■ তৃষ্ণা বসাক | হোর্ডিংএ আটকে গেছে মেয়ে

■ তৃষ্ণা বসাক | হোর্ডিংএ আটকে গেছে মেয়ে


‘এই ধাবমান শহরে তুমি এক পথচলতি বিনোদন হয়ে চৌকো হোর্ডিং-এ ঢুকেছ। আর কি বেরোতে পারবে? আর কি বেরোন যায়?

(ব্রত চক্রবর্তী)


বোঝা যায় না, সবসময় বোঝা যায় না কীসের বিজ্ঞাপন, সুটকেস থেকে পুরুষের অন্তর্বাস, ট্রাক্টর থেকে ট্রাঞ্জিসটর-আসলে এদের কোনটাই পণ্য নয়। তেমন, ততটা পণ্য নয়, যেমন, যতটা পণ্য ওই মহার্ঘ্য নারীশরীর, ওই হোর্ডিং-এ আটকে যাওয়া মেয়েটা, মেয়েরা। ই এম বাইপাস দিয়ে দুরন্ত গতিতে যেতে যেতে যাকে থমকে দেখে গাড়ির আরোহী ও চালক, আড়চোখে কামনা করে সব পথচারী, স্কুলফেরত কিশোর ছুঁড়ে দ্যায় চুম্বন। ওদের জন্যে কবির মন খারাপ হয়, অসহায়, ক্ষিপ্ত কবি ভাবেন কেমন করে বাঁচাবেন ওই চৌকো হোর্ডিং এবং হোর্ডিংহীন অদৃশ্য চতুষ্কোণে আটকে যাওয়া মেয়েদের? কিন্তু মেয়েটা কি বোঝে? লাস্যে বাঁকানো ধনুকশরীর নিয়ে যেকোন দিকেই ছুটে যেতে তৈরি সে। আর ছুটতে ছুটতেই মুছে যাচ্ছে সদর-অন্দর, নৈতিক-অনৈতিকের সীমারেখা। 

মজার ব্যাপার হল, মেয়েটা ছুটছে না, সে এক জায়গায় অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে, তাকে মাথায় নিয়ে ছুটছে খ্যাপা সময়, যার দাবী মিটে গেলে মেয়েটিকে ছুঁড়ে ফেলা হবে অসীম শূন্যতায়। তখনও হাসি-হাসি মুখে যৌনতার বিকিরণ ছড়িয়ে চলবে মেয়েটা, শুধু সময়ের কৃষ্ণগহ্বর তার সব বিকিরণ শুষে নেবে, বাইরে ছড়িয়ে পড়তে দেবে না।

কিন্তু তা বলে খেলা থামবে না, কারণ মার্জারসরণি দিয়ে হেঁটে চলেছে অন্তহীন মেয়েদের সারি, স্তন আর নাভির সম্ভার নিয়ে, আর তাদের ওই হাঁটা নকল করে যাচ্ছে নতুনতর মেয়েরা। আরও যত্নে মাজা ত্বক, আরও ধনুকের মতো বাঁকা ভুরু নিয়ে চটপট উঠে আসছে তারা, লক্ষ্য যেন তেন প্রকারেণ ওই হোর্ডিং -এ ঢুকে পড়া।

সেদিন এমনি এক হোর্ডিং-এ চোখ আটকে গেল। গ্লোসাইনে ঝলমল করছে এক পানপাত্র, দামী কোন সুরা নাকি সোডাওয়াটারের বিজ্ঞাপন সেটা? ভাল করে তাকাতে বোঝা গেল, ওটা আদপে পানপাত্রই নয়, গ্লাস-আওয়ার ফিগারের নিখুঁত একটি নারীশরীর, যার কটিদেশকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে পানপাত্র ধরার জায়গাটুকুর সঙ্গে। ঠিক বোঝা গেল না, নারী কি ওই ঠুনকো পানপাত্র, যে অভিজ্ঞতা ধরা আছে লোকায়ত গানে ‘বাবুরা মদ খাইলি, ভাঁড় ভাঙ্গিলি, পয়সা দিলি না’ নাকি সে ওই পাত্রের অন্তর্গত সুরা, যার উত্তেজক ক্ষমতাকে সহজে ব্যবহার করে ফেলা যায় পণ্যের বিক্রি বাড়াতে?
হোর্ডিং-এ বন্দি ওই মেয়েটিকে যারা ভোগ করতে পারল না, শুধু চোখ দিয়ে লেহন করেই ক্ষান্ত থাকতে হল যাদের, সেই অচরিতার্থ কামই কি ধর্ষণের মুখ্য চালিকাশক্তি? 
এরকম একটা থিওরি খাড়া করতে গেলে তেড়ে আসবেন অনেকেই, ধর্ষণের অনেক অনেক সমাজতাত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, ধর্ষণই যে মেয়েদের জীবনের চরম বিপর্যয় নয় এমন স্বস্তিবচনও শোনা যাবে। কিন্তু পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে নিরন্তর ধ্বস্ত, পিষ্ট হতে হচ্ছে যাদের, ধান ক্ষেতে ক্ষতবিক্ষত পড়ে থাকতে থাকতে তারা যে একবারও অভিমানে তাকাবে না হোর্ডিং -এর ওই মেয়েটার দিকে, তা কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়?

সেই তরুণী মায়ের কথাটা কানে বাজে এখনো। প্রথমে মনে হয়েছিল নিউরোসিসের রুগী। মরণাপন্ন মানুষের খড়কুটো ধরার মতো করে হাত আঁকড়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় সেই চাকুরে মা বলেছিল ‘দিনের শেষে বাড়ি ফিরে শুধু দেখতে চাই ও বেঁচে আছে, আজকের মতো নিরাপদে বাড়ি ফিরেছে, কিন্তু কাল?’ সেই তরুণী তিন বছরের, হ্যাঁ ভুল শুনছেন না, তিন বছরের এক শিশুকন্যার মা। বাচ্চাটি সদ্য স্কুলে ভরতি হয়েছে। শুধু দুর্ঘটনা নয়, মায়ের মনে সদা ক্রিয়াশীল শিশুকন্যার ধর্ষিত হবার ভয়। স্কুলের দারোয়ান, গাড়ির ড্রাইভার, এমনকি বাবাও বাদ নেই সম্ভাব্য ধর্ষকের তালিকা থেকে। এই ভয় চারিয়ে যায় চারপাশে। হয়তো এই ভয় গিলতে গিলতে আমরা মেয়েকে সুন্দরীতমা করে তোলার সাধনায় মাতব, আমাদের সাধ হবে আকাশছোঁয়া হোর্ডিং- এ মেয়েকে দেখার। এটা তো ঠিক, হোর্ডিং -এর মেয়েটিকে যতই লোভার্ত চুম্বন ছুঁড়ুক পথচারী, সেই চুম্বন কখনোই ছোঁয় না মেয়েটিকে, অনাঘ্রাত যৌনাভাস নিয়ে হোর্ডিং- এ আটকে থাকে মেয়ে, বেরোতে পারে না, বেরোতে চায়ও না।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.