শনির বচন | ফেক নিউজ ও স্বৈরতন্ত্রের যুগলবন্দী

ফেক নিউজ ও স্বৈরতন্ত্রের যুগলবন্দী

■ সরকারী প্রশ্রয়ে ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবিরের স্বার্থে ফেক নিউজ ছড়ানোর সক্রিয় চক্রের বিরুদ্ধে, না, কিছু বলা যাবে না। সেই চক্রের কুশীলব পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা উঠলে, সরকারী কলকাঠি নেড়েই মামলা ডিসমিস করে দেওয়াও যে অসম্ভব নয়, সেটা এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার। অর্থাৎ দেওয়াল লিখন স্পষ্ট। ক্ষমতাসীন শিবির তার রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীস্বার্থে যে কোন ছলচাতুরীর সাহায্যই নিক না কেন, সেটিই মাথা নত করে সুবোধ ভক্তের মতো মেনে নিতে হবে। না, কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। বরং প্রশ্ন তুললে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে দিনের পর দিন কয়েদ করে রাখা হতে পারে। এটাই এখন গণতান্ত্রিক দেশের স্বৈরতান্ত্রিক রীতি। তাই বুদ্ধিমান জনতা ঘরে দোর দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেই আত্মরক্ষার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। সেই ব্যবস্থার নামই ব্যক্তি স্বাধীনতা। মুখে কুলুপ আঁটার বিরুদ্ধে সরকারের কোন বক্তব্য নাই। মুখ খুললেই বিপদ। হয় সরকারের বন্দনা করতে হবে নয়তো মুখ বন্ধ রাখতে হবে। সরকারের বন্দনায় যত খুশি ফেক নিউজ ছড়ানো যেতে পারে। আদালত পুলিশ প্রশাসনের রক্তচক্ষুর ভয় থাকবে না। কিন্তু মুখ ফস্কে সত্য কথা বেড়িয়ে পড়লেই হারে রে রে করে তেড়ে আসবে প্রথমে প্রভুভক্তের দল। তারপর অবস্থার গুরুত্ব বুঝে পুলিশ ও প্রশাসন। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আইন বাঁকিয়েই সত্যবাদীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে দেশের সংবিধান। সকল সাংবিধানিক শপথ চেয়ে থাকবে নির্বাক হয়ে। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ চলতে চলতে সেটিই একদিন দেশীয় রাজনীতির রীতি হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। ফলে মানুষের ভোটাধিকার অর্জন করে যে যাবে লংকায় সেই হয়ে উঠবে রাবণ। 

এর ফলে একটি দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরে বাস্তবিক কোন বিরোধী পরিসর আর অবশিষ্ট থাকে না। জনগণ এক শিবিরের বদলে অন্য শিবিরের দিকে ঝুঁকলেও লাভ হয় না কোন। রাজা আসে রাজা যায়। হুকুম নড়ে না। আর একটি রাজনৈতিক শিবিরই যদি সরকারী ক্ষমতা ব্যবহার করে সামগ্রিক বিরোধী পরিসরটিকে গ্রাস করে ফেলে। তবে তো কথাই নাই। ঘোড়া কেনাবেচার সংস্কৃতিতে এর থেকে সহজ কাজ আর কি হতে পারে। নিরঙ্কুশ স্বৈরতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এটাই সর্বোত্তম পথ। 

