে রক্ষা পেতো না।​ ছিড়েখুঁড়ে খেতো শরীর।​ হিন্দুদের তো ঢালাও ভাবে মেরেছে।​ বৌদের-মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে। তাদের হাত থেকে বাঁচানোর কেউ নেই।​ ওদেরও ছাড়বে না ধরা পড়লে, আজ আর হারানোর কিছু নেই ,​ নিরুদ্দেশের হারানোর কিছুই থাকে না।​ কিন্তু বশির এভাবে পারলো ওকে ছেড়ে পালাতে?​ যে ছেলেটা সারাদিন ' তুমি আমার জীবন বলে ' মাথা নষ্ট করতো সে আজ ওকে রেখে পালিয়ে গেলো স্রেফ!​ শতকষ্ট রাগেও বশিরের জন্য হাসি পেলো ওর "শালা প্রেমিক!​ কাপুরুষের জাত "।​ বাকীদের সব রাগ গুলো বশিরের উপর বর্ষিত হলো যেনো।​ দ্রুত আবছা হয়ে আসা পাড়ের দিকে তবুও যেনো আকর্ষন, সব ফেলে আসার বেদনা ওকে জর্জরিত করে ফেললো।​ তবে কাঁদলো না। যার জন্য কাঁদতো সেই তো ওকে ফেলে পালিয়েছে....​

সাবরিনাদের নৌকা নদীর বাঁকে হারিয়ে যেতেই বশির ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসলো কোদাল হাতে।​ ঝিরঝিরে বৃষ্টি আবারো পড়তে শুরু করেছে।​ কাঁচা রাস্তার এঁটেল মাটি আরো পিচ্ছিল তখন।​ রাস্তা ধরে অনেকটা পিছিয়ে গেলো ও।​ প্রথমে পাশাপাশি দুটো সুপারিগাছে এক মানুষ সমান করে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে টানটান করে লোহারতার বেঁধে দিলো।​ কপাল ভালো থাকলে এখানে আটকেই দু একটার ভবলীলা সঙ্গ হয়ে যাবে৷​ তারপর একটু এগিয়ে এসে রাস্তার মাটিতে কিছু গর্ত করে ফাঁদ আটলো, মাইন পুঁতে দিলো। বিহারী কুত্তাগুলা এই জায়গা চেনে,ওরা পথ দেখিয়ে আনবেই হানাদারদের । ওদের গাড়ি আসলেও এগুতে পারবে না আর।​ সাধারন মানুষ আসবে না আর।​ যা যাওয়ার ছিলো সবাই গেছে।​ এখন আল্লাহ ভরসা।​ ​

বশিরদের লিডার গুরুভাইয়ের নির্দেশে পুরো গ্রামজুড়ে ওরা কয়েকভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে,​ একেকভাগে পাঁচ-ছয়জন করে।​ গোলাবারুদ কম ,​ হিসেব করে খরচ করতে হবে।​ বুদ্ধি দিয়ে লড়তে হবে।​ শত্রু সামনেও আছে, পিছনেও। বশিররা গ্রামের মাঝামাঝি এখন। কিমিদুয়েক দূরে গ্রামের শেষমাথায় পরিত্যক্ত রেলষ্টেশন গতপরশু কবজা করেছে হানাদাররা। ওখানে ক্যাম্প করেছে, ভারী মর্টারশেল- শটগান-স্টেনগানসহ ,তাতে দক্ষিনের পুরো সীমানাজুড়ে পাহাড়া দিতে পারবে ওরা। মিত্রবাহিনীর ঢোকা মুশকিল নদী বেয়ে।​ ওটা মুক্ত করা চাই।​ সোর্সের খবর ঠিক হলে 'আজ রাতে বিহারীরা অস্ত্রের চালান দিবে ;তবে আসবে ঠিকই কিন্তু ফিরে যেতে পারবে না ।​ ওটা আটকাতে হবে যেকরেই হোক'।​ বশিরদেরও হারানোর কিছু নাই,​ হয় মারবে -নয় মরবে।​ বশিরের দলের বাকী তিনজন এলো। ওরা অতিসন্তপর্নে গ্রামের ভিতরের গাছের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে চললো বড় রাস্তার দিকে। গ্রাম নিস্তব্ধ, জনমানুষহীন। ভূতুরে পরিবেশ।​ কে মিত্র কে শত্রু বোঝা মুশকিল৷ রাস্তা ছেড়ে পাশে একটু নিচে পুকুরের ধারে​ বশির আর মোহন কুঁড়েঘরের ভিতর বালুর বস্তা দিয়ে বানানো বাঙ্কারে পজিশন নিলো।​ বাকীরাও দুজন দুজন করে অন্য দিকে। মাঝ রাস্তা বরাবর মাইনপোতা।​ ​ এখন শুধু অপেক্ষার পালা............

