নীলাঞ্জনা

নীলাঞ্জনা

একটা সময় ছিল- যখন বেশ ভালোই কদর ছিল আমার। সে বহুযুগ আগের কথা। তখন ছিল বৃটিশ শাসনকাল।এ শহরের প্রকৃতি, রাস্তাঘাট- সবই তখন ছিল এক্কেবারে অন্যরকম। মানুষজনও ছিল আলাদা।

ওহো, আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি! আমি এই চৌধুরীবাড়ির বৈঠকখানা ঘর। জন্মলগ্ন থেকেই এই চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে আমার পথচলা শুরু। সেই আমলে এখানে প্রায়শই সান্ধ্য আড্ডা বসত। তোষামুদি, তর্কাতর্কি, অট্টহাসি, কলের গানের আওয়াজ, তামাক, সুরা, আতরের গন্ধ- সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক মজলিসী পরিবেশে ভরে উঠতো আমার চারিপাশ।

প্রাচুর্য্য আর আভিজাত্যের দম্ভে এমনিতেই সেসময়ে মাটিতে পা পড়তো না চৌধুরীদের। তার ওপরে নরনারায়ণ চৌধুরী রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়ার পর থেকে তো আর কোনও কথাই নেই! আমাকে সাজানো হয়েছিল বেশ কিছু দামী এবং শৌখিন আসবাবপত্র দিয়ে। তখন বিলাসিতার একটা অঙ্গই ছিল, রাজকীয় পোষাকে সুসজ্জিত হয়ে, খ্যাতনামা কোনও চিত্রকরকে দিয়ে নিজেদের ছবি আঁকিয়ে দেওয়ালের শোভা বর্ধন করা। তো আমাদের রায়বাহাদুর নরনারায়ণ ই বা বাদ যাবেন কেন? নরনারায়ণ, তাঁর পুত্র, পৌত্র... এমন করে পর পর পাঁচ পুরুষের বিশালাকার তৈলচিত্র আমার একপাশের দেওয়ালে আজও সুসজ্জিত।

তৎকালীন ভৃত্য রঘু, আমার বেশ যত্ন-আত্তি করতো। সর্বদা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতো আমাকে। রঘুর পরে তার ছেলে কালাচাঁদ, কালাচাঁদের পরে তার ভাইপো জগদীশ এই দায়িত্ব পালন করতো। কিন্তু জগদীশের পরে তার ছেলে আর এবাড়ির ভৃত্যের পেশায় যোগদান করেনি। ক্রমে ক্রমে ততদিনে চৌধুরীদের প্রতিপত্তিও অস্তগামী সূর্যের মত বিলীন হতে হতে বেশ অনেকটাই ম্রিয়মান ।

যুগের পর যুগ ধরে এই পরিবারের কত যে ভালোমন্দ ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছি আমি! বড় পরিবার ভেঙ্গে ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত হয়েছে আমার চোখের সামনে। বড় কষ্ট হয়েছিল আমার তখন। আমার মালিকানা কার দখলে যাবে, তা নিয়েও দুই ভাইকে বিশ্রীভাবে ঝগড়া করতে দেখেছি আমি। হ্যাঁ..মানুষের কাছে আমি জড়বস্তু হলেও আমার চোখ আছে, কান আছে, হৃদয় আছে... মানুষ সেগুলো দেখতে পায়না।

কালের নিয়মে সবকিছুই পাল্টাতে থাকে। আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়ে ওঠে আমাদের শহর, পথঘাট, মানুষের জীবনযাত্রা। বহুদিন, বহুবছর হয়ে গেছে আমি অত্যন্ত অবহেলায়, অনাদরে পড়ে আছি। আমার ভেতরের সেই দামি আসবাবপত্র, ঝাড়লন্ঠন, চৌধুরীদের পূর্বপুরুষদের সেইসব তৈলচিত্রগুলোর ওপরে এখন মাকড়সার জালের আস্তরণ।

