শুভ্র শোভন রায় অর্ক

শুভ্র শোভন রায় অর্ক

নগেন পাল প্রতিমা তৈরী করেন না তাও আজ প্রায় বছর পনেরো। এ অঞ্চলের নামকরা প্রতিমা শিল্পী ছিলেন নগেন বাবু। কোনরকম চাকচিক্য ছাড়াও তার তৈরী প্রতিমা দেখে বাহ্ বাহ্ করেননি এমন লোক পাওয়া কষ্টকর। কিন্তু হঠাৎ করেই কি হলো একদিন, চক্ষুদান করবে মায়ের প্রতিমার এমন সময় চেয়ার থেকে নেমে এসে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন, চোখের পাওয়ারি চশমাটা খুলে ফেলে শূন্য দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেদের জানিয়ে দিলেন তিনি আর কাজ করবেন না প্রতিমার। এবার থেকে সব দ্বায়িত্ব তাদেরই। কেউ জানতে পারেনি হঠাৎ তার কাজ ছেড়ে দেয়ার কারনটা। শত চাপেও তুলিটা ছুঁয়ে দেখেননি কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকে মাঝে মাঝে শিখিয়ে দেন বাকীদের৷ এভাবেই চলছিলো সময়.....।

শেষ ক্লাসের ঘন্টা বাজতেই ছেলেপেলেরা হইহুল্লোর করতে করতে বাড়ির পথে রওনা হয়ে যায়। ঘন্টাটা নামিয়ে, পতাকা নামিয়ে, ঘরগুলোতে তালা মেরে ছোটেলাল বাড়ির দিকে রওনা দেয়। বেশি দূরে না বাড়ি, হেঁটে যেতে বড়জোর মিনিট দশেক। ছোটখাট গড়নের মানুষ ছোটেলাল। জাতে হরিজন সম্প্রদায়ের। এজন্য কাজ পেতেও অনেক সমস্যা। অনেক কষ্টে স্কুলে পিয়নের চাকরীটা জুটিয়েছে জন্য আজ দুমুঠো ভাত কপালে জুটছে। একা সংসার, দুকূলে কেউ নেই। বিয়ে-থা করেনি এখনো। মেয়ে পাওয়াও মুশকিল। ছোটেলাল মানুষটা শান্ত স্বভাবের, নম্র, ভদ্রও। ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রবল। প্রতিটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ছোটেলালকে দেখা যায় একটা কোনায় চুপচাপ বসে থাকতে। তাছাড়া তো উপায়ও নেই। ছোটলাল যে নিচু জাতের। মন্দিরের ঘরে প্রবেশের অধিকার যে সমাজ দেয়নি ওদের। তবুও ভক্তি কমেনি তাতে ছোটেলালের, উৎসবে থাকা চাই....।।

বাসায় পৌঁছে হাতমুখ ধুয়ে রান্না করে দুটো খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম করতেই সন্ধ্যে। ছোটেলাল ঘর থেকে বের হয়ে আবছা অন্ধকারে বাড়ির পাশের মাঠে এসে এলাকার সঙ্গীদের সাথে আড্ডায় যোগদান করে৷ সবাই গলা ছেড়ে গান শুরু করে, ছোটেলাল হাততালি দেয় তালে তালে।

হরিজন পাড়ায় পঞ্চাশ-ষাটঘর পরিবার থাকলেও হিন্দু ঘর পনেরো-বিশটার মতন। সরকারী ড্রেনের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই পল্লী। নোংরা, অস্বাস্হ্যকর ঘিঞ্জি পরিবেশ।বাড়িঘরগুলো স্যাতসেঁতে।​ মানুষজনের পোশাক-আশাকও অপরিচ্ছন্ন।কেমন একটা বোটকা গন্ধ এলাকাজুড়ে। বেশিরভাগ মানুষই খেটেখাওয়া -দিনমজুর শ্রেনীর। সামনে যে পুজো, এপাড়ায় কিন্তু তার আমেজ নেই তেমন। থাকবেই বা কি করে চাইলেও তো এরা যেকোন মন্দিরে গিয়ে পুজো দিতে পারে না, পারেনা সবার সাথে বসে গল্প করতে, অঞ্জলি দিতে, আরতি দিতে। মন্দির আর কি ; কোন হোটেলে পর্যন্ত বসে খাবার খেতে পারেনা এরা, প্লেটগুলোও ছুৎ-অছুতের বিদ্বেষে কলঙ্কিত হবে এমনি আমাদের সমাজ ব্যবস্হা। সেই দুর্ভাগা মানুষগুলোর আবার উৎসব?

