বিকেলে লেকের ধারে, বুড়োদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। দেশের পরিস্থিতি, করোনার করাল গ্রাস, ভ্যাক্সিন বেরোলো কি বেরোলো না এবং সর্বোপরি ভোটের বাজারে কার কী হাল এই নিয়ে ব্যাপক গপ্পো চলেছে। কারো মাস্ক থুতনিতে, কারো বা এক কানে ঝুলছে, আবার কেউ বা তা কপালে তুলে ফেলেছেন উত্তেজনায়! হঠাত সবার খেয়াল হলো অন্যদিন যিনি সবচেয়ে বেশী বকেন, সেই বরুণবাবুর মুখ হাঁড়ি। একটি বাক্যও বেরোচ্ছে না। শেষে নিতাইবাবু বরুণবাবুকে খোঁচা দিয়ে বললেন “কী দাদা? শীত পড়েছে বুঝি?” বরুণবাবু মাস্কঢাকা মুখে রোষকষায়িত চোখে তাকিয়ে শুধু গলা খাঁকারি দিলেন। আরো কিছুক্ষণ কাটলো, বরুণবাবুর মুখে বাক্যি নেই! এবার সবাই মিলে চেপে ধরলেন বরুণবাবুকে। অবশেষে এক কাপ গরম চা খেয়ে বরুণবাবু বললেন “কাল বাড়িতে যা হলো –“ সবাই সমস্বরে বললেন “কী হলো? কী হলো?” “আরেক কাপ খাওয়াও, তাহলে বলছি –“
অতঃপর আরেক কাপ ধূমায়িত চায়ে চুমুক দিয়ে বরুণবাবু বললেন “তোমরা তো জানো, রিটায়ার করে ইস্তক আমি সকালবেলা ঘন্টা তিন চার খবরের কাগজ পড়ে আর সন্ধ্যায় ঘন্টা তিন চার খবরের চ্যানেল সার্ফ করেই কাটাই! পরদিন আড্ডার আপডেট জোগাড় করতে হবে তো – না কী? গিন্নীর সঙ্গেও এ নিয়ে ফাইট করেছি বিস্তর! খবর ভার্সাস সিরিয়াল! শেষে গিন্নী হেরে গিয়ে আলাদা একখানা টিভি কিনেছেন শোয়ার ঘরে! কিন্তু কাল যা হলো – তাতে তো –“
“আরে বলবেন তো কী হলো –“ অধৈর্য হয়ে একসাথে বলে উঠলো সবাই।
“কাল হঠাত শুনি রান্নাঘর থেকে আমার পুত্রবধূ প্রবল চিৎকার করছে ‘তোমার সোডিয়াম বেড়ে গেছে! নির্ঘাত সোডিয়াম বেড়ে গেছে! তাই এতো মাথা গরম! নুনটা চেঞ্জ করতেই হবে! যাও বলছি রান্নাঘর থেকে!’ দৌড়ে গিয়ে দেখি আমার ছেলে রান্নাঘরের কৌটোবাটা সব মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে! আমাকে দেখে একেবারে রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেলো! বিপদ দেখে গিন্নীর দ্বারস্থ হলুম! তিনি প্রথমেই ফিকফিক করে হাসলেন। দেখে গা পিত্তি জ্বলে গেলো। বললুম ‘হাসছো কেন?’ বললেন ‘ঐ সিরিয়ালের ফাঁকে বিজ্ঞাপণ হয় না? নুনের বিজ্ঞাপণটা খুব হিট করেছে! বৌমা তো সিরিয়ালের থেকে অ্যাডগুলোই গেলে বেশী! তা খোকার আবার কী হলো? দেখি গে- ‘”
“তারপর? তারপর?”
“তারপর খানিক বাদে ঘরে ঢুকে গিন্নী থপ করে আমার পাশে বসে পড়লেন। যদিও মুখখানা গম্ভীর করে রেখেছেন, কিন্তু তলে তলে যে তেনার বেশ আনন্দ হচ্ছে, তা চোখে মুখে ফুটে বেরুচ্ছে! আমার দিকে আড় নয়নে চেয়ে বললেন
‘আরো দেখো খবর! এরকমই হবে।‘
আমি বল্লুম ‘মানে?’
গিন্নী বললেন ‘খোকা কাল অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বাইরের ঘরে সোফায় একটু বসেছিলো। তুমি তখন খবর দেখছিলে!’