সময় কতটা হয়েছে।​ কখন সাবরিনারা নদীর শেষ মাথায় এলো খেয়ালি নেই।​ ওরা সবাই আচ্ছন্নে, ঘোরের মধ্যে।​ ততক্ষনে সবার চোখের জলও শুকিয়ে গেছে, সেখানে এখন শুধু অনিশ্চয়তার ভয়​ ।​ আসার সময় নদীতে ভেসে যাওয়া​ মানুষের লাশ চোখে পড়েছে।​ অনেক দূরের কোথাও হয়ত গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিলো হানাদারেরা।বৃষ্টির মধ্যেও কালো ধোঁয়া উড়ছিলো সেখানের আকাশজুড়ে। মানুষ অস্তিত্বহীনতার কালপাকে। নৌকার গলুই পাড়ে ভিড়তেই সবাই অন্ধকারে নেমে দাঁড়ায়৷​ মাঝি নৌকা বেঁধে ওদের রাস্তা দেখিয়ে এগুতে থাকে, সবাই নিঃশব্দে ওনাকে অনুসরন​ করে ।​ তারপর নদী থেকে​ সহজে দেখা যাবে না ততটা দূরত্বে গিয়ে হ্যারিকেন জ্বালালো।​ চড় এলাকাটা এখন ভালোয় ভালোয় এগুতে পারলে হয়।​ একদিকে ছিলো হানাদারের ভয়,​ এবার ডাকাতের। ডাকাতরা লুট করবে কিন্তু জানে নাও মারতে পারে কিন্তু হানাদাররা জানে মারবেই মারবে।দলটা কাঁপাকাঁপা​ বুকে এগিয়ে যেতে থাকলো। মুখ চিপে কাঁশতে লাগলো ঠান্ডায়,​ তাছাড়া এই জনমানবহীন নদীর চড়ে ঝিঝি পোকার শব্দ ছাপিয়ে শুধুই ভিজা বালিতে ওদের​ পায়ের ঘষা লাগার থপ থপ শব্দ, তাছাড়া আর কিছু নেই । মাঝে মাঝে হয়ত দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক৷ আৎকে উঠলেও ওরা একে- অপরের হাত ধরে থাকলো শক্ত করে৷​ কলাবাগানের কাছাকাছি চলে এলো ।​ ভিতরে ঢুকলো৷​ কিছুদূর গিয়ে বয়স্ক লোকটা জানালো আর পারছে না হাঁটতে। সবাই ই হাপিয়ে গিয়েছিলো, যতটা না শারীরিকভাবে তারচেয়েও বেশি মানসিক ভাবে। ওরা কিছুক্ষন থামার জন্য দাঁড়ালো। ভেজা কলাগাছে ঠেস দিয়ে বসে পড়লো সবাই।​ ​

মহিলাদের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করলো মাঝিকে উদ্দেশ্যে করে "আর কতদূর? "​

- 'আরো অনেকটা পথ '​

ওরা গাছে ঝোলা কলার কাদি থেকে আধকাচা কলাই পেড়ে খেলো। সারাদিন পেটে কিছুই তো যায়নি!

আবার সবাই চুপচাপ।​ শুধু নীরবে একজন অন্যের দিকে চেয়ে থাকা। এ নিঃস্তব্ধতার যেনো শেষ নেই,​ এক একটা মুহুর্ত অনন্তকাল,​ বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রতিটা ক্ষনে ক্ষনে, সামনে কি কেউ জানে না। কোথায় যাচ্ছে জানেনা, কি খাবে জানে না... জীবন বড়ই অনিশ্চয়তার।​ কেউ জানে না উপরওয়ালার ইচ্ছা কী?​ ​

মাঝি তাগাদা দিলো ওঠার।​ হেঁটে চললো ওরা।​ মাটিতে তাজা পায়ের দাগ।​ কিছুক্ষণ আগেও মানুষ গিয়েছে নিশ্চিত।​ তারা বন্ধু নাকি শত্রু কেউ জানে না।​ উপযুক্ত তিনটে মহিলা নিয়ে এ যাত্রা কতটা ভয়ংকর তারাই শুধু জানে যারা এ অবস্হার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে৷​ ​

