চতুর্থ পর্ব।। সেই কোন সকালে পবিত্র ক্ষেতের কাজে হাত দিয়েছে, আজ কাজের চাপ অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি। ওদিকে দেখতে দেখতে বেলা দ্বিপ্রহর ছাড়িয়েছে। বাড়ি ফিরতে আজ তার ঢের বেলা হবে । হেমন্তের আকাশ আজ যেন এক বেখাপ্পা রোদের প্রখরতায় তাতিয়ে তুলছে চতুর্দিক। হাতের ছোট্ট একফালি কাস্তের ফলায় একটু একটু করে ছেটে ফেলছে বাউনির তলার শুকনো ডাল আর হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অবাঞ্ছিত আগাছাগুলো । সে বড় ধৈর্য্যর কাজ। একটাও শুকনো পাতা রয়ে গেলে পরের ফলনের পচন অনিবার্য। এই বিশ্ব চরাচরের রীতি তার সকল সৃষ্টির জন্য অভিন্ন , একফোঁটা ফাঁকি দেওয়ার অবকাশ সেথায় নেই। পুরানো যা কিছু সব ফেলে দিয়ে তবেই তো নবীন বরণ । সহাবস্থান সেথায় নিষিদ্ধ। মাচার ফাঁক দিয়ে ক্ষেতের অপর প্রান্তে সরোজুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়ালো পবিত্র। গায়ে লেগে থাকা আলগা মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে গম্ভীর সুরে বলল
__" তুই এখানে কেন? "
__" থাম্পস আপ খাবি?"
সরোজুর কথায় পবিত্রকে বেশ বিস্মিত দেখালো। যে সরোজ অন্তত এক সহস্রবার অনুরোধেও ক্ষেতের ধার-পাশ ঘেঁষেনি কক্ষণো , সে আজ নিজে থেকে ক্ষেত দেখতে এসে থাম্পস আপ খাওয়াতে চাইছে ,এর পেছনে অন্য কোন রহস্য লুকিয়ে আছে সে বিষয়ে সে নিশ্চিত,তবে সেই রহস্যটা যে কি, সে খবর তার কাছে দুর্বোধ্য । হতবাক হয়ে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল...
__" থাম্পস আপ? হঠাৎ? কেন?"
__"সেই সকাল থেকে ক্ষেতে বসে আছিস। তাই ভাবলাম..."
পবিত্র ঠোঁট উল্টে বলল......"বাআবা!! জল গড়িয়ে দেয় না, থাম্পস আপ খাওয়াবে। ওওওই!! ......কি হয়েছে? কেন এসেছিস পরিষ্কার করে বলবি?"
__" আমায় কিছু টাকা ধার দিবি দাদা। আমি শোধ দিয়ে দেবো।"
এবারে না হেসে পারলো না পবিত্র। বলল.....
__"তোর ধার দেওয়ার ট্যাকা নেই, ওদিকে শোধ দেওয়ার আছে ট্যাকা আছে? তাহলে ধার চাইছিস কেন?"
__" বলছিতো শোধ দেবো। বিশ্বাস কর। এখন টাকাটা খুব তাড়াতাড়ি দরকার, তা নাহলে তোকে বলতাম না।"
__" তাআ কত চাই?"
__"হাজার বিশেক।"
__"কতোও??!!"
আঁতকে উঠলো পবিত্র। সরোজু এক কথার মানুষ, কথার নড়চড় হয়না। কথা যদি সে দিয়ে থাকে তাহলে ফেরত যে করেই হোক দেবে কিন্তু এতোগুলো টাকা তার হঠাৎ কেন প্রয়োজন হল এবং কোথা থেকেই বা সে শোধ করবে সেকথা পবিত্রর মাথায় ঢুকলো না। সরোজের হাত টেনে ধরে বলল....