ছোটলালের গোত্রের কিছু ছেলেপেলে এখন স্কুলে পড়াশুনা করে, বড় হয়েছে এরা। হঠাৎ একদিন এসে এরা ধরলো এবারের পুজোটা নিজেদের এলাকাতেই করবে, কি করা যায় এখন। কিন্তু সবাই কথাটা শুনে হেসেই উড়িয়ে দিলো। এত ব্যয়বহুল পুজো এখানে করা সম্ভব নাকি?​ কিন্তু ছেলেপেলেরা দমে যায় না। ছোটেলালও ধীরে ধীরে সম্মত হয়। ঠিকই তো যদি করা যায় খারাপ হতো না৷ কিন্তু খরচ তো অনেক। সাহস কমে তবুও চেষ্টা তো করা যেতেই পারে।

এক সন্ধ্যায় বাকীদের নিয়ে আলোচনায় বসে ছোটেলাল। প্রবীণ যে কজন তারাও আসেন। কিন্তু এদের আগ্রহ তেমন নেই। এতটাকা কোথায় পাবে, অন্যরা হঠাৎ এখানে পুজো করতে দিবে কিনা হাজারো অযুহাত দিয়ে পরিকল্পনা ভেস্তে দিলো, সব মদ গিলতে চলে গেলো। যেনো মদই এদের ধ্যান-জ্ঞান-শেষকথা, এদের আনন্দ....।।

পুজোর আগমন বোঝা যায় শরতের সকাল দেখেই। চারপাশে ঠান্ডা দমকা হাওয়ায় কুয়াশার ছোঁয়া৷ শিউলি ফুলের গন্ধে চারপাশ ম-ম করে। পাখিদের ডাকের মধ্যেও কেমন একটা পরিবর্তন এসে যায়। দুর্বাঘাসের ডগায় মুক্তোর মত শিশির জমে থাকে বিন্দু বিন্দু। সকালের দিকে কাঁথা গায়ে দিতে হয় তখন৷ ভোরের দিকে একদম নেয়ে-ঘেয়ে ধরমড়িয়ে ঘুমভাঙে ছোটেলালের। হাঁপাতে থাকে। দুহাত দিয়ে মুখের ঘাম মোছে। কয়েকমিনিট যায়। বিছানা ছেড়ে বাইরে চলে আসে। ঠান্ডা আবহাওয়া।চোখে-মুখে জয় ছিটায়​ 'স্বপ্ন নাকি দু:স্বপ্ন' কি দেখলো ও। এখন সব ঠিকমত মনেও আসছে না। দেখে "ছোট এক কিশোরী এসে হাতটেনে দিয়ে যায় ওকে, দশটা হাত ওর। পাড়ার মাঠে ছোট মন্দির বানানো। কিশোরী ছোটেলালকে দেখিয়ে দিলো কিভাবে কি করতে হবে পুজোর । হঠাৎ কোথা থেকে একদল ডাকাত এলো হা-রে-রে-রে করে তেড়ে। কিশোরী উধাও হয়ে গেলো। ডাকাতরা ছোটেলালকে ধরে বলি দিবে" এমন সময় ঘুম ভেঙে গেলো ওর...।। হয়ত কয়েকদিনের দু:চিন্তার ফল এগুলো। কিন্তু ওর মনে দুর্গাপুজোর ইচ্ছেটা বেড়ে গেলো আরো। সকাল হতেই স্নান সেরে বারোয়ারী মন্দিরে চলে গেলো ছোটেলাল। পুরোহিত মশায় সবে সকালের নিত্যপুজো সেরেছেন। ছোটেলাল ঠাকুর প্রনাম করে পুরোহিত মশাইকে নমস্কার করলো।

'একটা কথা ছিলো ঠাকুরকর্তা 'ছোটেলাল করজোড়ে বিনতি করে।

" হ্যাঁ বল "

প্রথমে আজ সকালে দেখা স্বপ্নের কথা বলে তারপর এলাকার পিচ্চিগুলোর দুর্গাপুজো করার আবদারের কথা জানালো। পুজোর অনুমতির প্রার্থনা করলো ছোটেলাল।

"আলাদা পুজো করবি মানে? " ভ্রুঁকুচকে তাকিয়ে থাকেন পুরোহিত মশায়। 'নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তোদের,পুজো করার ক্ষমতা আছে তোদের? এতবড় বারোয়ারী পুজো থাকতে কিসের আবার আলাদা পুজো? স্পর্ধা বেড়ে যাচ্ছে বুঝি দিনদিন? বাড়াবাড়ি করলে এ মন্দিরে ঢোকা চিরতরে বন্ধ করে দেবো তোদের। যা এখন, কাজ করতে দে। "

অনেক আশা নিয়ে আসা ছোটেলাল এত অপমানে মাথা হেট করে চলে আসে নিরবে। স্কুলে সারাদিন মনখারাপ যায়, অস্হিরতায় কাটে। আনমনে থাকায় কাজে ভুল হয়, স্যাররাও বকাঝকা করেন। ছোটেলালের জেদ চাপে সময় বাড়ার সাথে সাথে, পুজোটা করবেই তা সে ফুল-বেলপাতা দিয়ে হলেও।

