চিত্রাভানু সেনগুপ্ত

শব্দের মিছিল

আলো-আঁধারি জেল্লা মাখা গোধূলিতে গৃহস্থের উঠানের তুলসী মঞ্চে দীপ জ্বলে উঠলো। তিনবার শাঁখে ফুঁ দিয়ে কুমুদিনী সব ঘরে ধূপ দেখিয়ে গেলেন। রামকানাই ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দেখলেন, সরোজের ঘরে আজ আলো জ্বলেনি।​ দরজায় দাঁড়িয়ে ডেকে বললেন....."সরো-মা, আলো জ্বালিসনি?"

কিছু সময় নীরব থেকে ধরা গলায় উত্তর এলো...."মাথাটা ধরেছে বাবা।"

রামকানাই ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসলেন। সরোজের গলার স্বর তার কানে বাঁধেনি এমন নয়, তবু বিষয়টা তার বোধগম্য হয়নি এমন ভাব করে বললেন......"মাথাটা টিপে দিলে ভালো লাগবে? এদিকে আয়তো!​ দেখি আবার জ্বর বাধালি নাকি।"​

সরোজ তাড়াতাড়ি বাপের কোল আগলে নীরবে মুখ লুকিয়ে নিলো। রামকানাই তৎক্ষণাৎ স্নেহরসাক্ত ভাবে হাতের আঙুলগুলি সরোজের চুলের ভিতর ক্রমাগত চালনা করতে থাকলেন। কিছুক্ষন এভাবে চলার পর রামকানাই মুখ খুললেন.......

__" একদিন তোমায় বলবো মা, জীবন এমনই রহস্যময়। সময়ের চাকা যত গড়িয়ে চলে, তত নতুন নতুন দিক সামনে আসে। এমন ভাবে আসে, যা তুমি​ আগে কখনো ভাবোনি। কত বড় বড় ঝড়-ঝাপ্টা, জীবনের কতো ওঠা-পড়া, সবকিছুর সাথে মোকাবিলা করতে হয়। লড়াই চালাতে হয়, সাহস নিয়ে এগিয়ে চলতে হয়। থামা চলে না রে মা, লড়াই করে এগোতে পারলে আরো দশটা দিক বেরিয়ে আসে। এমনটাই ভবিতব্য , হতেই হবে । তুই মনে করিস এই রামকানাই একদিনেই এই গাঁয়ের কানাই ডাক্তার হয়ে উঠলো? এই জীবনে ঝড়টাই বেশি , সুখের ভাগ বড় অল্প। তাই তো মানুষ সুখ সুখ করে হাঁপিয়ে মরে। "

সরোজ কাঁপা গলায় বলে উঠলো...."একটা কথা আমার রাখবে বাবা?"

__"নিশ্চই, বলনা মা ! "

__"আমায় এখান থেকে কোথাও নিয়ে যাবে বাবা? কোথাও একটা! এখান থেকে অনেক অনেক দূরে।"

__"বেশ তো! তুই বল কোথায় যাবি? সেই ভালো রে মা, কবে থেকে তো ওই কথাই বলছি। কদিন ঘুরে এলে তোর ও ভালো লাগে আর এই বুড়োটারও। চল মা! তোতে আমাতে, কোথাও ঘুরে আসি।"

__"তুমি যে বাঁকুড়া যাওয়ার কথা বলছিলে?"

__"যাবি? তুই তো যেতে চাইছিলি না।"

কথা চলা কালীন পবিত্র কোথা থেকে ঘরে এসে উদয় হল, বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলে উঠলো...."কিসের শোক পালন হচ্ছে জানতে পারি? বাবা আর মেয়েতে আলো নিভিয়ে কি এতো গভীর আলোচনা চলছে, আমায় বলা যাবে?"

বিরক্তির সুরে রামকানাই বললেন......"বিলক্ষণ বলা যাবে, তবে তার আগে আমায় কটা প্রশ্নের উত্তর দাও দেখি পবিত্র! তোমার এইরকম সব কিছুতেই অহেতুক কৌতুহল প্রকাশের কারণ কি? পৃথিবীতে যেখানে যা ঘটুক, তার সাথে তোমার কাজের কোন উদ্দেশ্য থাকুক বা না থাকুক, সে'কথা জানার অধিকার থাকুক বা না থাকুক, তোমায় কেন সবকথায় নিজের মাথা ঘামাতে হবে?"

__"আহা, আমার মাথা ঘামানোর মত বিষয় কিনা সেটাই তো জানা আমার উদ্দেশ্য। তোমার মেয়ে ক'দিন হল কত খেল্ দেখিয়ে চলেছে, এসব পাঁচকান হচ্ছে, লোক হাসেছ, তাতে আমাদের সম্মান তো আর থাকেনা।"

__"তোমার সম্মান? নিজের পাঠ অর্ধেকও শেষ করনি তুমি, পাড়ায় যত সমাজ বিরোধীদের সাথে তোমার ওঠা-বসা। বাপের দেওয়া ছাদে থেকে, বাপের জমিতে চাষ করে, বাপের হোটেলে খাও আর আয় যা কর জমিয়ে রাখো। তোমার কি ধারনা, এসব নিয়ে লোকে আলোচনা করেনা? তাতে কি আমাদের সম্মান খুব বাড়ে বলে মনে হয়?​ কাল যদি জমি না থাকে, কি করবে ? নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভেবে দেখেছো?"

