কোন সভ্য দেশে নির্বাচন আসলেই রাজনৈতিক খুনোখুনি বৃদ্ধি পায়? নির্বাচনে পট পরিবর্তন হলেই বদলের ঔদ্ধত্বে বদলা নেওয়ার অশ্বমেধ ঘোড়া ছোটানো হয়? নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য জনগণকে ধর্মের নামে সম্প্রদায়ের নামে বিভক্ত করে পরস্পরের বিরুদ্ধে খাড়া করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়ে যায়? ক্রমাগত মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বহরে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়? এবং রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে জঘন্যতম ভাষায় অন্য রাজনৈতিক শিবিরের বিরুদ্ধে তোপ দাগা হতে থাকে? সাধারণ দলীয় সমর্থকদেরকে ক্রমাগত স্বহিংস করে তোলার জন্য রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা অবিরাম হিংসা ছড়াতে থাকে? না। কোন সভ্য দেশেই গণতন্ত্রের নামে এমন অসভ্যতাতন্ত্র চলে না। এই অসভ্যতাতন্ত্র চলে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলির মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেই। এবং কাঁটাতারে বিভক্ত আমাদের বাংলায়।
আগামী ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে পশ্চিমবঙ্গের বুকে গণতন্ত্রের নামে এই অসভ্যতাতন্ত্রের খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রাজনৈতিক হিংসার বলি হতে হচ্ছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকেই। বুলেটপ্রুফ ঠান্ডা গাড়ীতে বসা কমান্ডো বেষ্টিত দেশসেবকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রাণ যাচ্ছে অতি সাধারণ মানুষজনদেরই। যে মানুষদেরকে ঢাল করেই কমান্ডো পরিবেষ্টিত দেশসেবকরা রাজনৈতিক জমি দখল করতে আদা জল খেয়ে লেগে পড়েছে। দেশসেবার এমন মরিয়া দৃষ্টান্ত যে কোন সভ্য দেশেই বিরল। আজ অমুক পার্টির অফিসে দাও আগুন লাগিয়ে। কাল তমুক পার্টির সমর্থকদের বাড়িতে চালাও ভাঙচুর। রাজনৈতিক নেতাদের টিকি ছুঁতে না পারলে কি হবে? রাজনৈতিক দলের পতাকা বহনকারী সাধারণ মানুষের মাথা তো নাগালের মধ্যেই থাকে চিরকাল। এবং এই যে সহিংসতা, এর জন্য পেশাদার গুণ্ডাবাহিনীরও অভাব নাই। টাকার জন্য হেন কোন অপরাধ নাই, যা এইসব পেশাদার গুণ্ডাবাহিনী করতে রাজি নয়। আর বিশেষ করে নির্বাচনে আগে এদের দরও যায় বেড়ে। বিশেষ করে সরকার ফেলে দেওয়ার রাজনীতিতে প্রাকনির্বাচনী খুনোখুনি হানাহানি ভাঙচুরের জন্য এই সকল গুণ্ডাবাহিনীর কোন বিকল্প নাই। এদের সাফল্যের হাত ধরেই ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়া অনেক সহজ হয়ে ওঠেও।
এবং সবচেয়ে মজার কথা, রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা এইসব গুণ্ডাবাহিনীর ধ্বংসাত্বক কাজকর্মকে জনবিক্ষোভ বলে চালিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে নেয়। এবং এই স্বার্থরক্ষার খেলাকেই গণতন্ত্র বলে চালানো হয় সাংবিধানিক মর্য্যাদায়।
২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি তাই অগ্নিগর্ভ। যত বেশি রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করা যাবে। তত বেশি সংখ্যক জনগণের ভোটের উপর দখল নেওয়া সহজ হবে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা যত বেশি ভেঙ্গে পড়বে। তত বেশি রাজনৈতিক ফয়দা জমা হবে ইভিএমে। আর একবার এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেলেই কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই এই ধরণের নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে অস্তিত্বরক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করার তাগিদেই বাকি দলগুলিও এই বীভৎস সংস্কৃতির দাস হয়ে পড়ে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। সাড়ে তিন দশক বামপন্থী শাসনে থেকেও পশ্চিমবঙ্গ এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির থেকে মুক্ত হতে পারে নি। আর পারে নি বলেই আজ ২০২০-তে এসে রাজ্যরাজনীতির আগাগোড়া এমন বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে। আর পোকামাকড়ের মতো মরে পড়ে থাকছে মানুষের লাশ।
