বাসী কাজ সেরে রান্নার জোগাড় করতে বসে বিনু। ঘুম ভাঙে কোন রাত থাকতে। পল্টুকে চা করে দিতে হতো ভোর চারটেয়, সেই থেকে অভ্যেস।
তখন উঠতে ইচ্ছে করতোনা, বিশেষ করে ঠান্ডার দিনগুলোয়, নিজেকে নিজেই বলতো, আহা, ছেলেটা বাসী মুখে বেরোবে, একটু চা করে দে মেয়ে, সেই তো সারাদিন গড়িয়ে, জিরিয়ে থাকা। বিনু চা করতো। বেশী করে দুধ, চিনি আর চা পাতা দিয়ে। পল্টু খেয়েই দৌড় লাগাতো দুধের গাড়ী ধরবে বলে। স্টেশনে গাড়ী আসতো ঠিক সাড়ে চারটেয়, ক্রেট নামিয়ে বিলি ব্যবস্থা দেখে, সব মিটিয়ে ফিরতো বেলা একটায়। সেসব পাট চুকে গেছে কবেই। তবু মনে হয় এই তো সেদিন পল্টুর হাত ধরে এক সালোয়ারে চুপিচুপি বাড়ি ছেড়েছিল বিনু। মাধ্যমিক সবে শেষ হয়েছিল, বাড়ির লোক জানতো বিনু সেলাই শিখতে যাচ্ছে সুলতা দিদিমণির বাড়ি। দুদিন পর দাদার বন্ধুরা দেখতে পেয়ে খবর দিয়েছিল বাড়িতে। একমাথা সিঁদুর এবং পল্টু সহ বাড়ি নিয়ে এসেছিল দাদা। গরীব বিধবার মেয়ের অত সহজে জাত মান যায় না, বরং মনে মনে খুশীই হয়েছিল বিনুর মা শিবানী। প্রাথমিক মান অভিমান মিটে যাবার পর পঞ্চাশ জন লোককে মাংস ভাত খাইয়েছিল ওরা। সংসারের টুকটাক জিনিস যা পেয়েছিল টোনা টুনির সংসার সুন্দর হেসে খেলে কাটছিল বেশ।
তবে কিনা শিবানীর কপালে সুখ লেখেননি ভগবান। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যে কোল আলো করে নাতি এসেছিল, দুদিনের জ্বরে হঠাৎ করে সে কোল খালিও হয়ে গিয়েছিল। পল্টু দিনরাত পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে, ঘরে ঢুকতে চাইত না। বিনু শোক করতেও ভুলে গিয়েছিল যেন, সেও ছেলেমানুষ বই তো নয়! দেড়মাসের মাথায় চৌমাথায় ট্রাক চাপা পড়ে মারা গেল পল্টু!
সময় এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল বিনুর সামনে। এক একটা মুহূর্ত যেন এক যুগ! বিনু ওদের ভাড়াবাড়ির বিছানায় বসে দু হাঁটু আঁকড়ে শুধু দুলতো! দিনরাত! যন্ত্রের মতো করে যেত দৈনন্দিন কিছু কাজ! আর বসে দুলতো বিছানায় শোয়া অদৃশ্য শিশুটিকে নিয়ে!