পাঠক মনে করতেই পারেন। না, এতই কি আর সহজ। মানুষ তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। ঠগ জোচ্চোরি গায়ের জোর খুব বেশিদিন একটানা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। ইতিহাসের বিধান। মানুষ ঠিকই একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। বিরোধী পরিসর যতই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ুক না কেন। মানুষের বিদ্রোহকে দমিয়ে রাখা সহজ নয়। কোটি কোটি মানুষ জেগে উঠলে। কোটি কোটি হাত সংঘবদ্ধ হলে যত বড়ো প্রতাপশালী স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিই হোক না কেন। পতন অনিবার্য্য। ইতিহাসই তার ভুরি ভুরি নিদর্শন ধরে রেখেছে। ঠিক কথা। আর সেই ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নিয়ে আজকের স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি মানুষকে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ করে পরস্পরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। আর সেই কাজে ধর্ম ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষের মতো কার্যকর অস্ত্র আর কি হতে পারে। ঠিক সেই অস্ত্রেই দেশের লোককে ঘায়েল করতেই দাঁড় করানো হয় সারিবদ্ধ মিডিয়া। মিডিয়া ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক বিষ উগরিয়ে দিতে থাকে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাম্প্রদায়িক কাজকর্মকে দেশপ্রেম আখ্যা দিয়ে নিরন্তর মিথ্যা প্রচারের ভিতর দিয়ে। ফলে দিনে দিনে দেশপ্রেমের অর্থ দাঁড়িয়ে যায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবিরের ভক্ত বনে যাওয়াই। দেশপ্রেমের অর্থ দাঁড়িয়ে যায় ক্ষমতাসীন শিবিরের স্বার্থবিরোধী সকল কাজকেই দেশবিরোধী কাজকর্মের আখ্যা দেওয়ার ভিতরেই। ফলে এই ভাবে নানান গোষ্ঠীর ভিতরে পারস্পরিক বিদ্বেষের জন্মের ভিতরে দিয়েই পারস্পরিক দূরত্ব বাড়তে বাড়তে স্থায়ী হয়ে যায়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন শিবিরের যে যত বড়ো ভক্ত। সে তত বড়ো দেশপ্রেমী। এর সাথে দেশের প্রতি ভক্তি ভালোবাসার কোন সংযোগ নাই। স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির প্রতি নতজানু হয়ে সেই শক্তির স্বার্থে নিজের বুদ্ধিবৃত্তি বিবেক আদর্শ বলি দেওয়াই দেশপ্রেম। স্বৈরতন্ত্র এই ভাবেই দেশের মানুষকে দেশপ্রেমের ফ্রেমে বন্দী করে ফেলে। 

এবং সেই দেশপ্রেমে পান থেকে চুন খসলেই দেশবিরোধী চক্রান্তের অভিযোগে কয়েদ করে চালান করে দেওয়া হয় লৌহ যবনিকার অন্তরালে। মানুষ ভয়ে ভীতে ভক্তি প্রদর্শন করে আত্মরক্ষার উপায় অবলম্বন করে চলে। আর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বিদ্বেষী হিংসা ছড়ানোর কার্যক্রমে সামিল হয়ে পড়ে। জেনে বা অজান্তে। একবার এই চক্রব্যূহে ঢুকে পড়লে বেড়নো সহজ কথা নয়। কারণ তখন পারস্পরিক হানাহানিতেই যে শক্তিক্ষয় হয়। তাতে হীনবল হয়ে আর আসল শত্রুর বিরুদ্ধে সামান্য গলার আওয়াজও তোলা যায় না। যুদ্ধ শুরু করা তো দূরস্ত। এই ভাবেই স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি সমস্ত দেশকে বিভিন্ন টুকরোয় বিভক্ত করে পারস্পরিক টুকরোগুলির ভিতর নিরন্তর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সক্রিয় রেখে নিশ্চিন্তে দেশের সম্পদ লুঠ করতে থাকে। আর সেই লুঠতরাজ যদি কোন বিদেশী প্রভুর অঙ্গুলি হেলনে নানান বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফার স্বার্থে পরিচালিত হয়, তবে তো সোনায় সোহাগা। কপাল পোড়ে সাধারণ জনতার। জনতার চোখের সামনে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলিকে নাম মাত্র মুল্যে বিক্রয় করে দেওয়া হয় দেশি বিদেশী সংস্থার হাতে। দেশের সম্পদ বেচে দেওয়াই স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের মূল লক্ষ্য থাকে। আর সেই লক্ষ্য পুরণের খেলায় তারা বলি দেয় দেশের জনতাকে। যে জনতার ভোটেই তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেয়। 