__"এএই! কি হয়েছে তোর? কোথায় লাগবে এতো ট্যাকা বলতো? আবার বলতিছিস শোধ দিবি?"
__"থাক, লাগবে না। তুই বড় সন্দেহ করিস। আমি বরং এটা নিয়ে মহাজনের কাছে যাই।"
কাপড়ের কোঁচর থেকে চকচকে দুটো সোনার বালা বের করে আনলো সরোজ।
__"এটা তো দিদিমার দেওয়া সেই বালা, তোর বিয়ের জন্য রাখা ছিলো। মা জানে তুই এনেছিস?"
__"হুমম, তবে তোকে দেবো জানে না। আমি ভাবলাম ঘরের জিনিস ঘরেই তো থাকা ভালো! তাছাড়া তোরও তো খুব রাগ ছিলো, দিদিমা নিজের বালা জোড়া তোর বৌ-এর জন্য না দিয়ে আমায় কেন দিলো।"
__"আচ্ছা বেশ, ধর টাকাটা তোকে দিলাম। তারপর তুই আবার ফস্ করে মা কে বলে দিবি না?"
__"সত্যি, কাউকে বলবো না দাদা, দে না দাদা। বড় উপকার হয়। আমি জানি টাকাটা তোর আছে। একটা মানুষের প্রাণ ......"
কথা শেষ হবার আগেই পবিত্র বলে উঠলো....….
__" এএ তো মাত্র দুটো বালা। বিশ হাজার ট্যাকা কি মুখের কথা? আরো কিছু হলে নয় ভেবে দেখতাম। "
__"আরো কিছু? আর তো তেমন কিছুই আমার ...."
__"আছে রে আছে, ভেবে দেখ! "
__"কই? কি আছে বল ?"
__"বললেই তো তুই আমায় অচ্ছেদ্দা করবি, আমি কিন্তু সব সময় তোর ভালোটাই চিন্তা করি, তুইই কেবল ভুল বুঝিস আমায়, ভেবেছি আজ বাদে কাল ভালো ঘর দেখে....."
সরোজ অধৈর্য স্বরে বলল...."যা বলবি সোজা বলনা , এতো ভনিতা বুঝিনা। "
__"বাড়ির ভাগ? আছে কিনা বল? ওইতো একফালি জমি, ওর থেকে তুই যদি ভাগ নিস আমার কি থাকে? তুই মেয়েমানুষ, কোন ভালো ঘর দেখে বে' দিয়ে দিলে খাওয়া পড়ার চিন্তা থাকবে না। জানি তুই আমায় তোর শত্তুরই ভাবিস চিরকাল, আমি কিন্তু তোর ভালোই চাই, হাজার হোক মায়ের পেটের বোন, ওই গোবিন্দর সঙ্গে যদি বে' হত, ও তোকে দেখতে পারতো বল? নিজে কি খেতো আর তোকে কি খাওয়াতো? "
সরোজ কথা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর সুরে বলল....
__"থাক ওসব কথা,
পবিত্রর বেচাল আচরণ আর কথার তীর ছোট্ট বেলা থেকেই সরোজের বিশ্বাসযোগ্য কখনোই মনে হয়নি , কিন্তু তা বলে এমন? এমন ভাবে সুযোগ বুঝে একজনকে সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার সুপ্ত লালসা, এটা একদিনের পরিকল্পনা কোন মতেই যে নয়, তা সে বোঝে, তবু আপন সহোদরের এমন নিষ্ঠুর বাসনার কথা জানাটা তার কাছে স্বপ্নেরও অতীত! একই মাতৃ গর্ভজাত তারা দুইজন , একজন জন্মিয়েই এমন ভাবে পচন ধরে গেলো কেমন করে? কোথাও কি সত্যিই কমতি ছিলো ? গলার কাছে একটা দুর্বিষহ যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে উঠলো । সে জানে পবিত্রর এই সম্পদ ক্ষুধার শেকড় বেশ গভীরে বিস্তৃত। ভোগের বাসনা বড় ভয়ঙ্কর হয় , লিপ্সা ক্রমে বেড়েই চলে, সূচাগ্র হলেও সম্পদ হাসিলের প্রয়াসে সে যে কোন উপায় অবলম্বন করতে পিছপা হবেন না । কিন্তু আজ এতো ভাবার সময় তো তাঁর হাতে নেই! গম্ভীর সুরে সরোজু বলে উঠলো....