হঠাৎ একদিন শুনলাম , এ পরিবারের বর্তমান বংশধর রুদ্রনারায়ণ চৌধুরী আমাকে মেরামত করতে চান। জানতে পেরে একটু স্বস্তি পেলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হলো সেই মেরামতির কাজ। আমাকে যতটা সম্ভব- আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টার ত্রুটি রাখলেন না রুদ্রনারায়ণ। দেওয়ালের ফাটল ঢেকে রঙের প্রলেপ লাগানো হলো, পুরনো কাঠের আসবাব নতুন করে পালিশ করানো হলো, ঝাড়লন্ঠন আর তৈলচিত্র গুলিও যতটা সম্ভব পরিষ্কার করার ফলে যেন নতুনভাবে রূপ ফিরে পেল।

রুদ্রনারায়ণের ছেলে সৌম্য এখন সদ্য পড়াশোনা শেষ করে চাকরির অপেক্ষায়। নিজের নামের পরে ‘নারায়ণ ‘ শব্দটি আর ব্যবহার করেনা সৌম্য। তা নিয়ে রুদ্র নারায়ণ রাগারাগি করলেও, সে ছেলে বাবার রাগের তোয়াক্কা করেনা। বংশের ধারাপ্রবাহ অব্যাহত রাখার চাইতে, আধুনিকতা অক্ষুন্ন রাখাটাই বেশি জরুরি ওর কাছে। আমি অবশ্য এব্যাপারে দোষ দিই না সৌম্যকে । আরে বাবা-আজকালকার ছেলে... যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তো চলতে হবে ওকে।

আমাকে আজকাল সৌম্য বেশ পছন্দ করে। মাঝে মাঝেই এক পাল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এসে হাজির হয় এখানে। ওদের একটা গানের দল আছে। ওরা বলে ‘ব্যান্ড’। আমার দরজা- জানালাগুলো বন্ধ করে বেশ অনেক্ষণ ধরে চলে ওদের চর্চা। ওদের গানগুলো কিন্তু ঠিক আগেকার গানের মত নয় । বড্ড বেশি চীৎকার করে গান গায় ওরা। সঙ্গে অনেক বাদ্যযন্ত্রও থাকে। তবে সত্যি কথা বলতে, সব গান কিন্তু আমার খারাপ লাগেনা। বেশ অন্যরকম ! আমি ভালোই উপভোগ করি। রুদ্র নারায়ণের কিন্তু এসব একেবারেই পছন্দ না। মাঝে মাঝেই ঝামেলা লাগে বাবা- ছেলের মধ্যে। সৌম্য নাকি বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করছে । বংশের ঐতিহ্য মাটিতে মেশাচ্ছে!! .... আমি কত বোঝানোর চেষ্টা করি রুদ্রকে। কিন্তু ঐ যে! মানুষের কানে আমার বার্তা যে পৌঁছায় না!

বোঝেনা রুদ্র। নতুন কে তো স্বীকার করতেই হয়! না হলে যে কোনও উপায় নেই। আমি তো মেনে নিই সবকিছু.. বহুযুগ আগে আমার জানালাগুলো দিয়ে যখন সেইসময়কার হাওয়া- বাতাস ঢুকে খেলা করতো, তখন আমি তাদেরকে যেভাবে আপন করে নিতাম, আজও তো ঠিক তেমন করেই এখনকার আমুল পরিবর্তিত বাতাসকেও আলিঙ্গন করি।আমার প্রতিটি কোণে কোণে, প্রতিটি ইঁটের ভেতরে গাঁথা আছে এই চৌধুরী বংশের ঐতিহ্য... এ বাড়িতে ঝগড়া-অশান্তি হলে আমার সহ্য হয়না । মনেপ্রাণে এদের ভালো চাই আমি।

বছর দুয়েক হলো সৌম্য কোনও এক বিদেশী কোম্পানী তে চাকরি পেয়েছে।মাঝে মাঝেই দেশের বাইরে যেতে হয়। বড় ব্যস্ত আজকালকার ছেলেপুলে রা ।

