আমার ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যেত জায়গাটা,বুড়িটা যেখানে কুলো -ডালা নিয়ে বসতো। পাশেরাখত নানান রকম শাকপাতি। কাছের একটা বস্তিতে থাকত বুড়িটা।
দক্ষিণে সেই রায়চক ছাড়িয়ে ওর দেশ। এসব গপ্পো করেছিল আমায়।
সত্যি বলতে কি আমাদের এলাকায় কুলো-ডালা ব্যবহার করার লোক নেই। কাজের মাসীরাও এখন কাজে লাগার আগে জেনে নেয় মশলাবাটা মিক্সিতে না শিলনোড়ায়।
তাও বিয়ে-পৈতে এসব তো মানুষের জীবনে আছে। তখন ওই অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তাদের জায়গা করে নেয় সসম্মানে।
রমেন মানে আমার স্বামীটি এক্কেবারে গ্রামের ছেলে। রোজ পাতেতেনার শাকপাতা না হলে চলে না। গত বছর এই রকম সময়ে কি ভাবে যেন তার মনে সহসা উদয় হলো সজনেফুল ভাজা খাওয়ার কথা। এরকম নীরস লোক আমি দুটো দেখিনি। ফুল দেখে মানুষ কবিতা লেখে, গান গায়। ওর মনে হলো কিনা খাবার কথা! সঙ্গে সঙ্গেই আমার রান্নার দিদিকে আবদার জানানো হলো । দিদিটি আবার মানুষ ভালো। বললো, "এনে দ্যান, ভেজে দেব পোস্ত দিয়ে ভাজা ভাজা করে।"
সেই সন্ধান দিলো। বাজারে পাওয়া যাবে না। তবে ওই বুড়ির কাছে মিলতে পারে। ভোর ভোর না কিনলে লোকে নিয়ে নেবে। সজনেফুলের নাকি খুব ডিম্যান্ড।
আমি মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার সময় দেখলাম বুড়ি সবে পসরা মেলে বসছে। সজনেফুল পেলাম কিন্তু আরো একটা জিনিস চোখে পড়লো। এর আগে দেখেছি কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করিনি। আজ দেখলাম। দেখলাম ওর কুলোগুলো সত্যি দারুণ! নিখুঁত বোনা। বেশি ছিল না ওর কাছে। দুটো কুলো আর তিনটে ডালা।
মাথায় তক্ষুণি একটা প্ল্যান খেলে গেলো।
আমরা এই নতুন ফ্ল্যাটটায় এসেছি বছর দুয়েক। ফ্ল্যাটটা আমি এক্কেবারে নিজের মনের মতকরে সাজিয়েছি। নিউমার্কেট থেকে শান্তিনিকেতন মায় সাউথ ইন্ডিয়া, গোয়া সব জায়গা থেকে বাছা বাছাজিনিসে সাজানো।মাঝে মাঝে আমার নিজের আঁকা পেন্টিং।
খুব বড় আর্টিস্ট না হলেও বড় বড় শিল্পীদের নকল বা আল্পনা বা ফোক আর্ট আমি মন্দ আঁকি না।
ড্রইং রুমের একটা দেওয়াল এখনো একদম ফাঁকা। মেরুন রং সেখানে। কিন্তু কি দিয়ে সাজাবো ভেবে ভেবে অনেক দিনই অশান্তিতে ছিলাম। বুড়ির কুলোগুলো দেখে মাথায় বিদ্যুৎ খেললো।
মেরুনের সাথে কুলোগুলোর ন্যাচারাল রঙের দারুন কন্ট্রাস্ট হবে। দশাবতার আঁকবো। দশটা কুলো লাগবে। এক্কেবারে সমান মাপের।
জিজ্ঞেস করতে বুড়ি বললো দেশে ওর নাতিনিজে এই কুলো বোনে।
"এমনটি তুমি কোত্থাও পাবে নি গ।'’
কথাটা মানলাম ঘাড় নেড়ে। ভালো জিনিস আমি চিনি।
ওকে বললাম আমার দশটা লাগবে। কিন্তু আমি ভাগে ভাগে নেবো। যখন আঁকবো তার আগে নেবো।
"আমি তো রোজ একেনেই বসি। তোমার য্যাখুন দরকার বোলো, আমি এনি দেব।''
তা দিচ্ছিলো ও। একটা একটা দেয় আমি একটা একটা আঁকি। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ,….
ইচ্ছে ছিল নববর্ষের একটা বৈঠক করবো আর তাতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব আমার অভিনব দেওয়াল সাজানো দেখিয়ে। বন্ধুরা কেমন আলোচনার ঝড় তুলবে সেটা নিয়ে ভেবে ভেবে অনেকবার বেশ মানসিক তৃপ্তিও পেয়েছি আর নিজেই নিজের আইডিয়ায় মুগ্ধ হয়েছি।
মার্চমাসের গোড়াতেও একটা কুলো নিলাম। একবার ভাবলাম দুটোই নিয়ে নিই। আর দুটোই তো বাকি! কিন্তু নিতে গিয়ে দেখি আমার আগেরগুলোর সঙ্গে সমান মাপের একটাই পাচ্ছি। এ ঝামেলা আগেও হয়েছে। হাতে বানানো তো, তাই একটু ছোটবড় হয়ই, কিন্তু আমার যে একেবারে নিখুঁত চাই।
বুড়ি বললো এনে দেবে। আমি জানতামও দেবে। তাই খুব মন দিয়ে নয় নম্বর কুলোটা আঁকতে শুরু করলাম। আর প্ল্যান করতে লাগলাম আসন্ন নববর্ষের বৈঠকের।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় এক!