__" বেশ, আমি রাজি। তুই কাগজ তৈরি কর। তবে শর্ত একটা আছে। টাকাটা আমার এক্ষুনি চাই।"
●
বেলা গড়িয়ে গেলেও, টাকা জোগাড় হয়েছে। দুগ্গা দুগ্গা বলে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে কালিদেরকে রওনা করিয়ে খানিক নিশ্চিন্ত বোধ হচ্ছে। ধীরেন কাকা পেশায় একজন কুমোর, পড়াশুনার তেমন একটা না জানলেও হাতের কাজটিতে বেশ চৌকস । তবে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হলে অথবা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হলে কাকা সবটা ঠিকমত গুছিয়ে কতটা করতে পারবেন তা নিয়ে একটা চিন্তার থেকেই যায় , তবে ভরসা এই যে গোবিন্দ সাথে গিয়েছে, আজও এই একটা বিরাট ভরসার জায়গা রয়েছে সরোজের মনে । তবু চিকিৎসা শুরু না হওয়া পর্যন্ত দুশ্চিন্তা একটা রয়েই যায়। মনে কতগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চলেছে..... কালির দ্রুত আরোগ্যে কামনা করে স্বয়ং পরমেশ্বরের সামনে মাথা নোয়ালে আদৌ কি তাঁর কাছে সে নিবেদন বাক্য স্বীকৃত হবে ? সত্যিই কি তিনি জনসাধারণের দুর্দশা সম্বন্ধে অবগত? কিছুকাল আগেও জীবনের সমীকরণটা তার কাছে ঠিক যতটা সরল ছিলো, হঠাৎ একে একে সেসব নির্ভরশীলতার ভিত্তিস্তম্ভগুলো কেমন করে নড়বড়ে হয়ে উঠলো । কপালে তার দুশ্চিন্তার ভাঁজগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, রেণুর চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সরোজু। এই বুধখালি গাঁয়ে সরোজদের আর্থিক অবস্থার সাথে অন্যান্যদের বৈষম্য থাকলেও, এককথায় বিশ হাজার টাকা বের করে দেওয়ার মত স্বচ্ছলতা তাদের নেই। রেণু শুধোয়,
__"এতোগুলো টাকা তুই কোথায় পেলি সই?"
__" আমার ছিলো।"
__" ছিলো? কোথায় ছিলো? কে দিয়েছিলো। আমায় জানাস নি তো?"
__"তুই তো আমায় মস্ত জেরা করছিস। আমার যে ছিলো আমিই কি ছাই জানতাম ? এখন তুই এই নিয়ে একটা কথাও বলবি না সই। দিব্যি কর, আর শুধোবি না?"
__"তার মানে তুই আমায় বলবি না এই তো? না বলে থাকবি কতদিন ? একদিন কথাটা তোর থেকে জেনেই ছাড়বো। আমার নামও রেণু বুঝলি?"
সরোজের আচমকা এইরূপ ধনপ্রাপ্তির উৎসস্থল , তার স্বপক্ষে যথেষ্ট উপযুক্ত প্রমাণ ও অকাট্য যুক্তি খুঁজে না পেয়ে রেণু বেশ জোরদার বাকবিতন্ডা শুরু করলো । রেণুর অবিশ্বাস যতই গাঢ় হতে থাকলো, সরোজু ততই রসিকতার ভঙ্গিতে অযৌক্তিক তথ্য পেশ করে জবরদস্তি যুক্তির পাহাড় গড়ে তুললো। পশ্চিমা গগনে শরতের টুকরো টুকরো পেঁজা মেঘ রক্তিমা ভানুর ছটায় রেঙে উঠে গুমোট পরিবেশটাকে অনায়াসে হাস্যব্যাঞ্জক করে তুলল। একে একে বন্য পাখি, গবাদিপশুর দল তাদের বাসার মুখে রওনা হল। দুই গ্রাম্য তরুণীও মেঠো পথ ধরে যে যার ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে ঠাট্টাসুলভ ভঙ্গিতে পরস্পরের গায়ে টোকা মেরে একে অপরকে ....." হাঁদা, কিচ্ছু জানেনা," ইত্যাদি বলে এগিয়ে চলল। হঠাৎ একটি মহিলা কন্ঠস্বর সরোজের কানে এসে বাজলো.....
__"আপনি বুঝি সরোজু দিদি?"
অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতুহলী চোখের এক গ্রাম্যবধূ এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো। বধূটির শ্যামলা শীর্ণকায় শরীরে দীঘল চোখদুটোর মধ্যে বড় মায়া জড়ানো। এগিয়ে এসে বলল.....
__" আমি নয়না, এই গাঁয়ে নতুন বউ।"
সরোজ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল..."তুমি আমায় চেনো? আগে তো কখনো দেখিনি তোমায়?"