'জমি না থাকে ' কথাটা পবিত্রর কানে বেশ ভালোই বাঁধলো। অন্ধকারে মুখের ভাব বোঝা না গেলেও কথাটা শুনে পবিত্র মনে মনে​ তখনকার মতো বেশ ভয় পেলো। বিষয়টাকে হালকা করতে একটু কাষ্ঠ হাসির আশ্রয় নিয়ে বলল......" বেশ তো, তুমি যদি বল বাবা, নিজের ছোট বোনের ভালো মন্দ নিয়ে মাথা আর ঘামাবো না । মায়ের পেটের বোন!! ওর কথা না ভেবে কি পারি?"

রামকানাই বললেন...."এখন থেকে আর অহেতুক ভেবো না পবিত্র। আমার মেয়ের জন্য আমি যতটা পারি ভেবে যাবো, আর কাউকে লাগবে না। আর আমি তো তোমার বাপ! আমি কিছু হলেও বুঝি তুমি কতটা ভাবতে পারো। তাই বলছি, সরোজিনীর বিষয়ে তোমার সবসময় কথা বলা আমি পছন্দ করছি না। সাবধানে থেকো।"

পবিত্র তখনকার মত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলে ঠিকই তবে, সরোজ সকলের আড়ালে বাপকে তার বিরুদ্ধে খেপিয়ে ভিটে মাটি এমন কি জমি ছাড়া করবে, এ নিয়েও সন্দেহ বেশ সুদৃঢ় হয়ে উঠলো। রাতের বেলা অবসর খুঁজে সরোজকে হাত ধরে টেনে ছাদে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো...."ব্যপারখানা কি? আমার সাথে কোন চাল চেলে লাভ হবে না সরোজ, কুড়ি হাজার টাকা গুনে নিয়েছিস । এখন সুযোগ পেয়েই আমায় ভিটে ছাড়া করার জন্য বাবার কানে মন্তর ঢালতে শুরু করলি, ভাবছিস আমি বুঝি না?"

মুচকি হেসে সরোজ বলল...."তোতে আমাতে তফাৎ কি জানিস? আমি নিজের কথার মূল্য দিই। আমি তোকে বলেছি টাকা শোধ করবো, তো করে দেবো। সে সব তো হাওয়ায় হয়না, তুই কাগজ বানিয়ে আন।"

__"বাবা আমাকে হঠাৎ জমি না-থাকার কথা বলছিলো, এর আগে কখনো বলেনি কিনা।"

__"সে বাবার বিবেচনা। আমি তার কানে এসব কথা দিইনি। কদিনের মধ্যে আমরা বাঁকুড়ায় পিসিমনির বাড়িতে​ যাবো, পিসিমনির আশ্রমের কাজটা শুরু হয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে । কবে থেকে বলছিলো আমাদের একবার দেখে আসতে। জায়গাটা নাকি ভারি সুন্দর জানিস দাদা? সনুকপাহাড়ি, জামবনী গ্রাম। শুনলেই মন কেমন ভালো হয়ে যায় ! তাই না বল? যাবি দাদা আমার সঙ্গে?"

সরোজের সরলতা দেখে বড় ভাইয়ের অন্তর যে কাঁপলো না, একেবারে তাও বলা চলে না। বোনের মাথায় হাত রেখে বলল...."আচ্ছা, তোরা ঘুরে আয়। তবে আমার কথাটা মনে রাখিস কেমন?

সরোজ পবিত্রর হাতটা মুঠো করে ধরে বলল..."মনে রাখবো।"