কারণ একটাই, লাশ না পড়লে রাজনৈতিক মাইলেজ পাওয়া শক্ত। যত বেশি লাশ পড়বে। বা যত বেশি লাশ কুড়িয়ে রাজনৈতিক পতাকায় জড়ানো যাবে। তত বেশি ভোট নিশ্চিত করা সম্ভব হবে পশ্চিমবঙ্গে। মানুষকে বোঝানো সহজ হবে, আমাদের দলেই বেশি লাশ পড়েছে। তাই আমাদেরকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। কি করুণ পরিণতি রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির। এই লাশের রাজনীতির জন্য দুইটি বিষয় খুব জরুরী। এক, ক্রমাগত হিংসা ছড়িয়ে যাওয়া। আর দলীয় সমর্থকদেরকে হিংস্র করে তুলে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরী করা। যে অস্থিরতা তৈরীতে পেশাদার গুণ্ডাবাহিনীর কোন বিকল্প নাই। হিংসা ছড়ানোর জন্যই রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা প্রতিদিন হিংসাত্মক বক্তব্য রাখতেই মঞ্চে আসীন হন। এবং এই বিষয়ে তাদের তুলনা তারাই। এইভাবে গোটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল এমন ভাবেই বিষিয়ে গিয়েছে যে, সাধারণ মানুষমাত্রেই রাজনীতি এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত। আর সেই ফাঁকা স্থানটি দখল করে নিচ্ছে, মাফিয়া থেকে দুর্বৃত্তরা। এরাই ঠিক করে দিচ্ছে রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি।
প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতা খুললে তাদেরই মুখচ্ছবি দেখতে হয় আমাদের। প্রতিদিনের সান্ধ্যটিভির তরজায় তাদেরই গলা চড়তে থাকে তারস্বরে। কে কার কথা চেপে দেবে। তারই প্রতিযোগিতা।
রাজনীতি মানেই নিজের ও নিজের পরিবারের আখের গুছিয়ে নেওয়া। একটা নির্বাচনে যে পথেই হোক আর যেভাবেই হোক, জয় হাসিল করতে পারলেই কেল্লাফতে। পুরো পাঁচ বছরের জন্য অর্থ সম্পদ বিত্ত এবং প্রতাপের কোন অভাব হবে না। দরকারে মাঝ পথে দল বদল করলেও দেশের সংবিধানের বদান্যতায় বিধায়ক কিংবা সাংসদ পদ চলে যায় না। একেবারে বাহোবা নন্দলাল! ফলে নির্বাচনে জেতা আর নির্বাচিত হয়ে নিজের ধন সম্পদ প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করা ছাড়া, রাজনীতি করার আর কোন কারণের দরকার পড়ে না। এবং এইদেশে রাজনীতিই এখন সবচেয়ে লাভজনক পেশা। চোর গুণ্ডা বদমাইশ জোচ্চোর থেকে শুরু করে ধান্দাবাজ, অসাধু ব্যবসায়ী, নীতিহীন দুর্বৃত্ত সকলের জন্যই অবারিত দ্বার। যে কেউই রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করে নিতে পারে। আর এদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যেই এই হিংসার রাজনীতি। এই লাশের রাজনীতি। এই জনগণ ঠকানোর রাজনীতি।
কিন্তু কি করবে জনগণ? ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত উনানে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া? ভারতীয় গণতন্ত্রে জনগণের হাতে আর তো কোন উপায় নাই। একটি মাত্র বিকল্প ছাড়া। ইভিএম মেশিনে NOTA -র বোতামে আঙুল ছোঁয়ানো। কিন্তু এইটি তো আসলেই কোন বিকল্প হতে পারে না। জনগণ আজ সম্পূর্ণ দিগভ্রান্ত দিশাহার। হয় এই দল, নয় ঐ পার্টি। হয় এই শিবিরে গলা বাড়িয়ে দাও। নাহলে ঐ শিবিরে গলা বাড়িয়ে দাও। অর্থাৎ গলা বাড়িয়ে দিতেই হবে। হয় এ গলা কাটবে। নাহলে ও গলা কাটবে। কিচ্ছু করার নাই। জনগণের পক্ষে এই গণতন্ত্রে বিকল্প কোন অবস্থান তৈরী করার মতো কোন পথ আজ আর খোলা নাই। কথায় বলে যে যায় লংকায়। সেই হয় রাবণ। ভারতীয় গণতন্ত্রে এর থেকে বড়ো সত্য আর নাই।
তাই বিকল্পহীন এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও কতো লাশ পড়বে। আরও কতো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হবে। আরও কত ভাঙচুর করা হবে। আরও কত সাধারণ গৃহসংসারে হাহাকার নেমে আসবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। এমনকি এই বারের নির্বাচন উপলক্ষে একটা দুটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে গেলেও খুব একটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় হবে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর মস্ত বড়ো একটা সুবিধা রয়েছে। একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের অধকিকাংশ ভোটের উপরেই দখল নেওয়ার পথ খুলে যায়। ভোট কেন্দ্রিক নির্বাচনের সুবিধা অনুযায়ী শতকরা হিসাবে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাও বেশ বাড়িয়ে নেওয়া যায়। ফলে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগার একটা সম্ভাবনা কিন্তু থেকেও যেতে পারে। আবার দাঙ্গা না লাগালেই যে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সংঘটিত হবে। না, তার কোন রকম সম্ভাবনা নাই। উল্টে লাশের রাজনীতি যে উত্তরোত্তর জমে উঠবে তার কোন সন্দেহ নাই। রাজ্য রাজনীতিতে তাই লাশের রমরমা এখন। এক একটা লাশ মানেই আরও বেশি বিক্ষোভ। আরও বেশি ভাঙচুর। আরও বেশি অগ্নিসংযোগ। আরও বেশি হিংসাত্মক ভাষণ। আরও বেশি রাজনৈতিক মাইলেজ।
রাজনৈতিক মাইলেজ তৈরী করার এই সংস্কৃতিই গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে অসভ্যতাতন্ত্র কায়েম করে রেখেছে। আর জনগণ সেই অসভ্যতাতন্ত্রের যাঁতাকলে এমন ভাবেই আটকিয়ে গিয়েছে যে, গণতন্ত্রের এই অসভ্যতাকে আর আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। গণতন্ত্র আর অসভ্যতাতন্ত্র সমার্থক হয়ে উঠেছে।
১২ই নভেম্বর’ ২০২০