বল্লুম ‘সে তো রোজই দেখি!’
তিনি বললেন ‘কিন্তু কাল কী দেখছিলে?’
আমি ভয়ে ভয়ে মাথা চুলকে ঢোঁক গিলে বল্লুম ‘কাল না ইয়ে হয়েছিলো – মানে এখন তো ভোট এসে গেছে – কী আর করা যায়? সব চ্যানেল খবরটবর ছেড়ে ভোটের তরজায় ব্যাস্ত! এক এক চ্যানেল ছজন সাতজন করে নেতা নেত্রী ডেকে নিচ্চে! এখন তো আর কেউ স্টুডিওতে আসে না। সবই ভারচুয়াল! বাড়ি থেকে জয়েন করে! কারো পিছনে ক্যাঁ কোঁ আওয়াজ, কারো পিছনে দুমদাম আওয়াজ, কারো নেটওয়ার্ক দুর্বল, কারো গলা কেটে কেটে যাচ্ছে! কিন্তু কেউ এক ইঞ্চি ছাড়বে না! সে এক বিচিত্র ক্যাকোফোনি! আর রাজনৈতিক নেতা মানেই গলা একেবারে আছোলা বাঁশ! যিনি অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন তাঁকে কেউ কেয়ারই করে না! একসাথে হেঁড়ে গলায় বিকট চিতকার করে নিজের দলের দোষ ঢাকছে, না হয় অন্য দলকে কচুকাটা করছে! মুখে মারিতং জগত! কালকে বিষয় ছিলো চাষীদের পোতিবাদ! তা একজন বলছে পোতিবাদ করাই উচিত, এমন আইন হওয়াই উচিত না আর অন্যজন বলছে আপনি চাষের কী বোঝেন? কোনদিন চাষ করেছেন? আপনি কী করে বুঝলেন এতে চাষীদের লাভ না ক্ষতি? অন্যজন বললে আপনি করেছেন চাষ? আপনি তো বুর্জোয়া! আওয়াজ ক্রমে বাড়ছে! কিছুই বোঝা যাচ্ছে না দেখে আমি ঘুরিয়ে পরের চ্যানেল করলুম। সেখানে একজন খবর পড়ছেন । যাক নিশ্চিন্ত! ও মা! খবর থেকে ক্যামেরা চলে গেলো চাষীদের প্রতিবাদের মঞ্চে! সেখানে টিভি ক্যামেরা আর মাইক দেখে ইয়া লম্বা দাঁড়ি নিয়ে পাগড়ী পরা চাষীরা এগিয়ে এসে সৎ শ্রী আকাল বলে এমন হাঁক পেড়ে নৃত্য শুরু করলে যে তাড়াতাড়ি তার পরের চ্যানেলে ঘোরালুম! কিন্তু কপাল খারাপ! সেখানে খোলা মঞ্চে বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন এক নেতা! গলা ডেসিবেলের সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বলে চলেছেন ‘আমাদের সরকার এলে, করুণার টিকা সব্বাইকে র্যাসান দোকান থেকে ফিরিতে দেবো আমরা! করুণা হলেও দেবো, না হলেও দেবো! তখন কাউকে আর মাক্সে মুখ ঢাকতে হবে না!’ ভুল বকলেও, শোনা যাচ্ছে বলে শুনছিলুম আর কী!’
গিন্নী বললেন ‘হুম! খোকা তো জানে তোমায় টিভি বন্ধ করতে বলে লাভ নেই। ওর সারাদিন অফিসে খুব চাপ গেছে। তা এই একটানা বিচিত্র বিকট ভুলভাল চীৎকার শুনে ওর মাথা এতো গরম হয়ে গেছিলো যে রান্নাঘরে গিয়ে সব কৌটোবাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে! বুঝেছো তো?’
“এবার আমার খবর দেখা বন্ধ করতে হবে মনে হচ্ছে –“ প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন বরুণবাবু।
সব বুড়োদেরই দিন কাটে খবর শুনে। তাই তাঁরা সবাই ব্যাপক মাথা নেড়ে চিন্তা ব্যাক্ত করতে লাগলেন। এমন সময় অর্ধেন্দুবাবু বললেন “ঘোর কলি হে ঘোর কলি! এই ভোটের কতাই বলছি। কী দিনকাল পড়লো – অ্যাঁ! বাচ্চা কাচ্চারাও এসব থেকে বাঁচছে না বুঝলে?”
