সম্প্রতি একটি ইংরাজি সংবাদ চ্যানেলের সম্পাদক গ্রেপ্তার হয়েছেন মুম্বাই পুলিশের হাতে । তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন একটি অপরাধমূলক কাজের জন্য । কোন কোন মহল এই গ্রেপ্তারকে সাংবাদিক-স্বাধীনতার ওপর আঘাত বলে হৈচৈ করছেন । যদিও তাঁর গ্রেপ্তারির কারণ আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া ।ভারতে সংবাদপত্রের বা সাংবাদিক-স্বাধীনতার হার কোন তলানিতে পৌছেছে তা আমরা অবহিত ।সাংবাদিকদের কূকীর্তিও এদেশে কম নয় । আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে এই বাংলার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়ে জেলের ভাত খেয়ে এসেছেন । আবার সাম্প্রতিক অতীতে উগ্র অসহিষ্ণু ধর্মীয় প্রচারকদের হাতে খুন হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরালে কিংবা রাষ্ট্রের নির্যাতন সহ্য করেছেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক ।দিল্লিস্থিত ‘রাইটস এন্ড রিস্ক এনালিসিস গ্রুপ’এর হিসাব অনুযায়ী ২৫শে মার্চ থেকে ৩১শে মের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার ত্রুটিগুলি তুলে ধরার কারণে ৫৫জন সাংবাদিককে হয় গ্রেপ্তার করা হয়েছে নতুবা এফ আই আর করা হয়েছে, সমন ধরানো হয়েছে, শোকজ করা হয়েছে, শারীরিকভাবে হেনস্থা করা হয়েছে এবং হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে । এমনকি জাতীয় নিরাপত্তা আইনে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন সাংবাদিক জেলবন্দী রয়েছেন ।
রাষ্ট্র সর্বকালেই সংবাদমাধ্যমকে তার তাঁবে রাখতে চায়। তার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ লড়াইয়ের ঐতিহ্য আছে এদেশেও ।ঔপনিবেশিক শাসনে ১৮১৮তে দেশীয় ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশনার পাঁচ বছরের মধ্যেই ইংরাজ শাসক মুদ্রাযন্ত্র বিষয়ক নতুন আইন প্রবর্তন করেছিল, যাতে বলা হয়েছিল প্রকাশের পূর্বে লেখার অনুমোদন নিতে হবে ।ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন ফার্সি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল- আখবর’ পত্রিকা প্রকাশ করতেন ।সংবাদপত্রের এই কন্ঠরোধ আইনের প্রতিবাদে মিরাৎ-উল-আখবরের প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন । পত্রিকার শেষ সংখ্যায় প্রতিবাদি সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন ‘যে সম্মান হৃদয়ের শত রক্তবিন্দুর বিনিময়ে ক্রীত, ওহে মহাশয় তাহাকে দারোয়ানের নিকট বিক্রয় করিও না’ ।শুধু এটুকুই নয়, রামমোহন সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের কাছে এবং রাজা চতুর্থ জর্জের কাছেও মেমোরান্ডাম পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐহাসিক দলিল ।১৮২৫এ এই কালো আইন রদ হয় । কিন্তু ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে । স্বাধীন ভারতে ১৯৭৫এর ২৬শে জুন সরকার আভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ বা প্রেস সেন্সর আইন জারি করেছিল ।অর্থাৎ রাষ্ট্র যুগে যুগে একই প্রক্রিয়ায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে ।
সংবাদমাধ্যমে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ । তো গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ এবং অন্য তিনটি স্তম্ভের পলেস্তারা কতটা খসে পড়েছে তা মানুষ তার নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই বুঝতে পারছে । ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রীডম ইন্ডেক্স অনুযায়ী ১৮০ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১৩৬ নম্বরে ।