__"দেখবেন কি করে দি? আমি যেদিন এলাম সবাই আমায় দেখতে এলো, কেবল আপনি আসেননি।"
অচমকা সরোজের মনের মধ্যে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেল, মুহূর্তের সেই হাসি উদ্বেলিত সময়টা অন্তর্ধান হয়ে একবুক শূন্যতায় বুকটা খা খা করে উঠলো। রেণুর চোখের দিকে ফিরে তাকালো সরোজ। রেণু একটু বিব্রত ভাবে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো সরোজের ধারনা অমূলক নয়, এ গোবিন্দর বউ। সরোজের মনের ভাব হঠাৎ বেশ কঠিন হয়ে উঠলো, দৃঢ় স্বরে বলল...."আমার কাছে কি চাই?"
__"কি যে চাই তাই তো জানি না দি।"
__"তাহলে আমার পথ আটকে থেকো না। আমার কাজ আছে।"
নয়না এসে সরোজের হাত ধরে বলল..."তোমায় কিছু বলতে চাই দিদি শুনবে? একটি বার শুনবে দি?"
নয়নার চোখের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে সরোজ কি যেন বোঝার চেষ্টা করছিলো। তারপর মাথা নেড়ে বলল...."আচ্ছা বল।"
নয়না তার নিজের জীবনের কথা অকপটে বলে চলল। বলল সে এক অনাথ মেয়ে, কাকা কাকির গলার কাঁটা হয়ে ঝুলে ছিলো। সেই কাকদ্বীপে তাদের ঘর। গোবিন্দর বোনের হঠাৎ সম্বন্ধ স্থির হয় তার খুড়তুতো দাদার সাথে। বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়ে যায় দু-দিনের মধ্যেই। গোবিন্দদের বোনের বিয়ের তাড়াও ছিলো। বিয়ের দিন ছল করে তার কাকি হঠাৎ ছেলের বিয়ের দেনাপাওনা নিয়ে বেঁকে বসেন, বলেন এই সামান্য টাকায় ছেলের বিয়ে দিলে তাদের অনেক ক্ষতিই হচ্ছে, তাই একমাত্র যদি এই একই খরচে তাদের গলার কাঁটাটিও নামাতে পারে তবেই বিয়ে হবে। গোবিন্দকে তাদের পছন্দ হয়েছে।
__"তাঁকে আড়াল থেকে দেখে খারাপ লাগেনি দিদি। তাঁরও হাতে উপায় ছিলোনা। বিয়েটা পুতুল খেলার মত করে হয়ে গেল। সবই হল, তবু কি যেন নেই। সে মানুষ খারাপ না, আমার কোন অভাব সে রাখেনি, তবু কেমন যেন চুপচাপ, কেমন যেন সবেতেই ফাঁকি,বেশি কথা কয়না, ঘরে থাকেনা। ওর মুখে তোমার কথা যেটুকু শুনেছি, ভাবলাম তোমাকেই শুধু মনের কথা বলতে পারি।"
রেণু বিরক্ত হয়ে বলল..."তুমি চাওটা কি?"
__"কি চাই কি করে বলি?"
সরোজ নতশিরে খানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নয়নার হাতটা চেপে ধরে বলল...." আজ আসি ভাই।"
সরোজুর কথায় পবিত্রকে বেশ বিস্মিত দেখালো। যে সরোজ অন্তত এক সহস্রবার অনুরোধেও ক্ষেতের ধার-পাশ ঘেঁষেনি কক্ষণো , সে আজ নিজে থেকে ক্ষেত দেখতে এসে থাম্পস আপ খাওয়াতে চাইছে ,এর পেছনে অন্য কোন রহস্য লুকিয়ে আছে সে বিষয়ে সে নিশ্চিত,তবে সেই রহস্যটা যে কি, সে খবর তার কাছে দুর্বোধ্য । হতবাক হয়ে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল...
__" থাম্পস আপ? হঠাৎ? কেন?"
__"সেই সকাল থেকে ক্ষেতে বসে আছিস। তাই ভাবলাম..."
পবিত্র ঠোঁট উল্টে বলল......"বাআবা!! জল গড়িয়ে দেয় না, থাম্পস আপ খাওয়াবে। ওওওই!! ......কি হয়েছে? কেন এসেছিস পরিষ্কার করে বলবি?"
__" আমায় কিছু টাকা ধার দিবি দাদা। আমি শোধ দিয়ে দেবো।"
এবারে না হেসে পারলো না পবিত্র। বলল.....