সবাই আবার নতুন গল্পের সন্ধান পেয়ে বললে “কেন? কেন?”
বেশ শীত শীত হাওয়া দিচ্ছে লেকের দিক থেকে। পাশ দিয়ে একটা গরম বাদামভাজাওয়ালা যাচ্ছিলো। সে খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবার জন্য বাদামভাজা কিনে গায়ের চাদরটা টেনে নিয়ে জমিয়ে বসলেন অর্ধেন্দুবাবু। বললেন “সেদিন আমার নাতি অর্ক, এই বছর আঠেরো হয়েছে। তার আর আমার নাতনী ষোলো বছরের অধরার আলাপ শুনছিলাম। কী ভাবে ওদের ব্রেনওয়াশ হচ্ছে যদি শোনো! অর্ক হঠাত অধরাকে বললে ‘বোনি, এমনিতেই তো আমার বেঙ্গল ভালো লাগে না, তুই জানিস! আমি এইচ এস দিয়েই বাইরে চলে যাবো। কিন্তু বাবা মাও আর বেশীদিন এখানে থাকতে পারবে না।‘
অধরা বললো ‘কেন?’
অর্ক বললে ‘আমাদের বার করে দেবে তো বেঙ্গল থেকে!’
অধরা বলে ‘কে বার করে দেবে?’
অর্কর উত্তর ‘কেন ওরা! যারা আগে অন্য জায়গা থেকে হিন্দুদের বার করে দিয়েছে!’
অধরা বলে ‘কী করে বার করবে? আমরা এতো এতো লোক! বার করলেই হলো?’
অর্ক ওর হাতের মোবাইল বাড়িয়ে বলে ‘দ্যাখ হোয়াটসঅ্যাপে কী এসেছে! আমাদের একটা কি বড়জোর দুটো বাচ্চা হয়, আর ওদের এক একজনের টুয়েল্ভেটা! তাহলে দেখা যাচ্ছে ওরা আমাদের সিক্স টাইম মালটিপ্লাই করছে। তাহলে দশ বছরে ওরা কতো হয়ে যাবে ভাব! আমরা মাইনরিটি হয়ে যাবো আর আমাদের বার করে দেবে! কিন্তু যদি রামরাজ্য হয়, তাহলে তা হতেই দেবে না! আমি এবার রামরাজ্যের জন্যেই ভোট দেবো, তুইও দিস এরপর!’
শুনে চিন্তিত মুখে অধরা বললো ‘তাহলে তো চিন্তার কথা! হুম! কিন্তু আমি তো যে সরকার আছে তাকেই রাখতে চাই।‘
অর্ক ভুরু কুঁচকে বললো ‘এতো বোঝালুম তাও বুঝলি না? কেন রাখতে চাস শুনি!’
অধরা হেসে বললো ‘এখন তো সব অনলাইন! তোর মোবাইল আছে, আমার তো নেই। ক্লাস করতে হলে হয় বাবারটা চাও নয় মায়েরটা! তাও মায়েরটা পুরোনো, ভালো না। আর বাবা অফিসে থাকে। কিন্তু এই দ্যাখ কাগজে কী বলেছে! এদের ভোট দিলে আমাদের সব্বাইকে একটা করে ট্যাব দেবে! কী মজা! আমি আমার নতুন ট্যাব নিয়ে নেট ভরবো, গান শুনবো আর সিনেমা দেখবো!’
অর্ক ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো ‘আর তোর অনলাইন ক্লাস?’
হাঁ হয়ে শুনি অধরা বলছে ‘গোলি মারো! ক্লাস আবার লাগে নাকি? এখন গুগল সোনা আছে না? ওতেই সব আন্সার পেয়ে যাবো! অনলাইন পরীক্ষা তো! কে দেখছে?’ তোমরাই বলো কী চলছে বাজারে!” বলে অর্ধেন্দুবাবু একসঙ্গে বেশ কটা বাদাম মুখে পুরে কটমট করে চিবোতে লাগলেন। বুড়োদের মুখ হাঁ!