পরদিন ছেলেপুলে নিয়ে কয়েকজন মালাকারের বাড়ি গেলো ছোটেলাল। ছোটখাটো করে একটা প্রতিমা যদি বানানো যায়। কিন্তু পুজোর মৌসুম। একদিকে শেষ সময়, নিন্মে হলেও হাজার বিশেক টাকা ছাড়া হবেনা। একটাকা দিয়ে প্রতিমা বানানো সম্ভবও না। ওদের বাজেট হাজার পাঁচেক। ছোটখাটো প্রতিমা চাই শুধু। কিন্তু কেউ রাজীনা বানাতে। বাকী থাকলো নগেন পালের বাড়ি।কিন্তু তাদের প্রতিমার দাম তো আরো বেশি৷ গিয়ে তো লাভ নেই। তবুও ছেলেপিলের জোরজবরদস্তিতে গেলো ছোটেলাল। বাসায় গিয়ে দেখে কতরকম প্রতিমা। বড়, ছোট, একটা অসুর, দুটো অসুর,​ মায়ের মুখমন্ডলগুলো কি অসাধারন।​ কারিগরের হাত আছে বলতে হবে। সন্ধ্যের আগে আগে বাসায় তেমন কেউ ছিলোনা। শুধু নগেন পাল টঙে বসে ছিলেন। ছোটেলালরা গিয়ে নমস্কার দিলেন। আসার কারন বললো।

' না বাবা এখন তো আর অর্ডার নেয়া হচ্ছে না, সময় তো নেই হাতে '।

'তবুও কাকাবাবু যদি একটু চেষ্টা করতেন ' আকুতি করে ছোটেলাল।

ছেলেগুলোর মুখের দিকে ভালোকরে তাকান নগেন পাল। চেষ্টার সাথে না পাওয়ার ব্যাথাটা অনুভব করলেন। পরিচয় নিলেন ছেলেগুলোর। গল্প করলেন কিছুক্ষন। কাজ ছাড়ার আগে নিজেদের মাঝের বিভেদগুলো নিয়ে এতো ভাবতেন না নগেন পাল। এখন দিন যাচ্ছে যত বয়স বাড়ছে আশেপাশের বাস্তবতা ততই স্পষ্ট হচ্ছে চোখের সামনে। এইতো এত নামকরা প্রতিমা শিল্পী হয়েও শিল্পের সন্মান পাননি কখনো তেমন ভাবে, লোকে শিল্পী না বলে বলে মালি.... কি লাভ তাহলে।।

মহালয়া পার হয়ে যায়। ছোটেলালরা প্রতিমা তৈরী করাতে পারেনা কাউকে দিয়ে। ঠিক হয় শুধু ঘট বসিয়েই পুজো হবে। লোকমুখে শোনা - মায়ের প্রথম পুজো নাকি ঘট বসিয়েই করা হয়েছিলো৷ তাহলে ওরা করলে কি মা পুজো নিবেন না! ছেলেপেলেরা লেগে যায় কাজে। এলাকার বিভিন্ন বাসা থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে নিজেরাই প্যান্ডেল বানায় ছোট্টকরে৷ পরিচিতদের থেকে দান সংগ্রহ করে। হরিজন পাড়ায় প্রথমবার পুজোর শঙ্খ বেঁজে উঠে। পুরোহিতও পাওয়া যায় না। ঠিক হয় দেখে দেখে নিজেরাই মন্ত্রপাঠ করে নিজেদের মত মায়ের পুজো করবে। পঞ্চমীর সন্ধ্যায় প্যান্ডেলে আবারো গান ধরে সবাই একসাথে,​ ছোটেলাল খুশিতে কেঁদে ফেলে।

তিন-চারদিন থেকে নগেনপাল একাই ছোট একটা প্রতিমা তৈরী করছে দেখে তার ছেলেরা অবাক হয় খুব। এতটা বছর পর তাদের বাবা আবারো কাজ করছে তাও ছোট একটা প্রতিমা, কেনো?​ কার জন্য কেউ জানেনা। নগেন পাল ছেলেদের সাহায্যেও নেন না। পিচ্চি নাতি-নাতনীরা সাহায্যে করে শুধু। এতবছর পর কাজ করতে গিয়ে অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেন। কাজ চলে ধীরে। পঞ্চমী চলে আসে তবুও কাজ শেষ করতে পারেন না। চক্ষুদান বাকী, রঙ বাকী। পঞ্চমীর সারারাত একা প্রতিমার ঘরে বসে কাটান নগেন বাবু। একদম ভোরে আবার শুরু করেন রঙের কাজ৷ ওদিকে বাইরে দুর্গাষষ্ঠীপক্ষ​ শুরু হয় এদিকে সুনিপুন হাতে মায়ের ত্রিনয়ন আঁকেন নগেন বাবু। কাজ শেষে প্রশান্তি ঝরে পড়ে চোখে মুখে। দুটো ভ্যান ডেকে প্রতিমা উঠিয়ে পাঠিয়ে দেন গন্তব্যে, নগেন পালের উপহার।

রাস্তার লোকজন মায়ের মুখটা দেখে অভিভূত হয়ে যায়, করজোরে নমস্কার করেন কেউ ; কেউবা ঊলুধ্বনী দেয়।

নগেন পাল শূন্য রাস্তার দিকে অপলক চেয়ে থাকেন। মনে মনে শুধু ডাকেন মা........মাগো………..।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.