এসে গেলো করোনা। লকডাউন।
আমার তো মাথায় হাত। আর একটা কুলো বাকি! বাকি ন'টা টাঙিয়েছি। একটা জায়গা ফাঁকা। রোজ হা হুতাশ করছি!
আমার কান্ড দেখে রমেন হাসে। আমি আরো রেগে আগুন হই। আবার ভেঙেও পড়ি দুঃখে!
দেয়ালের ফাঁকা জায়গাটা গিলতে আসে যেন।
নববর্ষ একলা বৈশাখ হয়ে কেটে গেলো!
লকডাউনও চলছে চলবে। ঘরে বসা জীবন। কিন্তু কাজ বেড়ে গেছে প্রচুর। বাপের জন্মে এতো কাজ কখনো করিনি। হাড় বেটে গেলো বাসন মেজে, ঘর মুছে আর রান্না করে।
কাজ সেরে যখন ড্রইংরুমে বসি আবার সেই দেওয়ালের ফাঁকা জায়গাটা আমায় কুরে কুরে খায়। লকডাউন কবে উঠবে তার দিন গুনি।
কথায় বলে না "গোদের ওপর বিষফোঁড়া "!
করোনার সঙ্গে এলো "আমফান "!
বাপরে বাপ্! কি দাপট! সামনে থেকে মৃত্যুর হুঙ্কার আগে কক্ষনো দেখিনি। রমেনকে শক্ত হাতে ধরে বসে ছিলাম! ঝড়ের কি আওয়াজ! রমেনের অনেক অভিজ্ঞতা! অনেক ঝড় বন্যা নাকি সে দেখেছে! হতে পারে! গ্রামের ছেলে তো! সে সব অবশ্য বিয়ের আগে!
সকাল হতে বারান্দায় গিয়ে কান্না এসে গেলো! সত্যি! কি তাণ্ডব লীলা! কারেন্ট নেই! তবে জেনারেটর চলছে। কিন্তু
জল খরচ মাপা! কি যে হবে! আজ আমার আবার শ্যাম্পু করার দিন! সাতপাঁচ ভাবছি। তারপর ভাবলাম ফেসবুকে এইবেলা একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দিই যে আমরা সেফ। নাগরিক হিসেবে এটা তো আমার নৈতিক দায়িত্ব।
টুং টুং আওয়াজ! হোয়াটস্যাপে! তাকিয়ে দেখি আমার বন্ধু রাজীব। কাছেই থাকে। রাজীব একটা নামকরা দৈনিক কাগজের ফটোগ্রাফার।
তলায় লেখা!
‘ছবিগুলো দ্যাখ! ৫ নম্বরটা বিশেষ করে। ওটা ভাইরাল হবে!’
ধ্বংসের ছবি! ভাঙা গাছ! চ্যাপ্টা গাড়ি! তোবড়ানো মিনিবাস! ছেঁড়া তার!
আরে! এ কার ছবি! এতো সেই বুড়িটা! গাছচাপা! বুকের কাছে হাতে ধরা একটা ছোট্ট কুকুর ছানা!
আমার মাথা ভনভন করছিল।
সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম রাজীবকে! জানলুম সত্যিটা!
হ্যাঁ, আমার ওই কুলোওয়ালী বুড়িটাই! ওই বস্তিতেই কভার করতে গেছিলো রাজীব! লোকে দেখেছে বুড়িটা কি ভাবে কুকুরছানাটাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে চাপা পড়লো। একটুখানি বেঁচে ছিল। কিন্তু মুখে তৃপ্তির ছাপ! ছবিটা অবশ্য রাজীবের তোলা নয়। বস্তিরই কারুর! সে দেখাতে রাজীব চেয়ে নিয়েছে ছবিটা।
তবে বুড়ির বডি এখনো পড়ে আছে, কুকুরছানাটা সরে গেছে। সেই ছবিও আবার রাজীব তুলেছে!
ভালো করে কভারেজ করবে।
“কি ক্যাপশন দেব বলতো?”
রাজীবের প্রশ্ন!
"জীবে প্রেম করে যেইজন?’ নাকি?”
আমি ফোনটা কেটে দিলাম! কান্না চাপতে পারছিলাম না!
বারে বারে কল্কি অবতারের ফাঁকা জায়গাটায় চোখ পড়ছিলো আর আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো! সঙ্গে ভীষণ রাগও হচ্ছিলো! কে বলেছিলো বুড়িটাকে এতো দয়ার অবতার হতে! প্রতিবার কুলো কেনার সময় দুটো করে টাকা আলাদা করে কি দিই নি আমি "চা খেয়ো" বলে? আবার দিতাম। ভেবেও রেখেছিলাম দশটা কুলো আঁকা হয়ে গেলে বুড়িকে ছবি তুলে দেখিয়ে আসবো আর সাথে একটা পুরোনো কাপড়ও দেব! বেঁচে থাকলে তো পেতিস এসব!
তা নয়! নিজে মরলো আর আমার এতোদিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নকেও একেবারে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করলো!
সুচিন্তিত মতামত দিন