না, তিনি আর নাই। এই সেদিনও তিনি আমাদের মধ্যে ছিলেন। বেঁচে বর্ত্তে সক্রিয় অধ্যাবসায়। মাত্র পঁচাশী বছর বয়সে অকালে ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের। অপুরণীয় ক্ষতি নিয়ে বঙ্গসংস্কৃতি দাঁড়িয়ে পড়লো আচমকা হঠাৎ। কোন প্রস্তুতি ছিল কি আমাদের? কোন প্রস্তুতি থাকার দরকার আছে বলেও কি মনে করি আমরা? কতটা ক্ষতি হলো বাংলার। কতটা ক্ষতি হলো বাঙালির? আসলে এগুলি সবই অবান্তর এবং অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। মানুষ মরণশীল। জন্মিলে মরিতে হবে। অমর কে কোথা রবে। না নশ্বর দেহ নিয়ে কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে শিল্প ও সাধনা আদর্শ ও কর্ম নিয়ে। আমরা কেউই বেঁচে থাকবো না। আমাদের কোন পূর্বসুরীও বেঁচে থাকতে পারেন নি। পারবে না কোন উত্তরসুরীও। কিন্তু যে কর্ম ও সাধনা শিল্প ও আদর্শের জন্য জনপ্রিয় অভিনেতা কবি আবৃত্তিকার নাট্যনির্দেশক সমাজকর্মী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচিতি। সেই শিল্প ও সাধনা কর্ম ও আদর্শের অকাল প্রয়াণ হবে নাতো? বাঙালি কতদিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ধারণ করে থাকবে?
অনেকের কাছেই এমন প্রশ্নের কোন অর্থ হয় না। অনেকেই বিশ্বাস করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে তাঁর যে অবদান। তার আবেদন বহুদিন ব্যাপী আগামী বহু প্রজন্মের বাঙালিকে পথনির্দেশ দিয়ে যাবে। খুব ভালো কথা। তেমনটিই তো হওয়ার কথা। এক একজন মানুষ তাঁর কর্ম ও সাধনায় জীবন ও শিল্পে আদর্শ ও ব্যক্তিত্বে সমগ্র জাতিকে সমৃদ্ধ করে দিয়ে যাওয়ার মতোন শক্তি ও সামর্থ্য রাখেন। সেই সব মানুষকেই আমরা মহাপুরুষ বলে বরণ করে নিই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই শ্রেণীর একজন ব্যক্তিত্ব। প্রশ্ন সেখানে নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন মহীরুহের অবদান নিয়েও আশা করা যেতেই পারে সমাজে কোন বিতর্কে অবকাশ নাই। প্রশ্ন অন্যখানে। প্রশ্ন হলো আজকের বাংলায় এবং বাঙালির সমাজে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা ঠিক কতটুকু? যে মানুষটি সারা জীবনভর বঙ্গসংস্কৃতির সেবা করে গেলেন। দুই হাত ভরে উজার করে নিজের শেষ অর্জনটুকু অব্দি বাংলা ও বাঙালিকে দিয়ে গেলেন। সেই মানুষটিকে বাংলার সমাজ কতটুকু গ্রহণ করেছে?
খুব স্বাভাবিক, এমন প্রশ্নে অনেক শিক্ষিত বাঙালিই ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত বোধ করতেই পারেন। বাংলার সমাজ কি এমনই অকৃতজ্ঞ! যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদানকেও বিস্মরণের বেদীতে সমর্পণ করে দেবে? তাই আবার হয় নাকি? নিশ্চয় নয়। আরও বহুদিন বাঙালি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা দেখবে নিশ্চয়। অকর্মণ্য আলস্যের অবসরে। সৌমিত্র অভিনীত নাটক নিয়েও বিদগ্ধ জনেরা আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাবেন। কেউ কেউ নামের আগে ডক্টরেট বসাতে টানাটানি করবেন সৌমিত্রের অভিনয় লেখালেখি ইত্যাদি নিয়েও। সৌমিত্র পুরস্কারও আমদানী করা হবে নিশ্চয়। সৌমিত্র পুরস্কারে ভূষিতরা সমাজে মান্যগণ্য হিসাবে স্বীকৃতও হবেন বছর বছর। সৌমিত্রসদনও দুই একটি গড়ে উঠবে নিশ্চয়। অভিনেতার নামে রাস্তাঘাট ইত্যাদি। অভিনয় শেখানোর প্রতিষ্ঠানও খোলাটোলা হবে বইকি। ফলে বাংলার সমাজ সংস্কৃতির অঙ্গনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম আরও নানাবর্ণে বিকশিত হতে থাকবে। এমনটা আশা করা যেতেই পারে। এমনকি ভোটের রাজনীতিতেও চিরকালের বামপন্থী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষে বিপক্ষে শ্রদ্ধা অশ্রদ্ধাও জ্ঞাপন করা হবে নিশ্চয়। ফলে এটা বলাই যায়। যাই হোক না কেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ভুলে যাওয়া বাঙালির পক্ষে খুব সহজ কাজ হবে না নিশ্চয়। অনেকেই পেশাগত গরজে এই মানুষটিকে দুইবেলা জপতে আদাজল খেয়ে লেগে যেতে পারেন।