__"তোর ধার দেওয়ার ট্যাকা নেই, ওদিকে শোধ দেওয়ার আছে ট্যাকা আছে? তাহলে ধার চাইছিস কেন?"
__" বলছিতো শোধ দেবো। বিশ্বাস কর। এখন টাকাটা খুব তাড়াতাড়ি দরকার, তা নাহলে তোকে বলতাম না।"
__" তাআ কত চাই?"
__"হাজার বিশেক।"
__"কতোও??!!"
আঁতকে উঠলো পবিত্র। সরোজু এক কথার মানুষ, কথার নড়চড় হয়না। কথা যদি সে দিয়ে থাকে তাহলে ফেরত যে করেই হোক দেবে কিন্তু এতোগুলো টাকা তার হঠাৎ কেন প্রয়োজন হল এবং কোথা থেকেই বা সে শোধ করবে সেকথা পবিত্রর মাথায় ঢুকলো না। সরোজের হাত টেনে ধরে বলল....
__"এএই! কি হয়েছে তোর? কোথায় লাগবে এতো ট্যাকা বলতো? আবার বলতিছিস শোধ দিবি?"
__"থাক, লাগবে না। তুই বড় সন্দেহ করিস। আমি বরং এটা নিয়ে মহাজনের কাছে যাই।"
কাপড়ের কোঁচর থেকে চকচকে দুটো সোনার বালা বের করে আনলো সরোজ।
__"এটা তো দিদিমার দেওয়া সেই বালা, তোর বিয়ের জন্য রাখা ছিলো। মা জানে তুই এনেছিস?"
__"হুমম, তবে তোকে দেবো জানে না। আমি ভাবলাম ঘরের জিনিস ঘরেই তো থাকা ভালো! তাছাড়া তোরও তো খুব রাগ ছিলো, দিদিমা নিজের বালা জোড়া তোর বৌ-এর জন্য না দিয়ে আমায় কেন দিলো।"
__"আচ্ছা বেশ, ধর টাকাটা তোকে দিলাম। তারপর তুই আবার ফস্ করে মা কে বলে দিবি না?"
__"সত্যি, কাউকে বলবো না দাদা, দে না দাদা। বড় উপকার হয়। আমি জানি টাকাটা তোর আছে। একটা মানুষের প্রাণ ......"
কথা শেষ হবার আগেই পবিত্র বলে উঠলো....….
__" এএ তো মাত্র দুটো বালা। বিশ হাজার ট্যাকা কি মুখের কথা? আরো কিছু হলে নয় ভেবে দেখতাম। "
__"আরো কিছু? আর তো তেমন কিছুই আমার ...."
__"আছে রে আছে, ভেবে দেখ! "
__"কই? কি আছে বল ?"
__"বললেই তো তুই আমায় অচ্ছেদ্দা করবি, আমি কিন্তু সব সময় তোর ভালোটাই চিন্তা করি, তুইই কেবল ভুল বুঝিস আমায়, ভেবেছি আজ বাদে কাল ভালো ঘর দেখে....."
সরোজ অধৈর্য স্বরে বলল...."যা বলবি সোজা বলনা , এতো ভনিতা বুঝিনা। "
__"বাড়ির ভাগ? আছে কিনা বল? ওইতো একফালি জমি, ওর থেকে তুই যদি ভাগ নিস আমার কি থাকে? তুই মেয়েমানুষ, কোন ভালো ঘর দেখে বে' দিয়ে দিলে খাওয়া পড়ার চিন্তা থাকবে না। জানি তুই আমায় তোর শত্তুরই ভাবিস চিরকাল, আমি কিন্তু তোর ভালোই চাই, হাজার হোক মায়ের পেটের বোন, ওই গোবিন্দর সঙ্গে যদি বে' হত, ও তোকে দেখতে পারতো বল? নিজে কি খেতো আর তোকে কি খাওয়াতো? "
সরোজ কথা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর সুরে বলল....
