শনির বচন | জাগ্রত ভারতে নিদ্রিত বাংলা

শনির বচন | জাগ্রত ভারতে নিদ্রিত বাংলা

জয়শ্রী রাম! সরকার যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন। তা সে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ই হোক। ৩৭০ ধারা বিলোপ সাধনই হোক। সরকারী সম্পত্তি জলের দরে বেচে দেওয়াই হোক। কিংবা ঋণখেলাপী শিল্পপতিদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মুকুব করে দেওয়াই হোক। পিছনের দরজা দিয়ে ব্যাংক লুঠকারী মোদীদের নিরবে দেশত্যাগ করতে দেওয়াই হোক। কিংবা নোট বাতিল করে দেশবাসীকে কান ধরে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়াই হোক। সবই কিন্তু অচ্ছে দিনের জন্য। সবই কিন্তু বিকাশের জন্য। সবই কিন্তু নির্বাচনী ইশতেহার মাফিক। কৃষক বিরোধী নতুন তিনটি কৃষি আইনও তেমনই দেশহিতার্থেই দেশবাসীকে সরকারের তরফ থেকে উপহার। 

কিন্তু খালিস্তানী কৃষকরা তো সে কথা শুনবে না। তাই হাজার হাজার ট্র্যাক্টর নিয়ে লক্ষ লক্ষ কৃষক দিল্লী অভিযানে নেমে পড়েছে। তাদের পরিস্কার কথা। নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। এবং প্রত্যাহার করতে হবে বিশেষ লোকসভা অধিবেশন ডেকে। সোজা কথা? একটা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার। তা সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেছনে কতখানি পুলওয়ামা কতটা বালাকোট কিংবা কতটা ইভিএম মেশিন কিংবা কতটা তিন শতাধিক নির্বাচনী আসনে মোট ভোটারের থেকে বেশি ভোট পড়া রয়েছে, সেটা বিচার সাপেক্ষ। যেভাবেই হোক। হিন্দু মুসলিম করেই হোক। পুলওয়ামা বালাকোট দিয়েই হোক। ইভিএমের কারসাজিতেই হোক। সরকার যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাতে তো আর সন্দেহ নাই। 

কথায় বলে যো জিতা ওহি সিকান্দর। ফলে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের চোখ রাঙানি তো সহ্য করতেই হবে। সরকার যখন যে আইন আনবে। নতমস্তকে মাথা পেতে মেনে নিতে হবে। মাথা তুলে শিরদাঁড়া খাড়া করে গলা উঁচিয়ে প্রতিবাদ করলেই কিন্তু মুশকিল আছে। 

তেমন বেয়াদবি সরকার সহ্য করবেই বা কেন? খাড়া শিরদাঁড়ার উপরে মাথাটা মুসলমানের হলে, সে পাকিস্তানী। মাথাটা দলিতের হলে সে মাওবাদী। মাথাটা কম্যুইনিস্টদের হলে সে চীনের দালাল। আর যদি মাথায় পাগড়ি থাকে, তবে তো কথাই নাই সে খালিস্তানী। তাই পঁচানব্বই হাজার ট্র্যাক্টর নিয়ে বারো লক্ষ কৃষকের দিল্লী অভিযান আসলেই খালিস্তানী আন্দোলন। এমনটাই বলা হচ্ছে সকাল সন্ধ্া জয়শ্রীরাম জপতে জপতে। 

এদিকে সরকারের নতুন কৃষি আইনে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য থেকে ইতিমধ্যেই বাদ পড়ে গিয়েছে চাল, ডাল, আটা, আলু, চিনি, পিয়াঁজ, ভোজ্য তেল সহ মোট ২০ টির বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য। এতদিন যে পণ্যগুলি এই আইনের আওতায় থাকায় দেশে দুর্ভিক্ষ লাগেনি বিগত ছয় দশকে। এর কিন্তু একটা মস্ত সুবিধা রয়েছে। সেটা কি? না সরকার বাহাদুর, এবার সরাসরি মজুতদারদের স্বার্থরক্ষায় আইন এনেছেন। আপনি মজুতদারী কারবারে ফুলে ফেঁপে উঠলেও আইন আপনার টিকি ছুঁতে পারবে না। এই সরকারকে ভোট দিয়ে সমর্থন না করে থাকা যায়? সম্ভব? সরকারের মাথাদেরকে যারা নির্বাচনে জিততে কোটি কোটি টাকা সরবরাহ করে থাকে। সেই কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা এখন থেকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ইচ্ছে মতো দামে কৃষিপণ্য ক্রয় করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য গুদামজাত করে রেখে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে অগ্নিমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় করতে পারবে। কোন সরকারী বিধিনিষেধ থাকবে না। এই তো অচ্ছে দিন। এবং আমি আপনি সানন্দে জয়শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে এক ব্যাগ টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে এক ঠোঙা সবজি কিনে আনতে পারবো। দেশের জন্য না হোক দেশের সরকারের জন্য এইটুকু মাশুল দেবো না? তাহলে আর কিসের দেশপ্রেম বলুন তো?

ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর এই প্রথম আবার সেই নীলকর সাহেবদের আমলের মতো চুক্তিচাষ প্রথা ফিরে এলো। বড়ো বড়ো কর্পোরেট সংস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণে কৃষকদের চুক্তিচাষে বাধ্য করতে পারবে। তাও আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসল নষ্ট হয়ে গেলে, সেই ক্ষতির দায় কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলি নিতে বাধ্য থাকবে না। আর থাকবেই বা কেন? কোটি কোটি টাকা লগ্নী করে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তিকে সরকারী গদিতে বসিয়েছে কি আর এমনি এমনি? লগ্নীর চুক্তিমত একের পর এক আইন না করে সরকারের উপায় আছে কোন? ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে একটু দেখে নিতে পারলে মন্দ হতো কি? নীলকর সাহেবদের দাপট আর অত্যাচারের গল্পগুলি কিন্তু সেদিন হাজার হাজার নীলচাষীদের জীবনে কোন কল্পকাহিনী ছিল না। আগামী দিনেও থাকবে কিনা সন্দেহ। সন্দেহ করছে বলেই পঁচানব্বই হাজার ট্র্যাক্টর আর বারো লক্ষ কৃষকের এই দিল্লী অভিযান।

না গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কৃষিপণ্য ক্রয়ের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ন্যূনতম সহায় মূল্য দিয়ে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি এই আইনে সম্পূর্ণ বাতিলও হয়ে গেল। জয়শ্রীরাম। এখন থেকে কর্পোরেট সংস্থাগুলির স্বার্থে নির্ধারিত মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রয় করতে বাধ্য হবে কৃষকরা। তাতে তাদের যতই আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হোক না কেন। দেশপ্রেমের প্রমাণ নয়তো তারা আর দেবেনই বা কিভাবে? অথচ দেখুন। এই দেশবিরোধী কৃষকরা আজ একজোট হয়ে দিল্লী অভিযানের নামে কার্যত দিল্লী অবরুদ্ধ করে রেখে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের চুড়ান্ত ভোগান্তি চলছে। আর এরা সরকারকে কার্যত ব্ল্যাকমেল করতে মাস ছয়েকের খাদ্য নিয়েই দিল্লী অভিযানে নেমে পড়েছে। এবং আরও কৃষকদের প্ররোচিত করে চলেছে দেশবিরোধী এই আন্দোলনে সামিল হতে। ভাবুন একবার!

না, সেদিক দিয়ে দেখলে আমাদের বাংলার কৃষকরা কিন্তু সত্যিই প্রকৃত দেশপ্রেমী। তারা কিন্তু দেশবিরোধী এই কৃষক বিদ্রোহ থেকে শত যোজন দূরে। যখন উড়িষ্যা মধ্যপ্রদেশ মহারাষ্ট্রের কৃষকরাও কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে পথে নামছে। বরং গ্রাম বাংলার খেতে খামারে কান পাতলেই জয়শ্রীরাম ধ্বনির বিস্তার ও সরগম দ্রুতহারে ছড়িয়ে পড়ছে কাকদ্বীপ থেকে কার্শিয়াং। আলিপুরদূয়ার থেকে আদ্রা। এই বাংলায় এখন কেন্দ্রীয় সরকারের সব আইনই স্বাগতম। না, রাজ্য সরকার বা সরকারী ভাবে নির্বাচিত দল যতই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধীতা করুক না কেন। রাজ্যবাসী তাতে কান না দিলেই তো হলো। তাই রাজ্যের কৃষকরাও দিল্লীর কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। বরং সব মাথা ধীরে ধীরে সমবেত হচ্ছে জয়শ্রীরাম ধ্বনির চারপাশেই। একটু গ্রাম বাংলায় ঘুরে আসলেই বিষয়টি চাক্ষুশ করে আসা যেতে পারে কিন্তু। কেন্দ্র সরকারের নতুন কৃষি আইন কিন্তু সারা ভারতেই একই প্রভাব ফেলবে। পাঞ্জাবের কৃষকরা যদি বিপদে পড়ে। বাংলার কৃষকদের বিপদ তার থেকে কম হবে না আদৌ। নতুন কৃষি আইনে কৃষিকাজে বিদ্যুতমাশুলের উপরে সরকারী ভর্তুকি তুলে নেওয়াই হবে না শুধু। বিদ্যুৎ কিনতে হবে বেসরকরী সংস্থাগুলি থেকে উচ্চমূল্য। তাতে উচ্চমানের ফসল হবে কিনা বলা না গেলেও, কৃষকের হাড়পাঁজরা যে এক হয়ে যেতে পারে, সেকথা আন্দাজ করেই পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা লাখে লাখে এই কৃষক বিদ্রোহে সামিল হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাংলায়? না, কোন রাজনৈতিক দলই এই কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে পথে নামে নি এখনো। সব দলই জল মাপতে ব্যস্ত। আমাদের বাংলায় এই একটি সংস্কৃতি তৈরী হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক দলের স্বার্থের বাইরে কোন আন্দোলন সংগঠিত হয় না। পথেঘাটে মিটিং মিছিল গণআন্দোলন হরতাল ধর্মঘট সব কিছুই রাজনৈতিক দলগুলির স্বার্থে ও নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে থাকে। ব্যাতিক্রম ঘটলেও রাজনৈতিক দলের স্বার্থে দলের হাতে নিরপেক্ষ গণআন্দোলনও হাইজ্যাক হয়ে যায়। ঠিক যেমনটি হয়েছিল সিঙ্গুরের কৃষিজমিরক্ষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে। কিন্তু পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা এমন ভাবে রাজনৈতিক দল নির্ভর নয়। তাদের নিজস্ব কন্ঠ রয়েছে। কথায় বলে নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। কিন্তু সেটি বোধহয় আর আমাদের বাঙালিদের ক্ষেত্রে খাটে না। বাংলার কৃষক তাই আজও দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সপক্ষে পাশে দাঁড়ায়নি। হ্যাঁ অবশ্যই দঁড়াতো। বা দাঁড়াবে যদি কোন রাজনৈতিক দল তাদের সংগঠিত করে রাজনৈতিক স্বার্থে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক দলগুলি সবই সামনের বছরের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এখনো জল মাপতেই ব্যস্ত। 

৫ই ডিসেম্বর’ ২০২০


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.