আমার এই গতানুগতিক জীবনে এক নতুন মোড় এলো- যেদিন ঋতুপর্ণা এবাড়িতে প্রবেশ করলো সৌম্যর বৌ হয়ে । আগে এই ঘরে বাড়ির মেয়ে-বৌ রা বড় একটা আসতো না। কিন্তু এখনকার যুগে তো আর মেয়েদের অন্দরমহলে বন্দী থাকার রেওয়াজ নেই। প্রথম যেদিন ঋতুপর্ণা এখানে এলো, ওকে দেখে যেন প্রাণটা জুড়িয়ে গেল আমার! আহা! কি স্নিগ্ধ রূপ! কত গভীর দুটো চোখ! অদ্ভুত এক মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলো ও আমাকে।আমার চারপাশটা যেন অদ্ভুতভাবে আলোকিত হয়ে উঠলো সেদিন। প্রথমদিন দেখেই বুঝেছি, এযুগের মেয়ে হলেও- ঋতুপর্ণা একটু অন্যরকম... সে সাবেকিয়ানা পছন্দ করে।

রোজ এখানে আসে ঋতুপর্ণা। আমাকে বড় ভালো লেগেছে তার। নিজে হাতে আমার যত্ন করে। দুপুরবেলা সূর্যের প্রখর রোদ এসে আমাকে কষ্ট দেওয়ার আগেই , আমার জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়। তার স্নেহমাখা হাতের স্পর্শে আমি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছি। সারা দুপুরটা এই ঘরেই বই পড়ে কাটায় সে। কখনও রবি ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, কখনও বা তার হাতে দেখি মার্ক টোয়েন, কখনও চার্লস ডিকেন্স.... সাহিত্যরস আস্বাদন করতে করতে অভিভূত হয়ে যায় সে । ওইসময় আরও বেশি উজ্জ্বল, আরও প্রাণবন্ত দেখায় তাকে। আর আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকি।

মাঝে মাঝে দেখি, সৌম্যর নামসহ ছবি ভেসে উঠছে ওর পাশে রাখা বড়সড় চৌকাকৃতি যন্ত্রটায়। সেটা কানে নিয়ে দায়সারা কিছু কথাবার্তা বলে আবার পাশে রেখে দেয় ঋতুপর্ণা। বুঝি- এইসময়টায় সে শুধুমাত্র বই আর আমার সঙ্গে থাকতেই পছন্দ করে। কখনও পড়তে পড়তে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ও। আমি তখন আমার ভেতরের আবেগঘন আন্তরিকতাপূর্ণ বাতাস খেলিয়ে দিই ওর ঘন কালো চুলের মধ্যে।

শুধু একটা সময় আমার খুব দুঃখ হয়... যখন সে আমার কাছে এসে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কেন ঋতুপর্ণা? কে দুঃখ দেয় তোমাকে? সৌম্য? নাকি অন্য কোন কষ্ট- যা তুমি কারোর কাছে প্রকাশ করতে পারো না? দাও... তোমার সমস্ত দুঃখ কষ্ট আমাকে দাও ঋতুপর্ণা! আমি তোমার সমস্ত যন্ত্রণা আমার ইট, কাঠ, পাথরের মধ্যে শুষে নেব। তোমার চোখের জল যে একেবারেই সহ্য হয়না আমার!

রবিবারের সন্ধেবেলা।সৌম্য আজ বাড়িতে। কিছুক্ষণ আগে এসে আলো জ্বালিয়ে গেল ঋতুপর্ণা। কিন্তু এ কি? ঋতুপর্ণার মুখটা আজ এমন থমথমে কেন? হলো টা কি?