__"থাক ওসব কথা,
পবিত্রর বেচাল আচরণ আর কথার তীর ছোট্ট বেলা থেকেই সরোজের বিশ্বাসযোগ্য কখনোই মনে হয়নি , কিন্তু তা বলে এমন? এমন ভাবে সুযোগ বুঝে একজনকে সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার সুপ্ত লালসা, এটা একদিনের পরিকল্পনা কোন মতেই যে নয়, তা সে বোঝে, তবু আপন সহোদরের এমন নিষ্ঠুর বাসনার কথা জানাটা তার কাছে স্বপ্নেরও অতীত! একই মাতৃ গর্ভজাত তারা দুইজন , একজন জন্মিয়েই এমন ভাবে পচন ধরে গেলো কেমন করে? কোথাও কি সত্যিই কমতি ছিলো ? গলার কাছে একটা দুর্বিষহ যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে উঠলো । সে জানে পবিত্রর এই সম্পদ ক্ষুধার শেকড় বেশ গভীরে বিস্তৃত। ভোগের বাসনা বড় ভয়ঙ্কর হয় , লিপ্সা ক্রমে বেড়েই চলে, সূচাগ্র হলেও সম্পদ হাসিলের প্রয়াসে সে যে কোন উপায় অবলম্বন করতে পিছপা হবেন না । কিন্তু আজ এতো ভাবার সময় তো তাঁর হাতে নেই! গম্ভীর সুরে সরোজু বলে উঠলো....
__" বেশ, আমি রাজি। তুই কাগজ তৈরি কর। তবে শর্ত একটা আছে। টাকাটা আমার এক্ষুনি চাই।"
●
বেলা গড়িয়ে গেলেও, টাকা জোগাড় হয়েছে। দুগ্গা দুগ্গা বলে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে কালিদেরকে রওনা করিয়ে খানিক নিশ্চিন্ত বোধ হচ্ছে। ধীরেন কাকা পেশায় একজন কুমোর, পড়াশুনার তেমন একটা না জানলেও হাতের কাজটিতে বেশ চৌকস । তবে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হলে অথবা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হলে কাকা সবটা ঠিকমত গুছিয়ে কতটা করতে পারবেন তা নিয়ে একটা চিন্তার থেকেই যায় , তবে ভরসা এই যে গোবিন্দ সাথে গিয়েছে, আজও এই একটা বিরাট ভরসার জায়গা রয়েছে সরোজের মনে । তবু চিকিৎসা শুরু না হওয়া পর্যন্ত দুশ্চিন্তা একটা রয়েই যায়। মনে কতগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চলেছে..... কালির দ্রুত আরোগ্যে কামনা করে স্বয়ং পরমেশ্বরের সামনে মাথা নোয়ালে আদৌ কি তাঁর কাছে সে নিবেদন বাক্য স্বীকৃত হবে ? সত্যিই কি তিনি জনসাধারণের দুর্দশা সম্বন্ধে অবগত? কিছুকাল আগেও জীবনের সমীকরণটা তার কাছে ঠিক যতটা সরল ছিলো, হঠাৎ একে একে সেসব নির্ভরশীলতার ভিত্তিস্তম্ভগুলো কেমন করে নড়বড়ে হয়ে উঠলো । কপালে তার দুশ্চিন্তার ভাঁজগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, রেণুর চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সরোজু। এই বুধখালি গাঁয়ে সরোজদের আর্থিক অবস্থার সাথে অন্যান্যদের বৈষম্য থাকলেও, এককথায় বিশ হাজার টাকা বের করে দেওয়ার মত স্বচ্ছলতা তাদের নেই। রেণু শুধোয়,
__"এতোগুলো টাকা তুই কোথায় পেলি সই?"
__" আমার ছিলো।"
__" ছিলো? কোথায় ছিলো? কে দিয়েছিলো। আমায় জানাস নি তো?"
__"তুই তো আমায় মস্ত জেরা করছিস। আমার যে ছিলো আমিই কি ছাই জানতাম ? এখন তুই এই নিয়ে একটা কথাও বলবি না সই। দিব্যি কর, আর শুধোবি না?"
__"তার মানে তুই আমায় বলবি না এই তো? না বলে থাকবি কতদিন ? একদিন কথাটা তোর থেকে জেনেই ছাড়বো। আমার নামও রেণু বুঝলি?"
সরোজের আচমকা এইরূপ ধনপ্রাপ্তির উৎসস্থল , তার স্বপক্ষে যথেষ্ট উপযুক্ত প্রমাণ ও অকাট্য যুক্তি খুঁজে না পেয়ে রেণু বেশ জোরদার বাকবিতন্ডা শুরু করলো । রেণুর অবিশ্বাস যতই গাঢ় হতে থাকলো, সরোজু ততই রসিকতার ভঙ্গিতে অযৌক্তিক তথ্য পেশ করে জবরদস্তি যুক্তির পাহাড় গড়ে তুললো। পশ্চিমা গগনে শরতের টুকরো টুকরো পেঁজা মেঘ রক্তিমা ভানুর ছটায় রেঙে উঠে গুমোট পরিবেশটাকে অনায়াসে হাস্যব্যাঞ্জক করে তুলল। একে একে বন্য পাখি, গবাদিপশুর দল তাদের বাসার মুখে রওনা হল। দুই গ্রাম্য তরুণীও মেঠো পথ ধরে যে যার ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে ঠাট্টাসুলভ ভঙ্গিতে পরস্পরের গায়ে টোকা মেরে একে অপরকে ....." হাঁদা, কিচ্ছু জানেনা," ইত্যাদি বলে এগিয়ে চলল। হঠাৎ একটি মহিলা কন্ঠস্বর সরোজের কানে এসে বাজলো.....