কতদিন এভাবে কেটেছিল বিনুর আর মনে নেই। পল্টুর অল্প পুঁজির ব্যবসা তিরিশ হাজার টাকায় হাতবদল হয়েছিল। ভাড়া বাকী পড়েছিল কিছু, বাড়িউলি নিতে চায়নি বরং চেয়েছিল বিনু স্বাভাবিক হোক। টুকরো টাকরা সংসার গুটিয়ে নিয়ে বিনু আবার ফিরে এসেছিল মায়ের কাছে।
দাদা ইতিমধ্যেই বিয়ে করেছে। দেড় কামরার ঘরে বিনুর জায়গা হওয়ার কথা নয়, তবু কিভাবে যেন হয়ে গিয়েছিল। বৌদি মানুষটি খারাপ নয়, সে বিনুকে বুক বুক করে না রাখলেও হেলা ফেলাও করেনা। নিজের জন্যে স্নো পাউডার কিনলে বিনুর জন্যে টিপের পাতা, চুড়ি টুড়ি নিয়ে আসে। সে অল্প কথার মানুষ, বিনু আসার পরপরই বাড়ির কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। বিনু ভোর ভোর উঠে বাসি কাজ সেরে উনুন ধরিয়ে সকালের রান্না সারে। খেয়ে দেয়ে সব তারা বেরোয়। শিবানী এখনও দুবাড়ি রান্না করে। পাঁচ হাজার টাকা রোজগার তার মাসে। বিনুর দাদা কলকাতায় এক ছিটকাপড়ের দোকানে বসে। চালু দোকান, তাই বেতনও সময়মতোই ঘরে আসে। নেশাভাং কিছু নেই। বিনু যায় গরুবাথান ফ্রি প্রাইমারি স্কুল এ মিড ডে মিল রান্না করতে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বদান্যতায় জুটে গিয়েছিল চাকরিটা। না, কোনোরকম বিনিময় করতে হয়নি। মাঝে মাঝে ভালো কিছু হয় বলেই পৃথিবীটা টিঁকে আছে আজও।
#
টগবগ করে উনুনে ফুটতে থাকে ভাত। সকালের রান্না উঠোনেই হয়। মাটির উনোনে। গাছ গাছালি আছে কিছু, সারাদিন পাতা পড়ে, ডাল ছাঁটা হয়, আর নারকেল সুপুরির পাতা, ডাগ, কোনোকিছুই ফেলেনা শিবানী। সব কেটে কুটে, বেঁধে-ছেধে বস্তাবন্দী থাকে। গোটা শীতকালের রান্না, গরম জল বাইরের উনুনেই হয়। ছাইটুকুও ফেলেনা শিবানী। যত্ন করে প্যাকেট করে দেয় বিনু। সেসব কিনে নেয় ফ্ল্যাটবাড়ির মেমসাহেবেরা। মিহিন ছাই দিয়ে তাদের ঠাকুরের বাসন, পেতলের ফুলদানি চকচকে হয় ভালো। অর্গ্যানিক না কিসব বলে যেন। বিনুরই বুদ্ধি এসব। একটু কালির অক্ষর পেটে আছে তাই করে, বারো ক্লাসটা দিলে হয়তো ছোটমোটো একটা চাকরি যোগাড় হতে পারতো। রান্না মাসির কাজ আবার একটা কাজ হলো! তবু মাস গেলে বিনু হাজার দেড়েক পায়। ঐ বা কে দেয় আজকালকার বাজারে।
এবার ডাল বসিয়ে ঘরের পেছন থেকে কচুশাক তুলে আনে বিনু। ডাঁট গুলো সরু সরু লম্বা করে কাটে। দুটো আলু, বেগুন আর সিম দেয় একই ভাবে। আধখানা পেঁয়াজ কুঁচো করে। রাঁধুনি ফোঁড়ন দিয়ে চচ্চড়ি হবে একটা। পাতাগুলো ভাপ দিয়ে ফেলে কালোজিরে রসুন দিয়ে বেটে রাখবে। সকালের খাবারে এর চেয়ে বেশী কিছু লাগেনা। এ বাড়িতে চায়ের পাট নেই। বাইরে যে যার মতো খায় কখনও। অবশ্য বিনুর বৌদির রান্না ঘরে তোলা আছে চায়ের আসর, লোকজন অতিথ-কুটুম আসলে হয় কখনো। রান্না ঘরে গ্যাস আছে। বেলার দিকে বিনুর বৌদির গ্যাসে দুপুরের ভাতে ভাত আর রাতের রান্না সেরে রাখে। দিনে মানে যত বাসন হয় সেই মাজে। রাতের খাওয়ার পর জমা হয় যা সেসব বিনুর ভাগে। বৌদি একটু বেলা করে ওঠে। দাদা যতক্ষণ বিছানায় থাকে বৌদি ওঠেনা।
বিনুর সাথে সাথে শিবানীও উঠে পড়ে। বিনু যখন রান্না করে শিবানী তখন বারান্দায় বসে বিলাপ করে। বিষয়ের অভাব হয়না কোনোদিন।
বিনুর বাবা মারা গেছে কোন ছোটবেলায়! অথচ মায়ের বিলাপে বিনু স্পষ্ট মনে করতে পারে কালোকুলো, ছোটখাট, নিরীহ এক পুরুষকে। যেন কাঠের গেটটা খুলে এই ঢুকবে! এত বছরেও শিবানী ভুলতে পারেনা শাশুড়ির একচোখেমির কথা! বড় ছেলে মারা যাওয়ার পর তার বৌ, নাতি, নাতনির সাথে সম্পর্কটুকু রাখেনি সংসার টানার ভয়ে। সে বুড়ি মরে স্বর্গে গেছে কোনকালে, শিবানীর জ্বালা জুড়োয়নি এখনও!