খানিকক্ষন পরে দুটি কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। তার মধ্যে একটি কন্ঠস্বর সৌম্যর, অপরটি অচেনা । কন্ঠস্বর দুটি আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ ... ঠিক তাই।মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক কে নিয়ে এঘরে এসে বসলো সৌম্য। ভদ্রলোকের পরনে কালো রঙের পাঞ্জাবী, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে কেমন একটা ধূর্ত হাসি... আমার একেবারেই ভালো লাগছে না লোকটাকে ।

- "আপনার বাবাকে তো আমি কতদিন আগে থেকেই বুঝিয়ে আসছি , তা উনি শুনতেই চান না আমার কথা!" ... রুক্ষ গলায় বললো লোকটা।

- "হ্যাঁ জানি। বাবা তো গত তিনমাস ধরে বেড-রিডেন। গতকাল বাবাকে আমি বুঝিয়েছি অনেক্ষণ ধরে... এই বাড়ি মেইনটেইন করে পয়সা নষ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"

- "তা কি বললেন উনি?"... সৌম্যর দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করলো লোকটা।

- "মুখে কিছু না বললেও, এটা বুঝেছি যে বাবা আর কোনও আপত্তি করবেনা।"

- "গুড! আর এই বাড়ির আরও যে দুজন শরিক আছেন... ওই যারা এখন বিদেশে থাকেন...."

- "তাদের সাথেও কথা হয়ে গেছে। ওরা তো অনেকদিন আগে থেকেই রাজি। সমস্যা শুধু একজনকে নিয়ে !".... কেমন একটা চাপা উদ্বেগ নিয়ে বললো সৌম্য।

- "আবার কে?"

- "আমার ওয়াইফ.."

- "বলেন কি? আরে আজকালকার মেয়েরা তো ফ্ল্যাটে থাকতেই পছন্দ করে!"

- "না....আসলে ও একটু অন্যরকম। এই বাড়ির একটা ভিনটেজ লুক আছে, একটা ট্র্যাডিশনাল অ্যাস্পেক্ট আছে- যেটা ও ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।তাই এবাড়ি ভেঙ্গে প্রমোটিং হওয়ার ব্যাপারটা ও কিছুতেই মানতে পারছে না।"

উফ্ ! এসব কি শুনছি আমি? দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার! তোমার কি কোনও মায়াদয়া নেই সৌম্য? চৌধুরীবাড়ির পূর্বপুরুষেরা যেন ওই দেওয়ালের ছবিগুলোর ভেতর থেকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌম্যর দিকে। কি হবে এখন আমার? কি হবে এই চৌধুরী-ভবনের? আমরা তো না হয় ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়ে যাবো। আর আমার ঋতুপর্ণা? কি হবে ঐ মেয়েটার? ফ্ল্যাটের ওই ছোট্ট আধুনিক ঘর কি পারবে? আমার মত করে ওর সব দুঃখ-বেদনা গুলোকে নিজের কাঁধে তুলে নিতে? পারবে আমার মত করে ওকে আদর করতে?

সৌম্যর কথায় খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিশ্রীভাবে হেসে বললো লোকটা....

- "ধ্যুর! ওসব ফালতু ইমোশন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, ভালোভাবে বোঝান মিসেস চৌধুরীকে । দরকার হলে আমিও কথা বলছি ওনার সাথে। আরে বাবা! ব্যাপারটা কতখানি প্রফিটেবল আপনাদের কাছে! সেটা একবার ভেবে দেখেছেন?"

ট্রে তে করে চা আর খাবার নিয়ে এলো ঋতুপর্ণা। চোখে মুখে যেন কালো মেঘের ঘনঘটা।

ওকে আসতে দেখেই প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো সৌম্য....

- "এই ঋতু! তোমাকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম.. দিলীপবাবু কি বলছেন, মন গিয়ে শোনো।"

- "প্রয়োজন নেই আমার শোনার। তুমি শুনে নাও, তাহলেই হবে।"..... কঠিন গলায় কথাগুলো বলে, ট্রে টা রেখে বেরিয়ে গেল সে।

- "চিন্তা করবেন না। সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।".... নীচু স্বরে সৌম্য কে বললো লোকটা।

হায় ঈশ্বর! আমি বুঝতে পারছি, আমার আয়ু আর বেশিদিন নেই.. তোমার কাছে আমার একটাই বিনীত অনুরোধ .. আমার ঋতুপর্ণা কে ভালো রেখো তুমি... খুব ভালো রেখো!

Previous Post Next Post