__"আপনি বুঝি সরোজু দিদি?"
অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতুহলী চোখের এক গ্রাম্যবধূ এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো। বধূটির শ্যামলা শীর্ণকায় শরীরে দীঘল চোখদুটোর মধ্যে বড় মায়া জড়ানো। এগিয়ে এসে বলল.....
__" আমি নয়না, এই গাঁয়ে নতুন বউ।"
সরোজ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল..."তুমি আমায় চেনো? আগে তো কখনো দেখিনি তোমায়?"
__"দেখবেন কি করে দি? আমি যেদিন এলাম সবাই আমায় দেখতে এলো, কেবল আপনি আসেননি।"
অচমকা সরোজের মনের মধ্যে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেল, মুহূর্তের সেই হাসি উদ্বেলিত সময়টা অন্তর্ধান হয়ে একবুক শূন্যতায় বুকটা খা খা করে উঠলো। রেণুর চোখের দিকে ফিরে তাকালো সরোজ। রেণু একটু বিব্রত ভাবে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো সরোজের ধারনা অমূলক নয়, এ গোবিন্দর বউ। সরোজের মনের ভাব হঠাৎ বেশ কঠিন হয়ে উঠলো, দৃঢ় স্বরে বলল...."আমার কাছে কি চাই?"
__"কি যে চাই তাই তো জানি না দি।"
__"তাহলে আমার পথ আটকে থেকো না। আমার কাজ আছে।"
নয়না এসে সরোজের হাত ধরে বলল..."তোমায় কিছু বলতে চাই দিদি শুনবে? একটি বার শুনবে দি?"
নয়নার চোখের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে সরোজ কি যেন বোঝার চেষ্টা করছিলো। তারপর মাথা নেড়ে বলল...."আচ্ছা বল।"
নয়না তার নিজের জীবনের কথা অকপটে বলে চলল। বলল সে এক অনাথ মেয়ে, কাকা কাকির গলার কাঁটা হয়ে ঝুলে ছিলো। সেই কাকদ্বীপে তাদের ঘর। গোবিন্দর বোনের হঠাৎ সম্বন্ধ স্থির হয় তার খুড়তুতো দাদার সাথে। বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়ে যায় দু-দিনের মধ্যেই। গোবিন্দদের বোনের বিয়ের তাড়াও ছিলো। বিয়ের দিন ছল করে তার কাকি হঠাৎ ছেলের বিয়ের দেনাপাওনা নিয়ে বেঁকে বসেন, বলেন এই সামান্য টাকায় ছেলের বিয়ে দিলে তাদের অনেক ক্ষতিই হচ্ছে, তাই একমাত্র যদি এই একই খরচে তাদের গলার কাঁটাটিও নামাতে পারে তবেই বিয়ে হবে। গোবিন্দকে তাদের পছন্দ হয়েছে।
__"তাঁকে আড়াল থেকে দেখে খারাপ লাগেনি দিদি। তাঁরও হাতে উপায় ছিলোনা। বিয়েটা পুতুল খেলার মত করে হয়ে গেল। সবই হল, তবু কি যেন নেই। সে মানুষ খারাপ না, আমার কোন অভাব সে রাখেনি, তবু কেমন যেন চুপচাপ, কেমন যেন সবেতেই ফাঁকি,বেশি কথা কয়না, ঘরে থাকেনা। ওর মুখে তোমার কথা যেটুকু শুনেছি, ভাবলাম তোমাকেই শুধু মনের কথা বলতে পারি।"
রেণু বিরক্ত হয়ে বলল..."তুমি চাওটা কি?"
__"কি চাই কি করে বলি?"
সরোজ নতশিরে খানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নয়নার হাতটা চেপে ধরে বলল...." আজ আসি ভাই।"