তারপর আছে গিঁটে গিঁটে ব্যথা। আঁকাবাঁকা আঙুল দিয়ে কাজের বাড়িতে মশলা বাটা যায়না, ইনিয়ে বিনিয়ে সেই কথা বলে শাক বাছার ফাঁকে ফাঁকে। বয়সকালে এই হাতের রান্নার প্রশংসা করেছে কত লোকে সেকথা বলে। আর বিনুর কপালের কথা বলে। ফ্ল্যাট বাড়িতে রান্নার কাজে ঢুকলে রোজগার একলাফে বেড়ে যাবে অনেকটা, শিবানী কথা বলেও রেখেছে কিন্তু বিনু রাজি নয়। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, এখন কাজ করে টাকা পয়সা জমিয়ে রাখলে বুড়ো বয়সে বসে খেতে পারবে একথা মনে করিয়ে দেয় বারবার। তবু বিনু ঐ স্কুলের কাজটা ছাড়তে চায়না! এমন পোড়াকপালী মেয়ে রেখে মরণকে ডাকতেও ভয় পায় শিবানী।
কখনও কখনও ছেলের বউ এর কথা তোলে। বাড়িতে বিধবা ননদের সামনে লজ্জাহীনার মতো বেলা দুপুর পর্যন্ত বিছানায় থাকা অসহ্য বোধ হয় তার। এবং এতক্ষণ বিছানায় থাকার পরও কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা দেখে কপাল চাপড়ায়। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকে বুকে গেছে কোনকালে তবুও সেই শ্বশুরের বংশরক্ষা হচ্ছেনা দেখে আড়ালে ছেলের বউয়ের বাপান্ত করে!
বিনু সব শোনে। মাথায় নেয়না কিছু। ওর মনে সংসারের কোনকিছু তেমন দাগ কাটেনা। না মরা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে তাই রোজগার করা, কাজে যাওয়া, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি। এমনকি অটো স্ট্যান্ডের শিবু আজকাল ভাড়া নিতে চায়না, নরম সুরে কথা বলে, বিনু সেসবেও কোনো আগ্রহ দেখায় না।
রান্না শেষ করে খাবার দাবার গুছিয়ে রান্নাঘরে তুলে রাখে বিনু। দাদা উঠে স্নান সেরে এসেছে। বৌদি খাবার বেড়ে দেবে। দাদা যাবে সবার আগে। তারপর বিনুর মা। বিনু সাধারণত বেলার দিকে। অটোয় গেলে দশমিনিটে পৌঁছে যাবে। আজ হেঁটেই যাবে বলে সেও তৈরী হয়ে দাদার সাথেই বসে পড়ে।
#
বিনুর বাবা মারা গেছে কোন ছোটবেলায়! অথচ মায়ের বিলাপে বিনু স্পষ্ট মনে করতে পারে কালোকুলো, ছোটখাট, নিরীহ এক পুরুষকে। যেন কাঠের গেটটা খুলে এই ঢুকবে! এত বছরেও শিবানী ভুলতে পারেনা শাশুড়ির একচোখেমির কথা! বড় ছেলে মারা যাওয়ার পর তার বৌ, নাতি, নাতনির সাথে সম্পর্কটুকু রাখেনি সংসার টানার ভয়ে। সে বুড়ি মরে স্বর্গে গেছে কোনকালে, শিবানীর জ্বালা জুড়োয়নি এখনও!