বিধানবাবু লম্বা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন “লাগ ভেলকি লাগ!” বরুণবাবু বিধানবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন “হ্যাঁ হে বিধান, বলি এতো লম্বা করে ফেললে কেন হে দাড়িটা? দাড়িবুড়ো সাজবে নাকি? সামনেই তো খ্রীস্টমাস!” ডি-কস্টা সাহেব পাইপ কামড়ে বললেন “হুইচ ডাড়িবুড়ো ইউ আর টকিং অ্যাবাউট! দেয়ার আর কোয়াইট এ ফিউ!” বরুণবাবু বললেন “যথা?” ডি-কস্টা বললেন “স্যান্টা ইস ওয়ান, টেগোর ইস ওয়ান অ্যান্ড নাও ইভেন আওয়ার মোডি ইস ওয়ান! হুম আর ইউ ফলোয়িং বিডান? ও ইয়েস! ইয়োর নেম অলসো ইস আনক্যানিলি সিমিলার টু বিডেন! সো ইউ হ্যাভ এভ্রি চ্যান্স অফ গোইং টু দ্য টপ! হাঃ হাঃ হাঃ” নিজের রসিকতায় নিজেই ভারী খুশী ডি-কস্টা।
বিধানবাবু বললেন “ধুর! আমার চুল দাড়ি লম্বা রাখার কারণ অন্য! এই করোনার ভিতর কে যাবে সেলুনে চুলদাড়ি কাটতে? আমার ভাই ব্যাপক ভয়!”
বরুনবাবু বললেন “আচ্ছা, কাকে ভোট দিলে এই করোনাটা যাবে বলো তো? এটা বলতে পারলে, গেটের কাছে গরম মামলেট ভাজছে নিধিরামের দোকানে। যে বলবে তাকে আগাম খাওয়াবো ।তারপর ভবিষ্যতবানী মিললে একেবারে মহাভোজ! ওটাই সব নষ্টের মূল! আমাদের বয়সে বাইরে বেরোতেই ভয় হয়! আমার ছেলে তো আমার এই বৈকালিক ভ্রমণের ওপর খড়্গহস্ত! বলে ‘তুমিই বাড়িতে রোগ নিয়ে আসবে!’ এ আর সহ্য হয় না!“
ডি-কস্টা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন “ডেন ডেয়ার ইস অনলি ওয়ান!” বলে একটি আঙ্গুল ওপরে তুললেন।
অর্ধেন্দুবাবু বাঁকা হেসে বললেন “জানি, ব্যাটা ঠিক গড অলমাইটি বলে বসে থাকবে! ও আর ও ছাড়া কী বলবে?”
ডি-কস্টা কটমট করে তাকিয়ে বললেন “জেন্টলমেন, আই অ্যাম নট টকিং অ্যাবাউট অলমাইটি! আই আম টকিং অ্যাবাউট ক্সি!”
হারীনবাবু এতোক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। এবার হঠাত “হালার পো হালা এত্তোগুলা রক্ত খাইসে! হ্যারে আমি ছাড়ুম না!” বলে নিজের পায়ে চটাস করে থাপ্পড় মেরে একটি অ্যারোপ্লেনের সাইজের মশা মেরে বললেন “ক্সি? হেইডা আবার কেডা?”
ডি-কস্টা বললেন “আই অ্যাম টকিং অ্যাবাউট দ্য চাইনীজ প্রিমিয়ার! হি এক্সপোর্টেড ইট অ্যান্ড হি অনলি ক্যান উইথড্র হিস প্রোডাক্ট! অ্যাস ইট ইস, হি ইস ইগার টু ইনভেড ইন্ডিয়া! লেটস সাবমিট আওয়ারসেল্ভস টু হিম অ্যান্ড ব্রিং হিম টু পাওয়ার! হি উইল উইথড্র করোনা ফর এভার! এলস ইট উইল কাম ওয়েভ আফটার ওয়েভ! ইউ ইনভেন্ট ওয়ান ভ্যাক্সিন, হি এক্সপোর্টস অ্যানাদার ভ্যারাইটি! সো টু স্টপ দ্যাট দিস ইস মাই সাজেশন জেন্টলমেন! অ্যান্ড আই সিরিয়াসলি ডিসার্ভ দ্য মামলেট!” বলে মোটা ফ্রেমের চশমার ওপর দিয়ে বরুণবাবুর দিকে তাকালেন।
ভোটের পূর্বাভাষের এ হেন পরিণতির পর, সেদিন পিনড্রপ সাইলেন্স! কারো মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরোয়নি! শুধু ডি-কস্টা গোটা পাঁচেক মামলেট খেয়ে তবে বরুণবাবুকে ছেড়েছিলেন!
সুচিন্তিত মতামত দিন