সৌমিতা চট্টরাজ

"খালবিল" সৌমিতা চট্টরাজ

কখনো ভেবে দেখেছেন, ​ খালের পরে বিল'ই কেন বসে! বাঘের আগে কেনোই বা আসে ফেউ! এসকিউজ মি ডিয়ার ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স অ্যান্ড অল মাই বিলাভেড মিত্রোঁঁওওওওওজ... ক্যাবলাকার্তিকশ্য কোয়েশ্চন করার জন্য হ্যাভ মার্সি অন মি। আপনারা ভাববেনই বা কখন! কোথায়! কীভাবে! খাল কেটে কুমির আনতে ততক্ষণে ঘপাঘপ বোতাম টিপছিলেন তো। সে কী ভীষণ তোরজোর! 
স্পষ্ট মনে আছে গো। ২০১৪, আমার প্রথম ভোটাধিকার। ধুর মরা, নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছি কেন? সময় তো বিদ্রোহে আক্রান্ত হবার! 
যাইহোক মোদ্দা কথাটি হলো কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোতে দেখেছেন এতদিন, এবার খাল কাটতেই দাঁত খিঁচিয়ে বিল বেরিয়ে পড়ছে। যার কদাকার হাঁ তে বারবিকিউ গণতন্ত্রের মল্টেড কুচি। উমমম আমমম... চপড্ হিউম্যানিটি উইথ স্প্রিংকেলড উগ্র হিন্দুত্ববাদ। মুখে রুচছে নিশ্চয়ই। নাকি ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের অভাবে জিভ টাকরার চলটা উঠে পিত্তিজ্বলানী ঘা ! না, ইয়ে, মানে আমার সাথে এমনটাই ঘটছে কিন্তু আকছার। ভোট দাতাদের প্রত্যেকেই তো আর আম্বানির জামাইরাজা নয় যে ঘনঘন জামাই আদর পাবে! অধিকাংশেরই আলু-থালু হাল হকিকত। তাদের আলু, পেঁয়াজ, চাল,ডাল, আটা, ভোজ্য তেল সহ কুড়ির বেশী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনেই খেতে হয়। যদিও The Essential Commodious (Amendment) Bill 2020 অনুসারে এগুলোকে আবার অত্যাবশকীয় বলার কী আছে হে বাল'ক / বাল'ইকা ! ভারতের লোকজন হাওয়া, বাতেলা, ঢপ আর ধর্ম খেয়েই গায়েগতরে বাড়বে, একে অপরকে ঠুকবে, রে রে করে মারবে, রাম রাম বলে কাটবে। আবশ্যক স্রেফ হট গোমূত্র এবং স্টাফড্ গোবর বলস্। 

পাঠকদের অনুমতি না নিয়েই একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাচ্ছি কেমন। সালটা যেন কত কত কত ? সম্ভবত ১৯৫৫। সেইসময় এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল অভাবের সময় সরকার সরাসরি কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য কিনে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সর্বসাধারণ যারা কিনা পুঁজিপতিদের জামাই নয় তাদের মধ্যে বিলোবে। ফ্ল্যাশ নাউ-এ দেখাচ্ছে, এবার থেকে কৃষকদের কাছে এই সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে সরকার একেবারেই বাধ্য না। উপরন্তু কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে শনিরলুটে হামলে পড়ে খাবলা মারতে দেখা যাবে জনগণের ক্যাঁকলাশ পাঁজরে প্লীহায়। লামসাং পরিমাণে এইসমস্ত দ্রব্য অনির্দিষ্টকালের জন্য গুদামে ঢুকিয়ে বাজার দরের রিমোটের ভলিউম পুটুস পুটুস করে বাড়াবে। আর জনগণ চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে বাজারী মিডিয়ার কোনো এক মাঝারি সাংবাদিক কে নিউজরুমের ডেস্কে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ধুমধড়ক্কা চিল্লাতে শুনবেন, নেশন ওয়ান্টস টু নো, ইয়ে গণবণ্টন থা ইয়া গণলুণ্ঠন!