কর্মব্যস্ত মহানগরী কলকাতা। এই শহরের দৈনন্দিন জীবনধারা, গোড়াপত্তনের ইতিহাস, আবহাওয়া,উচ্চ শিক্ষার সুযোগ-সুবিধে, সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো,স্থাপত্য, ঐশ্বর্য সবেতে আপাদমস্তক ব্যস্ততাই চরিত্রের সর্বমূলে​ । এই শহরের প্রতিটি সড়কে, গলিতে,মোড়ে রোজ কত নতুন গল্প গড়ে আর ভাঙে , জীবনের দৈনন্দিন ওঠা পড়া পাল্টে যায় রোজ। গ্রাম্য ঘরোয়া নিরিবিলি জীবনের সাথে কোলাহল মুখর কলকাতার গতিপ্রকৃতির মধ্যে বিস্তর অমিল। এখানে সবই কেমন ছুটে চলেছে, গাড়ি-ঘোড়া, মানুষজন। শিয়ালদহ স্টেশনে বসে দুর্গাপুরগামী পূর্বা এক্সপ্রেস​ ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত দুইটি প্রাণী কেমন হতভম্ব দৃষ্টিতে চারিদিক নিরীক্ষণ করে চলেছে। এই সাত সকালে হাজার হাজার যাত্রী পৃথিবীর কোন্ প্রান্ত থেকে এসে কোন্ গন্তব্যের জন্য ধেয়ে চলেছে জানার উপায় নেই। সকলের যাত্রাপথের গল্প আলাদা, কারো হাতে ছোট বোঝা কারো মাথায় বোঝার পাহাড়। লাল পোশাকে কতগুলো মানুষ সারা প্লাটফর্ম ছেয়ে রয়েছে, সারাদিনের আসা যাওয়া করা​ শয়ে শয়ে ট্রেনের সময়, প্ল্যাটফর্ম নম্বর ইত্যাদি সবই তাদের নখদর্পনে। যাত্রীদের কারো ট্রেন ধরার তাড়া, তো কারো ট্রেন থেকে নামার পালা, মাঝে মাঝে বড় মাল বোঝাই দু চাকার ট্রলি গুলো টেনে মানুষ হৈহৈ করে ছুটে চলেছে, কেউ বিছানা পেতে স্টেশন চত্বরে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাদের পরবর্তী ট্রেন হয়তো আসতে বেলা গড়িয়ে যাবে। এরই মধ্যে গজিয়ে ওঠা জমকালো দোকানগুলোয় নিত্য প্রয়োজনীয় মোটামুটি সব রকমের পণ্যই মজুত করা। মানুষের ভিড় আর ব্যস্ততা সামলিয়ে দোকানিদের দম ফেলার অবকাশ নেই। চোখের নিমেষে মুখে মুখে হিসাব কষে পণ্য আর টাকা আদান প্রদানে রীতিমতো অঙ্কের হরি মাস্টারকে হার মানায়। এমন ব্যস্ততা​ কখনো গাঁয়ের বড় বড়​ মেলাগুলোতেও চোখে পড়েনি সরোজিনীর। রামকানাই অবশ্য অনেকটাই দেখেছে, হাতঘড়িটার সাথে স্টেশনের মাথায় ঝুলন্ত ঘড়িটা মিলিয়ে নিয়ে বলল....."আর বেশি দেরি নেই। এখুনি ট্রেন দিয়ে দেবে।"

__"বাবা, আজ এখানে কি কোন মেলা বসেছে?"

রামকানাই হেসে বলল...…"ধুর পাগল, মেলা কোথায় রে? এ হল কলকাতা শহর বুঝলি? এখানে সব সময় এমন ভিড়, একি আর তোর ছোট্ট গ্রাম?"

বিস্মিত হয়ে সরোজ আবার প্রশ্ন করলো __" এটা কলকাতার কোনদিক বাবা? দাদা কোথায় কাজে আসে?"

স্টেশন চত্বরের একটা ছোট্ট বেঞ্চিতে বাপ আর মেয়েতে একান্তে বসে চলতে থাকে কত রকম প্রশ্নোত্তর পর্ব। কলকাতার বিশালতা আর উৎপত্তির কারণ সম্বন্ধে রামকানাই কন্যার সাথে সবিস্তারে তথ্য আলোচনা করে চলেন। সরোজ যতই শোনে ততই অবাক হয়। আজ এই সময়টুকুতেই কত কি যে নতুন দেখলো, আর কত কি যে জানা হল না , ভেবেও উঠতে পারছে না সে।​ স্টেশনের ঘন জমাটি কোলাহল ভেদ করে এক গগনভেদী তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভয়াল আর্তনাদের মত​ ​ ধ্বনিত হয়ে ক্রমশ প্ল্যাটফর্ম চত্বরে এগিয়ে এলো । রামকানাই হেসে বলেন...."এইতো ট্রেন দিয়ে দিয়েছে রে মা। "​

ভারি অবাক লাগছে সরোজিনীর। এই শুরু হল তার অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা। এর আগে যে পিসিমনির বাড়িতে যাওয়া হয়নি এমন নয়। তখন সে ভারি ছোট। এখন সেসব তার মনেই পড়েনা।​ আজ তাই একদিকে নতুনকে জানার উদগ্রীব অভিলাষ, অপর দিকে অজ্ঞাতকে জড়িয়ে অনর্থক আশঙ্কা, এই দুই-এর দোলাচলে মনের গভীরে চলছে এক অস্বাভাবিক অস্থিরতা। ট্রেন ছুটে চলল অপরিচিত সফরে.....দূউরে দূউরে, ট্রেনের খুপরি জানলা দিয়ে বেপরোয়া বাতাস​ হালকা পালকের মত উড়িয়ে নিয়ে চলেছে সরোজের মনন সত্ত্বাকে, দীর্ঘদিনের থরে থরে জমিয়ে রাখা অলীক খামখেয়ালী ভাবনাগুলো প্রতিক্ষণে মনের মনিকোঠায় এঁকে তুলছে কত নতুন ছবি। ভাবনা ছুটে চলেছে কোন এক নতুন দেশের তরে, নবীন ভোরের তল্লাশে,.....যেথায় সাত সমুদ্র তের নদীর চর, যেথায় অচীন পুরের রাজকন্যে হারিয়ে গেছে গহীন অরণ্যে.....কে জানে সে কোন দেশ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.