তারপর আছে গিঁটে গিঁটে ব্যথা। আঁকাবাঁকা আঙুল দিয়ে কাজের বাড়িতে মশলা বাটা যায়না, ইনিয়ে বিনিয়ে সেই কথা বলে শাক বাছার ফাঁকে ফাঁকে। বয়সকালে এই হাতের রান্নার প্রশংসা করেছে কত লোকে সেকথা বলে। আর বিনুর কপালের কথা বলে। ফ্ল্যাট বাড়িতে রান্নার কাজে ঢুকলে রোজগার একলাফে বেড়ে যাবে অনেকটা, শিবানী কথা বলেও রেখেছে কিন্তু বিনু রাজি নয়। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, এখন কাজ করে টাকা পয়সা জমিয়ে রাখলে বুড়ো বয়সে বসে খেতে পারবে একথা মনে করিয়ে দেয় বারবার। তবু বিনু ঐ স্কুলের কাজটা ছাড়তে চায়না! এমন পোড়াকপালী মেয়ে রেখে মরণকে ডাকতেও ভয় পায় শিবানী।
কখনও কখনও ছেলের বউ এর কথা তোলে। বাড়িতে বিধবা ননদের সামনে লজ্জাহীনার মতো বেলা দুপুর পর্যন্ত বিছানায় থাকা অসহ্য বোধ হয় তার। এবং এতক্ষণ বিছানায় থাকার পরও কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা দেখে কপাল চাপড়ায়। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকে বুকে গেছে কোনকালে তবুও সেই শ্বশুরের বংশরক্ষা হচ্ছেনা দেখে আড়ালে ছেলের বউয়ের বাপান্ত করে!
বিনু সব শোনে। মাথায় নেয়না কিছু। ওর মনে সংসারের কোনকিছু তেমন দাগ কাটেনা। না মরা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে তাই রোজগার করা, কাজে যাওয়া, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি। এমনকি অটো স্ট্যান্ডের শিবু আজকাল ভাড়া নিতে চায়না, নরম সুরে কথা বলে, বিনু সেসবেও কোনো আগ্রহ দেখায় না।
রান্না শেষ করে খাবার দাবার গুছিয়ে রান্নাঘরে তুলে রাখে বিনু। দাদা উঠে স্নান সেরে এসেছে। বৌদি খাবার বেড়ে দেবে। দাদা যাবে সবার আগে। তারপর বিনুর মা। বিনু সাধারণত বেলার দিকে। অটোয় গেলে দশমিনিটে পৌঁছে যাবে। আজ হেঁটেই যাবে বলে সেও তৈরী হয়ে দাদার সাথেই বসে পড়ে।
#
স্কুলে আজ ডিম দেওয়া হয়েছে। বাচ্চারা আনন্দ করে খেয়েছে, একটা ডিম দু টুকরো আলু আর অনেকটা ঝোল। চেটেপুটে খেয়ে দেয়ে কেউ কেউ যখন বিনু মাসিকে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে আসে, বিনু বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনে। খুব ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের আদর করতে...কী মনে করে হাত বাড়ায়না বিনু, মায়ের কথা কানে বাজে, ওর পোড়া কপাল চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ভেংচি কাটে যেন। বিনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেঁচে থাকা ঝোল তরকারি ঢেকে রাখে। আজ অল্পই ভাত আছে, বিনু উঠে অফিসঘরের দিকে যায়, মিল এর হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে বাকী কাজ সেরে রোদ থাকতেই বেরিয়ে পড়বে। শীত চলে যাবার আগে আবার কামড় দিয়েছে বেশ, সামনেই পাতাঝরার মরশুম।
সুচিন্তিত মতামত দিন