সাবরিনার এসবে কিছুই যায় আসে না৷​ কি আর হবে।​ কি আছে হারানোর?​ এই শরীর টা?​ মাংসপিন্ড ছাড়া এটা আর কি?​ খুবলে খাবে?​ খাক....!! ওর হারানোর আর কি আছে৷ সঙ্গী যখন দুঃসময়ে​ পালিয়ে যায়​ তখন কার জন্য আর বেঁচে থাকা৷​ একটা সুন্দর জীবনই তো চেয়েছিলো। বেশি কিছু কি?​ হানাদার রা সব ছাড়খার করলো।​ আর কাপুরুষটা ভয়ে ওকে রেখে পালালো?​ বাহ্ জীবন।​ ও আকাশের দিকে তাকালো, গাঢ় নীলছে অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না।​ এ রাত কোথায় গিয়ে ঠেকে দেখবে ও।​ ​

কলাবাগান দ্রুতই পার হলো ওরা৷ একটু খোজা খুজি করতেই ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে পেলো এককোনায় বড় বড় জঙলি ঘাসের ভিতর। নিঃশব্দে বিশাল বিশাল গাছ দাঁড়িয়ে ওদিকে৷ ডিঙ্গিতে কোনরকমে ওপাড়ে পৌঁছুলো ওরা।​

এবার কাশ বনটা পাড় হলেই ইন্ডিয়ার জমি।​ কাশবনে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনি দূম করে বিস্ফোরনের শব্দ কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো এতদূরের আকাশ-বাতাস, মাটি।​ ওরা ঘুরে দেখতে পারলো আকাশে আগুনের ঝলকানি।​ এর পর মুহুমুহ বুলেটের শব্দ।​ ​

সেই অন্ধকারেও ভীত মানুষগুলোর ভয়ার্ত দৃষ্টি বোঝা যাচ্ছিলো।​ ​

মাঝির মুখ দিয়ে শুধু বের হলো " আহা বেচারা বশির"...।​

সাবরিনা মাথা ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়ানো মাঝিকে প্রশ্ন করলো অবাক ভাবে "বশির মানে? "​

"কেন আপনি জানেন না " ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলো মাঝি।​

"​ বশির.....?​ ​ কি বলতে চান আপনি?​ "​

"অনেক ভালো মানুষ ছিলো.... আল্লাহ সহায় হোক ওনার"​

একটু আগের আগুনের ঝলকের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে " বশির ওখানে...?​ "

হঠাৎই সাবরিনার মাথা গুলিয়ে যায়। কোন কিছুর হিসাবই ও মিলাতে পারে না।​ বশির তো আগেই গ্রাম ছাড়া হয়েছে পরিবার নিয়ে খবর পেয়েছিলো ।আর ওর কপালভালো মুক্তিবাহিনীর ওরা এলো৷​ উদ্ধার করে ওদের নৌকা দিয়ে পাড়াপাড়ের ব্যবস্হা করে দিলো।​ তাহলে কি বশিরই এসবের পিছে......? মাথাটা গুলিয়ে উঠলো।​

"মাঝি বললো -বশির বাবাই তো আপনাগো জন্য নৌকা ঠিক কইরা রাখছিলো,​ নিজে আসলো না- বাকীগো বাঁচায় দিলো "। দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো উনি মাথা নাড়াতে নাড়াতে।​

চলেন আগাই...

কিন্তু সেকথা সাবরিনার কানে পৌছুলো না।​ এ কি করলো ও। যাকে কাপুরুষ বলে এতক্ষন ঘৃনা করছিলো সেই বশির, ওর বশির ওকে বাঁচিয়ে নিজে রয়ে গেলো অলক্ষ্যে.....​

সাবরিনা দিকবেদিক দৌড় দিলো; যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে৷​ অন্ধকারও ওকে আটকাতে পারলে তো!​ উষ্টে পড়লো মুখ থুবড়ে,​ চিৎকার করে উঠলো।​ বমি করে দিলো।

পিছন থেকে বাকিরাও চলে এসেছে ততক্ষনে।​ অবাক ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে ওরা।​

সাবরিনা অজ্ঞান হওয়ার আগে চিৎকার করে বলে উঠলো " তুই সত্যি কাপুরুষ, আমাকে ছেড়ে একাই নিজে মরলি.... তোকে আমি মাফ করবো না "।​

অন্ধকারে কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো অনেকদূর পর্যন্ত, তবে কেউ শুনলো নাকি জানা নেই!

রাস্তা তখনো অনেক বাকী।​ ​

মাঝি তাগাদা দিলো।​

সাবরিনার জ্ঞানহীন দেহটা টেনে নেয়া ভীষন কষ্টকর................।।।​


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.