কিন্তু এর বাইরে? এর বাইরে সৌমিত্রের পরিচিতি কারুর কাছে অপু। অনেক বেশিজনের কাছে ফেলুদা। দুই একজন উঠতি কবি’র কাছে কবি। এবং অভিনয়ের হাতেখড়ি নিতে আসা অনেকের কাছেই অভিনেতা সৌমিত্র। যদিও একবিংশ শতকের অভিনয় ধারায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কতজন অনুসরণ যোগ্য মনে করবেন। সেটি কিন্তু আগামী সময়ই বলতে পারবে। বাংলা সিনেমা নাটকের অভিনয়ের জগতে সৌমিত্র-ধারা বলে এখনো কোন অভিনয়রীতি চালু হয়েছে বলে শোনা যায় না কিন্তু। ভবিষ্যতে হবে এমনটা মনে করারও যে বিশেষ কোন কারণ রয়েছে, তাও নয়। ফলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখনই আর্কাইভাল ভ্যালুতে আটকিয়ে গিয়েছেন বলে দিলে, খুব একটা ভুল বলা হবে না মনে হয়। হ্যাঁ স্মৃতিমেদুর বাঙালির মননে সৌমিত্রের সিংহাসন পাকা। সেই সৌমিত্র অপুই হোক আর ফেলুদা। চারুলতা কিংবা ঘরেবাইরের সৌমিত্রই হোক আর শতশত ছায়াছবির প্রধান মুখই হোক। বাংলা সিনেমার ইতিহাস এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে লেখার কোন উপায় রেখে যান নি সৌমিত্র। এমনকি বাংলা নাটকের ইতিহাসেও তাঁর আসন পাকা।
কিন্তু বাংলা সিনেমা নাটকের বর্তমান ও ভবিষ্যতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। সময়ই বলতে পারবে সেকথা। আগে থেকে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল হলেও। একথা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বাঙালি বিংশ শতকের সীমাতেই আটকিয়ে রাখতে পছন্দ করবে বেশি। সেটি সৌমিত্রের খামতি নয়। খামতি আজকের বাঙালির। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনেক কিছুর মধ্যে দিয়েই একটা ঘরনা। সেই ঘরনাকে বাংলার সমাজ বহু আগেই ডিঙিয়ে চলে এসেছে। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সাম্যবাদী সংস্কৃতমনস্ক সমাজ সচেতন বাঙালি মানসের হয়তো সর্বশেষ জনপ্রিয়তম প্রতিনিধি চলে গেলেন এবার। এই যে একটা মহা শূন্যস্থানের সৃষ্টি হলো। না, সেই ফাঁক ভরাট করার মতো এমন কোন লক্ষ্মণ আমাদের হাতে আজকে মজুত নাই। যার উপরে ভরসা করে বলা যায়, হবে হবে এও পুরণ হয়ে যাবে। ফাঁকা পড়ে থাকে না কিছুই।
সৌমিত্র ঘরানার এখনও যাঁরা টিম টিম করে আয়ুর কোঠায় কালাতিপাত করছেন। জনপ্রিয়তায় তাঁরা হয়তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থেকে অনেক পিছিয়ে। কিন্তু কর্ম ও সাধনায় শিল্প ও জীবনে আদর্শ ও ব্যক্তিত্বে যাঁরা সৌমিত্রর থেকে কোন অংশে কম নন। তাঁদের প্রভাবও বাংলার সমাজ ও জীবনে সংস্কৃতি ও মানসে বিশেষ আর অবশিষ্ট নাই। ফলে এঁদের সাথেই একটা শতাব্দীর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে আমাদের। বিংশ শতাব্দীর সকল অর্জন নিয়ে বাংলা ও বাঙালির একটা ঘরনা আমাদের চোখের সামনে দিয়ে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে। না। বাঙালির তাতে সত্যিই কিছু এসে যাচ্ছে না। একবিংশ শতকের নতুন যে আদর্শকে আপামর বাঙালি মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছে, এক কথায় তাকে অনুপম ভাষায় রূপ দিয়েছেন গায়ক অনুপম। “আমাকে আমার মতো থাকতে দাও আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি”। সত্যই তাই একবিংশ শতকের মূল্যবোধ আদর্শ ও লক্ষ্যের অনুপম বর্ণনা। অনুপম ভাষ্য। না, এর বাইরে পা রাখতে আমরা আর রাজি নই। কোনমতেই নই। আর সেইখানেই বিংশ শতকের শেষ ঘরনা থেকেও বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছি আমরা আমাদেরকে। ফলে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর এই শতকের বাংলার আইকনিক ফিগার নন। এবং তিনি ও তাঁর ঘরনা বাংলার যে সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি স্বরূপ। সেই ঘরনাও অপসৃত আজ শতাব্দীর মৃত্যুর সাথেই।
যে শতাব্দীর মৃত্যুই হয়ে গিয়েছে আমাদের মধ্যে। সৌমিত্র সেই শতকেরই এক অনন্য মহীরুহ। এক অনুপম প্রতিষ্ঠান। তার প্রাসঙ্গিকতা আজকে বঙ্গসংস্কৃতির আর্কাইভাল ভ্যালুর বাইরে নয় আর। তাই সৌমিত্র ও তাঁর ঘরনা আজ নস্টালজিক অনুভুতি মাত্র। বাংলার ইতিহাস বইতে খুঁজতে হবে। বাংলার সমাজ আজ এগিয়ে গিয়েছে অনেকদূর। অশীতিপর সৌমিত্রও অনেক দশক আগেই সেই দাঁড়িয়ে গিয়েছেন তাঁর বিংশ শতকীয় ঘরানায়। ঠিক এই কারণেই আজকে যাঁরা সৌমিত্রকে বাংলার আইকন বলে ভাবতে চান। তাঁরা আসলেই স্বকল্পিত জগতে সময়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছেন। বরং যাঁরা আজকে বাংলার আইকন বলে নতুন থেকে নতুনতর মুখ খুজে নিতে পেরেছেন। তাঁরাই সময়ের সাথে চলেছেন তালে তাল মিলিয়ে। তাঁরাই আজ ডহর বাবুর জীবনীর খোঁজ করবেন। বিদ্যাসগরের আবিষ্কার বলে মাইলের তথ্য জেনে নেবেন। সহজপাঠ প্রণেতা বলে বিদ্যাসাগরের নতুন পরিচিতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে ভিড় করবেন গরুর দুধে সোনার খোঁজে। তাঁদের অন্ধ বিশ্বাসে পোশাক দেখে মানুষ চিনতে আর ভুল হবে না কোনদিন। বাংলাকেও রামরাজত্বে সামিল করতে প্রয়োজনে নিজের মুখের ভাষাও বলি দিতে দ্বিধান্বিত নন তাঁরা আজ আর। তাঁরাই নিজেদের গরজে নতুন থেকে নতুনতর আইকন খুঁজে নিচ্ছেন প্রতিদিন। হ্যাঁ এই বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির জন্যেই। বিপুল তাদের সংখ্যা। বিপুল তাঁদের উদ্যোগ। এবং বিপুল তাঁদের ভক্তিরস। ভক্তিরসের সেই মাদকতায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বামপন্থী জীবনবোধের ঘরনা আজ আর কোন ভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক নয় সৌমিত্রর বঙ্গসংস্কৃতির ঘরনাও। একুশ শতকের বাংলা আজ বাঙালিত্বের সীমানা ডিঙিয়ে ক্রমেই হিন্দুস্তানী আইকনে মজে অনেক বেশি হিন্দু হয়ে উঠতে চাইছে। অনেক বেশি পরিমাণে সে নিজস্ব বাঙালিত্বের বৈশিষ্টগুলিকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়ে আরও বেশি করে গোবলয়ের ভারতীয় হয়ে উঠতে বদ্ধপরিকর। না সেই স্বপ্নপুরণের পরিকল্পনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিংশ শতকীয় ঘরনা কোনভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়। তাই শতাব্দীর মৃত্যুর সাথেই বাংলায় সৌমিত্র অধ্যায়েরও পরিসমাপ্তি ঘটে গেল। সৌভাগ্যবান সৌমিত্র। বেঁচে থেকে বাংলার এই পরিণতি দেখে যেতে হবে না আর তাঁকে। আমাদের মতো অভাজনেদের মতো। যাঁরা আজও রয়ে গেলাম। বাংলা ও বাঙালিত্বের নস্টালজিয়ায়।
২০শে নভেম্বর’ ২০২০
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
সুচিন্তিত মতামত দিন