সংশয় নেই যে সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস ও আস্থায় বড় রকমের ফাটল ধরেছে গত পঞ্চাশ বছরে, আর সেই ফাটল আরো চওড়া হয়েছে নব্বইয়ের দশক থেকে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের আবির্ভাবের পর থেকে । স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে সংবাদপত্রে গৌরব জনক ভুমিকা ছিল । এই পর্বে সংবাদপত্র সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রবাদপ্রতীম হয়ে আছেন । পঞ্চাশ ও ষাট দশক জুড়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি হচ্ছিল যার জন্য তখনকার সংবাদপত্রের সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রতিবেদন ও নির্ভিক সম্পাদকীয় জনমত গঠনে সহায়তা করেছিল । সংবাদপত্রে সম্পাদকের স্বাধীনতার ওপর সংবাদপত্র মালিকরা দখলদারি করার সাহস পায়নি । বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা ‘যখন সংপাদক ছিলাম’ গ্রন্থে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন । স্বাধীনতার পর বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি প্রফুল্লকুমার ঘোষ । এক মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীর তেলকলে ভেজাল ধরা পড়ায় তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেন । এহেন মুখ্যমন্ত্রীকে সরানোর জন্য চাপ আসে । স্ব্যং গান্ধিজির মারফত অনুরোধ আসে একজন মারোয়াড়ী প্রতিনিধিকে মন্ত্রীসভায় নেবার জন্য । প্রফুল্ল ঘোষ সম্মত না হওয়ার তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্ব চলে যায় । মুখ্যমন্ত্রী হন বিধানচন্দ্র রায় । বিবেকাবন্দ মুখোপাধ্যায় যুগান্তরে সম্পাদকীয় লেখেন ‘উপরতলার চক্রান্ত’ শিরোনামে । সম্পাদকীয়টি পড়ে বিধানচন্দ্র বিবেকানন্দ বাবুকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন যুগান্তর কে দেখাশোনা করেন ? তাঁদের কথোপকথনের অংশটি এইরকম “আমি বললুম, কেন, আমি যতক্ষণ সম্পাদক পদে আছি, ততক্ষণ আমিই দেখাশোনা করি । ডা রায় যেন কিছুটা কর্কশ কন্ঠে বললেন - ও কথা ছেড়ে দাও, অনেক সম্পাদক দেখেছি’ । আমি আহত কন্ঠে কিছু ঝাঁঝালো সুরে জবাব দিলুম – ‘আপনি অনেক সম্পাদক দেখে থাকতে পারেন, কিন্তু আপনি বিবেকানন্দ মুখুজ্জেকে দেখেননি... দেখুন ডা রায়,আমি যখন রোগী হয়ে আপনার কাছে যাব। তখন আপনার কথা নিশ্চয়ই শিরোধার্য করব... আপনি কথা বলছেন যুগান্তর সম্পর্কে, যুগান্তর সম্পাদকের সঙ্গে, অতয়েব সে ভাবেই আপনার কথা বলা উচিত” । তো এমনই নির্ভিক ছিলেন তখনকার সংবাদপত্র সম্পাদক । আর এখন আর্থিক দুর্নীতি ও লুটের ভাগ নেওয়ার দায়ে জেলে যাচ্ছেন সংবাদপত্রে সম্পাদকরা ! গা ঘিনঘিন করবে না ?
‘হৃদয়ের শত রক্তবিন্দু দিয়ে যা কেনা হয়েছে তাকে দারোয়ানের কাছে বিক্রি করো না’ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রথম প্রবক্তা রামমোহন রায় একথা বলতে পেরেছিলেন। তারপর হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় থেকে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত বহু মানুষ মেরুদন্ড ঋজু রেখে কাজ করে গেছেন। এখন হলুদ সাংবাদিকতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে মূল ধারার সংবাদ মাধ্যম ।
হলুদ সাংবাদিকতার উদ্ভব আঠেরো শতকের নব্বইয়ের দশকে আমেরিকায় । স্বাধীনতার আগে তো বটেই স্বাধীনতার পরে অন্তত ষাটের দশক পর্যন্ত এদেশে হলুদ সাংবাদিকতা গেড়ে বসতে পারেনি । হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম হয়েছিল আমেরিকায় দুটি সংবাদপত্রের অসুস্থ্য ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতিতে । জোসেফ পুলিৎজার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশ্বখ্যাত, আবার হলুদ সাংবাদিকতার জনক হিসাবে কুখ্যাতও বটে ।