ফলে ভোট একটা বড়ো বিষয়। স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ভোটই তুরুপের তাস স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিগুলির কাছে। এবং সেই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে দীর্ঘস্থায়ী করে রাখতেও সেই ভোটই ভরসা। অন্তত যতক্ষণ না সরাসরি সামরিক শাসন জারি করে দেশকে বন্দুকের নলের সামনে নতজানু করা না যাচ্ছে। ফলে সেই ভোটের রাজনীতিতে সর্বদা এডভান্টেজ পেতে একটা সুবিধাজনক জায়গাতে থাকতেই স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিগুলি কিনে নিতে বা ভয় দেখিয়ে অধিকার করে নিতে থাকে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলিকেই। সাংবাদিকের স্বাধীনতা বলে আলাদা কোন বস্তুর আর কোন অস্তিত্ব থাকে না তখন। সেই রকম পরিস্থিতিতে যদি কোন সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম দেশের হাড়ির খবর প্রকাশ করতে চায় বা চেষ্টা করে। তাদেরকে দেশরিরোধী রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। আর সেই প্রয়াসে আইন আদালতকে নিজেদের দিকে পেতে সব রকমের অনৈতিক উপায় অবলম্বন করে থাকে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিগুলি। এর ফলেই সৃষ্টি হয় এক ভয়ঙ্কর ভয়াবহ পরিস্থিতির। যেখানে সংবিধান মুখ লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। আইন নিশ্চুপ হয়ে থাকে। নির্বাক আদালতের কক্ষ থেকে বেআইনী রায় বার হতে থাকে একের পর এক। 

ফেক নিউজ ছড়ানো সাংবাদিক দেশপ্রেমের পুরস্কার পায় দেশরত্ন তকমায়। ফেক নিউজ প্রচার করা সংবাদমাধ্যমের টিআরপি বাড়তে থাকে হু হু করে। আর আসল সত্যকে জনতার সামনে নিয়ে আসতে গিয়ে সৎ সাংবাদিককে দেশবিরোধী কার্যকলাপের মিথ্যা অভিযোগে হাজতবাস করতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহের আইনে জড়িয়ে। এটাই একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার নগ্ন চিত্র। ফলে যদি কেউ আশা করে বসে থাকেন। ফেক নিউজ ছড়ানো সাংবাদিকের উচিৎ শাস্তি হবে। ফেক নিউজ প্রচার করা সংবাদমাধ্যামগুলি আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। তবে সেসব নেহাৎই বালখিল্য চিন্তাধারা মাত্র। আইন আদালত সবসময়ে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির হাতের ইশারায় চলতে থাকে। কারণ আইন আদালতকে কুক্ষিগত না করতে পারলে কোন স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিই বেশিদিন স্থায়ী হয় না। দেশ যখন স্বৈরতন্ত্রের খপ্পরে পড়ে। তখন আইন বা আদালতের স্বাধীন অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয় কোনমতেই। 

ফলে এই সময়ে প্রশ্ন তুললেই বিপদ। এই সময়ে অপরাধীদের শানাক্ত করার চেষ্টা করলেই বিপদ। এই সময় দেশবিরোধ রাজনৈতিক শিবিরগুলির বিরুদ্ধে মুখ খুললেই বিপদ। এই সময় স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির পরিচালকবর্গের বিরুদ্ধে আঙুল তুললেই বিপদ। এই সময় দিনকে দিন আর রাতকে রাত বললেই বিপদ। এই সময়ে দেশের সংবিধানকে মেনে চলতে গেলেই পদে পদে বিপদ। কারণ সেই সংবিধান আর দেশবাসীর রক্ষাকবচ নয়। দেশবাসীর একটিই রক্ষাকবচ। সেটি হল দেশবিরোধী ক্ষমতাসীন স্বৈরতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক শক্তির অন্ধ ভক্তে পরিণত হয়ে যাওয়া। তাতে মানুষ থেকে হনুমান বনে গেলেও মঙ্গল। আত্মরক্ষার সেটিই শেষ উপায়। অন্তত পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে না। সরকারী গারদের বাইরে মুক্ত আকাশের নীচে ঘোরাফেরা করা যাবে। গোটা দেশটাই যে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির ক্ষমতায় আস্ত একটি জেলখানায় পরিণত হয়ে গিয়েছে। সেই সোজা কথাটি বুঝে মনঃকষ্টও পেতে হবে না। যদি বিসর্জন দেওয়া যায় মনুষ্যত্ব।

২৯শে অক্টোবর ‘২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.