দু নম্বর বিলটি আরও দুনম্বরি। The Farmers Agreement of Price Assurances and Farm Service Bill 2020 ইন শর্ট মূল্য নিশ্চয়তা।

দাবী করা হচ্ছে যে কৃষকরা এই বিলের মাধ্যমে আয়গত নিশ্চয়তা পাবেন। বড়ো বড়ো কোম্পানিরা চুক্তি করবে। এবং সরকার কৃষকদের প্রতি যাবতীয় দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে। কচলে কচলে হাত ধুয়ে ফেলবে আরকি...টাটা বাই বাই সায়োনারা । 
মনে রাখবেন কিন্তু "দাবী করা হচ্ছে", দাবী আর কে কবে মেনেছে মশাই! ​ বাইচান্স (৯০%) খরায় বন্যায় কিংবা সাতপাঁচ কারণে ফলন ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই ক্ষতির দায় না নেবে কোম্পানি না নেবে সরকার। বরঞ্চ শস্য বা শস্যের সত্ত্বাধিকারী কে নাপসন্দ হলে কোম্পানি গোঁসা হয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে ভাঁড়ে মা ভবানী বসিয়ে দেওয়ারও ক্ষমতা রাখবে। যদিও প্রক্সি মারতে গিয়ে সরকার পক্ষ বলছেন তেমন হলে কৃষক আইনের দ্বারস্থ হতেই পারেন। এটা পড়েই জলি এল এল বি মুভির একটা তোলপাড় ডায়লগ নিংড়ে সারমর্ম টা লিখতে ইচ্ছে করল... ভারতবর্ষে জোড়াতালি, কাটছাঁট দিয়েও বাহান্ন লাখ কেস পেন্ডিং পড়ে আছে। হেয়ারিং ডেট আসতে আসতে ফরিয়াদি মরে ভূত হয়ে যায়, তবুও আমরা বিচারের আশায় বলতেই থাকি আই উইল সি ইউ ইন কোর্ট।

তিন নম্বরি বিলটির তো যত প্রশংসা করবো ততই কম। The Farmers Produce Trade and Commerce Bill 2020 ভুললে চলবে না এই বিলটির সাথে স্বামীনাথন কমিশনে'র সুপারি গুলোর কিন্তু আদায় কাঁচকলায়। ব্যবসায়িক সংস্থাদের সাথে কৃষকেরা সরাসরি চুক্তিবদ্ধ হওয়াতে সরকার ঝাড়া হাত-পা হয়ে সাপের পাঁচ পা দেখবে। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে ফলন বাবদ খরচের যে দেড়গুণ দাম কৃষকদের জন্য সুনিশ্চিত করতে বাধ্য ছিল সরকার সে সব এবার থেকে অতীত। ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির ১৫% কৃষিজ আয়ের পুরোটারই দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা হলেন কর্পোরেটরা। তৎসংলগ্ন ​ বিদ্যুত সরবরাহের সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুতে কৃষক কে ভর্তুকি বন্ধ করার যে পারফেক্ট ব্লুপ্রিন্ট তাতে তো সুনিশ্চিত ভাবে দেশের উন্নতি! দেশের বুনিয়াদের পোয়া বারো! ​ কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, ভালোমানুষীর যুগ নেই। আহা রে! সরকারের আগাপাশতলা মহান উদারীকরণের পশ্চাতে লাথি না মেরে একবার অন্তত যদি পশ্চাদনুসরণ করে কৃষকেরা সবটুকু মেনে নিতেন! সাধে কী বলে মূখ্যু চাষা!

লেখাটার পিছনে এতোক্ষণ সময় ব্যয় করলেন আপনারা! প্রাপ্তি আমার। বিশ্বাস করুন, কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এবার রয়েসয়ে একটু গলা গুলো ভিজিয়ে নিন। এবং ধীরে ধীরে ওই জলেই অভ্যস্ত হোন। কারণ শুকনো কথাতে তো আবার চিড়ে ভেজে না। এই রিসেস পিরিয়ডে নাই নাই করেও দু-তিনশো কৃষক আত্মহত্যা করবে, বা দিল্লী চলো বলতে বলতে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরবে, বা ধর্ণায় বসে জলকামান, আইনের লাঠি, আততায়ীর গুলিতে জখম হয়ে চিরতরে হারিয়ে যাবে সাত সাতটা স্টেডিয়ামের ভুলভুলাইয়ায়। গায়েব হলেই তকমা পাবে "ওরা তো খলিস্তানবাদী"। রাম রাম, কি সব অলক্ষুণে কথা লিখছি দেখুন দেখি। এমন হয় কখনো! সরকার আপনাদের মাই বাপ, আপনাদের ভাগ্যবিধাতা। আপনারা তার বাধ্য সন্তানসন্ততি। সরকার দিন বলছে তো দিন রাত বলছে তো রাত। মন কি বাত কঙ্কের জিভের চেয়েও ধারালো। ​ সত্য এক্কেবারে হড়হড় করে উগড়োচ্ছে। আফটার অল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের হোডিংয়ে তো সেই চাইনিজ রিফ্লেক্টার! তবু খতম হওয়ার আগে পর্যন্ত একটা কথা মানতেই হবে, ​ বাপের মনমর্জিয়ার বিরুদ্ধে যারা আওয়াজ তুলছে তাদের মায়ের দুধে দম আছে ভাই।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.