১৮৯৫তে পুলিৎজারের ‘নিউ ইয়র্ক ওইয়ার্ল্ড’ আর রুড্লফ হার্স্টের ‘নিউ ইয়র্ক জার্নাল’এর ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় অর্ধসত্য ও অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কদর্য প্রতিযোগিতা চলেছিল । দুটি পত্রিকার প্রচার সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল । অতঃপর সাংবাদিকতার এই ধরনটিই আমেরিকার সাংবাদিকতার মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছিল । একটি বৃটিশ পত্রিকা ১৮৯৮এ মন্তব্য করেছিল “অল আমেরিকান জার্নালিসম ইস নট ইওলো, দো অল স্ট্রিক্ট আপটুডেট ইওলো জার্নালিসম ইস আমেরিকান”। হলুদ সাংবাদিকতার কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য : নজর কাড়া শিরোনাম, ভিত্তিহীন কিংবা অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশন, সাধারণ হটনার অতিরঞ্জন এবং অনাবশ্যক সেনসেসনালাইজ করা, তথাকথিত বিশেষজ্ঞ সাহিত্যিকদের দিয়ে অবৈজ্ঞানিক ও সুকৌশলে কূশিক্ষামূলক লেখার প্রকাশ, আর্থিক দুর্নীতি কিংবা যৌন কেলেঙ্কারীর অতিরঞ্জিত প্রকাশ ইত্যাদি । এখন সংবাদপত্রগুলির বা টেলিভিশনের সংবাদ চ্যানেলগুলির মালিক ও সাংবাদিকদের সাংবাদিকতার জীবনবেদ এই হলুদসাংবাদিকতা ।বলেছি, সাংবাদিকতার এই ধরনটি এদেশের সংবাদপত্রগুলি রপ্ত করা শুরু করলো গত শতকের ষাটের দশক থেকে ।প্রবীন সংবাদপত্র পাঠকদের নিশ্চিতভাবেই মনে থাকবে বৃটিশ পার্লামেন্টের মন্ত্রী জন প্রফুমো ও মডের ক্রিষ্টিন কিলারের যৌন কেলেঙ্কারীর ঘটনা যার জেরে হ্যারল্ড ম্যাকমিলানের সররকারের পতন ঘটেছিল ১৯৬৩তে ।মনে পড়বে, তখন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা কৃষ্টিন কিলার- প্রফুমোর যৌন কেলেঙ্কারী নিয়ে রসালো ধারাবাহিক রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ করেছিল কাগজের কাটতি বাড়াতে ।সেই শুরু, তারপর রসালো গল্পতো জলভাত হয়ে গেলো, মূল্যবোধের সাংবাদিকতা বলে আর কিছু রইলো না ।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সম্পাদকের স্বাধীনতা খর্ব করা শুরু হল, সংবাদপত্র মালিকরাই সম্পাদক হয়ে গেলেন । ১৯৬২তে ভারত-চিন সীমান্ত যুদ্ধের প্রেক্ষিতে যুগান্তরে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখার জন্য বরখাস্ত হয়ে যান । বিভিন্ন সংবাদ পত্রে মালিকরাই সম্পাদক হয়ে যান । হলুদ সাংবাদিকতাও জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। তথাপি, সংবাদ মাধ্যমের ভুমিকা আজকের মত এতো কদর্য হয়ে ওঠেনি । ১৯৭৫এ জরুরী অবস্থা জারি করে অন্য মতের বহু মানুষ কারাবন্দি হন, মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করা হয় কন্ঠনালি তাক করা বন্দুকের নলের সামনে । সাতাত্তরে জরুরী অবস্থার অবসানের পর কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই । বৃহৎ পুজি নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র কখনোই সংবাদ পরিবেশনে নিরপেক্ষ থাকতে পারে না সত্য কিন্তু আজকের মত এমন উলঙ্গ হয়ে ওঠেনি, সংবাদ মাধ্যমের প্রতি মানুষের এমন ঘৃণাও জন্মায়নি । মধ্য আশি থেকে বিশ্বায়ন নামক শব্দবন্ধের আড়ালে বাজার অর্থনীতির প্রয়োগ শুরু হল আর এই প্রক্রিয়াতে সংবাদমাধ্যমগুলি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে গেল । ‘তাই সব শিয়ালের এক রা’ । একই উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ সব কটি সংবাদপত্রে প্রায় একই ভাষায় পরিবেশিত হয় । টেলিভিশন চ্যানেল এসে যাওয়াতে সংবাদমাধ্যম এখন আরো বেশি উলঙ্গ বিভ্রান্তি ছড়ানোর লক্ষ্যে । মানুষের দৈনন্দিন যাপনের কথা, পীড়িত মানুষে আশা আকাঙ্খার কথা তারা ভুলেও প্রচার করে না । দুর্গাপূজার সময় প্রায় এক সপ্তাহ জুড়ে প্যান্ডালের জাঁকজমক আর যুবক-যুবতীদের সাজ পোষাক ভিন্ন আর কিছু যেন দেশে নেই বাংলায় নির্বাচন এখনো ছমাস দেরি । অথচ সংবাদের সিংহ ভাগ ভোটযুদ্ধ কেন্দ্রীক, আর কোন খবর নেই ।বৈদ্যুতিন মাধ্যমের অনুষ্ঠানগুলি দেখুন যেন একাধিক হুলো বেড়ালের লড়াই পর্দা জুড়ে । আর কোন সংবাদ নেই এতো বড় দেশে ।ও,
সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ হতে পারে না ঠিকই, এখনকার সংবাদমাধ্যম সংবাদ বিকৃত করে । ‘পেইড নিউজ’ পরিবেশন করে, আমরা জানি ।কোটি কোটি তাকার বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে বিভ্রান্তি ও উদ্দেশ্যমূলক খবর প্রকাশ করে এটা আর সংবাদপত্র পাঠকের কাছে অজানা নয় ।
সংবাদপত্র মালিক দের নির্দেশে সংবাদ তৈরি করার ভুরিভুরি নজির আছে । তখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ডাকঘরের মাধ্যমে স্কুলে আসতো । বামফ্রন্ট সকারকে বদনাম করতে একবার একটি সংবাদপত্রের জনৈক সাংবাদিক পোষ্টম্যানকে কিছু টাকা দিয়ে প্যাকেট থেকে একটা প্রশ্নপত্র বের করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংবাদ করেছিল । আরো একটা ঘটনার কথা বলি, বছর ১৬/১৭ বছর আগেরকথা, মেদিনীপুরের গোঘাট এলাকায় ঘুর্ণি ঝড়ের দাপট বোঝাতে একটি ছবি ছাপিয়েছিল আনন্দবাজার এটা বোঝাতে যে সাইক্লোনের এমন তীব্রতা ছিল যে একটা গরুকে ছিটকে গাছের ওপর তুলে দিয়েছে, তারই ছবি । দুদিন পরে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ আসল সত্যটা ফাঁস করে দিয়ে জানিয়েছিল যে দুজন গ্রামীণ লোককে পাঁচশো টাকা দিয়ে মৃত গরুটিকে গাছে তোলা হয়েছিল ।বিকৃত ও অর্ধসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ বিকৃতির আর একটা নমুনা দিই । বানতলায় নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনায় তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা (সংবাদপত্রে ভাষায় ‘বাইট’)। জ্যোতি বসু ইংরাজিতে উত্তর দিয়েছিলেন ‘ইয়েস দিস হ্যাপেনস’ বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘হ্যা, এরকম ঘটে’। পরের দিন সংবাদ শিরোনাম হল জ্যোতি বসু বলেছেন ‘এমন তো কতই হয়’ ।না বলা ‘কতই’ শব্দটা জুড়ে দিয়েছিলেন সাংবাদিক প্রবর। সংবাদমাধ্যম সংবাদ বিকৃত করে, অসত্য অর্ধ সত্য সংবাদ প্রকাশ করে এইসব আমাদের জানা । কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার সংবাদ ‘ব্ল্যাক আউট’ করা । এমন অনেক সংবাদ যাতে মানুষের স্বার্থ রয়েছে, যে সংবাদ তার জানা দরকার সেগুলিকে প্রচারযোগ্য সংবাদ মনে না করা, প্রচার না করা ।
সংবাদমাধ্যমের প্রতি মানুষের এখন ঘৃণা জন্মাচ্ছে ।মূল ধারার সংবাদপত্রগুলির প্রচার সংখ্যা হু হু করে কমছে, তাদের অনেক সংস্করণ বন্ধ করে দিতে হচ্ছে, সাংবাদিক ও সংবাদপত্র কর্মীদের ছাটাই হচ্ছে তারই জেরে । নিউজপ্রিন্টের কোটা বজায় রাখতে তারা নিজেদের প্রচার সংখ্যা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখায়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলি তাদের টি আর পি নিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নেয় তেমন নজির সম্প্রতি সামনে এসেছে । আসলে সংবাদপত্রে পাঠক বা টেলিভিশনের দর্শকদের কাছে সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার বিন্দুমাত্র অবশেষ আজ আর নেই ।বরং সোশাল মিডিয়া এখন অনেক শক্তিশালী। সংবাদমাধ্যম যেসব সংবাদ ব্ল্যাক আউট করছে সেগুলি্র অনেকটাই জানতে পারছি সোশাল মিডিয়ার দৌলতে । আর সেই কারণেই এদেশের সরকার সোশ্যাল মিডিয়াকেও সরকারী খবরদারীর আওতায় আনতে চাইছে ।
আমরা জানি, সংবাদ মাধ্যম নিরপেক্ষ হতে পারে না কারণ সারা বিশ্বেই সংবাদ মাধ্যম বৃহৎ পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । তারা পক্ষ অবলম্বন করুক, পাঠক এবং দর্শক নিজের মত করে তাদের মতামত তৈরি করে গ্রহণ বা বর্জন করবে । কর্পোরেট মিডিয়া একটি দেশের মানুষের যায়গাগুলিকে, মানুষের ভাষা তার সাংস্কৃতিক ও মানিবিক মূল্যবোধগুলিকে ধসিয়ে দেবার কাজ করে চলে সুকৌশলে । এও এক সন্ত্রাশ – মিডিয়া সন্ত্রাশ । আর মানুষ এই মিডিয়া সন্ত্রাশকে প্রতিহত করতে পারে এবং করবে এই বিশ্বাসটুকু আমাদের রাখতে হবে ।